মসজিদের ঘড়ির কাঁটা
লিখেছেন লিখেছেন আবদুহু ২৪ মার্চ, ২০১৩, ০৫:২৬:২৪ বিকাল
নোটঃ 'সাইমুম সিরিজের বইগুলোতে মাঝে সাঝে এমন ঘটনার কাহিনী পড়তাম। কর্ণেল বরিসের লোকেরা সিংকিয়াং এ অথবা কু-ক্ল্যাক্স-কানের খুনী একটা দল হয়তো সার্বিয়ার কোন পাহাড়ী গ্রামে এভাবে মসজিদে হত্যাযজ্ঞ চালাতো। বাংলাদেশে কোনদিন এ গল্প সত্যি হবে ভাবিনি।'
ভোর হয়ে আসছে। পুর্বদিকের আকাশে সাদা রঙের আভাস, কয়টা পাখি ডাকছে আশেপাশে। এসময় সবচেয়ে বেশি আনন্দের বিষয় হলো বুক ভরে নিশ্বাস নেয়া। বাতাস এতো নির্মল! মসজিদ থেকে বের হয়ে আনিস রাস্তায় এসে দাড়ালো। গ্রামের মেঠো রাস্তাটা এখানে একটু বাঁক ঘুরেছে, তার ওপাশে প্রলম্বিত ধানক্ষেত। তেইশ বছর বয়সী আনিস ইটভাটায় কাজ করে। মাত্র কৈশোর পেরুনো ছেলেটা এই প্রায়ান্ধকার ভোরবেলায় মসজিদে ফজর নামাজ পড়ে হয়তো ভাবছে আজ সারাদিন কি কি কাজ করতে হবে। সকালের নাস্তাটা কি খাওয়া যায় তাও সে ভাবছিলো।
মসজিদ থেকে মুসল্লীরা একে একে বের হয়ে আসছেন। খুব বেশি না হলেও একজন দুজন করে অন্তত দশ পনেরো জন তো হবেই। হঠাৎ ওরা সবাই চমকে উঠে। আলো অন্ধকারের ভেতর থেকে মেঠো পথ ধরে ভৌতিক আকৃতির কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে। সামনে অস্ত্র বাগিয়ে ধরা, গায়ে ভারী পোশাক। আনিস সহ অন্য মুসল্লিরা ভীত হয়ে দ্রুত মসজিদে আশ্রয় নেয়। আর এদিকে মসজিদ মুসল্লী টুপি আর দাড়ি সহ কিছু মানুষ দেখে আগন্তুকদের চোখ চকচক করে উঠে। দ্রুত এগিয়ে এসে ওদের বিশাল বাহিনী মসজিদটিকে ঘিরে দাড়ায়। এক মুসল্লি তখনো মসজিদে ঢুকতে পারেনি, তাকে এক পুলিশ লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।
এরপরের ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে যায়। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর জেলায় মনিরামপুরের ঘটনা। এগারোটা গাড়ি থেকে নেমে আসা উর্দিপরিহিত পুলিশদের সাথে ছিলো দশ বারোজনের বিশেষ একটা দল। পায়ে কেডস আর গায়ে জিনস গেঞ্জি পরা ওদের মনে দাড়ি টুপির প্রতি অনেক ঘৃণা। তারা অন্যদের সরিয়ে মসজিদের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। মসজিদের চারদেয়ালের ভেতরে আটকে পড়েছে তখন গুটিকয় মুসল্লী। হয়তো বৃথা আশা করেছিলো আল্লাহর ঘরে তাদের কোন ক্ষতি হবে না।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালার বিচার এ ধরণীর মানুষের বোধ বুদ্ধির অনেক উর্ধ্বে। পরম করুণাময় নির্বিকার আরশের উপর বসে থাকেন। আর সীমান্তের ওপার থেকে আসা দেশপ্রেমিকরা তখন চাইনিজ রাইফেলে ব্রাশফায়ার করতে থাকে মাত্র ফজর নামায শেষ করা মুসল্লীদের উপর। ওরা ট্রিগার থেকে হাত সরায় না। মুহুর্মুহু গুলী বেরিয়ে যাওয়ার ঝাকুনি আর মনের ঘৃণা সব মিলে একাকার হয়ে যায়।
মসজিদের এক পাশে একটু দূরে বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে ছিলেন গৃহবধু মণি বেগম। তলপেটে গুলী খেয়ে সেও মাটিতে পড়ে যায়। মসজিদে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকে পয়ত্রিশ জন মানুষ। আনিসের মাথার খুলি ভেদ করে চলে যায় একটি গুলি। সকালের নাস্তা আর তার খাওয়া হয়ে উঠে না, প্রাণহীন দুচোখ তাকিয়ে থাকে গম্বুজের দিকে। মসজিদের মিহরাবের পাশে একটা ঘড়ি আছে, তার নিচে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর জুমার সময় দেখানো ছোট ছোট ছয়টা ঘড়ির ছবি। বড় ঘড়িটার কাঁটা শুধু চলতে থাকে টিক টিক টিক। বাংলাদেশ নামের দেশটাতে জন্ম নিয়ে আনিস গর্বিত হয়েছে। তার জন্ম স্বার্থক হয়েছে।
দুইহাজার তের সালের বাইশে মার্চ শুক্রবার ফজর নামাযের পর জয়পুর গ্রামে পুলিশের মাঝে থাকা বিশেষ বাহিনীর গুলিতে আনিসের জীবনঘড়ির কাঁটা থেমে যায়। জয় বাংলা।
ব্যাক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত
একটি অপ্রাসঙ্গিক খবর
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন