Last kiss on his forehead ডাঃ নাঈম খালেদ (শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মেঝ সন্তান)
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ১০ মে, ২০১৮, ০৪:৩৫:৫০ রাত
জামায়াত নেতা শহিদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পরবর্তি একটি ছবি প্রকাশ করেছেন তাঁর পরিবার । রক্ত মাখা ছবিটি দেখে বুঝা যায় এটি নিজামীর ফাঁসির কার্যকর হওয়ার কিছুক্ষণ পরের ছবি । প্রকাশ করেছেন তাঁর মেঝ পুত্র ডা নাঈম খালেদ। খালেদ ফেসবুকে তাঁর পিতাকে স্মরণ করে লিখেছেন-----
Last kiss on his forehead
ডাঃ নাঈম খালেদ
সন ২০০৬ -সদ্য MBBS পাশ করে মনে হল USMLE করে আমেরিকা যাবো। আব্বু সিদ্ধান্তটা খুব একটা পছন্দ করলেননা। মাঝে মাঝে এর ওর উদাহরণ দিতেন। অমুকে দেশে এফসিপিএস করেছে, অমুক বলল দেশেই নাকি সার্জারি ভালো শেখা যায়। আমি তখনও ব্যাপারটা ঠিক মত বুঝে উঠিনি। এক বিকেলে কি কারণে যেন রুমে আসলেন। আমি তখন পড়ছিলাম। আব্বু কিছুক্ষণ খোজ খবর নিলেন, তারপর খুব আক্ষেপের সূরে বললেন আমার কেন জানি মনে হয় আমার মৃত্যুর সময় কোন ছেলে আমার পাশে থাকবেনা। কথাটা বুকের মধ্যে তীরের মত গিয়ে লাগলো। সবকিছু বাদ দিয়ে দেশেই থেকে গেলাম।
সন ২০১৫/১০ই মে -রাতের আধার ভেদ করে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে মন্মথপুরের উদ্দেশ্যে। আবহাওয়াটা যেন ঝিম মেরে আছে, থেকে থেকে বিজলী চমকাচ্ছে। আব্বুর শেষ কথাগুলো এখনও কানে ভাসছে। সাবধানে যাস..। এলোমেলো স্মৃতি গুলো বড় কষ্টের। কথামালায় কষ্ট গুলো ঢাকার চেষ্টা করি। অন্ধকারটাকে বড় আপন মনে হয়।
আমরা যমজ ভাই। মোমেনের জন্মের পর আমি নাকি আম্মুর পেট থেকে বের হতে চাইনি। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলে obstructed labour। এদিকে আম্মুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ডাক্তার আব্বুকে বললেন রক্ত লাগবে। রক্ত জোগাড় করতে আব্বুর ছুটাছুটি আর পেরেশানির মধ্যেই আমার জন্ম। আব্বুর হাত ধরে মসজিদে যাওয়া, আব্বুর সাথে বল খেলা, শেষ রাতে আব্বুর কান্না ভেজা কণ্ঠের তেলাওয়াত ও দোয়া মনে হয় সেদিনের ঘটনা। আব্বু বাসায় আসলে সবসময় ডোরবেলে দুটি লম্বা আর একটি হাল্কা বেল দিতেন। আমরা ভাই বোন সবাই ছুটে যেতাম দরজা খুলতে। আব্বুর হাতে সবসময় কিছুনা কিছু থাকতো। আর মুখে জান্নাতি হাসি। ছোট বেলা থেকে শুরু করে আব্বুর শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের পছন্দের কাজ ছিল আব্বুর মাথায়, দাড়িতে তেল দেয়া অথবা আব্বুর হাতের উপর শুয়ে গল্প করা। আব্বু খুব অল্প কথা বলতেন কিন্তু কথাগুলো ছিলো খুব গুছানো। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলতেন উনার শব্দ চয়ন নাকি অসাধারণ। আব্বু নিছক কথা বলার খাতিরে কথা বলা অপছন্দ করতেন। যাই বলতেন তার পিছনে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা থাকতো। তাই হয়ত কথা গুলো খুব কার্যকর হতো। কিন্তু আব্বু ছিলেন খুব ভাল শ্রোতা। আর সবার খুব কাছের মানুষ। অধ্যাপক মফিজুর রহমান চাচা খুব মজা করে বলছিলেন গোলাম আজম সাহেব আর নিজামী ভাই। গোলাম আজম সাহেবের কাছে শ্রদ্ধায় যে কথাগুলো বলা যেতনা নিজামী ভাইয়ের কাছে তা অকপটে বলা যেত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আব্বুকে এক অসাধারণ নেয়ামত দিয়েছিলেন। সেটা হলো মানুষকে ভালোবাসা দেয়ার ও ভালোবাসা নেয়ার ক্ষমতা। এই ভালোবাসাটা অনেক সময় পেরেশানির পর্যায়ে চলে যেতো। আমাদের সামান্য সমস্যা নিয়ে উনি এতটাই পেরেশান হয়ে যেতেন যে সেটা দুর করতে আমরা আমাদের সমস্যার কথাই ভুলে যেতাম। মনে পড়ে জ্বর হলে আব্বু সারাদিনের ব্যস্ততা সেরে বাসায় এসে কাপড় না বদলিয়েই মাথার কাছে বসে যেতেন। পেরেশান হয়ে মাথায় হাতবুলিয়ে দিতেন আর দোয়া করতেন। আব্বুকে সারাদিন না দেখার অভিমান তখন চোখ বেয়ে বের হয়ে যেতো। কোন বিপদে পড়লে জানতাম টেনশন ও দোয়া করার একজন আছেন। সুতরাং নো টেনশন।
