স্বপ্নের দক্ষিন কোরিয়া : প্রবাসী শ্রমিকদের কিছু দুর্দশা
লিখেছেন লিখেছেন ভ্রমন পিপাসু ২২ মার্চ, ২০১৩, ১১:০৮:৩৫ সকাল
অনেকটা কাকতালীয় ভাবে আমার কোরিয়া আসা। যদিও কখনো কোরিয়া যাবার ব্যাপারে আমার মোটেও আগ্রহ ছিল না। তারপরও সুযোগ বলে কথা। তো চলে এলাম,
না, নিছক ভ্রমন করার উদ্দেশ্যে নয়, কাজের উদ্দেশ্যে,আমরা এক ফ্লাইটে প্রায় দেড়'শ বাংলাদেশী ঢাকা থেকে সিউল এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।বারো ঘন্টা কুয়ালালামপুর এ ট্রানজিট নিয়ে সকাল সাতটায় সিউল পৌছলাম। সেখান থেকে সরাসরি ট্রেনিং সেন্টার এবং দুদিন ট্রেনিং শেষে বিকেলে কোম্পানী থেকে লোক এসে যার যার কর্মস্থলে নিয়ে গেল।
আমরা চার জন বাংলাদেশী একটি কোম্পানীতে যোগ দিলাম। সেখানকার কাজ সম্পর্কে আমি বিস্তারিত বলতে চাই না।তবে এটুকু বলতে পারি, দেশের কোন স্বজন যদি সে কাজ দেখতো তবে হয়তো তার ছেলে/ ভাইকে কোরিয়াতে কাজে যাওয়ার কথা মুখেই আনতে দিত না। এখানে বলে রাখা ভালো, বর্তমানে যারা সরকারী ভাবে কোরিয়াতে যাচ্ছে, তাদের প্রায় সকলেই,শিক্ষিত,এবং এর মধ্যে বিশাল অংশই গ্রাজুয়েট।
প্রথম দিনই মনে হয়েছিল এখান থেকে পালিয়ে যাই,কিন্তু না, আমাকে দেখতে হবে,মনটাকে শক্ত করলাম,মনের জোরে ২/৩ দিন কাজ করে ৩য় দিন অসুস্থ হয়ে গেলাম।প্রায় ১ সপ্তাহ অসুস্থ ছিলাম,এর পর ২০ দিনের মাথায় সেই কোম্পানী থেকে রিলিজ নিলাম।এটা খুবই কস্টসাধ্য ব্যাপার,
আমি যেটা স্থানীয় প্রভাবশালী বাংলাদেশীদের সহায়তায় কোরিয়ান আইনজীবির মাধ্যমে করেছিলাম।
এরপর শুরু হলো আমার কোরিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘোরা ফেরা,এসময় আমি কোরিয়া ও কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্পর্কে জানতে পারলাম।
প্রথমত যারা সরকারী ভাবে কোরিয়া আসে তাদের সম্পর্কে বলি,
EPS (employee permit system) এর আওতায় যে সকল কোম্পানী শ্রমিক আনে তারা মুলত নিম্নমানের কোম্পানী অথবা অতি ঝুকি পূর্ন কাজ অথবা বেতন ভাতা ঠিক মত পরিশোধ করে না। যে কারনে এসব কোম্পানীতে কোন কোরিয়ান অথবা অবৈধ শ্রমিক কাজ করে না। ফলে বাধ্য হয়েই এরা বিদেশ থেকে শ্রমিক আনার জন্য আবেদন করে।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, EPS এ আসা প্রায় অধিকাংশ শ্রমিকই গড়ে প্রতিদিন ১ থেকে ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে বেশী কাজ করে।কিন্তু এর হিসাব নিতে গেলে অমানুষিক ভাবে কাজ চাপিয়ে দেয়া হয়।
অনেকের ই হয়তো যানা নেই যে,কোরিয়ার শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্য অথবা অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের চেয়ে অনেক বেশী শারিরিক পরিশ্রম করে থাকে কিন্তু বেশী বেতনের আশায় তারা সব কিছুই মাথা পেতে নেয়।
দ্বিতীয়ত, EPS আসার পর যখন একজন শ্রমিক তার স্বদেশী ভাইয়ের কাছে সাহায্য কামনা করে, সেই সুযোগ কে কাজে লাগায় কোরিয়াতে বিয়ে করা নামকাওয়াস্তে কার্ডধারী কিছু বাংলাদেশী কুলাঙ্গার। যারা কাজ পরিবর্তন করে ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে অসহায় নবাগত লোকটির কাছ থেকে সবর্স্ব কেড়ে নিতে সামান্য দ্বিধা বোধ করে না।
তৃতীয়ত,কোরিয়ার সামালোচিত EPS আইনে শ্রমিকদের নানা বণ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। একই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ভাগ্য বিরম্বনায় কেউ পরছে মৎস ভিসায় গভীর সমুদ্রে,আবার কেউ গেল দূর্গমপাহাড়ের উপড়ে জমি চাষ করতে কিংবা দূর্গন্ধময় চমরার ট্যনারী অথবা লোহা ভাংগার কাজে,আবার ভাগ্য ভালো হলে ২/১ জনের কপালে কম্পিউটার/মোবাইল ফা্ক্টরিতে কাজ করার নজির ও রয়েছে।
উল্লেখ্য, নেপালীদেরও গভীর সমুদ্রে মৎস শিকারে পাঠানো হয়, যদি ও তারা সমুদ্রে সাথে পরিচিত নয়।
সামালোচিত EPS আইনে কেউ চাইলেও ক্যাটাগরী পরিবর্তন করতে পারে না,যার ফলে মৎস,কৃষি ভিসায় আগত শ্রমিকরা অমানুষিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কয়েক দিন পরেই ভিসা নষ্ট করে অবৈধ অভিবাসী হয়ে যাচ্ছে।ক্যাটাগরী থেকেও কেউ তিন বারের বেশী কাজ পরিবর্তন করতে পারে না।
এবার আসি অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের কথায়,এখানে যারা অবৈধ ভাবে কাজ করছে তারা সাধারনত দালালদের মাধ্যমে ৮-১৪ লাখ টাকা খরচ করে শুধু মাত্র কোরিয়া ঢুকিয়ে দেয়ার চুক্তিতে আসে।তারা সাধারনত ভিজিট/ বিজনেস ভিসায় আসে,যার মেয়াদ সাধারনত ১-৩ মাস পর্যন্ত হয়।এই সময় পার হেলে এক মুহুর্তের ও গ্যারান্টি নেই।যখন তখন ইমিগ্রেশন পুলিশ এর হাতে ধরা পরার সম্ভাবনা রয়েছে। এদের ভিসা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা অনেকেই একে আল্লাহ ভিসা বলে সম্ভাধন করে।
উল্লেখ্য, কোরিয়াতে ইমেগ্রেশন পুলিশ নামে অবৈধ শ্রমিক ধরার একটি বিশেষ বাহিনী রয়েছে, যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে অবৈধ শ্রমিক ধরা।
এই অবৈধ শ্রমিকরা কেরিয়াতে সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার।
প্রথমত,অনেক ক্ষেত্রেই মাসের পর মাস কাজ করিয়ে বেতন না দিয়ে ঘোরাতে থাকে,বেতনের জন্য চাপ দিলে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।
দ্বিতীয়ত,কোরিয়াতে কার্ড ছাড়া, চিকিৎসা করা কস্টসাধ্য, যার ফলে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় ভূগে মৃত্যু বরন করছে।
তৃতীয়ত,আবার সেই স্বদেশী কুলাঙ্গারদের সমস্যা,অধিকাংশ এলাকায় এরা মাসিক হারে চাদা আদায় করে।না দিলে কিংবা প্রতিবাদ করলে কয়েক দিনের মধ্যে ইমেগ্রেশন পুলিশের কাছে তথ্য দিয়ে ধরিয়ে দেয়া হয়।
এছাড়া, মালিকদের অমানবিক খাটানো,অতিরিক্ত খাটানো,অস্বাস্থ্যকর বাস স্থান, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ, এসব নিয়েই কাটছে দক্ষিন কোরিয়া প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন