আশুরার ফজিলত, ইতিহাস, কারবালা ও রোজা!

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৩৯:৪৮ দুপুর

আশুরার রোজার ক্ষেত্রে মহররম মাসের দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেননা রাসুল (সা.) ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং ৯ তারিখ রোজা রাখতে নিয়ত করেছেন। হজরত আবু কাতাদা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলকে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ রোজা বিগত বছরের গোনাহ মুছে দেয়।’

মহররম হলো হিজরি সনের প্রথম মাস, যা আল্লাহ তায়ালার কাছে সম্মানিত চার মাসের এক মাস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬)।

মহররম মাসের ১০তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। কারণ আরবি আশারা থেকে এর উৎকলন। যার অর্থ হচ্ছে দশ।

আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এ দিনে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা আমরা পবিত্র কোরআন ও হাদিস থেকে জানতে পাই।

১০মহররম বা আশুরার দিনে সংগঠিত ঘটনা সমুহঃ


১) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদীনালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ মহররম তথা পবিত্র আশুরার দিবস।

২) দিনেরই কোনো এক জুমার দিন হজরত ইসরাফিল (আ.) এর ফুঁৎকারে নেমে আসবে মহাপ্রলয়। কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কেয়ামত।

৩) হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয় এ দিনে। এদিনেই হজরত আদম (আ.) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। আবার ভুলের কারণে তাদের পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তার তওবা কবুল করা হয়। এভাবে এ দিনই তার তওবা কবুল করা হয়।

৪) এ দিনে জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। আবার এদিনে নমরুদের বিশাল অগ্নিকুন্ড- থেকে মুক্তিলাভ করেন।

৫) এ আশুরাতেই তুর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে হজরত মুসা (আ.) কথোপকথন ও আসমানি কিতাব ‘তওরাত’ লাভ করেন।

৬) এ ১০ মহররমেই জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি হয়। তদ্রুপ হজরত নুহ (আ.) ও তার সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবণ থেকে মুক্তি লাভ করে।

৭) মাছের পেট থেকে হজরত ইউনুস (আ.) এর পরিত্রাণ লাভ করেন।

৮) আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা সবকিছুই সংঘটিত হয়েছে ১০ মহররম অর্থাৎ আশুরার দিনে।

১০) ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতঃ


কারবালার ইতিহাসঃ
রাসূল (সা.)-এর ওফাতের মাত্র ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির মুহাররম মাসের ১০ তারিখে জুমুার দিন ইরাকের কারবালা নামক স্থানে ক্ষমতালোভী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন তাঁরই প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন ইবনু আলী (রা.)। তার শাহাদাতের কারণ নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করেন। তবে তারিখুত তাবারিতে যে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা-ই প্রণিধানযোগ্য। হজরত হোসাইন (রা.) প্রিয় নবীজী (সা.)-এর নবুওয়াতের আদলে পরিচালিত খোলাফায়ে রাশেদীনের মহান আদর্শকে রক্ষা করার জন্য ইয়াজিদের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ইয়াজিদের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সপরিবারে শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে কিয়ামত পর্যন্ত এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। তার সেদিনের সে সংগ্রাম কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। আর ওই মহান ত্যাগের ফলে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে, ইয়াজিদের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ইসলামবিরোধী ছিল। তিনি এর বিরুদ্ধে জিহাদ না করলে অনেকে এটাকে বৈধ বলেই মনে করতেন। ইয়াজিদের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িগণের ইজমা ছিল বলে প্রমাণিত হতো। কিন্তু হজরত হোসাইন ইবনু আলী (রা)-এর শাহাদাত একথাটি সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বংশানুক্রমিক বাদশাহি ইসলাম সমর্থন করে না। তার এ শাহাদাত যুগে যুগে মুসলিম জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে লড়াই এবং শাহাদাতের প্রেরণা দান করে। মানব রচিত জুলুমের শাসনব্যবস্থা উৎখাত করে আল্লাহর বিধান কায়েম করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

মোটকথা ১০ মহররম যেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে এ দিনটির রয়েছে অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য। মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বহু বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

আর এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট আমল হলো ‘আশুরার সিয়াম’।

হজরত আলী (রা.) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে কি? যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন। তিনি বলেন, এই প্রশ্ন রাসুল (সা.) এর কাছেও জনৈক সাহাবি করেছিলেন। তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর তুমি যদি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরিমিজি : ১১৫৭)।

মহররম মাসের রোজা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি নিম্নে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করা হলোÑ হাদিস থেকে জানা যায়, রমাজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজাই উম্মতে মুহাম্মদির ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ওই বিধান রহিত হয়ে তা নফলে পরিণত হয়। হাদিসটি হলো, ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা : ৪২১০)।

হজরত জাবের (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত আছে, ‘রাসুল (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন না।’ (মুসলিম : ১১২৮)।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছান, তখন তিনি দেখলেন, মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটি অনেক বড়। এ পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফেরাউন ও তার বাহিনীকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘হজরত মুসা (আ.) এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।’ (বোখারি : ৩৩৯৭; মুসলিম : ১১৩৯)।

মুসলিমের অপর এক হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার দির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) ইহুদি-নাসারাও তো এ দিনটিকে বড়দিন মনে করে। আমরা যদি এ দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যাবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তারা যেহেতু এ দিনে একটি রোজা পালন করে, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এ ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব।’ (মুসলিম : ১১৩৪)।

ইমাম শাফেঈ ও তার সাথীরা, ইমাম আহমদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই মুস্তাহাব। কেননা রাসুল (সা.) ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন এবং ৯ তারিখ রোজা রাখতে নিয়ত করেছেন। হজরত আবু কাতাদা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলকে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ রোজা বিগত বছরের গোনাহ মুছে দেয়।’ (মুসলিম : ১১৬২)।

কারবালার শিক্ষাঃ
ঐতিহাসিক কারাবালার শাহাদাতের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (রা.) প্রমাণ করে গেলেন সত্য-মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়, হক ও বাতিল কখনও এক হতে পারে না। সত্যের বিষয়ে কোনো ছাড় নয় প্রয়োজনে শহীদ হবে। এ শাহাদাতের মাধ্যমে তিনি সব সত্য সন্ধানি মানুষকে শিখিয়ে গেলেন অসত্যের কাছে, জালিমের জুলুমের কাছে কখনও মাথা নত করবে না। প্রয়োজনে জীবন যাবে, দলে দলে সবাই শহীদ হবে তারপরও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। তাই তো উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক ও স্বাধীনতার বীরসৈনিক মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার বলেছেন: ‘কাতলে হুসাইন আসল মে মর্গে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারাবালা কি বা’দ।’ মূলত কারবালায় ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের মধ্যেই নিহিত ছিল ইয়াজিদের মৃত্যু, আর প্রতিটি কারবালার পরই ইসলামের নব উত্থান ঘটে।

হিজরি সনের প্রথম এবং নতুন মাস মুহাররম। প্রতিটি মুসলিমের ওপর আবশ্যক হচ্ছে এ মাসে গত এক বছরের ভুল-ভ্রান্তির বিষয়ে আত্মসমালোচনা করে আল্লাহর কাছে তাওবা করা। আগামী বছরকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এ মাসে সংঘটিত অতীত ঘটনা ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দৃঢ় পদে কাজ করে যাওয়া। কোনো হারানোর বেদনায় হা-হুতাশ ও আপসোস না করে সত্যের ওপর অবিচল থাকা। সবশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই
‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’


(সংগৃহিত)

বিষয়: বিবিধ

১০৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File