ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার দামাল সন্তান ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:০৩:০৬ রাত
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম
আজকের মানবসমাজ দু’টি বিপরীত মেরুতে বিভক্ত হয়ে আছে। বিশ্ববাসীর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন আজ দাসত্ব, জুলুম, স্বৈরাচারী ও পাপাচারের কবলে হাবুডুবু খাচ্ছে। পরিণামে মানব সমাজ যেন ধ্বংস ও বিনাশের পথে-ই এগিয়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত বিভক্তি আর হতাশার চাবুক আঘাত হানছে আমাদের মানব সমাজ, সভ্যতা, এবং ঐক্যের ইমারতের উপর। কখনো মনে হচ্ছে সত্য পন্থীরা যেন অপরাধী!!! প্রকৃত অপরাধীরা যেন সাধু!!! জালেমের বিশাক্ত হুংকার মানব সমাজ কে কাঁপিয়ে তুলছে। খোদাদ্রোহী দুনিয়া আজ অত্যাচার, নিপীড়ন, প্রতারণা, হঠকারিতা ও দুর্ধর্ষতার সীমানা ছেড়ে গেছে, নির্যাতিতের করুণ ফরিয়াদে আকাশ বাতাস দলিত মথিত ও তিক্ত-বিষাক্ত। কিন্তুু তারপরও কি সত্য পথের সৈনিকেরা কি ভিত? না, বরং প্রতিটি মুমিন এই বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দেয়া কে নিজের ঈমানীদায়িত্বের মধ্যে অন্তভূক্ত করে-ই এগিয়ে চলছে। এই রকম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে সকল নবী রাসুল (সাঃ) কে। যুগে যুগে যারাই সেই পদাংক অনুসরন করবে, তাদের প্রত্যেককেই একই পরীক্ষার সম্মুক্ষীন হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের প্রধান এজেন্ডা হিসেবে গ্রহন করেছে এ জমীন থেকে ইসলামের শিকড় স্বমুলে উৎখাতের। তার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করা হয়েছে এদেশের প্রধান ইসলামী দল জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দমন করার। এজন্য তারা বেছে নেয় জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, অপপ্রচার, হামলা মামলা আর তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র। আইনের সকল নীতি নৈতিকতা বিবেক বুদ্ধি উপেক্ষা করে অত্যন্ত হীন কায়দায় রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রতিপক্ষ দমনের এই আয়োজনে প্রকাশ্য মদদ যোগাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কারণ তারা এদেশের সম্পদ লুন্ঠন ও আধিপত্য বিস্তারে প্রধান বাঁধা মনে করছে এদেশের ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে। সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী বিচারকে। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এরশাদ কে নির্বাচনে আনার জন্য সাক্ষাত করেও বলেছেন ” আপনি নির্বাচনে না আসলে তো জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় আসবে” এমন বক্তব্য শিষ্ঠাচারের চরম লংঙন নয় কি? অনেকটা পুতুল খেলার মতই সাজানোর নাটকের মধ্যে দিয়ে চলছে একের পর এক ফাঁসির রায়। বিচারের রায়ের ক্ষন তারিখ আর ফাঁসির রায় কার্য়কর করার ঘোষনা দিয়েই চলছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য মন্ত্রী এমপিরা পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে শেখ হাসিনাই এখন জীবন-মৃত্যু দেয়ার মালিকানা নিয়েছে। নাউযুবিল্লাহ।
আজ পিরোজপুরের কুক্ষাত দেলু রাজাকারকে মাও: দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আর কসাই কাদেরকে আব্দুল কাদের মোল্লা সাজিয়ে তাদেরকে শাস্তি দিচ্ছে এই ট্রাইবুনাল। কিন্তু এই ট্রাইবুনালে প্রসিকিউশন, বিচার সংশ্লিষ্টরা এমনকি শেখ হাসিনাসহ সকলেই ভালো করেই জানেন এটি একটি সাজানো নাটক ছাড়া আর অন্য কিছু নয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ দমনের এই ষড়যন্ত্র ও কুটকৌশলের জড়িত তারা দুনিয়ার আদালত থেকে হয়ত পার পেলেও আল্লার আদালত থেকে রেহাই পাবেন কি???
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যারা কথায় কথায় জামায়াত নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার দিনক্ষন ঠিক করে আনন্দ উপভোগ করছেন, তাদের কি জানা নেই যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ, জীবন-মৃত্যু নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। এই হাদীসে সেই ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে: হযরত আবু আব্বাস আব্দুলাহ বিন আব্বাস (রা বর্ননা করেছেন- একদিন আমি রাসুল (স এর পেছনে ছিলাম তিনি আমাকে বলনেন হে যুবক! আমি তোমকে কয়েকটি কথা শিখাবো। আল্লাহ কে স্বরণ করবে তো তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন, আল্লাহ কে স্বরন করলে তাঁকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে তো আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে তো আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনো রাখ, সমস্ত মানুষ যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায় তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা ব্যাতিত আর কোনো উপকার করতে পারবে না।আর যদি সমস্ত মানুষ তোমার কোন অনিষ্ঠ করতে চায় তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দ্দিষ্ট করে দিয়েছেন তা ব্যাতিত আর কোন অনিষ্ট করতে পারবেনা। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে”।
সুতরাং সত্য পন্থীদের জীবনে জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসির রায় এগুলো নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। আসুন আমরা প্রিয় নবী রাসূল (স জীবনের খন্ডিত অংশের দিকে নজর দেই। পৃথিবীতে নবী রাসুলগন সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও যুক্তিসংগত পন্থায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবন করেছেন। কিন্তু সেখানেও বিরোধীরা তা বিচার বিবেচনা না করে, বেছে নেয় অন্ধ আবেগ ও উন্মত্ত হিংস্রতার পথ । সৃষ্টি করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজো কিন্তু তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা। ব্যাঙ্গবিদ্রুপ, উপহাস, গালিগালাজ ও অশালিন উপাধি সব যেন একই কারখানায় তৈরী। একটি অপচেষ্টা ব্যর্থ হলে নব উদ্যমে আরেকটা শুরু করা হতো। তাদের মিথ্যা প্রচারণায় পরিবেশ ভারী ও শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠতো। জ্বলে উঠতো হিংস্রতার দাবানল। কিন্তু মিথ্যা আবেগের ওপর ভর করে, দু'চারদিন টিকে থাকলেও অচিরেই তা নিস্প্রভ ও ম্লান হয়ে যেত। মানুষের মন এসবের প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলো। তখন কাফেরেরা মূলনীতি ঠিক করলো নিত্যনতুন গালি আবিষ্কারের।
কিন্তু রাসূলুলুল্লাহ (স আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রসার করার কাজে অবিচল থাকলেন। যে আচরণটা একেবারেই নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল, সেটা হলো, তাঁর মহল্লার অধিবাসী বড় বড় মোড়ল ও গোত্রপতি তাঁর পথে নিয়মিতভাবে কাঁটা বিছাতো, তাঁর নামাজ পড়ার সময় ঠাট্টা ও হইচই করতো, সিজদার সময় তাঁর পিঠের ওপর জবাই করা পশুর নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করতো, চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিত, মহল্লার বালক-বালিকাদেরকে হাতে তালি দেয়া ও হৈ-হল্লা করে বেড়ানোর জন্য লেলিয়ে দিত এবং কুরআন পড়ার সময় তাঁকে, কুরআনকে এবং আল্লাহকে গালি দিত। এতসব য়ড়যন্ত্র আর বাধাঁ দমাতে পারেনি তার মিশনকে। শেষ পর্যন্ত তারা যখন মূল দাওয়াতের বিরুদ্ধে যুক্তিতেও হেরে যায়, এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও সহিংসতার অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়, তখন রসূল সা. এই হত্যাকান্ডের দিয়ত আদায় করা ও শান্তি চুক্তির দায়দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বনু নাযীর গোত্রের লোকদের কাছে গেলেন। সেখানকার লোকেরা রসূল সা. কে একটা দেয়ালের ছায়ার নীচে বসালো। তারপর গোপনে সলা-পরামর্শ করতে লাগলো যে, একজন উপরে গিয়ে তাঁর মাথার ওপর বিরাটকায় পাথর ফেলে দিয়ে হত্যা করবে। আমর বিন জাহ্হাশ বিন কা’ব এই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। রসূল (সাঃ) তাদের দুরভিসন্ধি টের পেয়ে আগে ভাগেই উঠে চলে এলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড)
আজো পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলমানদের সাথে চলছে একই অচরণ। সারা পৃথিবীতে আজ মুসলমানরা নির্যাতিত। বিশেষ করে সারা দুনিয়ায় আজ জামায়াত ও ইখওয়ান এই দুটি আন্দোলন সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত। কারণ কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে যে আন্দোলনই এগিয়ে থাকবে তাদের বরণ করতে হবে একই পরিণতি। ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী উভয় সংগঠনই কঠোর পরীক্ষা ও প্রতিকূলতার বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দুনিয়াতে হকের বিজয়ের জন্য যখনই কোন ব্যক্তি বা দল সাহসিকতার সাথে মাথা উচু করেছে তখনই তাদেরকে এসব মনজিল অতিক্রম করতে হয়েছে। বলিষ্ঠ ঈমান ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ইখওয়নিী মুজাহিদগণ তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্দির স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে থাকতো । বাতিল তার সমস্ত শক্তি ও নষ্টামী সত্ত্বেও তাদের মজবুত অবস্থানে কোন প্রকার বিচ্যুতি সৃষ্টি করতে পারে নি। প্রথম মুর্শিদে আমকে তার পূর্ণ যৌবনে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যেরুপ নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার ওপর বেশ কয়েকটা বই লেখা হয়েছে। আবদুল কাদের আওদা শহীদ ও তার সংগীদেররক ১৯৪৫ সালে ফাসিতে ঝুলানো হয়েছে। এসব অমূল্য জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি শুধুমাত্র নীল উপত্যকারই ক্ষতি হয়নি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ অদ্যাবধি এ ক্ষতির জন্য তড়পাচ্ছে।
ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে অন্যতম সাইয়্যেদ কুতুব, হাসানুল বান্না সহ নেতাকমীদের উপর যে পৈশাচিক, নির্মম জুলুম নির্যাতন আগেও হয়েছে এখনো চলছে। জেলে ঢোকার সাথেই কর্মচারীগণ মারপিট করতো তারপর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত কুকুরকে লেলিয়ে দেয়া হতো। কুকুর তার পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেরে নিয়ে বেড়ায়। একটানা সাত ঘন্টা ব্যাপী তাকে জরো করা হয়। তার স্বাস্থ্য এসব নির্যাতন সহ্য করার যোগ্য ছিল না। কিন্তু তিনি তার সুদৃঢ় ঈমানের বলে পাষাণ প্রাচীরের ন্যায় সব অমানুষিক অত্যচার অকাতেরে সহ্য করেন। তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে “(আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ)”। জেলের অন্ধকার কুঠরী রাতে তালাবদ্ধ করা হতো। আর দিনের বেলা তাঁকে রীতিমত প্যারেড করানো হতো। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বক্ষপীড়া, হৃদপিন্ডের দুর্ভলতা ও সর্বাঙ্গে জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা ইত্যাদি বিভিন্ন রোগে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। পুলিশের কুকুর তাঁর শরীরে নখ ও দাতের আঁচর কাটে। তাঁর মাথায় খুব গরম এবং পরক্ষনেই বেশী ঠান্ডা পানি ঢালা হতে থাকে। লাথি,কিল, ঘুষি, অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ইত্যাদি তো ছিল দৈনন্দিন ব্যপার।
১৯৫৫ সালের ১৩ই জুলাই গন আদালতের বিচারে তাঁকে পনর বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয় তিনি এক বছর কাকাভোগের পর নাসের সরকারের পক্ষথেকে প্র¯তাব দেয়া হয় যে, তিনি সংবাদপত্রের মার আবেদন করলে তাকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে জবাব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, -”আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চান্বিত হচ্ছি যে, মযলুমকে যালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। আললাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবুও আমি এরূপ শব্দ উচ্চারন করতে রাযী নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট। সে মিশরেও দ্বীনের বিজয় দেশীয় ও আন্তজাতিক ষড়যন্ত্রকারী মহল ছিনিয়ে নিলেও নেতা-কর্মী, তাদের সন্তান, সব শ্রেনী পেশার মানুষের শাহাদাত বিজয়কে আবার অবিশ্যম্ভাবী করে তুলছে।
জামায়াতে ইসলামীর উপরও বহু পরীক্ষা এসেছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতাকে মৃত্যুদন্ড শুনানো হয়েছিল এবং তার সাথীদেরকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এটা ১৯৫৩ সালের কথা অর্থাৎ আওদা শহীদের শাহাদাতের এক বছর পূর্বে এবং সাইয়্যেদ মওদুদী (র এর মুখ থেকে সেই ঐতিহাসিক উক্তি উচ্চারিত হয় যা সোনালী হরফে লেখা হয়ে আছে এবং যার দীপ্তি কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের পথের পথপ্রদর্শনের পথ দেখাতে থাকবে। তিনি বলেছিলেনঃ শুনে রাখ---মৃত্যু এবং জীবনের ফযসালা এ জমিনের উপর হয় না। বরং আসমানে হয়ে থাকে ।যদি আমার মৃত্যুর সময় হয়ে তাকে, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে বাচাতে পারবে না।আর যদি আমার জীবনের সময় এখনো বাকি থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরাই উল্টো ফাসিতে ঝুলে যাবে। আমাকে মারতে পারবে না । এরপর থাকে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের ব্যপারটি। এরূপ দয়া ভিক্ষা কেবল একটি সত্তার কাছেই করা যেতে পারে যিনি চিরঞ্জীবও চিরস্থায়ী। তোমাদের কাছে আমার জুতার কাটাও ক্ষমা চাইবে না---------। এ উক্তির প্রতিধ্বনিতে বাতিলের প্রাসাদে ভূমিকম্পের কাফন ধরেছিলো এবং উক্তিকারী যে দৃঢ় বিশ্বাস থেকে একথা উচ্চারন করেছিলেন সেই বিশ্বাসই ছিল তার কর্মী পুজি। জীবন অবশিষ্ট ছিল। তাই ফাসির কুঠরিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া এবং ফাসির রজ্জু গলায় পরার সময় ক্ষন নির্ধারিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সত্যের সৈনিক বেচে থাকলেন। মৃত্যু পরাভূত হয়েছিল এবং জীবন আশাভরা দৃষ্টিতে মুচকি হেসে ভবিষ্যত পানে তাকাচ্ছিলো।
সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে মুমিনের জন্য দুনিয়া হচ্ছে একটি পরীক্ষাগার। এখানে বয়স বা আয়ুষ্কাল হলো পরীক্ষার সময়। মুমিনরা তো প্রাণের কথা ভাবেই না, এ তো কখন না কখন চলে যাবেই। চিরকাল থাকার জন্য কেউই এ পৃথিবীতে আসেনি। কাজেই এ দুনিয়ায় কিভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে চলতে হবে এটা চিন্তার নয়। বরং আসল চিন্তার বিষয় হলো ঈমানকে কিভাবে বাঁচানো যাবে কিভাবে থাকা যাবে আল্লাহর আনুগত্যের গন্ডির মধ্যে। যদি দুনিয়ায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঈমান হারিয়ে ফেলে তাতো বিরাট এক ব্যর্থতা। তাহলে সে ঈমানের মূল্য কী? আর ঈমান বাঁচাতে যদি দুনিয়ায় প্রাণ বিসর্জিত হয় তাহলে এ এক মহা সফলতা। এতো ফলাফলের আকাশ-পাতাল পার্থক্যই শুধু নয় এতে প্রাণ সৃষ্টির সার্থকতা পরিগ্রহ হবে। এমন মৃত্যু গৌরবের। এই মৃত্যুকে অভিনন্দন। সুতরাং প্রাণের জন্য উৎসর্গীত ঈমান আর ঈমানের জন্য উৎসর্গীত প্রাণ বড়ই ব্যবধান। এটি কখনও এক হতে পারে না। আর মুমিন ব্যক্তি যদি এই ঈমান ও নেকির পথে চলতে গিয়ে পার্থিব সকল নেয়ামত থেকেও বঞ্চিত হয় এটি পার্থিব দৃষ্টিতে ব্যর্থতার হলেও আল্লাহর কাছে তার বিনিময় যদি জান্নাতই হয় তাহলে ঐ ব্যক্তি থেকে আর সফল কে হতে পারে? আল্লাহ বলেন- “আল্লাহ্ ক্রয় করে নিয়েছেন মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে: অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হলো মহান সাফল্য।’’ আর সেই মহা সাফল্যের দিকেই দৌড়িয়েছেন সাহাবায়ে আজমাঈনগন। হযরত রাশেদ বিন সা’দ জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (সাঃ) জবাবে বলেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’ হযরত উম্মে হারেসা বিনতে সারাকা থেকে বর্ণিত, “তিনি হুজুর (সাঃ) এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি হারেসা সম্পর্কে কিছু বলবেন না? জঙ্গে বদরের পূর্বে একটি অজ্ঞাত তীর এসে তাঁর শরীরে বিঁধে যায় এবং তিনি শহীদ হন। যদি তিনি জান্নাতবাসী হয়ে থাকেন তাহলে আমি সবর করবো, অন্যথায় প্রাণ ভরে কাঁদব। হুজুর (সাঃ) জবাব দিলেন, হারেসার মা। বেহেশতে তো অনেক বেহেশতবাসীই রয়েছেন তোমার ছেলে তো সেরা ফেরদাউসে রয়েছেন।”
শহীদেরা তাদের মাবুদের সাথে তামাম জিনিসের বিনিময় করে শুধু একটি বাক্যের ভিত্তিতে ‘‘রাদিয়া আল্লাহু আনহুম অরাদু আন্হ’’। পৃথিবীর সকল শক্তি মিলে যেমনি একটি প্রাণী হত্যা করতে পারে না, ঠিক তেমনি সবাই মিলেও একটি প্রাণীকে বাঁচাতে পারবে না। সারা পৃথিবীর সবাই একজনের বিরুদ্বে বিদ্রোহ করেও তাকে যেমনি অসম্মানিত করতে পারে না, ঠিক গোটা পুথিবীর একসাথ হয়ে চেষ্টা করেও কাউকে লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। যারা এই মহৎ কাজে নিজেদের জান-মাল, বাণিজ্য, পিতা, পুত্র, ভাই বেরাদর, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের মায়া এবং ঘরের আরাম-আয়েশ, বিলাস ব্যসন সবকিছুই বিসর্জন দিতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের অধিকারী আর কে? সাফল্য ও বিজয়ের সিংহদ্বার তাদের জন্য ছাড়া আর কার জন্য উন্মুক্ত হতে পারে? তাদের শক্তির উৎস অনেক গভীর থেকে প্রথমত হক ও মিথ্যার সংঘাতের অনিবার্যতা পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নেই। সত্যপন্থীদের অবশ্য দীর্ঘকাল পরীক্ষার আগুনে ঝালাই হতে হবে। তাদের পরীক্ষা দিতে হবে নিজেদের সবর, সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আত্মোৎসর্গিতা, ঈমানী দৃঢ়তা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা, বিপদ-মসিবত, সমস্যা ও সঙ্কটের সুকঠিন পথ অতিক্রম করে তাদের মধ্যে এমন গুণাবলী সৃষ্টি করতে হবে যা কেবল মাত্র ঐ কঠিন বিপদসঙ্কুল গিরিপথেই লালিত হতে পারে।
সত্যিই, জনাব আব্দূল কাদের মোল্লা সহ আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদদের ঈমানী দৃঢ়তা দ্বীনের পথিকদেরকে উৎসাহিত করছে। ইতোমধ্যে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মৃত্যু পরওয়ানা জারি করা হয়েছে।কিন্তু দ্বীনের এই মুজাহিদকে এতটুকু হতাশাও আচ্ছন্ন করতে পারেনি, আলহামদুলিল্লাহ। এই জাতীয় সাহসী বীর মুজাহিদ এখন মাওলানা মওদুদী, সাইযেদ কুতুব, আর হাসান আল বান্নার কাতারে দন্ডায়মান। ঠিক একইভাবে ৯৩ বছর বয়স্ক মানুষ অধ্যাপক গোলাম আযম ৯০ বছরের সাজার দেয়ার পরও যখন দৃঢ় চিত্ত, আটল আর আবিচল। ১১ জানুয়ারি ২০১২ কারাগারে যাওয়ার পূর্বে তিনি লিখেছেন- প্রিয় দেশবাসী, এ সরকার ৯০ বৎসর বয়সে আমাকে জেলে নিচ্ছে। আমি জীবনে চারবার জেলে গিয়েছি। জেল বা মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনা। আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাইনা। শহীদ হওয়ার জযবা নিয়েই ইসলামী আন্দোলনে শরিক হয়েছি। মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দিলে শহীদ হওয়ার মর্যাদা পাবো ইনশাআল্লাহ। এবার বার্ধক্যে ও অসুস্থতা নিয়ে বন্দিজীবন কেমন করে কাটবে সে ব্যাপারে মহান মাবুদের উপর ভরসা করে আছি।” আমি জেল, জুলুম, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। মৃত্যু অত্যšত স্বাভাবিক। একদিন সবাইকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আখিরাতে বিশ্বাস করি, অনিবায তাক্বদির বিশ্বাস করি। আরও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোন কিছুই হয় না এবং তিনি যা করেন তা বান্দাহর কল্যাণের জন্যই করেন। সুতরাং, আমি আমার মৃত্যু নিয়ে সামান্যও শঙ্কিত নই। আমি নিশ্চিত, আমি এ দেশের মানুষের অকল্যাণের জন্য কোনো কাজ কোনোদিনই করিনি। নিরপেক্ষ তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার হলে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হবো, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। যারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারাও জানেন যে, আমি দোষী নই- এ সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে যে রকম প্রহসনের বিচার হচ্ছে তেমন হলে তো আর কোনো বক্তব্য থাকে না। আমার দীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মজীবনে সারাদেশে ব্যাপক সফর করেছি। জনগণের মধ্যেই বিচরণ করেছি। উন্নত নৈতিক চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে তা কখনো জনগণ বিশ্বাস করবে না। আমাকে ফাঁসি দিলেও জনগণ আমাকে আল্লাহর সৈনিক হিসেবেই গণ্য করবে, ইনশাআল্লাহ।” আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহর সাহায্য যথাসময়ে এগিয়ে আসবে। আর মাবুদের সাহায্য শেষেই আসে। শহীদের মিছিল যতো দীর্ঘ হবে, নির্যাতিতের আহাজারি আল্লাহর আরশকে যত প্রকম্প্রিত করবে এই আন্দোলনের বিজয় ততো সুনিশ্চিত হবে এবং আল্লাহর পথে দৃঢ়চিত্তের এই মুজাহিদেরা আমাদের মাঝে গাজী হিসেবে ফিরে আসবেন ইনশাল্লাহ। তাই কবি নজরুলের ভাষায় ”
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান,
আসি” অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৬৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন