নিয়তির পরিহাসঃ একজন সাহানার গল্প
লিখেছেন লিখেছেন নির্বোধ১২৩ ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৩৫:৩৩ সকাল
ক্ষমা করো বোন সাহানা। হা কুষ্টিয়ার সাহানা, তোমার কাছেই ক্ষমা চাইছি? কারণ তোমার মত শত শত রাজু সাহানারা ভাগ্যের ফেরে বিনা দোষে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে আমাদের নিষ্ঠুরতাকে পা দেখিয়ে চলে গেছে। কিন্তু দূর্ঘটনা পতিত হয়ে চারদিন মৃত্যুজঠরে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেও তুমি বাঁচার আশা হারাওনি। এমন কঠিন মৃত্যুকূপে থেকেও আশার স্বপ্নে চার চারটি দিন বেঁচে ছিলে! উদ্ধার কর্মীদের সাথে তোমার কথোপকথন শুনে আমরা সুখে থাকা মানুষগুলো কেঁদেছি – আহা, বেঁচে থাকার সে কী আকুতি, কী করুণ আর্তি ছিল তোমার কন্ঠ জুড়ে! বাঁচার কী স্বপ্নই না দেখেছিলে; দমকল কর্মী আবুল খায়ের তোমায় কথা দিয়েছিলেন – বোন তুমি নিশ্চিন্ত থাক, যেকোন মূল্যে তোমাকে উদ্ধার করবই। আর সেই আশায় উদ্দীপ্ত হয়ে তুমিও নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলে!
বিশ্বাস করো বোন, উদ্ধার কর্মীরা কিন্তু তাদের কথা রেখেছিল,তোমায় উদ্ধার করার প্রবল বাসনা নিয়ে তারা ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের অনুরোধে বৃহৎ পরিসরে যান্ত্রিক অপারেশনের কাজটা ঠেকিয়েও রেখেছিল প্রায় সারাটা দিন। ২০/২২ ঘন্টার অমানুষিক পরিশ্রম করে স্যান্ডুইচ হয়ে পড়ে থাকা ছয়টি ছাদের পরত কেটে কেটে সুরঙ্গ তৈরী করে উদ্ধার কর্মীরা যখন তোমার কাছে পৌঁছল; নিয়তি তোমার উদ্ধার পথে বাঁধ সাধল। মাঝে বিশাল বীম প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াল। তবু কিন্তু উদ্ধার কর্মীরা দমে গেলেন না। প্রবল মানবপ্রেম ও ভালবাসায় আবার নতুন উদ্যমে সেই বীমের বাঁধা অতিক্রম করতে উঠে পড়ে লেগে গেল। আবার কয়েক ঘন্টার পরিশ্রমের পর যখন তোমাকে মৃত্যুজঠর থেকে যখন টেনে বের করতে যাচ্ছিল নিয়তি তার ক্রুর হসি হাসল।
হা, তোমার শরীর খানিকটা আসার পরই রডের বাঁধায় আাবার আটকে গেল! উদ্ধার কর্মীরা তবু দমল না। নতুন করে আবার সে বাঁধা অতিক্রম করতে লেগে গেল। নিয়তি যখন বুঝলো এই নাছোড়বান্দা লোকগুলোকে আর ঠেকানো যাচ্ছেনা ঠিক তখনই সে তার শেষ খেলাটা খেলল। হাবিয়া দোজখ থেকে আগুনের ফুলকি এনে তোমাদের বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও নিভিয়ে দিল। তোমার মত আরো কিছু অসহায় বন্দীকে বাঁচানোর যে আশা মনে নিয়ে প্রবল বিক্রমে তারা যুদ্ধ করে যাচ্ছিল সেই আশাকে কফিন বন্দী করে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল।
সেই নরকে তুমি ছাড়া আরো ৩/৪ জন বন্দী ছিল কিন্তু একমাত্র তুমিই স্বচ্ছন্দে কথা বলে সবার প্রতিনিধিত্ব করছিলে। তোমাদের জীবন সজীব রাখার জন্য উদ্ধার কর্মীরা পরম মমতায় আপন হাতে সেলাইন বানিয়ে দিল, হালকা খাবার ও অক্সিজেন দিল, বাতাস দিল। কিন্তু তোমাদের জীবন টিকিয়ে রাখতে যে অক্সিজেন স্প্রে করা হচ্ছিল তা ই হয়ে উঠল ধ্বংসের কারণ। সেই অক্সিজেনেই হঠাত দাউ দাউ আগুন জ্বলে উঠেছিল।
চারদিক আগুন আর ধূঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে তিনজন উদ্ধার কর্মী মারাত্নক ভাবে আহত হয়। পরি-মরে করে সবাই আপন প্রাণ বাঁচাতে তোমায় ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হল। বিশ্বাস কর; তোমাদের বাঁচাতে তাদের জীবনও তোমাদের মতই সংগীন হয়ে পড়েছিল। নিষ্টুর নিয়তি তাদের প্রাণ হাতে পেয়েও ছেড়ে দিল কিন্তু তোমার আর বাঁচা হলনা। ১১১ ঘন্টায়ও যে দূর্ঘটনা তোমার প্রাণ কেড়ে নিতে পারেনি নিমেষের আগুন তা ই সস্পন্ন করে ছাড়ল। তোমাকে উদ্ধার পর্বের ২২ ঘন্টা পর রাত দশটায় কর্মীরা আহত হয়ে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়।
তারপরও নতুন উদ্যমে আবার উদ্ধার কাজে নামার চিন্তা ভাবনা চলছিল কিন্তু ভোর ৬টা পর্যন্ত সুড়ঙ্গ হতে ধূঁয়ার কুন্ডলী আর বন্ধ হলনা। সেই আগুন বোধহয় কারখানায় রাখা কাপড় আর কার্টনে ছড়িয়ে পড়েছে। দমকল কর্মীরা কেবল পানি ছিটিয়ে সে আগুন আর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সূতরাং তোমার সাথে আর যোগাযোগ না হলেও নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় – এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে পদাঘাত করে এতক্ষণে তুমি চীর শান্তির না ফেরার দেশে চলে গেছ। সুখে থেকো বোনা, আমাদের এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তোমাদের বাঁচতে দেয়নি। পৃথিবীর আলো হাওয়ায় বেঁচে থাকা সুখী মানুষদের ক্ষমা করো। পরকালে যেন তোমাদের অনন্ত সুখের ভাগ্য হয়, সেই কামনাই রইল
মৃত্যুর সুড়ঙ্গ থেকে প্রাণ হাতে করে ফিরে আসা উদ্ধার কর্মীদের বুকফাঁটা আর্তনাদ লাখো মানুষের অন্তর দলিত মথিত করে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তোমরা যেন তাদের কত আপনজন। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার মত স্বার্থপর সুখী মানুষের এক সময় মনে হল; রাজু সাহানারা তো পর নয় – তারা যে আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন। তাই আসুন - সবাই বিপন্ন মানবতার ডাকে হাতে হাত মিলাই, কাঁধে কাঁধ রেখে অন্ততঃ হাবিয়া দোজখ পাড়ি দিয়ে এখনো যারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে; সবাই মিলে তাদের জন্য কিছু করি।।
বিষয়: বিবিধ
২৬৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন