রোম যখন পুড়ছে, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে ।
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ১৯ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:২৭:৫৭ সকাল
রোম যখন পুড়ছে, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে ।
পঞ্চম রোম সম্রাট নীরো জন্মেছিলেন ৩৭ খ্রিস্টাব্দে। আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৮ সালে। মাত্র ৩১ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। ক্ষমতায় ছিলেন জীবনের শেষ চৌদ্দটি বছর। তিনি ছিলেন সংগীতপ্রিয়।
বংশী বাদক হিসেবে তার ছিল সুখ্যাতি। রাজকর্ম পরিচালনায় তিনি ছিলেন অদক্ষ। নির্মম, নিষ্ঠুর এবং অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড করতেন কয়েকজন স্বার্থান্বেষী রাজকর্মচারীর পরামর্শে। যে প্রাসাদে তার জন্ম সেটাকে অপছন্দ করতেন আশৈশব। একটি বৃহৎ দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদ তৈরি করা ছিল তার আশৈশব লালিত স্বপ্ন। তাই যে দিন দাউ দাউ করে জ্বলছিল রোম নগরী সেদিন উৎফুল্ল হয়েছিলেন সম্রাট নীরো। রোম থেকে ৩৫ মাইল দূরে আন্টিয়াম নামক প্রমোদ ভবনে তখন তিনি বাঁশিতে তুলছিলেন সুরের ঝংকার। অগ্নিকাণ্ডের দুঃসংবাদ শুনে তিনি অট্টহাসি দিয়ে বলেছিলেন, এবার প্রশস্ত জায়গায় হবে আমার স্বপ্নের প্রাসাদ। তার এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিল অনেক সভাসদ এবং প্রজাসাধারণ। এরপরই চতুর্দিকে দেখা দিল বিদ্রোহ। এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে গেলেন নীরো। বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়ে নিজ হাতে ধারাল ছুরি দিয়ে কণ্ঠনালি দ্বিখণ্ডিত করে আত্মহত্যা করলেন রোম সাম্রাজ্যের কিংবদন্তি মহানায়ক জুলিয়াস সিজারের উত্তর পুরুষ, সম্রাট ক্লডিয়াসের সৎপুত্র এবং রোম রাজবংশের চির কলঙ্ক ক্লডিয়াস সিজার নীরো।
বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করা হয় সরকারি দলের স্বার্থে। কখনো তা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে বা কখনো পরের নির্বাচনটিও জেতার পথ তৈরি করতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে দোহাই দেওয়া হয় জনগণের, জনস্বার্থের, জনকল্যাণের। যে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রায় কবর রচিত হয়েছিল তাকেও বলা হয়েছিল ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। এই সংশোধনী জারি করতে বঙ্গবন্ধুর কষ্ট হয়েছিল এবং সম্ভবত দ্বিধাও তাঁর কম ছিল না। সংসদে সেদিন দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই।’ দুঃখের কথা আরও কয়েকবার তিনি ভাষণে বলেছেন, সারা জীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে কেন তিনি একদল কায়েম করলেন, তার কৈফিয়তও দিয়েছেন।
বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জেতার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য বহু পরিবর্তন এনেছে সংবিধানে। এর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সুযোগ আওয়ামী লীগের জন্য তৈরি হয় উচ্চ আদালতের বিতর্কিত রায়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বহু বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, হাইকোর্টের মামলায় বৈধ হিসেবে বিবেচিত, আপিল বিভাগে একজন বাদে বাকি সব অ্যামিকাস কিউরি কর্তৃক সমর্থিত। এই সরকার অব্যাহত রাখার পক্ষে সংবিধান সংশোধন কমিটির আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল, আইনজ্ঞ ও নাগরিক সমাজ একমত হয়েছিল। পুরো আলোচনা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুধু কিছু সংস্কারকে ঘিরে, তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সভাপতিত্বে তাঁর অবসরে যাওয়ার প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে এই মামলার রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান করা হয়। সংক্ষিপ্ত আদেশের প্রথম লাইনে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন থেকে অবৈধ। আবার দ্বিতীয় লাইনে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে ভবিষ্যতে আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়। তৃতীয় লাইনে ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচারপতিদের না রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয় সংসদকে।
সরল বিশ্বাসে এই আদেশ অবলম্বনে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা হলে কোনো আইনি জটিলতা হতো না, বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতারও আকস্মিক উদ্ভব ঘটত না। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বরং সেটি মঙ্গলজনক হতো। আওয়ামী লীগ তা করেনি। তারা আদালতের আদেশের শুধু প্রথম লাইন সামনে রেখে তাদেরই অধীনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে রায়ের পর রকেট গতিতে সংবিধান সংশোধন করে ফেলেছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির দুঃখজনক নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে এবং আছে (যেমন—এই সরকারের আমলের বিতর্কিত ভোলা উপনির্বাচন)। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিবন্ধকতাগুলোও (যেমন—প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র অবিশ্বাস, দলীয়করণ প্রশাসন, পক্ষপাতপূর্ণ ও সীমিত ক্ষমতার নির্বাচন কমিশন) এখনো রয়েছে এবং অলৌকিক কিছু না ঘটলে থেকে যাবে। এই বাস্তবতায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংযোজন আগামী নির্বাচনে কারচুপি করে জেতার অপচেষ্টা হিসেবে ভাবলে বিরোধী দলকে দোষ দেওয়া যাবে না। এই পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত হরতালকে ডেকে এনেছে, নজিরবিহীনভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশি বর্বরতার মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন ও নিপীড়নের তাণ্ডবকেও ডেকে এনেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা ইতিমধ্যেই বিঘ্নিত হতে শুরু করেছে। ১৮ দলীয় জোট তত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এক দফার আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে ।
এরই মধ্যে আগামী ৫ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের এক মহাঅবরোধ কর্মসূচি। গত ৬ এপ্রিল ছিল রাজধানীতে তাদের মহাসমাবেশ। ওই সমাবেশে তারা সরকারের বিবেচনার জন্য ঘোষণা করেছে ১৩ দফা দাবি। যদি এক মাসের মধ্যে সরকার তাদের দাবি মেনে না নেয় তাহলেই বাস্তবায়িত হবে রাজধানী অবরোধের মতো বিশাল এবং ভয়াবহ কর্মসূচি। তাদের ১৩ দফা দাবি ইতোমধ্যেই প্রচারিত হয়েছে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে। দাবিগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘কোরআন এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার লক্ষ্যে তৈরি করতে হবে এন্টি ব্লাসফেমি অর্থাৎ ধর্ম অবমাননা প্রতিরোধ আইন।’
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সাফ বলে দিয়েছেন এন্টি ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের কোনো ইচ্ছা নেই তার সরকারের। আরও একটি ঘোষণা দিয়েছেন স্পষ্ট ভাষায় সেটি হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতেও আর ফিরে যাবেন না তিনি। এ দুটি ঘোষণা এসেছে গত ৭ এপ্রিল। বিবিসিতে প্রদত্ত তার সাক্ষাৎকারটি ৮ এপ্রিল প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশের সব টেলিভিশনে। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তার পরদিন। বিগত দিনে যে দুটি দাবিকে কেন্দ্র করে হরতাল, মিছিল, বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, গ্রেফতার, সংঘাত-সংঘর্ষ, গোলাগুলি, বোমাবাজি এবং শত শত হত্যাকাণ্ডের মতো অবাঞ্ছিত ও নির্মম কার্যক্রম দেশব্যাপী চলছে অবিরাম, সে দুটি দাবির ব্যাপারে স্পষ্ট জবাব পেয়ে গেল দেশবাসী। বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা বিদ্যমান তাতে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন অনেকে। বিজ্ঞজনেরা ভেবেছিলেন, এ ব্যাপারে হয়তো কিছুটা কৌশলী হতে পারেন সরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোনো রাখঢাক না করে সোজা-সাফটা সরকারের মনোভাব মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোকা কিংবা অপরিপক্ব রাষ্ট্রনায়ক নন, তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো একজন ঝানু স্টেটস্ম্যানের কন্যা, আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীনতম বিশাল দলের প্রায় তিন যুগের সভাপতি এবং দুইবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি যে ঘোষণা বিবিসির মতো মিডিয়ার মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন তা তাৎপর্যহীন বলে মনে হয় না । প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণ দেন, মনে হয় তার প্রতিপক্ষ নেই দেশে। বিরোধীদলীয় নেতা এবং বিএনপি প্রধানের দিকে তাকালে মনে হতো যেন এতিম হয়ে গেছেন খালেদা জিয়া। দেশে তোলপাড় হওয়ার মতো ঘটনাবলী যেমন_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, সাগর-রুনি হত্যা, শেয়ারমার্কেট, হলমার্ক, পদ্মা সেতু, ডেসটিনি, রেল কেলেঙ্কারি, বিশ্বজিৎ হত্যা ইত্যাদি গণজাগরণ মঞ্চের তলায় যেন চাপা পড়ে গেল সরকারের সব কেলেঙ্কারি। তিনি হেফাজতে ইসলামের রূপ এবং শক্তি বিগত ৬ এপ্রিল নিশ্চয়ই দেখেছেন শাপলা চত্বরে। এ বিশাল সংগঠনকে অবজ্ঞা কিংবা তাচ্ছিল্য করা যে 'মরণের ওষুধ কানে বাঁধা'র নামান্তর তা সাধারণ রাজনীতিবিদদের বোধগম্য না হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এর তাৎপর্য গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবু হেফাজতে ইসলাম এবং বিএনপির মতো বিশাল দুটি সংগঠনের প্রাণের দাবিকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে তিনি কতটা ঝুঁকি নিলেন তা দেখার জন্য আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে দেশবাসীকে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ চত্বরে সৃষ্টি হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার বিচারের রায় প্রকাশিত হয় ওই তারিখে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কিছুসংখ্যক তরুণ ফেসবুক ও ব্লগের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ৫ ফেব্রুয়ারি একত্রিত হয় শাহবাগ চত্বরে। তারা সমস্বরে স্লোগান দেয়_ এ রায় মানি না, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। সে দিন থেকে তারা শাহবাগে গড়ে তোলে গণজাগরণ মঞ্চ। দলে দলে মানুষ ভিড় জমায় শাহবাগ চত্বরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাতারে শরিক হওয়ার জন্য শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আন্দোলনের নেতৃত্ব ধীরে ধীরে চলে যায় আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। দেশ আজ স্পষ্টত দ্বিধা-বিভক্ত। একদিকে সরকার ও গণজাগরণ মঞ্চ, অপরদিকে হেফাজতে ইসলাম। দুটি শিবিরের অবস্থান আজ মুখোমুখি।
গত দুই মাস ধরে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা সত্যি মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক এবং দুঃখজনক। হরতালের পর হরতাল, নির্মম ভাঙচুর, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, অর্থনীতি নিমজ্জমান, দরিদ্র গৃহে হাহাকার, সমুদ্রের অতল গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে সোনার বাংলা, তারপরও চৈতন্য উদয় হচ্ছে না কেন? কেন দেশ বাঁচাতে নমনীয় হচ্ছেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
আজ রোমের মতো জ্বলছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় নীরোর মতো শাসক হতে পারেন না প্রধানমন্ত্রী। আগুন নিভানোর ব্যবস্থা করতে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে তাকে। ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশের অভিজ্ঞতার আলোকে এক সপ্তাহ আগেই দূর-দূরান্ত থেকে হেফাজতের লোকজন চলে আসতে পারে ঢাকায়। যদি তেমনটিই হয় এবং অবরোধের নামে যদি শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের অবস্থান সে ক্ষেত্রে কি করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? তখন যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে! তাই 'সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়', কথাটি মনে রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন