আজ ঐতিহাসিক ১১ই মে-কুরআন দিবস এবং কুরআনকে সমুন্নত করার দিন।
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ১১ মে, ২০১৪, ০১:১৮:৩৪ দুপুর
এতিহাসিক ১১ই মে - কুরআন দিবস এবং কুরআনকে সমুন্নত করার দিন।
আমি আমার এ দুটি আঁখি কি করে ধরে রাখি
অঝোরে কান্না বেরিয়ে আসে............
যখন মাসের পরে মাস পেরিয়ে ১১ই মে আসে............
যেভাবে ঘটনা শুরু :
১৯৮৫ সালের ১০ই এপ্রিল। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটলো এক জঘন্যতম ঘটনা। ভারতীয় ২ উগ্রবাদী হিন্দু নাগরিক পদ্মমল চেপারা ও শীতল শিং আদালতে কোরআন বাজেয়াপ্ত করার মামলা দায়ের করে। তারা কোরআনের উল্লেখিত সূরা বাকারার ১৯১নং আয়াত ও সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। কোরআন যেহেতু কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের হত্যা করার কথা বলেছে সেহেতু কোরআন একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানী দাতা গ্রন্থ(নাউযুবিল্লাহ)। তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নং ধারা সি আর পিসি ১১৫(ক) ও ২৯৯ (ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আল কোরআনকে ভারতীয় সংবিধান বিরোধী বলে উল্লেখ করে। বিচারপতি পদ্মা খাস্তগীর ভারতীয় সংবিধানে ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে যে বক্তব্য রযেছে তা হজম করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ই এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেয়। এ ঘটনায় গোটা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। যার উত্তাল তরঙ্গের জলরাশি আছড়ে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ সহ প্রতিটি জেলায়। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে পুলিশ ইসলাম প্রিয় তৌহিদি জনতার মিছিলে অত্যাচার নিপীড়নও চালায়।
যেভাবে কোরআন প্রেমিকদের খুনে রঞ্জিত হয়েছিল
চাপাইনবাবগঞ্জ :
চাপাই নবাবগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব হোসাইন আহমদ একটি সভার আহবান করেন। সেই সভা থেকে ১১ই মে ঈদগাহ ময়দানে বিকেল ৩টায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। সভার প্রস্তুতির জন্য পুরো জেলাতে লিফলেট ও মাইকিং করা হয়। এর পূর্বের দিন শুক্রবার মসজিদে জুমআর খুৎবায় এবং নামাজ শেষে ইমাম সাহেবেরা পরের দিন সামবেশে অংশ গ্রহণের জন্য আহবান জানান। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনা বইতে থাকে। আবাল-বৃদ্ধ সবাই সেই সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু ১১ই মে হঠাৎ করে তৎকালীন পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন এবং মেজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে সভা স্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে ব্যপাক পুলিশ মেতায়েন করে। পুলিশ জনতাকে ছত্র ভঙ্গ করার চেষ্টা করে। ওয়াহিদুজ্জামান দম্ভ করে চেচিয়ে ওঠে বলে “এই মহুর্তে স্থান ত্যাগ করতে হবে নইলে গুলির আদেশ দিব, শালা মৌলবাদীদের সাফ করে দিবো”। উত্তেজিত আবেগকুল জনতা চলে গেল না। তারা জানিয়ে দিলেন, গুলির ভয়ে এ স্থান ত্যাগ করা মানেই আল কোরআনের অপমান, আমরা এস্থান ত্যাগ করবো না। এই উত্তাল তরঙ্গমালার সাথে সেই দিন শামিল হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী তৌহিদী ছাত্র-জনতার প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। যেই আল কোরআনকে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয়েছিল এই কাফেলার যাত্রা তারা তাদের সকল কর্মী বাহিনী নিয়ে ঈদগাহ ময়দানে শামিল হয়েছিল কোরআন অবমাননার প্রতিবাদ জানাতে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিলের মাধ্যমে তারা ঈদগাহ ময়দানে জমায়েত হয়। এক পর্যায়ে মেজিষ্ট্রেট মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান বিনা উস্কানিতে গুলির নির্দেশ দেয়। পুলিশ একনাগাড়ে প্রায় পনের মিনিট পর্যন্ত গুলি রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিপে করতে থাকে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লো পনের বছরের কিশোর ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্কুল কর্মী আবদুল মতিন। পুলিশের গুলিতে একে এক শাহাদাৎ বরণ করলেন কৃষক আলতাফুর রহমান, রিক্সা চালক মোক্তার হোসেন, দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রশিবিরের কর্মী রশিদুল হক, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শিবিরের কর্মী শীষ মোহাম্মদ ও সেলিম এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দৌলা। আহত হয় শামীম, গোলাম আযম বুলু, শরীফুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, রায়হান, এনামুল হক, মাহবুব, রেজাউল, শাহজাহান, রাজুসহ নাম না জানা আরো অনেকেই। লাশ আর আহতদের স্তুপে ভরে গেল ঈদগাহ ময়দান। পলায়নরত অসহায় মানুষের পিছু ধাওয়া করে শহরের অভ্যান্তরেও গুলি চালাতে থাকে। টুপি, পাঞ্জাবি, দাঁড়ি দেখলেই নির্মমভাবে তাদের উপর আক্রমন চালানো হয়।
আহতদের রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো দুটো মিনিবাসে করে। দেড়ঘন্টা পর যখন মিনিবাস থানা পার হচ্ছিল কুখ্যাত মেজিষ্ট্রেট আবারো গাড়ি থামিয়ে গুলির নির্দেশ দেয়। এতে আহত হয় গাড়ীর হেলপার, মারা যায় কাপড় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। আহতদের নামিয়ে দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় এবং নিখোঁজ হয় কয়েকজন আহত ব্যক্তি। কেবল হত্যা ও জখম করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ হতাহতদের গুম করে ফেলেছিল সেই দিন। জানাজার মুহুর্তে লাশ কেড়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের আত্নীয়-স্বজনদের কাছ থেকে।
এ ঘটনায় শহীদ হলেন য়ারাঃ
(১) পনের বছরের কিশোর ইসলামী ছাত্রশিবিরের স্কুল কর্মী আবদুল মতিন
(২) কৃষক আলতাফুর রহমান
(৩) রিক্সা চালক মোক্তার হোসেন
(৪) দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রশিবিরের কর্মী রশিদুল হক
(৫) অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র শিবিরের কর্মী শীষ মোহাম্মদ ও সেলিম
(৬) ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দৌলা
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে যেখানে শহীদের সংখ্যা ১১, চাপাই নবাবগঞ্জবাসীদের মতে ২০ এর অধিক। নিখোঁজ সংখ্যা ৮/৯। কিন্তু প্রেসনোটে শহীদের সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ০৬।
সাবাস চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী !
এতো রক্ত, এতো গুলি, এতো আহত এতো তান্ডব- তারপরও পরবর্তী দিনগলোতে সাহসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসী। পুলিশের গুলির মুখে নারায়ে তাকবীর ধ্বনি তুলে ছুটে আসেন তারা ঈদগাহ ময়দানে, কারফিউ উপেক্ষা মিছিল আর শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে ছোট্ট শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১৩ই মে পরদিন হরতাল আহবান করা হয়। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাজারে ও মসজিদে লিফলেট দেয়া হয়। গভীর রাতে কারফিউ ভঙ্গ করে সাইকলে চড়ে মোল্লার ফাঁসির দাবিতে পোস্টারিং করা হয়। পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী যে অভূতপূর্ব হরতাল পালন করেছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেদিন কেবল গাড়ি-ঘোড়া বা রিক্সাই নয়, মহানন্দার বুকে কোন নৌকাও চলেনি। এভাবেই মানুষ প্রকাশ করেছে কুরআনের প্রতি ভালোবাসা এবং স্বৈরাচারকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
এই ঘটনায় ছাত্রশিবির বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করে ১৪ ই মে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও ১৫ই মে প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচী পালন করে এবং বের করা হয় বিশেষ বুলেটিন। অপরদিকে বাংলাদেশের এ ঘটনার ফলে সারা বিশ্বে একটি জনমত সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৩ ই মে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি বাসক বামনের আদালতে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেয়।
সেই থেকেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এটি ঐতিহাসিক কোরআন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। চাপাই নবাবগঞ্জ ঈদাগাহ মাঠে যেন আজো শোনা যাচ্ছে কিশোর শীষ মোহাম্মদের আর্তনাদ, শহীদ রফিকুলের করুন আহাজারী। আব্দুল মতিন ও সেলিমের আর্তচিৎকারে শহীদ সবুর ও নজরুলের বুক ফাটা কান্না। এই আওয়াজ প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলেও কর্ণকুহরে প্রবেশ না যারা আছেন শাসকের সিংহাসনে। বরং নব্য জাহিলিয়াতের আওয়াজ শুনা যায়। কিন্তু এই ১১ই মে কুরআনের ভালোবাসায় সিক্ত তৌহিদী জনতাকে মনে করিয়ে দেয় -
আল কুরআনকে ভাণলাবেসে
প্রাণ দিয়েছিল যারা
আজকে দেখো সামনে এসে
রক্ত মাখা শহীদ বেশে
ফের দাঁড়িয়েছে তারা.......
১১ই মে এর রক্ত আগুনের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে, অসংখ্য মানুষ জেগে ওঠে কুরআনের প্রেমে উদ্বেলিত হয়ে। সেই সাহসে দীপ্ত হয়ে আজো চলছে কুরআন প্রতিষ্ঠার অকুতোভয় কাফেলা-
জেহাদের এই কাফেলা বন্ধু চিরদিন জেগে থাকবে,
সত্যের পথে মুক্তির পথে তোমাকে আমাকে ডাকবে........
তাই আসুন ! আজ আমরাও কুরআনপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে, কুরআনের শহীদদের এ মহান ত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শমিল হই।
“সিনায় ফুঁকে নাও আয়াতুল কুর্সির অমর সাহস, সিংহের বিক্রমে উচ্চারণ কর বিশ্বাসের পংক্তিমালা, যদি এগিয়ে চলার মিছিলে ফেটে পড়ে তোমার বজ্রের মত স্লোগান, বৈশাখের ঝড়ের মত দেয়ে চলা নৃত্যে কেঁপে উঠে গ্রহলোক, গ্রাম গ্রাম মানুষ চেতনায় নতুন সূর্য
উঠবেনা ?”
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে তার অনুগত বান্দা হিসেবে কবুল করুন।
আমীন ।।
বিষয়: বিবিধ
১৯৪৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ্ সেই সব শহিদদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুণ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন