রুমি সাহেবের ভৃত্য
লিখেছেন লিখেছেন নির্বোধ১২৩ ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১১:০৩:৫৪ সকাল
মৌলভী জালাল উদ্দিন রুমির নাম অনেকেই জানি। তিনি একজন সুপন্ডিত, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ লোক ছিলেন। তাঁর এক বিশ্বস্থ ও পুরাতন ভৃত্য ছিলো। সে ছিলো খুবই নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণ। মনিবের প্রতি ছিলো তার প্রগাঢ় ভক্তি; অথচ দুর্বল স্মৃতি শক্তির অধিকারী কিন্তু অতিশয় সরল সোজা ও মোটা বুদ্ধির মানুষ। সুতরাং তার আচার-আচরণ ও কথা বার্তায় তেমন মাধুর্য ছিলো না। প্রায়ই তার কর্মকান্ডে রুমি সাহেব রুষ্ঠ হতেন আবার তাকে বিশেষ স্নেহও করতেন। তাছাড়া বহুদিনের পুরোনো ও বিশ্বস্থ মানুষ, এই বৃদ্ধ বয়েসে যাবেই বা কোথায়। তাই তাকে বহুবার ছাড়াতে চেয়েও তার অনেক নির্বুদ্ধিতা আর বেয়াড়া কর্মকান্ড সত্ত্বেও তাকে ছাড়াতে পারতেন না।
ভৃত্যটি কখনোই নিজের বুদ্ধিতে কিংবা কাজের গুরুত্ব বুঝে কোন কাজ করতে পারতো না। অনেক সময় যে কাজটি করার কথা তা করতে ভুলে যেতো অথবা উল্টা-পাল্টা ভুল কাজটিই সে করে রাখতো। এতে মনিবের অনেক ক্ষতি হতো। তাই মনিব তাকে প্রায়ই তিরস্কার করতেন। তখন সে বরং নিজের দোষ খন্ডাতে আরো উল্টা-পাল্টা কথা বলতো, তাতে মনিব আরো ক্ষুব্ধ হতেন। অথচ সে যখন বুঝতে পারতো তার বোকামীর জন্য বা খেয়ালের অভাবে তার দ্বারা মনিবের ক্ষতি হচ্ছে তখন সে অনুশোচনায় দগ্ধ হতো।
তাই অনেক ভেবে চিন্তে একদিন সে মনিবকে বললো; ”জনাব, আমি বুঝতে পারি আমার খেয়ালের অভাবে বা ভুলের দরুণ প্রায়ই আপনার ক্ষতি হয়। আপনিও আমাকে গালমন্দ করেন, বুড়ো বয়েসে এসব তো আর ভালো লাগেনা। আমি কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি করতে চাইনা। বরং যা কিছুই করি আপনার মঙ্গল ও খুশির কথা ভেবেই করি”।
মনিব জবাব দিলেন; ”আমি তা জানি। যাও, এবার থেকে আরো মনযোগের সাথে, আরো জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো, তাতেই আমি খুশি হবো”।
ভৃত্যটি আবার বললো; ”জনাব, আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে, যদি অনুমতি দেন তবে পেশ করি”।
”ঠিক আছে বলো” - বললেন রুমি সাহেব।
ভৃত্যটি তখন হাত কচলিয়ে বললো; ”প্রতিদিন আমাকে দোষারোপ না করে আমার করণীয় দৈনন্দিন কাজগুলো বরং লিস্টি করে দিন, আমি সেই লিষ্টি মিলিয়ে কাজগুলো করে রাখবো। আমি কম বুদ্ধির এক দুর্বল স্মৃতির মানুষ, লিষ্টির বাইরে কোন কাজের জন্য আর আমাকে যেন দায়ী করবেন না জনাব। আপনি যেসব কাজের লিষ্টি করে দিবেন আমি লিষ্টি মিলিয়ে সেই কাজ গুলো করে রাখবো”।
মনিব বললেন - "ঠিক আছে, তাই হবে। এখন থেকে তোমাকে কাজের লিস্ট ও রুটিন করে দেবো, তুমি সে মতোই কাজ করবে”।
এরপর থেকে ভৃত্যটি কাজের লিস্ট ও রুটিন মিলিয়ে খুব যত্নের সাথেই কাজগুলো করে রাখে, তাতে বিপত্তির পরিমান ও বেশ কমে আসে। রুমি সাহেব খুশিই হলেন - ”যাক, বেটার মাথায় তাও একটু বুদ্ধি আছে। খুঁজে পেতে ভাল উপায়ই একটা বের করেছে, এভাবে চললেও গাধাটাকে কোন রকম মানিয়ে চলা যাবে”। এভাবেই ভালোয়-মন্দে দিন কেটে যাচ্ছে।
একবার রুমি সাহেব তাঁর এক বিশিষ্ট আত্নীয়-বাড়ি বেড়াতে যাবেন। আত্নীয়-বাড়ির জন্যে তিনি নানান রকম ফলমূল ও উপঢৌকন ঝুড়িতে সাজিয়ে ভৃত্যকে দিলেন। রুমি সাহেব গাধার পিঠে রওয়ানা হলেন। পিছনে ভৃত্যটি ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পায়ে হেঁটে মনিবকে অনুসরণ করছে।
পাথুরে পাহাড়, তার কোল ঘেষে পথ। একপাশে খাঁড়া পাহাড় অন্য পাশে ফসলের খেত। প্রচন্ড রোদ আর গ্রীস্মের তাপদাহে মাঠ-ঘাট যেন তাতিয়ে আছে। একটু বাতাস নেই, মাথার উপর গ্রীষ্মকালীন সূর্য যেন আগুন ঢালছে। রাস্তায় কোন ছায়া বা বড় গাছ ও দেখতে পাচ্ছেন না যে তার নীচে বসে একটু শান্ত হবেন। তাই রুমি সাহেব কাঁধের আলোয়ান দিয়ে মাঝে মাঝে একটু বাতাস করে স্বঃস্থি খুঁজছেন। এত রোদে পথ চলতে গিয়ে গাধাটিকেও বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
চলতে চলতে আরো কিছুদূর যাবার পর পথের অনতিদূরে একটা জলাশয় ও ছায়াময় একটা বড় গাছ দেখতে পেলেন। রুমি সাহেব সেই গাছের ছায়ায় গিয়ে থামলেন - উদ্দেশ্য গাছের ছায়ায় নিজেরা শরীর জুড়াবেন, গাধাটাকেও জলপান করাবেন আর বিশ্রাম দিবেন।
গাছের ছায়ায় পৌঁছে রুমি সাহেবের আলোয়ানের খোঁজ হলো; কাঁধে আলোয়ানটি নেই। কখন যে ওটা রাস্তায় পড়ে গেছে তাঁর খেয়াল নেই। রুমি সাহেবের মন বিগড়ে গেলো, একে তো আলোয়ান হারিয়েছেন তার উপর আত্নীয়-বাড়ি যাচ্ছেন, কাঁধে আভিজাত্যের প্রতীক আলোয়ানটা নেই, এটা তাঁর জন্য ভীষণ বিব্রতকর বিষয়ই বটে।
তিনি ভৃত্যকে বললেন - "বেটা, রাস্তায় যে আমার আলোয়ানটা পড়ে গেছে তা কি দেখতে পাও নি”?
”হ্যাঁ দেখেছি তো, সেটা আরো তিন ক্রোশ আগেই পড়েছে” - ভৃত্যটি চট্পট জবাব দিলো।
আলোয়ানটি এত দূরে পড়েছে শুনে তিনি হতাশ হলেন, এখন আর ওটার খোঁজ করতে যাওয়া বৃথা তাই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ভৃত্যকে ধমক দিলেন - ”তা’হলে আমাকে বলো নি কেন ? আর পড়তেই যখন দেখলে তা উঠাও নি কেন, সেটাও কি তোমাকে বলে দিতে হবে”?
