জেলগেটে দেখা ----------------আল মাহমুদ

লিখেছেন লিখেছেন অজানা পথিক ০৩ জুন, ২০১৩, ০৯:০৫:১৯ রাত





সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে

আজ তুমি আসবে ।

সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে । যদিও উত্তরের বাতাস

হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে , তবু আমি ঠান্ডা পানিতে

হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম,

আজ তুমি আসবে । সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে

আগুন ধরিয়ে দিল । বলল , বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন

দেখবেন , বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে ।



দেখো , সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে ।

আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে । ক্ষুধার্ত মানুষ

হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে । সংবাদপত্রগুলোও

না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয় ।

রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে

আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি

চেপে ধরেছি ।

হায় স্বাধীনতা , অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা

সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম ।



আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি

যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায় । যাতে

আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই ।

কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি ? আমি পাষাণ কারার

চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি ।

শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে

জাগিয়ে রাখতাম ।



চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে ।

আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম।

এক চিলতে বাগান

ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামা ভিজিয়ে

চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুললাম ।


বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো ।

তারপর গেলাম গোলাপের কাছে ।

জেলখানার গোলাপ , তবু কি সুন্দর গন্ধ !

আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না , ছিঁড়তেও দেয় না

কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম ।



আজ আর সময় কাটতে চায়না । দাড়ি কাটলাম । বই নিয়ে

নাড়াচাড়া করলাম । ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে ।

গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানে আসছে ।

চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসের কড়াই ফুটছে ।

আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে

গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে ।



না বাইরে এখন আকাল । মানুষ কি খেতে পায় ?

দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে ?

অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই না আনতে পারে ।

আ , পাখিরা কত স্বাধীন । কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে

জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম ।



আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে ।

সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয় ।

আমি কতবার তোমাকে বলেছি , দেখো

মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না ।

এর অন্য ব্যবস্হা দরকার , দরকার সামাজিক ন্যায়ের ।

দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে ।

আ , যদি আমার কথা বুঝতে ।



প্রিয়তমা আমার ,

তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে । আর

উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে ।

দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষের কোলাহল ।

যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে ।

যারা ঠেলে ।

চালায় ।

হানে ।

ঘোরায় ।

ওড়ায় ।

পেড়ায় ।

আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায় ।

সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী ।

কোনদিন শুকোয় না । শোনো , তাদের কলরব ।



বন্দীরা জেগে উঠছে । পাশের সেলে কাশির শব্দ

আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম

বললাম , আজ বারোটায় আমার ‘দেখা’ ।

খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো ।

সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে ।

যেন তুমি সংবাদপত্র ! যেন তুমি

আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা !


সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে

মাঝ আকাশে টেনে আনলো

ঠিক তখুনি তুমি এলে ।

জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম , তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে

চুপচাপ বসে আছো ।

হাসলে , ম্লান , সচ্ছল ।

কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না ।



সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমি খাবার দিতে শুরু করলে ।

মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে ,

আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে ।

আমি মাথা নাড়লাম ।



মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে ,

অমুক বিপ্লবী আর নেই

আমি মাথা নামালাম । বললে , ভেবোনা ,

আমরা সইতে পারবো । আল্লাহ , আমাদের শক্তি দিন ।

তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম ।

যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের

মাঝখানে থামলো ।

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

355295
২৬ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০৪:৪৯
জোনাকি লিখেছেন : ধন্যবাদ Happy Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File