মীর কাসেম আলীর মন খারাপ : (গোলাম মাওলা রনি)

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ০৫ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৫৭:২০ রাত

জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল গত রমজানে। আমি তখন কাসিমপুর কারাগারে বন্দী। সে দিন আমাকে একজন চোর-গুণ্ডা বা বদমাশের মতো মহা যতন করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে দিন আমার নামের সাথে এমপি নামক একটি পদবিও ছিল। আমাকে নেয়া হলো প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তারপর কী মনে করে যেন সন্ধ্যার পরপরই পাঠানো হলো কাসিমপুর। গভীর রাতে আমি যখন কারা ফটক অতিক্রম করে আমার বন্দিনিবাসের দিকে যাচ্ছি, তখন ক্ষুধা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং অপমান আমাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। জীবনের প্রথম কারাবাস আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ ওখানে যায়নি আর তাই আমি জানতাম না ওখানকার নিয়মকানুন, সুযোগ সুবিধা বা অসুবিধাগুলো।

কাসিমপুর কারাগারের মূল ফটক পার হয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয়। তখন সম্ভবত ১৪ বা ১৫ রোজা চলছিল। আকাশে অর্ধচন্দ্রের মিষ্টি আলো। আমি হাঁটছি, সাথে দু’জন কারারক্ষী। চার দিকে গা ছমছম করা সুমসাম নীরবতা। ভয়ে ভয়ে কারারক্ষীদের বললাম আমি যেখানে থাকব সেখানে আর কে কে আছেন। তারা বলল মীর কাসেম, মাহমুদুর রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। রাতে কারো সাথে দেখা হবে না, তবে সকালে দেখতে পাবেন সবাইকে। সকালে দেখা হলো মীর কাসেমের সাথে। করমর্দন করলেন এবং আমার দিকে অতীব আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে! কোথায় যেন দেখেছি! আমি বললাম, টিভিতে দেখেছেন। তিনি ও আচ্ছা বলে তখনকার আলোচনার ইতি টানলেন। আমি কিছুটা মনোক্ষুণ হলাম। কারণ মাহমুদুর রহমান কিংবা গিয়াস উদ্দিন আল মামুন যতটা আন্তরিকতা, আগ্রহ এবং খোলামেলা ব্যবহার দেখালেন, সে তুলনায় মীর কাসেমের অভিব্যক্তি ছিল স্বতন্ত্র। আমার মনে হলো লোকটি ভীষণ রাশভারী, বেরসিক অথবা মনেপ্রাণে প্রচণ্ড আওয়ামীবিদ্বেষী। কিন্তু আমার সেই ভুল ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি।

রোজার মাসে আমরা ইফতারি এবং রাতের খাবার একসাথে খেতাম। রোজার পর সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবার একসাথে খেতাম। প্রথমে আমরা ছিলাম চারজন, পরে আমাদের সাথে যোগ হন অপর জামায়াত নেতা এ টি এম আজহার। তাকে গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে কাসিমপুরে আনা হয় রমজানের ঠিক কয়েক দিন পর। আমরা ফজর ছাড়া বাকি নামাজ জামাতে আদায় করতাম। আর প্রতি বিকেলে আমাদের ভবনের সামনে খোলার মাঠে চেয়ার নিয়ে বসে গল্পগুজব করতাম আবার মাঝে মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতাম। দু-তিন দিন পর আমার সাথে অন্য সবার মতো মীর কাসেমের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং আমরা পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে বন্ধুর মতো আচরণ করতে থাকি।

জেলখানার অখণ্ড অবসরে আমি প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠতাম। নামাজ-কালাম, তসবিহ-তাহলিল, বই পড়া, ঘুম, ব্যায়াম সব কিছু রুটিন মতো করার পরও হাতে অনেক সময়। মন ভার হলেই আমি বারান্দায় পায়চারি করতাম। মীর কাসেম তখন পরম স্নেহে আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেন নতুবা আমার রুমে আসতেন। তিনি কথা বলতেন কম এবং শুনতেন খুব বেশি। তিনি আমার জীবন, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ, সংসার, নির্বাচনী এলাকার খুঁটিনাটি নিয়ে মেধাদীপ্ত প্রশ্ন করতেন এবং সব কিছু শোনার পর সুন্দর বা আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত থাকতেন। কয়েক দিন পর আমি বুঝলাম মীর কাসেম সমাজের অন্য মানুষের মতো নন। এ আমি বুঝেছিলাম তার আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস ও ইবাদত বন্দেগির ধরন দেখে। যেসব বিষয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগত, আমি নির্দ্বিধায় সেগুলো তাকে জিজ্ঞেস করতাম এবং তিনি সাধ্য মতো সুন্দর করে আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলতেন।

জেলে যাওয়ার আগে বহুজনের কাছে বহুবার তার ব্যাপারে বহু কথা শুনেছি। তার নাকি আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তিনি জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা, দেশে-বিদেশে তার রয়েছে নামে বেনামে বহু প্রতিষ্ঠান। দেশের মধ্যে চলাফেরার জন্য তিনি সব সময় নাকি নিজস্ব হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন ইত্যাদি।

তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় গুজবটি হলো তিনি নাকি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিলেন। আমি এসব গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করতাম না। আবার যারা ওসব বলত তাদের সাথে তর্কও করতাম না। কারণ, গুজবকারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্তর এত নিচু মানের যে, তাদের সাথে তর্ক করাটাই মস্তবড় এক নির্বুদ্ধিতা। আমি নিজে ব্যবসাবাণিজ্য করি সেই ১৯৯১ সাল থেকে। বাংলাদেশে কয়জন ধনী আছেন এবং কোন কোন ধনীর কী কী ব্যবসা আছে তা মোটামুটি নখদর্পণে। বাংলাদেশের ধনীদের বসবাসের কয়েকটি এলাকা আছে তাদের মেলামেশার জন্য কয়েকটি ক্লাব আছে, তাদের ব্যক্তিগত বিলাসিতার গাড়ি, বাড়ি, নারী, বাগানবাড়ি, বন্ধু-বান্ধব, সভা-সমিতির এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের নাম ধাম অনেকের মতো আমিও জানি। ওই সমাজে মীর কাসেম নামে কোনো লোক নেই।

তথ্যসূত্রঃনিউজ ইভেন্ট ২৪.কম

বিষয়: বিবিধ

১৪৫১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

281611
০৬ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০১:২৪
আবু জারীর লিখেছেন : বাংলা লিংকের দামে তো আর চোখের পানি পাওয়া যায়না? নিকট অতীতে কবে চোখের পানি ঝড়েছে তাও বলতে পারবনা। কিন্তু একি? গোলাম মাওলা রনির লেখাটা পড়ে মাঝ খানে আসতে না আসতেই আজ হঠাত করে চোখে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার আসল কেন বুঝতে পারলাম না।
০৭ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৪৯
225624
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আমারও একই অবস্থা হয়েছে, ভাইয়া।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File