বসন্ত আসিল কোকিল ডাকিল

লিখেছেন লিখেছেন সুহৃদ আকবর ২২ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪৮:২৯ রাত

‘আহা আজি ও বসন্তে এত ফুল ফোটে

এত বাঁশি বাজে

এত পাখি গায়।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কবি গুরুর গানের সূত্র ধরেই যেন বাংলার বুকে বসন্তের আগমন ঘটে। সে আসে গাছের কচি পাতা জুড়ে। আসে বাগানের ফুলে। গাছের ডালে। কোকিলের গানে। নদীর ¯্রােতে। দখিনা সমীরণে। ছোট্ট মেয়ের পায়ের নূপুরে। আসে পলাশ, অশোক, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের ডালে। ফুলে ফুলে লাল হয়ে যায় প্রকৃতি। গাছগুলো নব যৌবন লাভ করে। ফুলের গন্ধে আমোদিত হয় চারদিক। তখন মনে হয় গাছের ডালে কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এ সময় ঢাকার রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেনে সবচেয়ে বেশি ফুল তখন চোখে পড়ে। জাতীয় জাদুঘরের সামনে লম্বা একটা শিমুল আছে। বসন্ত আসলে সে গাছকে কচি পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বসন্তের শুরুতে দু’চারটা ফুল ফুটতে শুরু করে শিমুলের সেই গাছে। কিছুদিন পর এ গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে, ঢেকে যাবে পাতা। ধীরে ধীরে ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে গাছের শরীর। তখন এ ফুলের সৌন্দর্য আমাদের মনকে মোহিত করে; ছুঁয়ে দেয় হৃদয়-মন। গাছের তলে পড়ে থাকা দু’চারটি ফুল কুড়িয়ে আমাদের প্রিয় জনের হাতে আমরা দেই। তখন আমাদের বন্ধুটি কিংবা প্রিয়তমাটি খুশি হয়। প্রিয়তমার হাসিতে যেন ঝরে পড়ে মুক্তোর মালা। বন্ধুর সাথে বন্ধুর ভালবাসা দৃঢ় হয়। মধুর হয় সম্পর্ক। অটুট হয় বিশ্বাসের বন্ধন।

রমনার লেকের ধারে কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে কোপোত-কপোতীর মিলনমেলা। তারা তখন কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসে। তাদের কথা যেন আর ফুরোতেই চায় না। আহমদ ছফার ভাষায় ‘তাজা, উষ্ণ, রূপরাঙা, রসরাঙা কথা আমার মনের বৃন্তে বৃন্তে বসন্তের পল্লবের মতো মুকুলিত হয়।’ এভাবে আবহমান বাংলার প্রতিটি ঘরের পাশ বাড়ির আঙিনা, উদ্যান, পথ-ঘাট, বন-বাদাড় ভরে যায় বসন্তের ফুলে। ফুলের গন্ধে চারিদিক আমোদিত হয়। ছেয়ে যায় ফুলের সৌন্দর্য।

বসন্তে শুধু যে ফুল ফোটে তা কিন্তু নয়। বসন্তে পাখিও ডাকে। বন থেকে ভেসে আসে পাখির গান। কিচিরমিচির ডাক। গাছের এক ডাল থেকে অপর ডালে লাফিয়ে বেড়ায় টুনটুনি, দোয়েল, কোয়েল, মাছরাঙা, ময়না। নজরুলের ভাষায়:

‘দেখ বসন্তের পাখি

কোয়েলা গেছে ডাকি।’

তখন মাঝে মাঝে আমরা শুনতে পাই কোকিলের কুঁউ কুঁউ ডাক। বড় মায়াবী কন্ঠ কোকিলের! পাগলকরা সে সুর। প্রাণ আকুল করা সে গান। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে কোকিল যখন গেয়ে উঠে; তখন হেসে উঠে, নেচে উঠে আমাদের মন। তখন আমাদের ভেতর এক ভিন্ন অনুভূতি খেলে যায়। উদাস দুপুর কিংবা নিঃসঙ্গ বিকালে কোকিলের কন্ঠ আমাদেরকে আমোদিত করে। তার ইন্দ্রজালিক সুরে আমরা হারিয়ে যাই কল্পলোকে, বিচরণ করি স্বপ্নের ভূবণে। কোকিলের দরদভরা কন্ঠ আমাকে আমার পুরাতন বান্ধবীর কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। আমার মতো আরও অনেকের মনের বদ্ধ দরজায় হয়তো সে কড়া নাড়ে। কোকিলের কন্ঠে তখন ঝরে পড়ে প্রিয়তমার হাসির সৌন্দর্য। মধুর মধুর কথা।

মনে পড়ে সেই ফাল্গুন চৈত্র মাসের উদাসকরা দুপুরে আমার পাতা কুড়ানি বন্ধবীর কথা, যাকে একদিন আমি আমার মন-প্রাণ সঁপে ভালবাসতাম। যাকে নিয়ে আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম। আমার বাসন্তী কালের সেই বান্ধবীকে কাল বৈশাখী ঝড় অকস্মাৎ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি এখনো আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীটির অপেক্ষায় থাকি। তাকে নিয়ে রচনা করি ভালবাসার অমর মহাকাব্য। আবার চেয়ে থাকি কাল বৈশাখীর তান্ডবের দিকে। চেয়ে থাকি কখন বসন্ত আসে সেই দিকে। কোকিলের ডাক শোনার প্রহর গুনি। বসন্ত যদি আমাকে আমার হারিয়ে যাওয়া পরান সখার খোঁজ দিতে পারে এ আশায়। তার হাসি মুখে মাথা দুলিয়ে বলা সরল কথাগুলোর কথা স্বরণ হলে এখনো আমার কলিজা বিধে যায়। বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়। এখনো আমার কানে বীণ হয়ে বাজে তার কথাগুলো। তার মায়াবী মুখ! বেতফলের মত চোখ! সরলতা-চপলতা-চঞ্চলতা কিছুই ভুলে থাকার নয়। ভুলে থাকা যায় না। তার হাটা-চলা, কথা বলা, চাহনি, রাগ, অভিমান সবই এখন আমার কাছে সোনালী স্মৃতির টুকরো। এক একটা হিরক খন্ড তুল্য। আমার হৃদয়ের ক্বাবায় অমর থাকবে আমার সেই প্রিয়তমার মুখটি। তার স্মৃতিগুলো। বসন্তের কোকিল আমাকে সেই সুখের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বসন্ত আমাকে কষ্ট দেয়। আমাকে ভাসায়। আমাকে ভাবায়। আমাকে কাঁদায়। পগল করে। উদাসী বানায়। আমাদের প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে জন্যই হয়তো বলেছেন।

‘কোকিল ডাকে বকুল-ডালে, যে মালঞ্চে-সাঝ-সকালে রে,

আমার বন্ধু কাঁদে সেখায় গাঙেরি কিনারে॥

গিয়া তারে দিয়া আইস আমার শাপলা-মালা

আমার তরে লইয়া আইস তাহার বুকের জ্বালা।’

বিষয়: বিবিধ

১৩২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File