গ্রীষ্মের তাপদাহ, তার উপর বুড়ো মানুষ মাথায় ঝুড়ির বোঝা নিয়ে এতটা পথ পায়ে হেঁটে বেজায় ক্লান্ত। সে চট্পট লিস্টি বের করে দেখলো এমন কোন নির্দেশ তাতে লেখা নেই। তাই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে জবাব দিলো - "রাস্তায় কিছু পড়লে যে ওটা উঠানোও আমার দায়িত্ব তা তো আপনার করা লিস্টিতে নেই হুজুর। আমি ওটা না উঠিয়ে এমন কি দোষ করলাম? এমন কিছু পড়লে যদি আমাকেই উঠাতেই হয় তাহলে এই নিন, লিস্টি সংশোধন করে দিন। এখন থেকে কিছু পড়লে না হয় উঠাবো” - বলেই লিস্টটা সে মনিবের দিকে এগিয়ে দিলো।
রুমি সাহেব দেখলেন - এ তো ভারি ফ্যাসাদ, এই মোটা বুদ্ধির গাধাটার চেয়ে ওই ভারবাহী গাধাটাও যে অনেক ভালো। ওর যেমন বুদ্ধি নেই তেমনি প্রতিবাদও নেই। এই যে তাতানো রোদে আমাকে পিঠে করে বয়ে আনলো, ভীষণ ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্থ সত্ত্বেও তো সওয়ার বয়ে আনতে কোন কসুর করেনি। এই যে জলাশয়ে নেমে কত পানি পান করলো এখনো পর্যন্ত হাঁফাচ্ছে। আর এই বেটা কিনা আমার আলোয়ান পড়ে যেতে দেখেও না উঠিয়ে এখন তর্ক করছে যে, ওটা ওর লিস্টে নেই। বেটা বোকা, নাকি সেয়ানা? এবার বাড়ি ফিরে সবার আগে এই গাধাটাকেই ছাঁটাই করবো।
ভৃত্যের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে প্রায়ই তিনি এমন প্রতিজ্ঞা করেন বটে, কিন্তু তার প্রতি কী যে এক অজানা মমত্ত্ববোধে, তিনি আর তা করতে পারেন না।
ভৃত্যের হাত থেকে কাগজটি নিয়ে তিনি লিখলেন - "যাত্রাপথে এখন থেকে কিছু পড়তে দেখলে তা উঠাতে হবে”। তারপর কিছুক্ষণ ছায়ায় জিরিয়ে শরীর মন শান্ত করে আবার রওয়ানা হলেন।
দিন শেষে সন্ধ্যার প্রাক্কালে তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছালেন। ভৃত্য মাথার ঝুড়িটি গৃহস্বামীর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে ঘন ঘন ঘাড় মর্দন করছে। গৃহস্বামী খুব শরীফ মানুষ, ব্যস্ত হয়ে বললেন - "এ কি করেছেন জনাব? বলুন দেখি, কষ্ট করে এতসব কি এনেছেন? এত দূরের পথ এমন ভারি বোঝা বয়ে আনতে এই বেচারার কতই না কষ্ট হয়েছে, শুধু শুধু তাকে কষ্ট দেয়া হলো”।
রুমি সাহেব বিনীত জবাব দিলেন - "আমার নিজের বাগানের সেরা ফলমূল, ভাবলাম যাচ্ছি যখন কিছু নিয়ে যাই আপনাদের জন্য”।
ভৃত্তটি তখন জাবাব দিলো - "কষ্ট তো হয়েছেই জনাব, বাড়ি থেকে যা নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম শুধু তা থাকলে তো এত কষ্ট হতো না, পথে যে হুজুর আবার নতুন ফরমান জারি করলেন তাইতেই না বোঝা আরো ভারী হয়েছে আমারও কষ্ট বেড়েছে”।
রুমি সাহেব অবাক হয়ে ভৃত্যকে জিজ্ঞেস করলেন - ”রাস্তায় আবার তোমাকে কি করতে বললাম, আর কিসেই বা বোঝা এত ভারি হলো”?
ক্লান্ত বিরক্ত ভৃত্যটি তেমনি ঘাড় ডলতে ডলতে জবাব দিলো - "গরীব যা ই করে তার জন্যেই কৈফিয়ৎ, মনিব কিছু করলে কোন দোষ নেই। কেন হুজুর এই যে লিষ্টি দেখুন না, আপনিই তো লিখে দিয়েছেন রাস্তায় কোনকিছু পড়তে দেখলে তা যেন উঠিয়ে নিই”!
তখন আর কারো বুঝতে বাকি রইলো না যে, বোকা ভৃত্য - রাস্তা জুড়ে গাধা যত মলত্যাগ করেছে তার সবই ঝুড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে তাই বোঝা এত ভারি হয়েছে। ঝুড়ি ভর্ত্তি ফলমূল আর উপঢৌকন এখন গাধার গোবরের নীচে তলিয়ে আছে।
বিষয়: সাহিত্য
১০২৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নির্বুদ্ধিতা কতটা ক্ষতিকর তা বুঝা যায় গল্পে!
শিক্ষণীয় উপস্হাপনার জন্যে ধন্যবাদ অজস্র!
(একই মন্তব্য দুই জায়গায় করলাম,)
ভাল থাকুন নিরন্তর।
ভাল থাকুন, শুভেচ্ছা নিন।
আপনার গরুর গাড়িটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ!
কত দিয়ে কিনলেন? কোন হাটে মিলে?
মজার গাড়িটা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।
মনে কিছু নিবেন না বন্ধু।
শুভেচ্ছা জানবেন।
শুভেচ্ছা জানবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন