জিএসপি সুবিধা স্থগিতঃ আপাতত হতাশার কারণ নেই

লিখেছেন লিখেছেন নির্বোধ১২৩ ০২ জুলাই, ২০১৩, ০৬:০৮:৩৩ সকাল

জিএসপি’র কথকতাঃ

উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অগ্রাধিকার মূলক বাণিজ্য-সুবিধা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ’৭৪-এর বাণিজ্য আইন অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স’ (জিএসপি)সুবিধা চালু করে। সে সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে কিছু অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্য যেমন; কাঁচা চামড়া, ফার্নিচার, সিরামিক্স, সার, কার্পেট, গলফ খেলার সামগ্রী, চশমা হিমায়িত খাদ্য এবং বিশেষভাবে বোনা শক্ত ফেব্রিক (ত্রিপল/তাবু) ইত্যাদি রফতানীর সুযোগ পায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরণের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় রপ্তানি করতে পারে। তার মধ্যে পোশাক খাতের কোন পণ্য নেই।

বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ও পদক্ষেপঃ

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যতম সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন”(এএফএল-সিআইও) ২০০৭ সালেই বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদন করে। বিষয়টি প্রায় ৬ বছরের মত সময় ঝুলে থাকার পর ইদানিং তা সিনেট কমিটিতে শুনানির মধ্যেই গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১২৭ জন পোষাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের জিএসপি-ভাগ্য নতুন করে সংশয়ের মুখে পড়ে। বাংলাদেশের পোষাক খাতে কর্ম পরিবেশ অবনতির কারণ দেখিয়ে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র্র এ সুবিধা স্থগিত করেছে। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নতি হলে এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হবে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ কাজের পরিবেশ উন্নতি হলে এ সুবিধা আবারো চালু হবে।

এ প্রসঙ্গে; ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করা হয়নি, স্থগিত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের তিনি জানান, বাংলাদেশে আর কোন রকম বিয়োগান্তক ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের উচিত শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করা। এতে বাংলাদেশেই লাভবান হবে।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো জিএসপি সুবিধার স্থগিতাদেশ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ আশাবাদী। তারা বলছেন, এ স্থগিতাদেশ একেবারেই সাময়িক। এটি এক ধরণের চাপ প্রয়োগের রাজনৈতিক কৌশল মাত্র।

জিএসপি সুবিধা স্থগিতকরণের প্রভাবঃ

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় আপাততঃ বাংলাদেশের গার্মেন্টস ও বস্ত্র শিল্পে এর কোন প্রভাব পড়ছে না। কারণ, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরী পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের (জিএসপি)টি কখনোই পায় না। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে সুবিধাটি অর্জনের জন্য তৎপরতা চলছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার দরুণ শিল্প কারখানার মান ও কর্ম পরিবেশ উন্নত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ কোন পণ্যেই আর সে সুবিধাটি পাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে; ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৪৯০ কোটি ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ৫০ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে মাত্র ২২ কোটি ডলার মূল্যের অন্যান্য পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় রপ্তানি করা হয়।

রফতানীকৃত তৈরী পোষাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্ত বাংলাদেশের সুবিধাঃ

প্রকৃত চিত্র হচ্ছে; বাংলাদেশের রফতানিকৃত তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২ শতাংশ সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সে হার ১৫ শতাংশ (অর্থাৎ গড় শুল্কহারের চেয়ে বরং ৩ শতাংশ বেশীই)! এছাড়া বাংলাদেশে থেকে রফতানীযোগ্য ৯৭ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিলেও মাত্র ২২ মিলিয়ন ডলারের বিশেষ কোটা বাদে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের এই পণ্যকে সেই সুবিধার আওতার বাইরেই রাখা হয়েছিল।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানী ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। আর এর মাত্র এক শতাংশ (অর্থাৎ ৫ কোটি ডলার) মূল্যের পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় রপ্তানি হয়েছে মাত্র। এক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধার অঙ্কটি তেমন বড় না হলেও এই সুবিধা স্থগিতের কারণে বর্হিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির একটা প্রশ্ন জড়িত বটে।

বাংলাদেশের রফতানি বানিজ্যে পোষাক শিল্পের অবস্থান ও ভুমিকাঃ

বাংলাদেশে মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে তৈরি পোশাক রফতানি করে। বছরে গড়ে বাংলাদেশ পোশাক রফতানির মাধ্যমে আয় করে ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপিতে তৈরি পোশাকের অবদান শতকরা ১০ ভাগ। আর গবেষণায় দেখা গেছে পোশাক খাতে কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বছরে খরচ হয় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অন্যান্য দেশ জিএসপি সুবিধা বন্ধ করলে বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেঃ

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভূক্ত (ইইউ) দেশগুলো সহ কানাডায়ও বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শুল্কমুক্ত জিএসপি সুবিধাটি পেয়ে থাকে এবং ইইউ ভূক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের একটা বড় বাজারও বটে। গত বছর বাংলাদেশ দুই হাজার কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। সে পোশাক রপ্তানির বড় অংশটাই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে।

যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রভাবিত করলে সত্যিই সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। আশংকার কথা যে; বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ ও কর্মকান্ডে যুক্তরাষ্ট্র সহ ইইউ ভূক্ত দেশ সমূহ বাংলাদেশের উপর তেমন সন্তুষ্ট নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিলের ফলে বাংলাদেশের সিরামিক খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনাই বেশী কারণ, জিএসপি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমানে সিরামিক সামগ্রী যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য আইটেম যা রফতানি হয় তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কাজেই জিএসপি সুবিধা স্থগিতের কারণে আপাততঃ সিরামিক ছাড়া তৈরী পোষাক সহ অন্যান্য আইটেমে তেমন প্রভাব পড়বে না।

তবে আশার কথা যে; ইউরোপীয় ইউনিয়ন আপাতত সে সুবিধা বাতিলের কথা ভাবছে না। তারা বরং বাংলাদেশের শ্রম মান উন্নয়নে পাশে থাকার কথাই জানিয়েছেন। আজ এক বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমানে ইউরোপের বাজারে কেবল অস্ত্র ছাড়া সব ধরনের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পায় বাংলাদেশ। জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের মতো যে কোন পরিস্থিতি অবশ্যই এড়াতে হবে, কেননা তেমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে।

বিষয়: বিবিধ

৯৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File