পিয়াসের মোবাইল চুরি

লিখেছেন লিখেছেন সুহৃদ আকবর ১০ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:২৯:৪০ দুপুর



দেখতে না দেখতে পিয়াসের মোবাইলটি চুরি হয়ে গেল। এইতো কিছুদিন আগেও পিয়াস মোবাইলটি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকত। সে-ই সুদূর মনপুরা দ্বীপ থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে পিয়াস। মেঘনার বিধৌত পলিমাটি অঞ্চলে সে বড় হয়েছে। তার চোখে মুখে রাজ্যের স্বপ্ন। পিয়াসের বাবা মনপুরা ইউপি চেয়ারম্যান। মা প্রাইমারি স্কুলের শিকিা। চোর কি আর এতকিছু বোঝে। সে বোঝে চুরি, সে বোঝে টাকা, সে বোঝে পেট, সে বোঝে ুধা। চোর নাকি মায়ের কানের সোনা চুরি করতেও কসুর করে না। অভাবের চোরদের চুরি না করলে পেট চলে না। স্বভাবের চোরদের চুরি না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। কথায় আছে চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ধরা পড়লেতো লাথি গুঁতো চড় থাপ্পড় আছেই। সামান্য জোঁক দেখলে যে ব্যক্তি ভয় পায় সেও ধরা খাওয়া চোর দেখলে এগিয়ে যায় চড় থাপ্পড় মারার জন্য। যেদিন পিয়াসের মোবাইলটি চুরি হল সেদিন ছিল মঙ্গলবার। পিয়াস আমার রুমমেট। তার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চেহারায় মায়ার একটা ছাপ রয়েছে। রাতদিন একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে থাকে। গ্রাম থেকে এলেও শহুরে একটা ছাপ তার মধ্যে দেখা যায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় তার শরীরটাকে ধনুকের মত লাগে। কিছুটা মাছ শিকারের আশায় ঝিম ধরে বসে থাকা ধলা বকের মতই। এতে মুরুব্বীয়ানা একটা ভাবসাব ফুটে উঠে তার মধ্যে। আগে কথাবার্তা তেমন বলত না। ইদানিং একটু আধটু কথাবার্তা বলে। হেডফোন দিয়ে ল্যাপটপে নাটক মুভি দেখার সময় ও আমার পাশে চুপটি মেরে বসে। মুভি দেখে আর মিটিমিটি হাসে। ঘটনাটি দেখে মেহেদী মজা করে বলে, “পিয়াস হল আপনার নির্বাক মুভির নীরব দর্শক”।

গত তিনমাস হল পিয়াস ঢাকায় এসেছে। এসে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো। ঢাকায় এসে আমাদের বাসায় উঠেছে। পিয়াসের আংকেল তুহিন বাসাটি ঠিক করে দিয়েছিল। সপ্তাহে তিনদিন পিয়াসের কোচিং। যেদিন কোচিং থাকে সেদিন তাকে শাহজাদপুর থেকে ফার্মগেট যাওয়া আসা করতে হত। জ্যামে আটকা পড়লে মিনিমান দুই কি আড়াই ঘন্টা সময় লাগে ফার্মগেট যেতে। কোচিং থেকে ফিরে পিয়াস লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে থাকে। তার মনে পড়ে মায়ের কথা। এমন বিকালে মা গরম ভাত বেড়ে বসে থাকতেন তার জন্য। তখন এর কদর বুঝত না সে। তবে ঢাকায় এসে হাড়ে হাড়ে টের পেল মায়ের আদর। মায়ের হাতের ভাত খাওয়ার কথা মনে পড়তেই পিয়াসের বুকটা ধক করে উঠল। সে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। পানিতে চিকচিক করল তার চোখ। পিয়াসের এক স্যার বলেছেন, “এই পৃথিবীতে যদি আপন কেউ থেকে থাকে তাহলো তোমার মা এবং বাবা”। এবাবে পিয়াসের দিনগুলো কাটতে লাগল। পিয়াস সে স্বপ্ন নিয়ে সে ঢাকায় এসেছে সে স্বপ্নগুলো পাখা মেলে উড়তে পারে না। পিয়াসের মনে পড়ে গ্রামের কথা। পুকুর পাড়ের শিমুল গাছটির কথা। পাড়ার বন্ধুদের কথা। সর্ষেবাটা ইলিশ খাওয়ার কথা। বিকাল হলে গ্রামের বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরির কথা। তখন গোধূলির রক্তিম সূর্যের মতই তার বুকের ভেতরও রক্তরণ শুরু হতে থাকে।

আবির রাঙা আলোয় শহরের গাছগুলো চিকচিক করছে। পাখিরা দলবেঁধে আকাশে উড়ঠে। শরতের মেঘেরা এদিক ওদিক ছোটছুটি করছে। কোচিং শেষ হয় বিকাল চারটায়। কোচিং বিল্ডিংয়ের সামনে এসে একবার আকাশের দিকে তাকালো পিয়াস। শরতের আকাশটা আজ বেশ সেজেগুজে আছে। আকাশ দেখে সে চুপিচুটি হাসল। গাড়িতে উঠতে উঠতে পাঁচটা বেজে গেল। এখানে সেখানে শুধু মানুষ আর মানুষ। পিচডালা কালো রাস্তায় পেকামাকড়ের মত মানুষ গিজগিজ করছে। গাড়ির ভেতর মানুষ। শপিংমলে মানুষ। পার্কের ভেতর মানুষ। গত শুক্রবারে একটু নিরিবিলিতে ঘোরাঘুরির জন্য হাতিরঝিলে গিয়েছিল পিয়াসÑ সেখানেও দেখল মানুষ। হাজার হাজার মানুষ। নানান রঙের মানুষ। দলে দলে মানুষ আসছে। হাতধরাধরি করে তারা হাঁটছে। পিয়াস প্রথমবার যখন ঢাকায় এসেছিল তখনতো তার চু চড়কগাছ। বড় বড় বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত অনেণ। রাস্তার পাশের ভিুকরাও পিয়াসের দৃষ্টি এড়াত না। মানুষগুলোর অনেকেরই হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই। তাদেরকে দেখে পিয়াস মনে মনে ভাবে আহ্, লোকগুলোর কতইনা কষ্ট। মানুষের দুঃখে কেঁপে উঠে পিয়াসের বুক। অসহায় মানুষের চোখের পানি সে সহ্য করতে পারে না। এভাবে ছোটবেলা থেকে সাধারণ মানুষের প্রতি একটা টান আর দায়িত্ববোধের বীজ অংকুরিত হয় পিয়াসের মধ্যে।

আজ কেচিং শেষ হল পাঁচটায়। স্যার এটা সেটা বলে সময় বেশি নিয়ে নিয়েছেন। খামারবাড়ির মোড়ে এসে বিআরটিসি বাসে উঠল সে। আজ পিয়াসের মনটা একটু বেশি খারাপ। মন খারাপ থাকলে সে কারো সাথে বলে না। নিজের সাথে নিজেই কথা বলে। কোচিং শেষে পিছন থেকে এক বন্ধু ডেকেছিল সে ফিরে তাকায়নি। নিজের দুঃখে নিজের কাছে রাখা তার স্বভাব। তাছাড়া দুপুরের ভাত এখনো তার পেটে পড়েনি। ুধায় পেট ছোঁছোঁ করছে। পিয়াস অনেক কষ্টে গাড়িতে উঠল। বাসে পচন্ড রকম ভিড়। বসার মতো কোনো সিট পেল না। একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জায়গা করে নিতেও তার কষ্ট হল। এই ভিড়ই কাল হল তার। গাড়িতে দরজার পাশ ঘেষে দাঁড়ালো পিয়াস। তাকে টার্গেট করল এক লোক। লোকটির পরনে জিনস। হাতে বেসলেট। চোখে কালো রঙের সানগ্লাস। পরিপাটি পোসাকে বডি স্পে মেখেছে। দেখতে ভদ্রলোকের মতো দেখালেও আসলে আস্ত এক শয়তান। অধিকাংশ খারাপ মানুষই ভালো মানুষের পোসাক পরে থাকে। একটু যুযোগ পেলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। মানবতা মনুষ্যত্ব সব খসে পড়ে। গাড়ি একটু চলে তো একটু থামে। এই সুযোগে পিয়াসের পকেটে হাত দিল লোকটি। প্রথমবার হাত দেওয়ার সময় পিয়াসের হাতের সাথে হাত লাগে। এতে লোকটিই পিয়াসকে সরি বলল। পিয়াস কিছু মনে করল না। মনে মনে ভাবল -“এত মানুষের ভিড়ে হয়তো এমতিতেই লোকটির হাত তার সাথে লেগেছিল”। সে ভাবাটা যে পিয়াসের ভুল ছিল কিছুণ পরই সে তা টের পেল। ঢাকা শহর অনেক কঠিন শহর। এখানে রাস্তায় হাঁটতে বের হলেও চারটি চোখ নিয়ে বের হতে হয়। সামনে পিছনে ডানে বামে। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। আবার লোকটি পিয়াসের পকেটে হাত ছিল। আবার পিয়াসকে সরি বলল। পিয়াস হেসে হেসে বলল, -“ও কিছু না ভিড়ের মধ্যে হাততো লাগবেই”। লোকটি মনে মনে বলল, “বন্ধু তুমি দেখি বেশ ভালো। জীবনে এত চুরি করলাম আর ধরা খেলাম তোমার মত এমন লোকতো আর দেখি নাই”। একটু পরেই মহাখালীতে এসে থামল বাসটি। পিয়াসের সামনে দিয়ে অনেক লোক নামল। পিয়াসকে ডিঙিয়েই লোকগুলো একেএকে বের হতে লাগল। সেই লোকটিও পিয়াসের সামনে দিয়ে বের হল। বের হবার সময় পিয়াসের দিকে চোখ পড়তেই লোকটি হেসে দিল। পিয়াস তখন সে হাসির অর্থ বুঝতে পারেনি। তবে বুঝতে বেশি সময়ও লাগেনি। পিয়াসের চোখের সামনে দিয়ে নিমিশেই লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটি। পিয়াস পকেটে হাত দিয়ে দেখে তার মোবাইলটি নেই। তার অনেক শখের মোবাইল। এই মোবাইলের সাথে পিয়াসের অনেক দুঃখ সুখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তার অনেক স্বাদের মোবাইলটি চুরি হয়ে গেল। এসএসসি পাশ করার পর তার বাবা মোবাইলটি কিনে দিয়েছিলেন। তখন দাম পড়েছিল উনিশ হাজার। এ মোবইল দিয়ে ছবি তোলা যায়। গান শোনা যায়। ফেসবুক ব্যবহার কথা যায়। ইউটিউভে ভিডি দেখা যায়। তবে পিয়াস ইউটিউভে রেসলিং খেলা আর বাংলা নাটক দেখতে বেশি ভালোবাসত। মাঝে মধ্যে কারী সাহেবদের কুরআন তেলাওয়াত শুনত। অনেক সময় সারারাত পিয়াস মোবাইলে এটা সেটা দেখত। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ত। দেরিতে ঘুমানোর ফলে কত দিন যে তার কোচিং মিস হলো তার হিসাব নেই।

একদিন বাসায় এসে পিয়াস বলল -“আজ একটা ঘটনা ঘটে গেছে”। আমি বললাম- “কি ঘটনা?” সে বলল, “আমার মোবাইলটি চুরি হয়ে গেছে”। আমি সাথে সাথে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়লাম। কারণ, কোনো বিপদের খবর শুনলে ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়তে হয়। এটা আমাদের ইসলাম ধর্মের শিা। আমি তার মনের অবস্থা বুঝে তাকে শান্তনা দিলাম। বললাম, -“যাক সমস্যা নেই চোর সব সময় চুরিই করবে। দেখবা তুমি আরো দামি মোবাইল কিনে ফেলেছ”। আমার কথা শুনে পিয়াসের মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটল। এ কথায় পিয়াস কতটুকু শান্তনা খুঁজে পেয়েছে জানিনা। তবে শোক কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে বলা যায়।

রাতে পিয়াসের আংকেল তুহিন মোবাইল চুরি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করল। কোনো কিছু নিয়ে একটু গবেষণা করা তার স্বভাব। কিভাবে চুরি হল। কোন গাড়িতে উঠেছে। মোবাইল হাতে ছিল নাকি পকেটে ছিল। পিয়াসের গ্রামের একটা লোক ঢাকায় থাকে। চোর বাটপারদের সাথে নাকি তার যোগাযোগ রয়েছে। সে নাকি চোরা মোবাইল চুরির খবর বলতে পারে। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রথমে জিডি করতে হবে তাহলে সে মোবাইল বের করে দিতে পারবে। জিডির কথা শুনে পিয়াস আর অগ্রসর হল না। তাছাড়া জিডি করার নিয়ম সে এখনো পুরোপুরি জানে না।

মোবাইল চুরির পর থেকে পিয়াস কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথে ভালো করে কথা বলে না। সে শুধু শুয়ে থাকে। শুয়ে কপালের উপর ডান হাত দিয়ে রাখে। যেন সবকিছু এই কপালের দোষ। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। উপরে তাকালে তো ছাদ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। পিয়াসের উচিত খোলা ছাদের উপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। বাড়িতে থাকলেতো তা সম্ভব হতো। এই ঢাকা শহরে তা কি সম্ভব। পিয়াসের মত অনেকেরইতো বিপদ হয় কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না।

আগে পিয়াস সারাণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সেজন্য কারো সাথে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারত না। এখন রুমমেটদের সাথে মাঝে মধ্যে কথা বলে। চা খেতে বের হয়। এটাসেটা প্রশ্ন করে। অনেক কিছু শেয়ার করে। গ্রামের বন্ধুদের কথা বলে। গল্প করতে গিয়ে অনেক বিষয় তার জানা হয়ে যায়। সে মনেমনে ভাবে, -“আসলে মোবাইল আর ইন্টারনেটের বাইরে ও একটা জগৎ আছে তা আমরা খুব কম মানুষই জানি। ইন্টারনেট পৃথিবীটাকে অনেক সহজ করেছে সত্যি তবে আমাদের কাছ থেকে দয়ামায়া সহযোগিতার মনোভাব কেড়ে নিয়েছে। এমনকি আমরা পাশের মানুষটির সাথে হাসিমুখে কথা বলার পর্যন্ত সময় পাই না। আমাদের চারপাশে অধ্যয়নের অনেক বিষয় বয়েছে। আসলে গোটা পৃথিবীটাই হল একটা পাঠশালা। অধ্যয়নের বিষয়বস্তু অনেক। এই যে, লেকের ধারে মানুষের বসবাস। গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির। জোছনা রাতের চাঁদের আলো। বাতাসে দোল খাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত ধানতে। আকাশের বুকে মেঘের ওড়াওড়ি। নদীর অবিরত ছুটেচলা”। এসব ভাবতে ভাবতেই পিয়াসের মনটা ভালো হয়ে গেল। সাথে সাথে পিয়াসের আম্মারর ফোন বেজে উঠল, “হ্যালো পিয়াস, তোর জন্য তোর বাবা একটা মোবাইল কিনেছে। বলেছে ইউনিভার্সিটিতে চান্স ফেলে মোবাইলটি দিবে। এখন আমার কাছে আছে”। এপাশ থেকে পিয়াস তার আম্মাকে বলল, “মা, আমি আপাতত মোবাইল ব্যবহার করছি না। এখন সময় শুধু পড়ালেখার”।

যোগাযোগ- ০১৮২০১৪৭৬৫৪



বিষয়: সাহিত্য

১৩১৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

345258
১০ অক্টোবর ২০১৫ দুপুর ০৩:৪৯
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : খুব ভালো কাজ করেছে
০৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:২২
289245
সুহৃদ আকবর লিখেছেন : কেন ভালো কাজ করেছে? জবাব চাই ভাই

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File