এই লজ্জা কার??

লিখেছেন লিখেছেন এম আর সুমন ১৭ জুলাই, ২০১৩, ০৭:৫৮:২৮ সন্ধ্যা

দশ বছরের শিশু রাহুলের মা নীনা’র একটাই চিন্তা। কিছুতেই খেতে চায় না ছেলেটা। বিশেষ করে সকাল বেলায় স্কুলে যাওয়ার আগে তো নয়ই। রাহুলের বন্ধুদের মধ্যে তৃন আর সূর্যের মায়ের সাথেও প্রায়ই দেখা হয় তার। সূর্যের মা সুতপা তো তার বাল্যবন্ধু। দুজনে অনেক জল্পনা কল্পনা করে। ওদের দুজনের ছেলেই একদিন বড় হবে। বড় হলেও কি একইভাবে আম্মু আম্মু বলে গলা জড়িয়ে ধরবে?

সুতপা সেদিন বলছিলো, জানিস নীনা আমার সূর্যটা না একেবারে বউ ভক্ত হবে। মাকে কেয়ারই করবে না। নীনা জোরে হেসে ওঠে।

সুতপা থামে না, সত্যি বলছি। তুই জানিস না , এইটুকু বয়সেই সে কিনা বলে মম, আমি লাঞ্ঝের সময় পম্পিকে মাংস ধার দিয়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয়বার দিয়েছো?

সে কি বলে জানিস, প্রত্যেক দিনই তো দেই।

আমার দিতে ভাল লাগে।

এসব শুনে নীনা তো হেসেই খুন। সুতপা চালিয়ে যায়, বোঝ নীনা, দশ বছর বয়সেই তার মেয়েদের খাওয়াতে ভাল লাগে ! পরে কি হবে এক একখান! হা হা হা...

পম্পিও অনেক কিউট দেখতে। এত সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। দেখতে মনে হবে কোনো বিদেশী পুতুল যেন। নিখুত একেবারে। খুব ভাল লাগে যখন ছোট ছোট উচ্চারনে কথা বলে। পম্পির বয়স ৯ বছর হবে। চতুর্থ শেণীতে উঠেছে এবার। এরা সবাই মাসরাখ সরকারী প্রাইমারীতে পড়ে। পাটনা’র মধ্যে এ স্কুলটির সুনাম রয়েছে।

সরকার বেশ কিছুদিন হলো শিশুদের জন্য দুপুর বেলায় খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রথম যেদিন খাবার দিলো স্কুল থেকে সেদিন রাহুলের সে কি গল্প। জানো মা স্কুলের খাবারে ভিটামিন বেশি। জেনি মিস বলেছে। এখন থেকে আমি কিন্তু সকালে কিছুই খাব না। স্কুলে গিয়ে খাব। আর আমার ব্যাগে প্লেট দিয়ে দিও।

আজ সকালে উঠেও একই রকমের যুক্তি তর্ক করে , না খেয়েই রওয়ানা দিচ্ছিল ছেলেটা। রাহুল একেবারেই ওর বাবার মত জেদি হয়েছে। দুপুরে স্কুলে খাবা দিবে বলে সে সকালেও খাবে না। ওদের স্কুলে দুপুর বেলা খাবার দেয়ার সময় অবশ্য অনেক মজা হয়। সবাই মিলে একত্রে খেতে বসে। তাই অন্যের খাওয়া দেখে বাচ্চারা খায়। এইটুকুই যা ভরসা।

গত পরশু রাহুলের ছোট মামা বেড়াতে এসেছিলো। তখন যে মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো তাই দিয়ে জোর করে একটি মিষ্টি খাইয়ে দেয় নীনা। অন্যদিন হলে জোর করে খাওয়ানো যেত। কিন্তু বুধবার দিন রাহুলকে কেউ ধমকও দেয় না। বুধবার তার জš§ হয়েছিলো , তাই। সেটা রাহুলও জানে। তাই বুধবার এলেই সে মহারাজা হয়ে যায়। আজও তাই একটি মিষ্টি মুখে নিয়েই দৌড় দেয় রাহুল।

নীনা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহুলের দিকে। স্কুলের ব্যাগটি নিয়ে ছেলেটি যখন দৌড়ে যায়, দেখতে খুব ভাল লাগে। নীনার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। রাহুলের স্কুল ব্যাগটিতে লেখা আছে স্পাইডার। আবার উপরে একটি স্পাইডার এর ছবিও আছে। এমনিতে নীনা খুব মাকড়সা ভয় পায়। কিন্তু রাহুলের স্কুল ব্যাগে মাকড়সার ছবিটি দেখতে দেখতে সেই মাকড়সাটিকেও খুব আপন মনে হয়।

রাহুলের বাবা মাসরাখ এলাকার পাশেই উপজেলা শহরে ব্যবসা করেন। দুপুর দুইটার নীনার ফোনে রাহুলের বাবার কল আসে। নীনা মোবাইল ধরার পরেই ওই প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ। তুমি তাড়াতাড়ি আসো, রাহুল স্কুলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর কিছু বলতে পারে না রাহুলের বাবা। ও প্রান্তে ফোনে অনেক কণ্ঠে কান্নার শব্দ।

নীনা বুঝতে পারে না কিছুই। সে বাসা থেকে নেমে স্কুলের দিকে দৌড় দেয়। শরীর চলতে চায় না। সুস্থ শরীরে স্কুলে গেল ছেলেটা। কি হয়েছে বুঝতে পারছে না। বাজারে পৌছে দেখে অনেকেই স্কুলের দিকে দৌড়াচ্ছে। সুতপা আর তার ভাসুরও সামনে পড়লো। ওদেরকে জিজ্ঞেস করতেই কেউ কিছু বলতে পারলো না , কেবল কান্নার শব্দটুকুই বোঝা গেল। নীনা কিছুই বুঝতে পারছে না। স্কুলে তো বাচ্চার নিরাপদ। সেখানে কি এমন হতে পারে, যে সবাই স্কুলের দিকে দৌড়াচ্ছে। একটি চুড়ান্ত অমঙ্গলের চিন্তা এসেই আবার মিলিয়ে যায় নীনার মনে। ওরা স্কুলে পৌছে যায়। লোকজনের মধ্যে একটা শব্দই শুধু কানে আসে নীনার, স্কুলের খাবারে বিষ !

স্কুলের সামনে অনেক লোকের ভিড়। ভিড়ের মধ্যেও রাহুলের বাবার কান্নার শব্দ শুনতে পায় নীনা। তবে কি...রাহুলের কোনো ...

আর কিছইু ভাবতে চায় না নীনা। দ্রুত ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢোকে সে।

একটি ভ্যানে বেশ কয়েকটি বাচ্চা শুয়ে আছে।

ওই তো রাহুল, নীনার নাড়ি ছেড়া ধন... রাহুল , রাহুল...

রাহুল কথা বলে না, একটি বাচ্চাও কথা বলছে না। এখোনো দু ’একটি ভ্যানে করে বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খালি রাহুলকে যে ভ্যানে রাখা হয়েছে সেটাকেই কেউ হাসপাতালে নিচ্ছে না ! রাহুলের ঠিক পাশেই ছোট্র পুতুলের মত দেখতে পম্পি শুয়ে আছে , নির্বাক । সুতপা ছোটাছুটি করছে সূর্যের খোজে।

রাহুলের বাবাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কি হয়েছে রাহুলের, কিছুই মাথায় ঢুকছে না নীনার।

নীনা শুধু তার সন্তানকে কোলে নিতে চায় । দেখতে চায় রাহুল দৌড়াচ্ছে। পেছনে তার স্পাইডারম্যান অঙ্কিত স্কুল ব্যাগ ।

( মূল ঘটনা ঃ ১৭ - ০৭ -২০১৩, ভারতের পাটনার সারান জেলায় একটি গ্রামে স্কুলের দেয়া দুপুরের খাবার খেয়ে নিহত হয়েছে ২২ টি শিশু)

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File