:"ধসে পড়া ভবনের ভেতর থেকে বেঁচে থাকার আর্তনাদ": উদ্ধার কাজে ছিল না অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার হয়েছে হাতুড়ি ও হেক্সো ব্লেড.

লিখেছেন লিখেছেন ইনোসেন্ট সবুজ ২৫ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:১৫:২৬ সকাল

ভাই, এটা আমার বোন তাসলিমার ছবি। আমার বোনটার একটু খবর দিবেন? গৌরিপুরের শিল্পী খাতুনের আহাজারি যেন কেউ থামাতে পারছে না। সন্তানের খোঁজে একের পর এক মোবাইলে ফোন দিচ্ছেন দিনাজপুরের ফাতেমা বেগম। দুই সন্তান করিম ও আরিফা চাকরি করে এই ভবনেই। তাদের মোবাইল বাজছে কিন্তু কেউই রিসিভ করছে না। কল দিতে দিতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। কেউবা সন্তান, কেউবা বোন অথবা ভাই আবার কেউ স্বামী অথবা স্ত্রীর সন্ধানে এসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন সাভারে ধসে পড়া রাফা প্লাজার সামনে। অন্যদিকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাঁচার জন্য আহাজারি করছে অসংখ্য আটকে পড়া মানুষ। কিন্তু উদ্ধার কাজে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকায় আটকে পড়াদের ভাগ্যে কি আছে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। গতকাল সকাল ৯টার দিকে সাভার আ’লীগ নেতার রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়লেও উদ্ধার কাজে দেখা গেছে লোহার কয়েকটি হাতুড়ি, কয়েকটি রড কাটার হেক্সো ব্লেড, কিছু রড। অথচ ৯ তলা ভবনের ভেতর থেকে আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে হলে প্রয়োজন অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি। এছাড়া গতকাল বিকেলে ৫টা পর্যন্ত উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার লোকজনকে দেখা গেলেও তাদের কাছে অত্যাধুনিক কোনো উদ্ধার সরঞ্জামাদি দেখা যায়নি। উদ্ধার কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ। তাদের সহযোগিতা করছে বিভিন্ন মানব সেবামূলক সংগঠনের সদস্যরা। উদ্ধার কাজের নজির এমন ছিল যে, কাউকে ভেতর থেকে বের করার জন্য একটি শক্ত দড়িও ছিল না। গার্মেন্টসের কাপড়ের রোল দিয়ে অনেককে টেনে উঠানো হয়েছে। মাঝে মাঝে সেই কাপড় ছিড়ে গেলে তাতে জোড়া লাগিয়ে আবারো তা ব্যবহার করতে হয়েছে। সরকারি বাহিনীর এমন উদ্ধার তৎপরতায় ভিকটিম পরিবারসহ স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছেন, এমন একটি উদ্ধার কাজে তেমন কোনো অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি নেই কেন? অনেকেই বলছেন, হতাহতের আসল সংখ্যা লুকানোর জন্যই এটি করা হতে পারে।

সাভার বাসস্ট্যান্ডে ধসে পড়া ৯ তলা ভবনে আটকাপড়া লোকজনকে উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। তবে উদ্ধার কাজে তাদের তৎপরতায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন জানায়, ঘটনার অনেক পরে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে আসলেও তারা উদ্ধার কাজে তেমন ভূমিকা রাখছে না। এমনকি স্থানীয়রা উদ্ধার কাজ চালালেও পুলিশ তাতে বাধা দিয়েছে। সাভারের স্থানীয় রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর যতজনকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের স্থানীয়রাই করেছে। কিন্তু পুলিশ উল্টো এসে তাদের বাধা দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ভবনে অনেক লোক আটকা পড়লেও, উদ্ধারকর্মীরা তাদের উদ্ধারে সেভাবে কাজ করছে না। অথচ আমরাই ইচ্ছে করলে সুন্দরভাবে লোকজনকে উদ্ধার করতে পারতাম। কিন্তু পুলিশ তা করতে দিচ্ছে না। উদ্ধার করা আহত লোকদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সও ছিল না বলে জানান তিনি।

সরজমিনে ভবনের ছাদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তেমন কোনো উদ্ধার তৎপরতা ছিল না। স্থানীয় লোকজন হাতুড়ি দিয়ে ছাদের অংশ ভেঙ্গে ভেতরে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করেছে সেনাবাহিনী। এছড়া যারা জীবন বাজি রেখে ভবনের ভেতরে ঢুকেছেন তারা সাধারণ মানুষ। এদিকে যে জিনিসটি বেশি নজর কেড়েছে সেটি হলো উদ্ধার তৎপরতায় সরকারি বাহিনীর অত্যাধুনিক কোনো মেশিনের ব্যবহার না করা। সরজমিনে দেখা যায়, হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে একটি লোককে বের করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শক্ত রশি নেই। ফলে গার্মেন্টসের কাপড়ের রোলের অংশকে রশি বানিয়ে তা দিয়ে উদ্ধার করা হয়। টেনে উদ্ধারেও সাধারণ মানুষ ছিল সরব। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ভেতর থেকে পানি পানি বলে চিৎকার করলেও পর্যাপ্ত পানি দেয়া যায়নি। যে পরিমাণ পানি দেয়া হয়েছিল তাও সাধারণ মানুষ দিয়েছে।

পাশের ভবন থেকে একটি আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেন ‘আমার পা কেটে বাহির কর, আমি আর সইতে পারছি না’ ধ্বংসস্তূপের ভেতর শোনা যাচ্ছে এই নারীর এমন আর্তনাদ। তার পাশেই দেখা যাচ্ছে দেয়ালের নীচে শুধু হাতটি চাপা পড়ে আছে। তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। আর বলছেন, প্রয়োজনে আমার হাতটা কেটে ফেলুন। আমাকে উদ্ধার করুন। তাদের এমন আর্তনাদে চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু কিছুই করার নেই। পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন অনেকেই। তারপরও তাদের উদ্ধারে একের পর এক শ্যাবল দিয়ে দেয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা চলছে। এ সময় উদ্ধারকারীরা তাকে হাত দিয়ে উদ্ধারের আশ্বাস দিচ্ছেন। একটুখানি দেয়াল ভাঙ্গার পর দেখা গেল, ধসে পড়া ভবনের পেছনের দিকে এ নারীর বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে একটি বড় দেয়াল। ভালোভাবে মাথা উঁচু করতে পারছেন না কারণ আরেকটু ওপরে ধসে পড়া আরেকটি দেয়াল। সারামুখ তার কংক্রিটের ধুলোয় ঢাকা। কখনো একটু উঠে বসেন। কখনো আবার শুয়ে পড়েন। এক তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছেন এ নারী। তবে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের প্রাণপণ চেষ্টায় তিনি উদ্ধার হন। এভাবে অনেককে এই হাতুড়ি বাহিনী জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। বের হয়ে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গের ২ জন মারা গেছে। এছাড়া আরো দুই জনের পায়ের ভেতর দিয়ে একদিক দিয়ে রড় ঢুকে আরেক দিয়ে বাহির হইয়া গেছে।

এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগের কথা অস্বীকার করে সাভারে রানা প্লাজা ধসে উদ্ধারের প্রধান সমন্বয়কারী ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জানিয়েছেন, আমরা সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বেশ কয়েকটি টিম এখানে কাজ করছে। সর্বশেষ ব্যক্তি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোহরাওয়ার্দী বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসে। আমরা ওপর থেকে গর্ত করে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করি। এ কাজে ফায়ার সার্ভিস ও জনগণের সর্বোচ্চ সহায়তা পাই। তিনি জানান, একজন ব্যক্তি জীবিত থাকতে এই স্থান ত্যাগ করব না। ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি উদ্ধার কাজে সহায়তার জন্য অযথা মানুষকে এখানে ভিড় না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের বিভ্রান্তিকর সংবাদ যাতে পরিবেশিত না হয় সেদিকে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেন। তিনি জানান, বর্তমানে এখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১০টি টিম, সেনাবাহিনীর ১০টি টিম এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। তিনি জানান, বিভিন্ন তলায় আটকে পড়া মানুষের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

তবে ধ্বংসস্তূপে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ রড ও কংক্রিট সরানোর জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্র ও সরঞ্জাম নেই বলে স্বীকার করেছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। তারা বলেন, এমন একটি ভবন থেকে এতগুলো মানুষকে উদ্ধার করতে হলে অত্যাধুনিক সরঞ্জামদি প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সেগুলো নেই। ফলে যা আছে তা দিয়ে উদ্ধার কাজ করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল রেকার দিয়ে ধসে পড়া ভবনের দেয়ালের অংশ সরানোর চেষ্টা করছে। তবে ধ্বংসস্তূপ সরানো যাচ্ছে না। ধসে পড়া দেয়ালগুলোর বড় বড় অংশ ভাঙাও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ভেতরে ঢুকে বিপুল উদ্যোগে উদ্ধার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এখন যে উদ্ধার কাজ চলছে, তা অনেকটাই বিক্ষিপ্ত। এমন যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ধারকাজে তেমন সাফল্য আসবে না বলে তারা জানান।

স্বজনদের খোঁজে হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষা করছেন। অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। আবার কাউকে মোবাইলের মাধ্যমে আটকে পড়াদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে দেখা যায়। ভবন থেকে উদ্ধার হওয়া সাইফুল বিকাল ৪টার দিকে জানান, এখনও ভবনের ভেতরে কমপক্ষে তিন হাজার লোক আটকা পড়ে আছে। আজকের (গতকাল) মধ্যে উদ্ধার করা গেলে এদের অনেককেই বাঁচানো যাবে। কিন্তু যেভাবে উদ্ধার তৎপরতা চলছে তাতে তাদের জীবিত ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই তিনি জানান। তিনি বলেন, ছাদের মাঝখানে এবং সিড়ির পাশে যদি দেয়াল কাটা যায় তাহলে অসংখ্য মানুষকে বের করা যাবে। কিন্তু যেভাবে হাতুড়ি দিয়ে কাজ করা হচ্ছে তাতে এদের জীবিত বের করা কোনক্রমেই সম্ভব হবে না।

স্থানীয়রা জানায়, রানা প্লাজার উদ্ধার কাজে নেমেছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দমকল বাহিনী, র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। কিন্তু তারা যেভাবে কাজ করছেন তাতে এদের জীবিত উদ্ধার করা যাবে না। তারা ব্যস্ত জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে। ভবন ভেঙ্গে অথবা কেটে ভেতর থেকে আটকে পড়াদের বের করে আনার কোনো চেষ্টা তারা যেভাবে করার দরকার সেভাবে করছে না। পুরো সাভার এলাকাজুড়ে মানুষের মনে হাহাকার, কে কার আত্মীয় তা কেউ মনে রাখছে না। নিহত ও আহতরা সবাই যেন সাভারবাসীর আত্মীয়। সাভারের মানুষ যে যেভাবে পারছে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে। রানা প্লাজা ধসের পড়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে। রাস্তার দুই ধারে অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ি আসা যাওয়ায় তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

চারদিকে লাশের মিছিল, এ যেন এক মৃত্যুপুরী। সবার চোখে পানি। সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করা অবস্থায় ধসে পড়া বহুতল ভবন রানা প্লাজার আশপাশের আকাশ-বাতাস কান্নার শব্দে ভারী। ভবনটি যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানার পরও যাদের কেউ কেউ গতকাল কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তাদের জোর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে কর্তৃপক্ষ। কাজ না করলে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হবে এমন হুমকিতে সবাই ভয়ে কাজে যোগ দেয়। সকালে কাজে যোগদানের পর পুরো ভবনটি যখন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর ঠিক সেই সময় ভবনটির পেছন দিকে থেকে ধসে পড়া শুরু হয়। নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধ উপেক্ষা করে ছুটে যাচ্ছেন ধ্বংসস্তূপের দিকে। পুরো ৯ তলা ভবন ধসে পড়ায় উদ্ধার শেষ হতে কত সময় লাগবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে জানা গেছে, এখনো ১০ ভাগ উদ্ধারকাজও সম্পন্ন করা যায়নি। সাভারবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাভারের ইতিহাসে এতো বড় দুর্ঘটনা আগে ঘটেনি। এতো লাশ কিভাবে সাভারবাসী সামলাবে সেটাই তারা ভেবে পাচ্ছে না। সাভারে বহুতল ভবন ধসের ঘটনা এই প্রথম।

এইখানে মুল খবর

বিষয়: বিবিধ

১৫৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File