যাত্রা বিরতি হলো নামাজের জন্য। নামাজের পরে শুনলাম সব শেষ। অব্যাক্ত বেদনা আর নীরবতাকে সঙ্গী করে আবার যাত্রা শুরু। এই পথ দিয়েই আব্বু কতবার সাঁথিয়া গেছেন। সাথে ড্রাইভার এই সাত্তার চাচা। আব্বু কখনো গাড়িতে ঘুমাতেননা। সামনের সিটে বসতেন। বাম হাতে দরোজার উপরের হাতল ধরে থাকতেন। চলত হালকা কিছু কথা ও দোয়া দুরুদ। থেকে থেকে বলতেন সাত্তার ঘুম পাচ্ছে নাতো? ঘুম পেলে এক জায়গায় থেমে চা খেয়ে নাও। মনটা শক্ত করে বললাম চাচা ঘুম পাচ্ছে নাতো? চাচা চুপ করে থাকেন।
মন্মথপুরে পৌঁছে দেখি আমাদের ছোট গ্রামটা লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে গুমোট কান্নার আওয়াজ। কষ্ট বুকে চেপে সান্ত্বনা দেয়াটা বড় কঠিন। ওরা আব্বুকে একটা এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসলো। গুটিকয়েক নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কাউকে আব্বুকে দেখতে দিলোনা। আমি সম্ভবত সর্বশেষ আব্বুকে দেখতে এ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। সাদা কাফনে ঢাকা দেহ। মুখটা শুধু খোলা। মনে হলো ঘুমিয়ে আছেন, সারা জীবন যেভাবে দেখেছি। ঠোটে সেই প্রশান্তির মৃদু হাসি। ইয়া আইয়াতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাহ..। দাড়ি কিছুটা এলোমেলো। অদ্ভুত ছেলে মানুষীতে মনে হল যদি তেল দিয়ে দিতে পারতাম। মাথার নিচে রক্তে ভেজা কাফনের কাপড়। নাকে রক্ত ভেজা তুলা, গালে আর চোখের উপরে কিছু রক্ত। এতক্ষণ পরেও রক্ত শুকিয়ে যায়নি। আব্বুর গাল থেকে রক্ত মুছে দিলাম। শরীরটা এখনো জীবিত মানুষের মত উষ্ণ। মানুষের মৃত্যুর পরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। ফলে মৃত দেহ ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। কোরআনের আয়াত গুলোকে বড় জীবন্ত মনে হল। তোমরা শহীদদের মৃত বলনা, তারা জীবিত ও জীবিকা প্রাপ্ত। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আম্মু একবার কাবা ঘরের সামনে দোয়া করেছিলেন আল্লাহ আমাদের পরিবারকে ইব্রাহিম আলাইহিসালাম এর পরিবারের মত কবুল কর। আব্বু বললেন বড় কঠিন দোয়া করলে। এই পথে যে আপন পর হয়ে যায়, তবু পথ চলতে হয়। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যে এ পথের জান্নাত। হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা এক করে আব্বুর কপালে চুমু দিলাম, শেষ বারের মতো। চোখটা আজ বড় অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়লো ১০ বছর আগের সেই বিকেলের কথা। আল্লাহ নিশ্চই আব্বুর আক্ষেপ আমলে নিয়েছিলেন। তাই হয়ত উনাকে অমর করে রাখলেন।
আল্লাহ তা'য়ালা শহিদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর শাহাদাতকে কবুল করে জান্নাতের সু'উচ্চ মাক্বাম দান করুন!
#আমিন! #আমিন! #আমিন!
বিষয়: বিবিধ
১১১১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
on the other hand blood on his face gave the very very bad news for the people which are involve this type of henious crime. Because the day of judgement he will go to the court of Allah the way we put him in his Kabar.
মন্তব্য করতে লগইন করুন