মল্লিক: ইসলামী সংস্কৃতির তূর্যবাদক
লিখেছেন লিখেছেন সুহৃদ আকবর ২৫ মার্চ, ২০১৩, ০২:৪৫:২৩ দুপুর
অনেকদিন পর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ীতে গেলাম। রমযান শুরু হতে আর মাত্র কিছুদিন বাকী। গ্রামের গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ, নদী-মাঠ-খেত আর নানান রঙের পাখি দেখে আমার তখনকার সময় কাটছিল। বলা যায় অলস সময়। অলস সময় হলেও সে সময় ভাবনা আর দেখার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেয়েছিলাম।
মল্লিক ভাই মারা গেলেন ১২ আগষ্ট ২০১০ ইং। আমার দুর্ভাগ্য সংবাদটি সাথে সাথে পেলাম না। পাবার কথা ছিল কারণ, ঢাকাতে আমার অনেক সুহৃদরা থাকেন। কিন্তু খবর পেলাম একদিন পরে। যোহরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে গিয়ে। মসজিদের মুয়াজ্জিন শুনালেন করুন সংবাদটি। বললেন, আকবর ভাই,মল্লিক ভাই গতকাল মারা গেছেন। সাথে সাথে ইন্নালিল্লাহ পড়লাম। আর কি যে খারাপ লেগেছিল আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। নিমিষেই আমার মুখ মলিন হয়ে গেল। মন ভারাক্রান্ত হল। কারণ, মনে বড় স্বাদ ছিল, আশা ছিল স্বপ্ন ছিল অন্তত একবার হলে ও মল্লিক ভাইয়ের সাথে দেখা করবো। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন যে বিধাতা পূরণ করেন না; আমার ইচ্ছাও তিনি পূরণ করলেন না। এতদিন যে স্বপ্ন দেখতাম আমার মনের আকাশে মল্লিক ভাই মারা যাওয়ার সাথে সাথে নীল আকাশের সে আশার প্রদীপের অপমৃত্যু ঘটলো। এত দুঃখ কোথায় রাখি? ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে মানুষটিকে এত ভালবাসতাম; অথচ একবারের জন্য ও দেখতে পেলাম না! কারণ আমি তখন চট্টগাম থাকতাম। পড়তাম চট্টগাম কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। এর পরে মাস্টার্স এডমিশন নিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। তার আগেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। পাড়ি দিলেন অন্তত জীবনের পথে। তিনি তো গান ও গেয়েছিলেন:
”পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়
মরন একদিন মুছে দেবে সকল রঙিন পরিচয়॥”
মল্লিক শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতির স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু স্বপ্নদ্রষ্টা নয়; রূপকার তথা জন্মদাতা। বাংলাদেশের ইসলামী সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতির পুরোধা ব্যাক্তিত্ব। দেশের সর্বত্র তিনি বিচরণ করেছেন। বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় তিনি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্বপ্নের সওদা বিলি করে বেড়িয়েছেন। মানুষের মাঝে নতুন আশার আলো জাগিয়ে তুলেছেন। দ্বারে দ্বারে ইসলামী গান-গজলের প্রচার করেছেন। ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন।
”আন্দোলন সেতো জীবনের অন্য নাম
জীবন মানেই সংগ্রাম জীবন মানেই সংগ্রাম॥
যদি মন স্বপ্ন দেখা ভুলে যেত
যদি বেদনার মাঝে সুখ মুখ লুকাতো
কিছু হতো না তবে কিছু হতো না জীবনের সন্ধান কেউ পেতো না॥”
তার ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশে ইসলামী গান-গজল এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে।
আমরা মুসলিম। ইসলাম আমাদের ধর্ম; শুধু ধর্ম নয় জীবন চলার একমাত্র মাধ্যম। জীবন চলার পাথেয়। কুরআন আমাদের সংবিধান। এতে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়া আছে। প্রতিটি বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামের যে একটা সংস্কৃতি আছে তা আমরা কেবল শুনেছি তবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মল্লিক তা আমাদেরকে দেখিয়েছেন। তবে তার আগে কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদও ইসলামী অসংখ্য কবিতা-গান লিখে ইসলামী সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু মল্লিক তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞানকে ইসলামী সংস্কৃতির জন্য নিবেদন করেছেন। বাংলাদেশে বিশেষ করে তরুণ-যুব সমাজের মাঝে ব্যাপকভাবে ইসলামী গান-গজলের একটা স্রোত তৈরী করতে সক্ষম হন। এখানেই মনে হয় তাঁর স্বকীয়তা নিহিত। তাই আমি মনে করি নির্দিধায় মল্লিককে বাংলাদেশের ইসলামী সংস্কৃতির জনক বলা যেতে পারে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে মল্লিক অন্য কোন দেশে না জন্মে বাংলাদেশে জন্মেছেন। যার ফলে আমরা ইসলামী সংস্কৃতিকে জানতে,বুঝতে ও ভালবাসতে শিখেছি। তা না হলে ইসলামী সংস্কৃতি কি আমরা জানতে পারতাম না। ইসলামী সংস্কৃতি আমাদের কাছে অধরা থেকে যেত শুধু এর নাম শুনে আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে হত। সোনার হরিণের মত এর পিছূ ছুটতাম। এ সংস্কৃতি কেমন, কেমন তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ তিনি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। আরও শিখিয়েছেন ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ কি, আর জাহেলিয়াতের সংস্কৃতিই বা কেমন।
মল্লিক ভাইকে আমি মন-প্রাণ উজাড় করে ভালবাসি। কারণ, তিনি আমাদের অতি আপনজন। ইসলামী সংস্কৃতির এক অনন্য ব্যক্তি। যার সারা দেহে ছড়িয়ে আছে ইসলামী সংস্কৃতির আলোক জ্যোতি। জানিনা পাঠক, আমার সে অন্ধ ভালবাসার মূল্য কত? তবে আজীবন আমি মল্লিক ভাইকে ভালবেসে যাব। আমার হৃদয়ের মণি-কোঠরে একটি জায়গা বরাদ্ধ থাকবে আমৃত্যু পর্যন্ত। মল্লিকের শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে, একমাত্র তিনিই পেরেছিলেন ইসলামী সংস্কৃতিকে মানুষের দ্বোর গোঁড়ায় পৌঁছে দিতে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী রেনেসার কবি র্ফরুখ আহমদ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, হিজল বনের কবি গোলাম মোহাম্মদ ইসলামী গান লিখে এ সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছেন। তারা তাদের ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ঘুমন্ত মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলেছেন। আর সেই জাগরণেরই একজন তূর্যবাদক আমাদের প্রিয় মল্লিক। মল্লিক তার গানকে মানুষের নিকট থেকে আরো নিকটে মনের গহীনে নিয়ে গেছেন।
মল্লিক ছিলেন ”সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী”র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি তার অসম্ভব মেধা আর খাটুনি দিয়ে সাইমুমকে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পীগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০শত ইসলামী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি তার গানকে অডিও ও ভিডিও এর মাধ্যমে প্রচার করেন। যার ফলে দেশের তাওহীদি জনগণ তাঁর গানের ভক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে ইসলামী বিপ্লবের কর্মীরা। মল্লিকের গান শুনে আন্দোলনের কর্মীরা ইসলামের কাজ করার জন্য নতুনভাবে প্রেরণা লাভ করে।
*”এখানে কি কেউ নেই খোদার রঙে জীবনকে রাঙাবার
এখানে কি কেউ নেই খোদার রাহে জীবনকে বিলাবার॥”
*”জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ
বীর মুজাহিদ জিন্দাবাদ
হযরত আলীর বিপ্লবী খুন
তোর দীলে আজ হোক আবাদ॥”
*”জিহাদ করতে চাই আমি জিহাদ করতে চাই
জিহাদ ছাড়া অন্য কোন পথে মুক্তি নাই॥”
এভাবে বিপ্লবের কর্মীদের একান্ত আপন ও প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন মল্লিক।
পৃথিবীর বুকে আমাদের বাংলাদেশ অতিশয় সুন্দর দেশ। যে দেশ সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলায় ভরপুর। যাকে পৃথিবীর রাণী বলা হয়। যার দেহ সবুজের মন মাতানো নজর কাড়া আভরণ দিয়ে ঢাকা থাকে সব সময়। আর এ দেশের আকাশ-নদী-মাঠ কবিকে বড়ই ভাবুক করে তুলেছে।
*”রোদের ভেতর ইলশে গুড়ি সঙ্গে পাখির ডাক
আম বাগানের ভেতর যেন মৌমাছিদের ঝাঁক॥
মন মেলে দেয় পাখা
যায় না ঘরে থাকা
আকাশে কার তুলির আঁচড়
রংধনুকে রাখ॥
ঘাসের ডগায় হীরক জ্বলে
মুুক্ত ফুলের বুকে
হঠাৎ হাওয়া দোল দিয়ে যায়
একটু খানি ঝুঁকে॥
কে এক রাখাল ছেলে
ছুটলো মাথাল ফেলে
সোহাগে তার উঠলো নেচে
হিজল বনের বাঘ॥”
সাইমুম অর্থ-মরুভূমির ভয়াবহ ঝড়। যা সকল কিছু ওলটপালট করে দেয়। তেমনি মল্লিক ভাইও তার সাইমুম শিল্পিগোষ্ঠেীর মাধ্যমে সকল অপ-সংস্কৃতিকে দূরীভূত করেছেন। লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন জাহেলিয়াতের সকল ভীত। বাংলাদেশের আকাশ যখন ভারতীয় আর ইউরোপের নগ্ন সংস্কৃতির দখলে তখন আমাদের মল্লিক ভাই দৃপ্ত কদমে এদেশের আকাশে ইসলামী সংস্কৃতির পতাকা উড্ডীন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোন রক্ত চক্ষুকে ভয় পাননি। হুমকিতে চুপসে যাননি। বাঁধার প্রাচীর মাড়িয়েছেন অটলভাবে।
মল্লিক ছিলেন ইসলামী পূণর্জাগরণের এক অগ্র-সৈনিক। ইসলামী প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে যত প্রকার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে মল্লিক তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে দূর করেছেন। তার প্রতিটি গান ও গজল অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাধনার ফল। এবং অনুষন্ধিৎসার ফসল। মল্লিক ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতির সারথি।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তিনি আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। বসত গড়েছেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসেনি আসনেও না। সে এক নিষ্ঠুর নিয়ম। এরকম নিয়ম প্রচলন করার পেছনে বিধাতার ইচ্ছাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বলা হয় সবই তাঁর লীলা। কিন্তু মল্লিক আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ থেকে কেয়ামত অবধি। বাজনা ছাড়া যে গান হতে পারে, সেটা আমাদের নিকট হাস্যকর মনে হলেও মল্লিক তা আমাদেরকে দেখিয়েছেন। সম্প্রতি একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি একটা যুবতী মেয়ের শরীর দুলানো। তখন আমি অনেক বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। মনের অৎান্তেই গুন গুন করে গাইতে লাগলাম-
*”টিক টিক টিক টিক যে ঘড়িটা বাজে ঠিক ঠিক বাজে
কেউ কি জানে সেই ঘড়িটা লাগবে কয়দিন কাজে॥
তার মন সব সময় পথহারা মানুষকে পথের দিশা দিতে ব্যাপৃত ছিল।
*”মন আমার কাঁদেরে
প্রাণ আমার কাঁদেরে আজ কাঁদে
মানুষের মুক্তি চেয়ে জীবনের স্বস্তি চেয়ে॥”
আসুন, এই তমসাচ্ছন্ন অচলায়তন সমাজকে আলোর মুখ দেখাবার জন্য মল্লিকের গান ও গজলের ব্যাপক চর্চা করি। আমাদের সকলের জীবন সত্য-সুন্দর ও নির্মল সংস্কৃতিতে ভরে উঠুক। হে পরম করুণাময়, তুমি আমাদের প্রিয় মল্লিক ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করো। মল্লিক, তুমি অনেক ভালো থেকো, সুখে থেকো, অমরাবতীর সবুজ কাননে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন