চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা!

লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:২০:৩৩ সকাল



১৯৮৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই আলোচিত-সমালোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান দীর্ঘ ২৯ বছর পর ফের খবরের শিরোনামে আসলেন। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। ১৯৮৫ সালে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন দেশের কোরআন প্রেমিক জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও বহাল তবিয়তেই ছিলেন তিনি। প্রায় তিন দশক পর আবারো সংবাদের শিরোনামে আসলেন যুদ্ধ না করেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সনদগ্রহণ করে। সে কারণে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে নিয়ে ফের বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের দু’জন উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী নাগরিক পদ্মপল চোপরা ও শীতল সিং মুসলমানদের পবিত্র ঐশীবাণী কোরআনের সকল আরবি কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন।

রিটে বলা হয়েছিল, কুরআনে এমন কিছু আয়াত আছে যেখানে কাফির ও মুশরিকদের হত্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। তাই এই গ্রন্থ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে।

ওই বছরের ১২ এপ্রিল বিচারপতি মিসেস পদ্মা খাস্তগীর এই মামলা গ্রহণ করে এ বিষয়ে ৩ সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ভারতসহ সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুসলিম জনতাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জেও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে আয়োজন করা হয় এক প্রতিবাদ সমাবেশের। সেদিন বেলা ১১টায় সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা হোসাইন আহমদকে এসপি অফিসে ডেকে নিয়ে চাপ দিয়ে সভা স্থগিতের জন্য লিখিত অঙ্গিকার নেওয়া হয়। পরে প্রশাসন নিজ উদ্যোগে সভা স্থগিত করা হয়েছে মর্মে সভা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে মাইকিং শুরু করে।

কিন্তু তৌহিদী জনতা প্রশাসনের অপপ্রচার ও বাধা উপেক্ষা করে দলে দলে আসতে থাকে ঈদগাহ ময়দানের দিকে। উপায় না দেখে ঈদগাহ ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এ পরিস্থিতিতে মাওলানা ইসারুল হক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে শুধুমাত্র মুনাজাত করেই সভা শেষ করে চলে যাওয়ার অনুমতি চান।

কিন্তু তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান ক্ষিপ্ত হয়ে জনতাকে গালিগালাজ করতে থাকেন এবং কোনোভাবেই এখানে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন।

এসময় তৌহিদী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের নির্দেশে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে প্রথমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল মতিন। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় শীষ মোহাম্মদ, রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সেলিম, সাহাবুদ্দীন, কৃষক আলতাফুর রহমান সবুর, রিকশাচালক মোক্তার হোসেন ও রেল শ্রমিক নজরুল ইসলাম নিহত হন। আহত হয়েছিলো আরো অর্ধশতাধিক মানুষ।

পবিত্র কুরআনের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী তৌহিদী জনতার উপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেওয়ায় ওই দিন ৮জন মুসল্লিকে জীবন দিতে হয়েছে। ওই ঘটনায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন। আলোচিত সেই মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান বর্তমানে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান।

১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিচার এখনো হয়নি। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের অভিযোগের তীর মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে হলেও বিগত ২৯ বছর বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো তাকে তিরস্কার না করে বিভিন্ন মেয়াদে পুরস্কৃত করেছে।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে দীর্ঘ সময় ধরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান। এরপর ২০১৪ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করে প্রমাণ করেছে তিনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েই তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধা সেজে সনদ গ্রহণ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে আজ রোববার মুক্তিযুদ্ধ ও জনপ্রশাসনবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকার) বৈঠকে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত ওই হত্যাকা-ের বিচারের জন্য এখনো আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় আছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। ২৯ বছর পার হয়ে গেলেও বর্বরোচিত এই হত্যাকা-ের মূল নায়কদের শাস্তির দাবি থেকে সরে আসেনি নিহতদের স্বজনরা।

এ বিষয়ে ওই ঘটনায় নিহত রাশিদুল হকের ভাই গোলাম মোর্তজা শীর্ষ নিউজকে বলেন, দেশের সরকারগুলো এত বড় একটা হত্যাকা-ের বিচার না করে উল্টো ঘটনার নায়ক ম্যাজিস্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে পুরস্কার দিয়েছে। তিনি বলেন, ভাইকে হারানোর বেদনা শুধু আমরাই বুঝি। মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।

ঘটনার ২৯ বছরেও আলোচিত ওই হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নিহত আব্দুল মতিনের বড় ভাই সাদিকুল ইসলাম শীর্ষ নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ৩৫ বছর পর তার বাবার হত্যাকারীদের বিচার করেছে। খুনিদের ফাঁসি দিয়েছে। আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার আমরা পাবো না কেন? ৫০ বছর গেলেও আমরা এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের বিচারের দাবি থেকে পিছু হটবো না।

তিনি বলেন, ২৯ বছরে দেশে অনেক সরকার এসেছে কিন্তু কোনো সরকারই এই হত্যাকান্ডের বিচার করেনি।

তিনি আরো বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সহযোগিতা কামনা করেন।

সাদিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনেছি তিনি নাকি (মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান) নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যা সনদ গ্রহণ করেছেন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে প্রতারণার জন্যও তার শাস্তি দাবি করেন সাদিকুল।

১৯৮৫ সালের ১১ মে’র ঘটনায় নিহত রিকশাচালক মোক্তার হোসেনের ছেলে খাইরুল ইসলাম শীর্ষ নিউজকে বলেন, আমার বাবা নিহতের সময় আমার বয়স ছিল সাত বছর। আমার একটি বোন আছে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমরা খুব কষ্ট করে দিন কাটিয়েছি। ভেবেছিলাম বাবার হত্যাকারীদের বিচার হবে। কিন্তু ২৯ বছর চলে গেলো কোনো বিচার আমরা পাইনি। যার হুকুমে পুলিশ গুলি করে আমার বাবাসহ ৮ জনকে হত্যা করেছিল তিনি এখন সরকারের বড় কর্মকর্তা। আমরা এই খুনি মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিচার চাই।

মোক্তার হোসেনের স্ত্রী পুরমানুন খাতুন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই।

সংগৃহীত:

বিষয়: বিবিধ

১৩০৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

265291
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৩১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এই অপরাধের দায়িত্ব সবারই নিতে হবে। এই সময় এর মধ্যে দশ বছর তো বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এই খুনির বিচার করে নাই। বৃটিশ আইনের সুযোগে এই খুনি আমলাতান্ত্রিক সুবিধায় এত উপরে উঠেছে।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:১০
208972
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : সহমত।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪৩
208978
কাহাফ লিখেছেন : সহমত আপনার সাথে।আসলে স্বার্থ বিবেচনায় আওয়ামী-বিএনপি একই প্রকৃতির।
265320
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:১৫
মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন : বিএনপি আর বাললীগ ক্ষমতায় থাকা কালে এই বিচার হবে কোন দিন।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:১৭
209051
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : হবে না এটা ১০০% নিশ্চিত থাকতে পারেন।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:০৬
209097
মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন : এই দুই দল ইসলামের শত্রু, কেউ প্রকাশে আবার কেউ ভিতরে ভিতরে।
265472
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৭
সাগর কন্যা লিখেছেন : কুলাঙ্গার,নরপিচাশ খুয়া মুক্তিযুদ্ধের ব্যানার টানাইছিল।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:৩১
209419
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File