কালের কন্ঠের বোমা ফাটানো নিউজ
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫৩:৪৫ দুপুর
৫ জনে ১০% ঘুষ
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র
মসি রহমান ১%, মিন ৪%, কায়সার ২%, নিক্সন ২% ও সেক্রেটারি ১%। এটি কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার বহুল আলোচিত ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা ঘুষ বণ্টনের একটি হিসাব। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের কোন ব্যক্তিকে কী পরিমাণ ঘুষ দেওয়া হচ্ছে তারই প্রামাণ্য দলিল এটি। আর তাতে অনেকের সঙ্গে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ পাঁচজনের নাম।
গতকাল বুধবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। বিশ্বব্যাংকের ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার মূল আলামত এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার ডায়েরি, যেটি এখন রয়েছে কানাডার একটি আদালতে। গত ৯ নভেম্বর রমেশের ডায়েরি নিয়ে ২৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্বব্যাংক। এটির ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় পরামর্শকের কাজ পাওয়ার জন্য ১০% ঘুষের খসড়া হিসাবের উল্লেখ রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে- মসি রহমান ১%, মিন ৪%, কায়সার ২%, নিক্সন ২% এবং ১% সেক্রেটারির নামে ঘুষের বরাদ্দ করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, মসি রহমান হলেন ড. মসিউর রহমান, মিন হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, কায়সার হলেন আবুল হাসান চৌধুরী, নিক্সন হচ্ছেন হুইপ নুরে আলম চৌধুরীর ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরী এবং সেক্রেটারি হলেন সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
এদিকে রমেশ সাহার ডায়েরিতে ঘুষ বণ্টনের বিষয়ে উল্লিখিত তথ্য পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন এ ডায়েরির তথ্য জানতে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে। ডায়েরির অনুলিপিসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে দুদকের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের কানাডা সফরের প্রক্রিয়া চলছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০% অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন রমেশের ডায়েরিতে উল্লিখিত ব্যক্তিরা।
রমেশ সাহার ডায়েরির তথ্য সম্পর্কে গতকাল জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবুল হোসেন ও আবুল হাসান সন্দেহভাজনদের তালিকায় রয়েছেন। তদন্তকালে তাঁদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ অথবা কানাডিয়ান পুলিশের হাতে থাকা রমেশের ডায়েরি অথবা রমেশ ও ইসমাইলের বক্তব্য পাওয়া গেলে তাঁদের আসামি করা হবে।
দুদকের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, রমেশের ডায়েরিতে যে পাঁচজনের নাম রয়েছে, তাঁদের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এখন রমেশের ডায়েরিটি খুবই প্রয়োজন। সেই ডায়েরির অনুলিপি ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তো আর একজনকে মামলায় জড়ানো যায় না। শুধু তা-ই নয়, রমেশ সাহা ও ইসমাইলের জবানবন্দির বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য।
গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘুষের তালিকার কথা তো পুরনো কথা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে কী আছে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। তবে রমেশের ডায়েরির অনুলিপি সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতেই দুদকের প্রতিনিধিদল কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই তথ্য পেলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হবে।
দুদক সূত্র জানায়, আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি মন্ত্রী থাকাকালে বিতর্কিত এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী দুইবার যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে এসএনসি-লাভালিনের কর্তাব্যক্তিদের সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটিকে গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করার সুপারিশ করেছিলেন তিনি। সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন মূল্যায়ন কমিটি ভাঙা এবং নতুন করে গড়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। রমেশ সাহা, কেভিন ওয়ালিস ও ইসমাইল কাজ পাওয়ার জন্য কানাডায় বসে ঘুষ দেওয়ার একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলাদেশের কোন কোন ব্যক্তিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়া গেলে পদ্মা সেতুর পরামর্শক হিসেবে কাজ পাওয়া যাবে এর একটি তালিকা করেন তাঁরা। তালিকাটি কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ রমেশের অফিসে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় রমেশ ও ইসমাইলের বিরুদ্ধে কানাডার আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। মসিউর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। কিন্তু প্রকল্পটি শুরুতেই পড়ে দুর্নীতির অভিযোগের মুখে। বিশ্বব্যাংকের চাপে ছুটিতে যান ড. মসিউর রহমান। পদত্যাগ করেন ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কয়েক দফা ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংকের তদন্তদল। পাশাপাশি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মাঠে নামে দুদক, গঠন করে অনুসন্ধান কমিটি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে সাবেক দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে বাদ দিয়ে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সাবেক দুই মন্ত্রীকে মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে রাখা হয়। কিন্তু ওই মামলায় মসিউর রহমানের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। এক পর্যায়ে সরকারের মন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের মামলা করার চাপের মুখে বাতিল হয় ঋণচুক্তি।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে এসএনসি-লাভালিন, হালক্রো গ্রুপ, একমঅ্যান্ডএজেড, ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কম্পানি লিমিটেড এবং হাই পয়েন্ট রেন্ডাল। এর মধ্যে এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এর পরই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ১৮.০৪.১৩
বিষয়: বিবিধ
২০২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন