সালামের হাকীকত
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ০৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:২৪:৪৯ রাত
সালাম
وَإِذَا حُيِّيْتُم بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّواْ بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا {নিসা-৮৬}
আর যখনই কেউ মর্যাদা সহকারে তোমাকে সালাম করে কখন তাকে তার চাইতে ভালো পদ্ধতিতে জবাব দাও অথবা কমপক্ষে তেমনিভাবে৷ আল্লাহ সব জিনিসের হিসেব গ্রহণকারী ৷
- শব্দের ব্যাখ্যা ও এর ঐতিহাসিক পটভূমিঃتَحِيَّةٍ
تحية এর শাব্দিক অর্থ حيك الله আল্লাহ তোমাকে জীবিত রাখুন- বলা। ইসলাম পূর্ব কালে আরবরা পরস্পরের সাক্ষাতকালে একে অন্যকে حيك الله কিংবা انعم الله بك علينا কিংবা انعم صباحا ইত্যাদি সম্ভাষনে সালাম করত । ইসলাম সালামের এ পদ্ধতি পরিবর্তন করে السلام عليكم বলার রীতি প্রচলিত করেছে । এর অর্থ তুমি সর্বপ্রকার কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাক ।
ইবনে আরাবী আহকামুল কোরআন গ্রন্থে বলেনঃ সালাম শব্দটি আল্লাহ তায়ালার উত্তম নাম সমূহের অন্যতম । السلام عليكم এর অর্থ رقيب عليكم অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সংরক্ষক।
ইসলামী সালাম অন্যান্য জাতির সালাম থেকে উত্তমঃ জগতের প্রত্যেক সভ্য জাতির মধ্যে পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের সময় ভালবাসা ও সম্পীতি প্রকাশের জন্য কোন না কোন বাক্য আদান প্রদান করার প্রথা প্রচলিত আছে । কিন্ত তুলনা করলে দেখা যাবে ইসলামী সালাম যতটুকু ব্যাপক অর্থবোথক, অন্য সালাম ততটুকু নয় । কেননা এতে শুধু ভালবাসাই প্রকাশ হয়না, বরং ভারবাসার সাথে সাথে ভালবাসার যথার্থ হকও আদায় করা হয় । অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয় যে, আল্লাহ আপনাকে সর্ববিধ বিপদাপদ থেকে নিরাপদ রাখুন । এ দোয়াটি আরবদের প্রথা অনুযায়ী শুধূ জীবিত থাকার দোয়াই নয়, বরং পবিত্র জীবনের দোয়া । অর্থাৎ সর্ববিধ বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার দোয়া । এতে এ বিষয়েরও আভিব্যক্তি রয়েছে যে,আমরা ও তোমরা সবাই আল্লাহ তায়ালার মুখাপেক্ষী । তার অনুমতি ছাড়া আমরা একে অপরের উপকার করতে পারিনা । এ অর্থের দিক দিয়ে বাক্যটি একাধারে ইবাদত এবং মুসলিম ভাইকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ারও উপায় বটে ।
ইবনে আরাবী আহকামুল কোরআন গ্রন্থে ইমাম ইবনে উয়াইনার এ উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ اتدري ما السلام؟ يقول انت امن مني অর্থাৎ, সালাম কি বস্তু তুমি জান? সালামকারী ব্যক্তি বলে তুমি আমার পক্ষ থেকে বিপদমুক্ত ।
মোটকথা ইসলামী সালামের বিরাট অথর্গত ব্যাপ্তি রয়েছে । যথাঃ
১. এতে রয়েছে আল্লাহর যিকর
২. আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়া
৩. মুসলমান ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতির প্রকাশ
৪. মুসলমান ভাইয়ের জন্য সর্বোত্তম দোয়া
৫. মুসলমান ভাইয়ের সাথে এ চুক্তি যে, আমার হাত ও মুখ দ্বারা আপনার কোন কষ্ট হবেনা
কেননা সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ স. বলেন সেই প্রকৃত মুসলমান যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ ।
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : "المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده، والمهاجر من هجر ما نهى الله عنه" متفق عليه
সালামের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশকে একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং একেও এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের কর্তব্য ও অধিকারের শামিল করে দেয়া হয়েছে। এতে করে একদিকে আবেগের প্রকাশ এবং অন্যদিকে আপন ভাইয়ের জন্যে দোয়া তথা শুভাকাংখার অভিব্যক্তি ঘটে। নবী কারীম (সঃ) মদীনায় আসবার পর প্রথম যে খুতবাটি প্রদান করেন, তাতে তিনি চারটি বিষয়ের নির্দেশ দেন। তার একটি ছিলো এইঃ
أِفْشُوا السلامَ بيْنَكٌمْ -
‘নিজেদের মধ্যে সালামকে প্রসারিত করো।’ এর চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব নিম্নোক্ত হাদীস থেকে প্রকাশ পায়ঃ
أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : " وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا ، وَلا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا ، أَوَلا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ ؟ أَفْشُوا السَّلامَ بَيْنَكُمْ " –
‘তোমরা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবেনা, যতোক্ষণ না মু’মি হবে। আর ততোক্ষন পর্যন্ত মু’মিন হবে না, যতোণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা গ্রহণ করে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে? তা হচ্ছে এই যে, তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামকে প্রসারিত করো।’ (মুসলিম-আবু হুরায়রা রাঃ)
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ رضي الله عنه ، أَنَّ رَجُلاً جَاءَ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ ، قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم : " عَشْرٌ " ، ثُمَّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللَّهِ ، فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم : " عِشْرُونَ " ، ثُمَّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ : السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ ، فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم : " ثَلاَثُونَ " [ رواه الترمذي وقَالَ : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ] .
আর একবার মুসলমানের প্রতি মুসলমানের ছয়টি কর্তব্য ও অধিকার নির্দেশিত করে তিনি বলেনঃ
يسلِّم اذا لقيه –
‘তার সঙ্গে যখনই মিলিত হবে, তাকে সালাম করবে।’ (নিসায়-আবু হুরায়রা রাঃ)
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে সালামের সূত্রপাতকারী ও অগ্রাধিকার লাভকারীকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলে কারীম (সঃ) বলেছেনঃ
‘সালামের সূচনাকারী অহংকার থেকে বেঁচে থাকে।’
তিনি আরো বলেনঃ
انَّ اولى النّاس بالله من بدء السلام –
‘সালামের সূত্রপাতকারী হচ্ছে আল্লাহর রহমত থেকে অধিকতর নিকটবর্তী লোকদের অন্যতম।’ (আহমদ, আবু দাউদ-আবু উসমান রাঃ)
স্পষ্টতঃ প্রেমর দাবীই হচ্ছে এই যে, মানুষ সামনে এগিয়ে তার ভাইয়ের জন্যে দোয়া করবে এবং এভাবে তার হৃদয়াবেগ প্রকাশ করবে। রসূলুল্লাহ (সঃ) পথ দিয়ে চলবার কালে সর্বদাই নিজে সালামের সূচনা করতেন। পথে যার সঙ্গেই দেখা হোক-নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাইকে তিনি সালাম করতেন। বরং শিশুকে সালাম করার ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে অগ্রসর থাকতেন। সালাম সম্পর্কে তিনি বলেনঃ
اذا لقى احدكم اخاه فليسلِّم عليه فان حالت بينهما شجَّرةٌ او جدارٌ او حجر ثمَّ لقييه فليسلِّم عليه –
‘যখন তোমাদের ভেতরকার কেউ তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত হবে তখন তাকে সালাম করবে। অতঃপর এ দু’জনের মধ্যে কোন গাছ, প্রচীর, পাথর বা অন্য কোন জিনিস আড়াল সৃষ্টি করে এবং তারপর আবার সাাত হয়, তষনও সালাম করবে। (আবু দাউদ-আবু হুরায়রা রাঃ)
বিশেষভাবে তিনি পরিবারের লোক-জনকে সালাম করার জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন এবং হযরত আনাস (রাঃ)-কে বলেছেনঃ
يا بنىَّ اذا دخلت على اهلك فسلِّم يكون بركة عليك وعلى اهل بيتك –
‘হে বৎস! যখন তুমি নিজ ঘরে প্রবেশ করো, সবাইকে সালাম করো। এটা তোমার এবং তোমার পরিবারের লোকদের জন্যে কল্যাণকর হবে।’ (তিরমিযি-আনাস রাঃ)
সালামের আদান-প্রদান যখন সঠিক অনুভূতি নিয়ে করা হবে, এক ভাই অপর ভাইকে শান্তির জন্যে দোয়া করবে এবং এর মাধ্যমে তার হৃদয়ের ভালোবাসা ও শুভাকাংখার গভীরতা প্রকাশ পাবে, কেবল তখনই সালামের দ্বারা ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রচলিত ইসলামের মতো অভ্যাস বশতঃ মুখ থেকে গোটা দু'য়েক শব্দ নিঃসৃত হলেই তা দিয়ে পারস্পারিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে পারে না, এতে সন্দেহ নেই।
আসুন প্রচলিত সামাজিক সালাম নয়, আমরা সকলে সালামের মর্ম অনুধাবন করে সালামের ব্যাপক প্রচলন ঘটাই ।
বিষয়: বিবিধ
১১৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন