মায়াপুরী হাতিরঝিল নান্দনিক স্থাপত্যের নিদর্শন

লিখেছেন লিখেছেন সুহৃদ আকবর ২৪ মার্চ, ২০১৩, ০৬:১১:৪৮ সন্ধ্যা

শুরুতে একটা গান মনে পড়ে গেল, ‘বন্ধু মায়া লাগাইছে ফিরিতি শিখাইছে সোনাবন্ধে আমারে মায়া লাগাইছে’ এই গানের মতই হাতিরঝিল আমাকে মায়া লাগাইছে। দিয়েছে উষ্ণ, ¯িœগ্ধ, কোমল, শীতল, মোহনীয় ভালবাসার স্বাদ। জড়িয়েছে ভালবাসার বাঁধনে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর হাতিঝিল এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। সে সময় হাতিরঝিলের ওভার ব্রিজগুলোকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। ব্রিজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে লাল, সাদা, বেগুনি, আকাশী, খয়েরী রঙের আলো। যখন লাইটগুলো একটার পর একটা রঙ পরিবর্তন করে তখন তাকে এত সুন্দর দেখায় যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সে তখন শুধু হাতিরঝিল থাকে না সে পরিণত হয় মায়াবী এক দেবীতে। মায়াবী রূপসী দেবীর মতো তার শরীর থেকে বের হতে থাকে সৌন্দর্যের আলোচ্ছটা। সে তখন হয়ে উঠে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। তখন মনের ভেতরও ভিন্ন এক অনুভূতি খেলা করে। শিহরণে দোলা দেয় আমাদের মন। মনে হয় তার রূপ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। গলে গলে যাচ্ছে জোছনা রাতের চাঁদের মতো। সে তখন হয়ে যায় মায়াবতী নারী কিংবা ডানাকাড়া পরী অথবা চঞ্চলা মায়ারী বন হরিণী।

এভাবেই হাতিরঝিল প্রতি সন্ধ্যায় তার রূপ সাগরে হাবুডুবু খেতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানায়। হাতছানি দিয়ে ডাকে। মুচকি দিয়ে হাসে। ঠিক যেন আলতা রাঙা পায়ে, মেহেদী মাখা কোমল হাতে। যেভাবে কোনো স্ত্রী মেহেদী রাঙা হাতে টানা টানা চোখে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে তার দয়িতার জন্য। এভাবে কত রকমে কত ভাবেই যে হাতিরঝিলের মায়াবী রূপের বর্ণনা দেয়া যাবে তার হিসেব নেই। হাতিরঝিল আমাদের স্পর্ধাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের ভোতা অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে দিয়েছে। মনে সাহসের বীজ সঞ্চারিত করেছে। এতদিন পর বোধহয় মানুষকে বলার মতো আমাদের অন্তত একটা জিনিস হলো। তাও আবার কম কিসের। তার নাম হাতিরঝিল। অমরাবতী হাতিরঝিল। স্বপ্নপুরী হাতিরঝিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হাতিরঝিল প্রকল্প পাশ করা হলো। এমন এক সময় এ হাতিরঝিল প্রকল্পটি পাশ হয়েছে যখন হাতিরঝিলের জায়গা জমি আওয়ামীলীগ-বিএনপির দস্যু খেকোদের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা হয়ে যায়।

প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মানুষ হাতিরঝিলের রূপ বৈচিত্র দেখার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হয়। প্রাণভরে উপভোগ করে এই ঝিলের টলমনে পানি আর নান্দনিত স্থাপত্যের পরিচয় বহনকারী এই আকর্ষনীয় স্থানকে।

কেউ তার প্রিয় বন্ধুটির হাত ধরে আসে। কেউবা আসে তার প্রিয়তমার বাহু জড়িয়ে। কেউ আসে পুরো পরিবার নিয়ে। আবার কেউবা আসে এক পাল বন্ধু-বান্ধব সহকারে। এভাবে সবাই এসে হাজির হয় হাতিরঝিলের কাছে। প্রথমে এসে অনেকে হকচকিয়ে উঠে। অনেকের আবার বিশ্বাসই হয় না যে তারা বাংলাদেশের কোনো জায়গায় বিকেলে বা রাতে ঘুরতে বেরিয়েছে। তখন তাদের কাছে মনে হয় তারা বুঝি সিঙ্গাপুর, দুবাই, অট্টেলিয়া, লন্ডন, কানাডার দৃষ্টিনন্দন কোন স্পট পরিদর্শন করছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই আমি অবিভূত। আামি আপ্লুত। আমি অনেক অনেক মুগ্ধ। হাতিরঝিল আমার সে ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে। ধারণার ভেড়া ভেঙ্গে দিয়েছে। হাতিরঝিল আমার কানে এসে বলে, ‘এটা বাংলাদেশের ঢাকা শহর, আপনি কী সব আবোল তাবোল ভাবতাছেন ভাই।’ তখন আসলেই আমার ভুল ভাঙ্গে তখন আমি সংশোধন করে নিই নিজেকে। আপনারাও যদি কখনোবা হাতিরঝিল যান তখন আমার মতো আপনাদেরও মনেই হবে না যে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের কোথাও আপনারা আছেন। কেননা সময় ঘাতক যানজট, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ আরো নানান সমস্যায় জর্জরিত এই ঢাকা শহর। সেই শহরেই কিনা এত সুন্দর! এত নির্মল, এত কোমল একটা জায়গা। মুহূর্তেই আপনার মনটা নেচে উঠবে। গেয়ে উঠবে। আপনি বিমোহিত হয়ে যাবেন। আনন্দের আতিশাষ্যে ফুলে ফেপে বেলুনের মতো হয়ে যাবেন। উড়াল দিতে পারেন নীল আকাশপানে।

হাতিরঝিল নামটার ভেতর কেমন জানি একটা জাদু আছে। এক মধুমাখা স্বাদ আছে। একটা টান আছে। একটা পাগলকরা সুর আছে। সেই কারণেই আমার মনে হয় বোধহয় হাতিরঝিল প্রতিদিন আমাকে ডাকছে। প্রতিনিয়তই ডেকে যাচ্ছে তার অপরূপ সৌন্দর্যের সুধা পান করার জন্য।

হাতিরঝিলের ঝিলিমিলি জলতরঙ্গ প্রথম দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়। দেখে আমার বিশ্বাসই হলো না। তবে বেশ ভাল লাগল। মনে মনে ভাবলাম সত্যি যদি হয় তাহলে অবশ্যই তাকে আমি দেখতে যাবে। আমাকে দেখতেই হবে। মনে পড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন সকাল দশটায় নাস্তা করছিলাম মহাখালীর কন্টিনেন্টাল হোটেলে। সেখানেই দেখা হলো সবুজ ভাইয়ের সাথে। উনি আমার আগে নাস্তা করে বিল পরিশোধ করেছেন। এরপর হাসি মুখে আমার পাশে এসে বসলেন, বললেন, আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবে। কোথায়? বললেন, হাতিরঝিল। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। নাস্তা করা শেষ হলে মোটর সাইকেলে চড়ে আমরা হাতিরঝিলের দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু বিধিবাম, হাতিরঝিলের মুখে আসতেই দায়িত্বরত বিডিআর সদস্যরা আমাদেরকে আটকে দিল। জানালেন, ভেতরে যাওয়া যাবে না। তাই আমারা সেদিন ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। সবুজ ভাই বললেন, আমরা আমাদের বাসার সবাই মিলে একদিন রাতে আসবো। আমি বললাম ঠিক আছে।

এরপর একদিন বিকেলে নাস্তা করার পর অনেকটা আকস্মিকভাবেই নাঈমকে নিয়ে হাতিরঝিল বেড়াতে গেলাম। তখন বিকাল ৫টা। প্রকৃতির চরিদিকে গোধূলির লাল-সাদা রং ছড়িয়ে পড়েছে। ঝিলের জলে খেলা করছে রোদের কিরণ। মায়াময় একটা পরিবেশ। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। বাতাসে ধুলোর ধোয়া উড়ছে। আমি নাকে রুমাল চেপে হাঁটছিলাম। নাঈম তার কনিষ্ঠ আঙুলে আমার আঙুল লাগিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আর মাথা দুলিয়ে স্বভাবসূলভ কথা বলতে থাকল। নাঈম সহজ-সরল, সজ্জন ব্যাক্তিত্ববান একজন মানুষ। আমি বয়সে তার বড়, তবুও সে খুব সহজে অল্প কয়দিনে আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আসলে কিছু কিছু মানুষের সরলতা-ভালবাসা-আন্তরিকতা দেখলে আমাকে অনেকটাই অবাক হতে হয়। অবাক না হয়ে উপায় থাকেনা। সে রকমই একজন সাদা মনের মানুষ নাঈম। সে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে সে বড় একজন সাংবাদিক হবে বলে আশা করছি। বর্তমানে সে প্রতিমুহূর্তের বাংলা নামক একটা অনলাইন প্রত্রিকার নিবন্ধিত রিপোর্টার। তার অনেক যোগ্যতা আছে। সেদিনের বিকেলটা আমাদের দারুণ কেটেছে। আমরা দু’জন হাঁটতে হাঁটতে ওভারব্রিজ পার হয়ে মহানগর আবাসিক এলাকায় গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এরপর বাসায় এলাম।

এরপর আরেকদিন বাসার সবাইকে নিয়ে হাতিরঝিল দেখতে বের হলাম। আমিসহ বাকী সফরসঙ্গীরা হলো সবুজ ভাই, বাশার ভাই, সাইফুল ভাই, নাঈম ও আরিফ। শুরুটা হয়েছিল বাশার ভাইয়ের নাবিস্কো চকলেট খাওয়ার মধ্যদিয়ে। সবাই পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। পথে দুইটা নার্সারীতে ঢুকে গাছ দেখলেন সবুজ ভাই। আমরা নার্সারীর মালিককে বললাম, পরে আসব, আপনার এখান থেকে গাছ কিনব। একথা বলে বাগান থেকে বের হলাম। নিকেতনের ডা. ফজলে রাব্বী পার্ক এর ভেতর দিয়ে হেঁটে আমরা হাতিরঝিল পৌঁছলাম। প্রবেশের আগে একটা চা দোকান থেকে চা খেলাম। বলতে ভুলে গেছি, এর আগে কিন্তু আমরা সবাই চিতই পিঠা খেয়েছিলাম। নাঈম খেয়েছে ভাপা পিঠা। সাইফুল ভাই খেয়েছে দুটো, আমরা সবাই একটা করে। বাশার ভাই আর সাইফুল ইসলাম পিঠা খাওয়ার পর চলে গেল। আমরা হাতিরঝিলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কখনো জোড়া জোড়া কখনো হাত ধরাধরি করে কখনোবা দলবদ্ধভাবে হাঁটতে লাগলাম। পথের পাশে ফুলের বাগান আর সদ্য রোপন করা কচি গাছ গাছালি আমাদেরকে অভিবাদন জানালো। সময় তখন মাগরিবের পর। ঝিরিঝিরি কোমল বাতাস আমাদের গায়ে এসে লাগল। আমাদের সবার মন উদাস হল। আকাশের বুকে উদিত হল রাতের চাঁদ। ঝিলের পানিতে পড়লো তার ছায়া। চাঁদের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে ঝিলের টলমল পানি খেলা করছে। দু’টি পাখি মাথার উপর দিয়ে এইমাত্র উড়ে গেল। ঝিলের মাঝে বসানো হয়েছে ফুলের টব। এটা অনন্য স্থাপত্যশিল্পের পরিচয় বহন করছে। টবগুলোকে কানা বকের মত মনে হচ্ছে। মনে হয় মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিছুক্ষণ পর তুহিন আমাদের সাথে এসে যোগ দিল। সে আমার আগের রুমমেট। তুহিন তার উশখো খুশকো চুল আর স্বভাবসূলভ হাসি দিয়ে আমাদের সাথে হাত মেলালো। কোলাকোলি করল। আমরা সবাই হাঁটতে হাঁটতে তিনটি ব্রিজ অতিক্রম করলাম। দেখলাম। এভাবে হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলাম। মাঝখানে সবুজ ভাইয়ের সৌসন্যে মুড়ির আর চিড়ার মোয়া খেলাম। এর মাঝে আমি দশটি কলমের শিষ কিনলাম। মাত্র ৫ টাকা দিয়ে। এ যেন শায়েস্তা খাঁর আমললের টাকায় ৮মণ চাল কেনার বাস্তব অভিজ্ঞতা। এসব অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অন্য কোথাও মিলবে না একমাত্র হাতিরঝিল ছাড়া। এযেন এক কল্পরাজ্য।

হাতিরঝিলে রয়েছে ছোট বড় আট দশটা ব্রিজ। সামনে আরো হবে। ব্রিজগুলো অসাধারণ! অনন্য স্থাপত্যের নান্দনিক এক নিদর্শন। যা এই পৃথিবীর আর কোথায়ও নেই। নেই একথা পুরোপুরি ঠিক না; তবে এমন সুন্দর ব্রিজ নেই। হবেও না। যা শুধুমাত্র আমাদের হাতিরঝিলেই চোখে পড়বে। এছাড়া আর কোথাও মিলবে না এমন কারুকার্যময় নঁকশার ব্রিজ। শুনেছিলাম তাজমহলের নঁকসাকারীর হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। যাতে সে এমন সুন্দর নঁকশা আর কোথাও করতে না পারে। হাতিরঝিলের নঁকশাকারীর হাতকাটা না হলেও তাকে যেন অন্তত কঠোরভাবে এটা বলে দেয়া হয় যে, সে যাতে দেশ-বিদেশের কোথায়ও এ রমম নঁকশার কোনো স্থাপত্য নির্মাণ না পারে। হাতিরঝিল তার নান্দনিক কারুকার্যময় স্থাপত্যশৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এই ঢাকার বুকে।

হাতিরঝিলের তুলনা দেবার মতো যেন এমন স্থাপত্য আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না পৃথিবীব্যাপী। হাতিরঝিল অপ্রতিদ্বন্দ্বি। যে রকম বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। বিদ্রোহী কবি-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রূপসী বাংলা কবি জীবনানন্দদাশ। সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ। হিজল বনের কবি গোলাম মোহাম্মদ। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ। ইসলামের কবি গোলাম মোস্তফা। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সরল গদ্যের জনক হুমায়ূন আহমদ। ইসলামী সংস্কৃতির কবি মতিউর রহমান মল্লিক। এদের কোনো তুলনা নেই। এরা বাংলা সাহিত্যের এক একজন তারকা। তারা নিজ নিজ মহিমায় অতুলনীয়। স্ব-মহিমায় ভাস্বর। সে রকম হাতিরঝিলও অতুলনীয়।

আমরা হাতিরঝিলে এতটাই হেঁটেছি যে হাটতে হাটতে আমাদের পা ব্যাথা হয়ে গেল। তখন সময় রাত নয়টা। আর নয় এখন যাওয়ার পালা। এরপর আমরা হাতিরঝিলের মায়াবী রূপ দর্শন শেষে বাসার দিকে রওয়ানা করলাম। বাসায় আসলাম। হাতিরঝিলের মাটিতে লেগে রইল আমাদের পদরেখা। আমাদের স্মৃতির খাতায় জমা হল একটি সোনালী মুহূর্ত। হাতিরঝিল, তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যমণি। ভালবাসার আকর। মায়ার প্রতিমা। আসলেই তুমি অনেক সুন্দর। আননি একবার আসতে পারেন হাতিঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

শুরুতে একটা গান মনে পড়ে গেল, ‘বন্ধু মায়া লাগাইছে ফিরিতি শিখাইছে সোনাবন্ধে আমারে মায়া লাগাইছে’ এই গানের মতই হাতিরঝিল আমাকে মায়া লাগাইছে। দিয়েছে উষ্ণ, ¯িœগ্ধ, কোমল, শীতল, মোহনীয় ভালবাসার স্বাদ। জড়িয়েছে ভালবাসার বাঁধনে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর হাতিঝিল এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। সে সময় হাতিরঝিলের ওভার ব্রিজগুলোকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। ব্রিজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে লাল, সাদা, বেগুনি, আকাশী, খয়েরী রঙের আলো। যখন লাইটগুলো একটার পর একটা রঙ পরিবর্তন করে তখন তাকে এত সুন্দর দেখায় যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সে তখন শুধু হাতিরঝিল থাকে না সে পরিণত হয় মায়াবী এক দেবীতে। মায়াবী রূপসী দেবীর মতো তার শরীর থেকে বের হতে থাকে সৌন্দর্যের আলোচ্ছটা। সে তখন হয়ে উঠে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। তখন মনের ভেতরও ভিন্ন এক অনুভূতি খেলা করে। শিহরণে দোলা দেয় আমাদের মন। মনে হয় তার রূপ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। গলে গলে যাচ্ছে জোছনা রাতের চাঁদের মতো। সে তখন হয়ে যায় মায়াবতী নারী কিংবা ডানাকাড়া পরী অথবা চঞ্চলা মায়ারী বন হরিণী।

এভাবেই হাতিরঝিল প্রতি সন্ধ্যায় তার রূপ সাগরে হাবুডুবু খেতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানায়। হাতছানি দিয়ে ডাকে। মুচকি দিয়ে হাসে। ঠিক যেন আলতা রাঙা পায়ে, মেহেদী মাখা কোমল হাতে। যেভাবে কোনো স্ত্রী মেহেদী রাঙা হাতে টানা টানা চোখে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে তার দয়িতার জন্য। এভাবে কত রকমে কত ভাবেই যে হাতিরঝিলের মায়াবী রূপের বর্ণনা দেয়া যাবে তার হিসেব নেই। হাতিরঝিল আমাদের স্পর্ধাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের ভোতা অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে দিয়েছে। মনে সাহসের বীজ সঞ্চারিত করেছে। এতদিন পর বোধহয় মানুষকে বলার মতো আমাদের অন্তত একটা জিনিস হলো। তাও আবার কম কিসের। তার নাম হাতিরঝিল। অমরাবতী হাতিরঝিল। স্বপ্নপুরী হাতিরঝিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হাতিরঝিল প্রকল্প পাশ করা হলো। এমন এক সময় এ হাতিরঝিল প্রকল্পটি পাশ হয়েছে যখন হাতিরঝিলের জায়গা জমি আওয়ামীলীগ-বিএনপির দস্যু খেকোদের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা হয়ে যায়।

প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মানুষ হাতিরঝিলের রূপ বৈচিত্র দেখার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হয়। প্রাণভরে উপভোগ করে এই ঝিলের টলমনে পানি আর নান্দনিত স্থাপত্যের পরিচয় বহনকারী এই আকর্ষনীয় স্থানকে।

কেউ তার প্রিয় বন্ধুটির হাত ধরে আসে। কেউবা আসে তার প্রিয়তমার বাহু জড়িয়ে। কেউ আসে পুরো পরিবার নিয়ে। আবার কেউবা আসে এক পাল বন্ধু-বান্ধব সহকারে। এভাবে সবাই এসে হাজির হয় হাতিরঝিলের কাছে। প্রথমে এসে অনেকে হকচকিয়ে উঠে। অনেকের আবার বিশ্বাসই হয় না যে তারা বাংলাদেশের কোনো জায়গায় বিকেলে বা রাতে ঘুরতে বেরিয়েছে। তখন তাদের কাছে মনে হয় তারা বুঝি সিঙ্গাপুর, দুবাই, অট্টেলিয়া, লন্ডন, কানাডার দৃষ্টিনন্দন কোন স্পট পরিদর্শন করছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই আমি অবিভূত। আামি আপ্লুত। আমি অনেক অনেক মুগ্ধ। হাতিরঝিল আমার সে ভুল ভেঙ্গে দিয়েছে। ধারণার ভেড়া ভেঙ্গে দিয়েছে। হাতিরঝিল আমার কানে এসে বলে, ‘এটা বাংলাদেশের ঢাকা শহর, আপনি কী সব আবোল তাবোল ভাবতাছেন ভাই।’ তখন আসলেই আমার ভুল ভাঙ্গে তখন আমি সংশোধন করে নিই নিজেকে। আপনারাও যদি কখনোবা হাতিরঝিল যান তখন আমার মতো আপনাদেরও মনেই হবে না যে বাংলাদেশের ঢাকা শহরের কোথাও আপনারা আছেন। কেননা সময় ঘাতক যানজট, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ আরো নানান সমস্যায় জর্জরিত এই ঢাকা শহর। সেই শহরেই কিনা এত সুন্দর! এত নির্মল, এত কোমল একটা জায়গা। মুহূর্তেই আপনার মনটা নেচে উঠবে। গেয়ে উঠবে। আপনি বিমোহিত হয়ে যাবেন। আনন্দের আতিশাষ্যে ফুলে ফেপে বেলুনের মতো হয়ে যাবেন। উড়াল দিতে পারেন নীল আকাশপানে।

হাতিরঝিল নামটার ভেতর কেমন জানি একটা জাদু আছে। এক মধুমাখা স্বাদ আছে। একটা টান আছে। একটা পাগলকরা সুর আছে। সেই কারণেই আমার মনে হয় বোধহয় হাতিরঝিল প্রতিদিন আমাকে ডাকছে। প্রতিনিয়তই ডেকে যাচ্ছে তার অপরূপ সৌন্দর্যের সুধা পান করার জন্য।

হাতিরঝিলের ঝিলিমিলি জলতরঙ্গ প্রথম দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়। দেখে আমার বিশ্বাসই হলো না। তবে বেশ ভাল লাগল। মনে মনে ভাবলাম সত্যি যদি হয় তাহলে অবশ্যই তাকে আমি দেখতে যাবে। আমাকে দেখতেই হবে। মনে পড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন সকাল দশটায় নাস্তা করছিলাম মহাখালীর কন্টিনেন্টাল হোটেলে। সেখানেই দেখা হলো সবুজ ভাইয়ের সাথে। উনি আমার আগে নাস্তা করে বিল পরিশোধ করেছেন। এরপর হাসি মুখে আমার পাশে এসে বসলেন, বললেন, আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবে। কোথায়? বললেন, হাতিরঝিল। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। নাস্তা করা শেষ হলে মোটর সাইকেলে চড়ে আমরা হাতিরঝিলের দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু বিধিবাম, হাতিরঝিলের মুখে আসতেই দায়িত্বরত বিডিআর সদস্যরা আমাদেরকে আটকে দিল। জানালেন, ভেতরে যাওয়া যাবে না। তাই আমারা সেদিন ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। সবুজ ভাই বললেন, আমরা আমাদের বাসার সবাই মিলে একদিন রাতে আসবো। আমি বললাম ঠিক আছে।

এরপর একদিন বিকেলে নাস্তা করার পর অনেকটা আকস্মিকভাবেই নাঈমকে নিয়ে হাতিরঝিল বেড়াতে গেলাম। তখন বিকাল ৫টা। প্রকৃতির চরিদিকে গোধূলির লাল-সাদা রং ছড়িয়ে পড়েছে। ঝিলের জলে খেলা করছে রোদের কিরণ। মায়াময় একটা পরিবেশ। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। বাতাসে ধুলোর ধোয়া উড়ছে। আমি নাকে রুমাল চেপে হাঁটছিলাম। নাঈম তার কনিষ্ঠ আঙুলে আমার আঙুল লাগিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আর মাথা দুলিয়ে স্বভাবসূলভ কথা বলতে থাকল। নাঈম সহজ-সরল, সজ্জন ব্যাক্তিত্ববান একজন মানুষ। আমি বয়সে তার বড়, তবুও সে খুব সহজে অল্প কয়দিনে আমার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। আসলে কিছু কিছু মানুষের সরলতা-ভালবাসা-আন্তরিকতা দেখলে আমাকে অনেকটাই অবাক হতে হয়। অবাক না হয়ে উপায় থাকেনা। সে রকমই একজন সাদা মনের মানুষ নাঈম। সে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে সে বড় একজন সাংবাদিক হবে বলে আশা করছি। বর্তমানে সে প্রতিমুহূর্তের বাংলা নামক একটা অনলাইন প্রত্রিকার নিবন্ধিত রিপোর্টার। তার অনেক যোগ্যতা আছে। সেদিনের বিকেলটা আমাদের দারুণ কেটেছে। আমরা দু’জন হাঁটতে হাঁটতে ওভারব্রিজ পার হয়ে মহানগর আবাসিক এলাকায় গিয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এরপর বাসায় এলাম।

এরপর আরেকদিন বাসার সবাইকে নিয়ে হাতিরঝিল দেখতে বের হলাম। আমিসহ বাকী সফরসঙ্গীরা হলো সবুজ ভাই, বাশার ভাই, সাইফুল ভাই, নাঈম ও আরিফ। শুরুটা হয়েছিল বাশার ভাইয়ের নাবিস্কো চকলেট খাওয়ার মধ্যদিয়ে। সবাই পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। পথে দুইটা নার্সারীতে ঢুকে গাছ দেখলেন সবুজ ভাই। আমরা নার্সারীর মালিককে বললাম, পরে আসব, আপনার এখান থেকে গাছ কিনব। একথা বলে বাগান থেকে বের হলাম। নিকেতনের ডা. ফজলে রাব্বী পার্ক এর ভেতর দিয়ে হেঁটে আমরা হাতিরঝিল পৌঁছলাম। প্রবেশের আগে একটা চা দোকান থেকে চা খেলাম। বলতে ভুলে গেছি, এর আগে কিন্তু আমরা সবাই চিতই পিঠা খেয়েছিলাম। নাঈম খেয়েছে ভাপা পিঠা। সাইফুল ভাই খেয়েছে দুটো, আমরা সবাই একটা করে। বাশার ভাই আর সাইফুল ইসলাম পিঠা খাওয়ার পর চলে গেল। আমরা হাতিরঝিলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কখনো জোড়া জোড়া কখনো হাত ধরাধরি করে কখনোবা দলবদ্ধভাবে হাঁটতে লাগলাম। পথের পাশে ফুলের বাগান আর সদ্য রোপন করা কচি গাছ গাছালি আমাদেরকে অভিবাদন জানালো। সময় তখন মাগরিবের পর। ঝিরিঝিরি কোমল বাতাস আমাদের গায়ে এসে লাগল। আমাদের সবার মন উদাস হল। আকাশের বুকে উদিত হল রাতের চাঁদ। ঝিলের পানিতে পড়লো তার ছায়া। চাঁদের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে ঝিলের টলমল পানি খেলা করছে। দু’টি পাখি মাথার উপর দিয়ে এইমাত্র উড়ে গেল। ঝিলের মাঝে বসানো হয়েছে ফুলের টব। এটা অনন্য স্থাপত্যশিল্পের পরিচয় বহন করছে। টবগুলোকে কানা বকের মত মনে হচ্ছে। মনে হয় মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করছে।

কিছুক্ষণ পর তুহিন আমাদের সাথে এসে যোগ দিল। সে আমার আগের রুমমেট। তুহিন তার উশখো খুশকো চুল আর স্বভাবসূলভ হাসি দিয়ে আমাদের সাথে হাত মেলালো। কোলাকোলি করল। আমরা সবাই হাঁটতে হাঁটতে তিনটি ব্রিজ অতিক্রম করলাম। দেখলাম। এভাবে হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলাম। মাঝখানে সবুজ ভাইয়ের সৌসন্যে মুড়ির আর চিড়ার মোয়া খেলাম। এর মাঝে আমি দশটি কলমের শিষ কিনলাম। মাত্র ৫ টাকা দিয়ে। এ যেন শায়েস্তা খাঁর আমললের টাকায় ৮মণ চাল কেনার বাস্তব অভিজ্ঞতা। এসব অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অন্য কোথাও মিলবে না একমাত্র হাতিরঝিল ছাড়া। এযেন এক কল্পরাজ্য।

হাতিরঝিলে রয়েছে ছোট বড় আট দশটা ব্রিজ। সামনে আরো হবে। ব্রিজগুলো অসাধারণ! অনন্য স্থাপত্যের নান্দনিক এক নিদর্শন। যা এই পৃথিবীর আর কোথায়ও নেই। নেই একথা পুরোপুরি ঠিক না; তবে এমন সুন্দর ব্রিজ নেই। হবেও না। যা শুধুমাত্র আমাদের হাতিরঝিলেই চোখে পড়বে। এছাড়া আর কোথাও মিলবে না এমন কারুকার্যময় নঁকশার ব্রিজ। শুনেছিলাম তাজমহলের নঁকসাকারীর হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। যাতে সে এমন সুন্দর নঁকশা আর কোথাও করতে না পারে। হাতিরঝিলের নঁকশাকারীর হাতকাটা না হলেও তাকে যেন অন্তত কঠোরভাবে এটা বলে দেয়া হয় যে, সে যাতে দেশ-বিদেশের কোথায়ও এ রমম নঁকশার কোনো স্থাপত্য নির্মাণ না পারে। হাতিরঝিল তার নান্দনিক কারুকার্যময় স্থাপত্যশৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এই ঢাকার বুকে।

হাতিরঝিলের তুলনা দেবার মতো যেন এমন স্থাপত্য আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না পৃথিবীব্যাপী। হাতিরঝিল অপ্রতিদ্বন্দ্বি। যে রকম বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। বিদ্রোহী কবি-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রূপসী বাংলা কবি জীবনানন্দদাশ। সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ। হিজল বনের কবি গোলাম মোহাম্মদ। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। বাংলা উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ। ইসলামের কবি গোলাম মোস্তফা। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সরল গদ্যের জনক হুমায়ূন আহমদ। ইসলামী সংস্কৃতির কবি মতিউর রহমান মল্লিক। এদের কোনো তুলনা নেই। এরা বাংলা সাহিত্যের এক একজন তারকা। তারা নিজ নিজ মহিমায় অতুলনীয়। স্ব-মহিমায় ভাস্বর। সে রকম হাতিরঝিলও অতুলনীয়।

আমরা হাতিরঝিলে এতটাই হেঁটেছি যে হাটতে হাটতে আমাদের পা ব্যাথা হয়ে গেল। তখন সময় রাত নয়টা। আর নয় এখন যাওয়ার পালা। এরপর আমরা হাতিরঝিলের মায়াবী রূপ দর্শন শেষে বাসার দিকে রওয়ানা করলাম। বাসায় আসলাম। হাতিরঝিলের মাটিতে লেগে রইল আমাদের পদরেখা। আমাদের স্মৃতির খাতায় জমা হল একটি সোনালী মুহূর্ত। হাতিরঝিল, তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যমণি। ভালবাসার আকর। মায়ার প্রতিমা। আসলেই তুমি অনেক সুন্দর। আননি একবার আসতে পারেন হাতিঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

বিষয়: বিবিধ

১৪০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File