রং বে রং ; জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় ।
লিখেছেন লিখেছেন হুরপরী ১৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:৩৮:৩৯ দুপুর
ফরহাদ মজহার: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।। ১৯ পৌষ, ১৩৯৯ শ্যামলী।
ভারতে কতিপয় সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভারতের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভা...ঙার পর, আগে নয়। ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও তার সহযোগী শাসক শ্রেণী বাবরি মসজিদ ভাঙা হোক সেটা চেয়েছিল কিনা বলা মুশকিল, তবে দৃঢ়ভাবে ভাঙন ঠেকিয়ে হিন্দুদের তারা রুষ্ট করতে চায়নি। রুষ্ট করলে আগামী নির্বাচনে হিন্দুদের ভোট তারা হারাবে। বাবরি মসজিদ ভাঙা ও ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের ভূমিকার মধ্য দিয়ে একটি দিক স্পষ্ট হচ্ছে: ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতি ‘গণতন্ত্রকেও রক্ষা করতে পারে না। ভোটের একটা নিজস্ব গতিপ্রতিক্রিয়া আছে, যাদের হাতে ভোট আছে তারা যতোই অসচেতন, সাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্রবিরোধী হোক তাদের চটানো যাবে না। ‘গণতন্ত্র’ কথাটি আমি এখানে ঊদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করছি এ কারণে যে এই গণতন্ত্র দিয়ে প্রধানত ভোটাভুটিকেই বোঝানো হয়। অর্থাৎ এই ধারণায় প্রক্রিয়াটাই মুখ্য, গণতন্ত্রের আসল মর্মটা নয়।
কেন শুধু প্রক্রিয়াটাই ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে মুখ্য হলো, আসলটা নয়? গণতন্ত্রের আসল মর্মশাসটা আমরা ধরি না বা ধলতে পারি না কেন? এর কারণ হলো আমরা ছিলাম দুই শ বছর ব্রিটিশদের গোলাম। আমরা ছিলাম দাস ওরা মনিব। যখন দেশ চালানোর দায় আমাদের ওপর ন্যস্ত হলো তখন আমরা মনিবের বহিরঙ্গ, আচার আচরণ, ওঠাবসা, ইত্যাদি নকল করলাম। আমরা ভাবলাম বাইরের প্রক্রিয়াটাই হলো আসল, ওটাই নকল করতে হবে। ফলে ভোটাভুটি, পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা, সরকার গঠন, ইত্যাদির ভড়ংটা আমরা নিলাম। কিন্তু গণতন্ত্র তো তড়ং নয়। তার একটা সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও নীতিগত ভিত্তি আছে। ইয়োরোপের নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেখানকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রবক্তা যে বুর্জোয়া শ্রেণী তার গড়ে ওঠার, তার শিক্ষা ব্যবস্থার, আচার আচরণ ও সংস্কৃতির একটা বিবর্তন আছে। তাকে রক্তক্ষয়ী ভাবে সামন্ত শ্রেণীর সঙ্গে লড়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। আমাদের শাসক শ্রেণী আর যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতন্ত্র নিয়ে লাফঝাঁপ করে তার সেই ইতিহাস নেই। সে কারণে গণতন্ত্র যেখানে ইউরোপের মর্মের মধ্যে ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় স্থান করে নিয়েছে, সেটা আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের শাসক ও শোষক শ্রেণী এবং তাদের সমর্থকরা মর্মে মর্মে সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎপদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল থেকে গেছে।
এই দিকটা যদি আমরা বুঝি তাহলে ভারতের ঘটনা থেকে আরেকটি শিক্ষা লাভ করতে হবে আমাদের। সেটা হলো, সংবিধানে লিখে রেখে, সাংবিধানিকভাবে বা আইনি পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা যায় না। এই শিক্ষাটা আমরা বাংলাদেশ গড়ার সময় লিখিনি। যেহেতু অন্যের দোষ আমরা সহজে ধরতে পারি এবং উল্লাস বোধ করি, ফলে ভারতের অবস্থা দেখে কিছুটা যদি আমরা শিখি। ইউরোপ বা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সংবিধানগুলো নকল করে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সংবিধানি তৈরি করলেই একটি সমাজ ও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। সংবিধান দিয়ে গণতন্ত্র গড়ার চেষ্টা বাংলাদেশে বিফল হয়েছে তার জয়ের পরপরই। অবশ্য ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল সেটুকুও রক্ষা করতে পারিনি আমরা। ভারতে গণতন্ত্র সংবিধানে, এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও দেখা যাচ্ছে যে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করে নেওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে নালিশ জানানোর ও বিচার পাওয়ার সুযোগ আছে। তবুও সমাজের মর্মে গণতন্ত্র শেকড় লাভ করেনি। অর্থাৎ বহিরঙ্গেই থেকে গেছে, থেকে গেছে বাইরে বাইরে। এর ফলে ভারতের কোনো উপকার হয়নি, সে কথা আমি বলছি না। বা বহিরঙ্গ নকল করলেই সেটা খারাপ এটাও আমার থিসিস নয়। আমরা কোনো কিছু শেখা যখন শুরু করি তখন অনুকরণ করে শেখাটা অন্যায় নয় মোটেও। কথা হচ্ছে, মর্মে যদি গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা না ঘটে, তাহলে বহিরঙ্গের ভড়ং দিয়ে গণতন্ত্র অর্জন করা যাবে না। ভোটাভুটির প্রক্রিয়া চালু করে নয়, সংবিদান দিয়েও নয়। গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর দুর্বলতা এবং অসততার জন্য আমরা ডিগবাজি খেয়েছি আগে। ভারত খাচ্ছে একটু পরে এই হলো তফাৎ। ভেতরে না থাকলে বাইরে থেকে নকল করে কোনো কিছুর প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ভারত তার অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িকতার মূলোচ্ছেদ করতে পারেনি, ভেতরে যা নষ্ট হয়ে থাকে তাকে বাইরে থেকে দেখা যায় না এবং ধরাও যায় না। সাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারী হিসেবে দেখা যাচ্ছে শুধু সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোকে। সেই দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখানেও আমাদের শেখার আছে। সেটা হলো এই, গণতন্ত্র বলতে যদি আমরা বুঝি যেকোনো মত, আদর্শ, চিন্তা ইত্যাদি প্রচার করার অধিকার তাহলে ভারত সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে সেই দলগুলোর যারা সমর্থক তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে। এতোদিন যদি তাদের সেই অধিকার দেওয়া হয়ে থাকে এখন তা হরণ করে নিতে হচ্ছে কেন? এখান থেকে ভারতীয় রাষ্ট্রের স্ববিরোধীতা খুব ন্যাংটোভাবে ধরা পড়ছে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে দার্শনিক ও নীতিগত ভিত্তি তার গোড়াটাই দেখা যাচ্ছে এখানে নড়বড়ে। সেই দার্শনিক ও নীতিগত ভিত্তিটা হচ্ছে এইরকম: গণতন্ত্র মানে যে কোনো মত, আদর্শ ইত্যাদির প্রচার ও তার ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল করার অধিকার। এখন দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে যেকোনো মত, আদর্শের প্রচার ও তার ভিত্তিতে ক্ষমতা দখল করার অধিকার বহাল রাখা যায় না। কারণ যারা গণতন্ত্রী নয়, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তাদের মত প্রচার ও দল করার অধিকার দেওয়া হলে গণতন্ত্রের খোদ ভিত্তিটাই তারা উপড়ে ফেলতে সক্ষম। অতএব এদের বিরুদ্ধে সাফ সাফ একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ দরকার। যারা গণতন্ত্রী ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের জন্য গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার, আর যারা গণতন্ত্রের দুষমন আর অগণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্রও বল প্রয়াগ করে।
ভারতে সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ করার ঘটনাটি সে কারণে দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ। এর রাজনৈতিক-দার্শনিক তাৎপর্য দারুণ। সে বিষয়ে অল্প কিছু কথা বলার আছে, বলছি পরে। তার আগে যে কথা বলার জন্য কলম ধরা সেটা বলে রাখা দরকার। ভারতে সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধকরণের এই উদাহরণ একটি নীতিগত অবস্থানকে দৃঢ় করে। সেটা হলো, জামায়াতে ইসলামীসহ যেকোনো রাজনৈতিক দল, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের কখনোই কোনো স্থান দেওয়া উচিত নয়। কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো সুযোগ করে দেওয়া চলবে না। সেটা হবে বিপজ্জনক। মূল কথা হচ্ছে গণতন্ত্র মানে সকলের অধিকার নয়, সকল মত ও পথের অধিকার গণতন্ত্র স্বীকার করে না। কারণ তখন গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র বিরোধীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফলতে পারে।
গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তি সার্বভৌম, ব্যক্তির সার্বভৌম ইচ্ছার অভিপ্রকাশ হবে রাষ্ট্র। কোনো সমাজে যদি ব্যক্তি নিজের এই সার্বভৌম সত্তাকে উপলব্ধি করতে না পারে এবং সেই উপলব্ধির জন্য জরুরি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শর্ত যদি গরহাজির থাকে সেই সমাজে ভোটাভুটির প্রক্রিয়া চালু করে কিংবা সংবিধানে বানিয়ে, আইন তৈরি করে, কোর্টকাছারি আদালত খাটিয়ে গণতন্ত্র হয় না, হবে না। সেক্ষেত্রে কর্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্রের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক শর্তগুলো তৈরি করা।
গণতন্ত্রের দার্শনিক ও নীতিগত ভিত্তিটাকে যদি আমরা উপলব্ধি নাও করি তবুও শেষের যুক্তিটা এখানে খুবই সহজ এবং পরিক্ষার। ধরা যাক গণতন্ত্রকে আমরা স্রেফ একটা নিয়ম বা প্রক্রিয়ার অধিক ভাবতে শিখিনি। ধরা যাক আমরা শুধু এতোটুকুই বুঝতে পারি যে গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটা নিয়ম বা প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শাসক নির্বাচন করি এবং সেই শাসকের কর্তব্য হচ্ছে সেই নিয়মটিকে রক্ষা করা যাতে একটা সময়ের ব্যবধানে একই নিয়মে আমরা নতুন শাসক নির্বাচন করতে পারি। এখন কেউ যদি পরিষ্কার বলে যে আমরা এই নিয়মে শাসক হবো ঠিকই, কিন্তু শাসক হয়েই আমরা এই নিয়ম আর রাখবো না। কেন? কারণ এই ধরনের নিয়ম, প্রক্রিয়া বা সংবিদান মানুষের তৈরি। মানুষের তৈরি বিধান দ্বারা রাষ্ট্র ও সমাজ চলতে পারে না। রাষ্ট্র ও সমাজকে চলতে হবে আল্লাহর তৈরি বিধান দ্বারা, কোরআন সুন্নাহর ভিতিতে। তাহলে কি হবে এখানে? একটা নিয়ম বা প্রক্রিয়ার সুযোগ গ্রহণ করে সেই নিয়ম বা প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার জন্য যে সকল শক্তি তৎপর তাদেরকে কি সেই সুযোগ আমরা দেব? যদি আসলে এই ধরনের নিয়ম বা প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা ও চর্চার মাধ্যমে সেই নিয়ম আর প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে তো কিছুতেই জামায়াতে ইসলামী বা নিয়ম ধ্বংসকারী কোনো শক্তিকে আমরা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দিতে পারি না। মূলত এই সকল শক্তিকে দমন ও ধ্বংস না করলে এই ধরনের কোনো নিয়ম বা প্রক্রিয়া কোনো দিনই প্রবর্তন করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ গণতন্ত্রের এই সীমিত সংজ্ঞার পরিমণ্ডলেও দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নিয়মনীতি প্রবর্তনের খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ।
অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে ঠিকই তো, আল্লার বিধানেই তো মানুষ চলবে, মানুষের আবার বিধান কিসের? ঠিক আছে। কোথায় আছে সেই বিধান? সেটা আছে কোরআনে, আল্লাহর কালামে। আর কোথায় আছে? আছে হাদিসে, নবীর কথায়, ‘তাঁর জীবন যাপনে। কিন্তু সেই কালাম, কথা এবং জীবনযাপন ব্যাখ্যা করে আমাদের সময়কালে গ্রহণযোগ্য বিধান কে দেবে? জামায়াতে ইসলামী বলছে সেটা দেবে তারা। কোরআন সম্পর্কে তাদের ব্যাখাই বিধান। তাদের কথা মতো আমাদের চলতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রের নীতি, কাঠামো, আইন কি হবে তার ব্যাখ্যা দেবে জামায়াতে ইসলামী। সেটাই আল্লার বিধান আকারে আমাদের মানতে হবে। নবীর কথা এবং জীবনযাপনের ব্যাখ্যাও দেবে তারা। ওদের ব্যাখ্যাই হচ্ছে, আল্লাহর বিধান। দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী নিজেই আসলে আল্লাহর স্থান দখল করে নিতে চাইছে। এখানেই হলো জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক। জামায়াত গণতন্ত্রেরই শুধু শত্র“ নয়, জামায়াত ইসলামেরও শত্র“। জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান খোলামেলাভাবে শেরেকী। আল্লাহর কালামকে ব্যাখ্যা করার স্বঘোষিত কর্তৃত্ব যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাহর সঙ্গে শেরেকী করে। ইসলামের দৃষ্টিতে তারা আসলে কাফের।
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ফাণ্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদের এখানেই হচ্ছে মৌলিক ফারাক। বাংলাদেশে ইরানের বিপ্লবের পর ওকে হেয় করার জন্য পশ্চিমে মৌলবাদী ইসলাম কথাটার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। কিছুটা আমাদের অজ্ঞতায় এবং কিছুটা পশ্চিমের বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ইসলাম হচ্ছে ট বর্বর ধর্ম, মূসলমান মানেই একটি পশ্চাৎপদ দাঁড়ি টুপি পাগড়ি পড়া, মধ্যযুগীয় চরিত্র - পশ্চিমের বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এটাই ক্রমাগত প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আসলে পশ্চিমের এই বর্ণবাদিতা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। আয়াতুল্লাহ খোমেনী বা হিযবুল্লাহ ধরনের মৌলবাদ নাকচ করছে পশ্চিমেক আগাগোড়া। তারা আধুনিক বিশ্বের আলোকে ইসলামকে গ্রহণযোগ্যভাবে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার দায় কাঁধে নেয়নি। তাদের সাধনা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামকে আধুনিক করে তোলা নয়, বরং ইসলামকে বিশুদ্ধভাবে আত্মস্থ করা। অর্থাৎ আল্লাহর কালামে বা ছহি হাদিসে ইসলাম যেভাবে আছে সেই মূল ধারাকেই চিহ্নিত করা ও গ্রহণ করা। মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, পশ্চিমা সভ্যতার সকল ধরন ও অভিপ্রকাশের বিরুদ্ধে তার জেহাদ। সেই সভ্যতার ধ্বংস ছাড়া ইসলামের মুক্তি নেই বলে মৌলবাদী ইসলাম বিশ্বাস করে। মৌলবাদী ইসলামের মূল প্রবণতা ইসলামের ব্যাখ্যা নয়, আল্লাহর ওপর কর্তৃত্ব করা নয়। বরং সেই আদি বাক্য, কালাম বা বিধানে প্রত্যাবর্তন করা যা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে বলে তারা বিশ্বাস করে।
জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদের এই আকাশ পাতাল তফাৎ খেয়াল রাখলেই আমরা বুঝব কেন জামায়াতে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী আর কেন মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও বিশুদ্ধ ইসলামের প্রবক্তা। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়বার নৈতিক ও মানসিক শক্তি অর্জনের জন্যই মৌলবাদ বিশুদ্ধ ইসলামের কাছে তার তার্কিক ও মতাদর্শিক ভিত্তি অন্বেষণ করে, কারণ পশ্চিমের কাছ থেকে সে কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নয় আর সাম্রাজ্যবাদের দোসর হওয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই ইসলামের বিকৃতি সাধন করে কারণ তার কাজ হচ্ছে ইসলামের ছুতোয় সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও আগ্রাসনের প্রসার ঘটানো। মৌলবাদ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফিরে যেতে চায় আইয়ামে জাহেলীয়া যুগের অল্প পরের ইসলামী যুগে; নবীর জীবন, শিক্ষা ও কথার কালপর্বে। আর জামায়াতে ইসলামী চায় সেই যুগটাকেই আধুনিক লেবাস পরিয়ে বর্তমান কালের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে যাতে সাম্রাজ্যবাদের খোদ চেহারাটা আমরা আর বুঝতে না পারি।
যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামকে কোনো স্থান আমরা না দেই তাহলে কি মৌলবাদকে আমরা স্থান দেব? যদি জামায়াতে ইসলামীকে আমরা নিষিদ্ধ করি তাহলে কি মৌলবাদকেও নিষিদ্ধ করতে হবে না? মৌলবাদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা না করার প্রশ্ন সবসময় খাটবে না। কারণ ইসলামী মৌলবাদ বিশ্বাস করে এবং বলে যে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ একটি পশ্চিমা জিনিস। মৌলবাদী ইসলাম কখনোই ব্যক্তিকে সমষ্টির ওপরে স্থান দেয়নি। অর্থাৎ ইসলাম ব্যক্তিতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। যীশু নিজে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে সমস্ত মানবজাতির মুক্তি এনেছেন। খ্রিস্ট ধর্মে ক্রুশে কষ্ট পাওয়া ব্যক্তি যীশুর এই ভাবমূর্তির ওপর গড়ে ওঠছে, ব্যক্তিতন্ত্রের নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি। পুঁজিতন্ত্র এর বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে ও তার প্রসার ঘটিয়েছে। মৌলবাদী ইসলাম খ্রিস্টধর্ম, ব্যক্তিতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র এই তিনেরই ঘোর বিরোধী। মৌলবাদী ইসলাম ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুর কিন্তু সমষ্টির স্বার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ। মৌলবাদী ইসলাম যেহেতু খ্রিস্টধর্মের ঔরসজাত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না সে কারণে তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সে অংশগ্রহণও করে না। তার ক্ষমতা দখলের পথটা হচ্ছে বিপ্লবী পথ। কিন্তু জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, এবং নিজের একটা স্থান করে নিতে চায়। জামায়াতকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া বা না দেওয়া কিংবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবহায় স্থান দেওয়া বা না-দেওয়ার প্রশ্ন আছে, মৌলবাদী ইসলামের ক্ষেত্রে সেটা নেই।
অনেকে দাবি করতে পারেন যে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে জামায়াতকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। জামায়াতে ইসলামী যদি কোনো রাজনৈতিক দল না হতো তাহলে সেটা একটা পথ হতে পারত। কারণ সমাজে আরো বহু গণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা, চেতনা, মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশ আছে। সেগুলোকে যেভাবে মুক্তচিন্তার চর্চা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি আমরা সেভাবে জামায়াতকেও মোকাবিলা করা যেত। কিন্তু জামায়াত ক্ষমতা চায়; কারণ জামায়াত জানে একমাত্র ক্ষমতা দিয়েই সে তার অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। জামায়াত যেখানে ক্ষমতা দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, সেখানে ক্ষমতা লাভের জন্য জামায়াতকে অবস্থা ও শর্ত তৈরি করে দেওয়াটা হলো স্রেফ আত্মহত্যার সামিল। জনমত সৃষ্টি করে জামায়াতকে প্রতিরোধ করার ধারণা সে কারণে মারাত্মক ভুল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে জামায়াতের বিরুদ্ধে জনমত আমাদের সৃষ্টি করতে হবে না। হবে। কিন্তু কি ধরনের জনমত সৃষ্টি করা হবে? যদি জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করতে চায় তাহলে সেই রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে কোনো স্থান দেওয়া যাবে না এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জামায়াতে ইসলামীসহ সকল অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে। জনগণের কাছে। অর্থাৎ জনমত সৃষ্টি করতে হবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য, শুধু জামায়াতী চিন্তাধারার বিরোধিতা করার জন্য নয়।
ভারতে সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ করার ঘটনাটির রাজনৈতিক -দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে যে কথা বলতে চেয়েছি সেটা এখন বলি। মার্কস, লেনিন আর তাঁদের অনুসারী কমিউনিস্টদের একনায়কতন্ত্রবাদিতার পক্ষে নয়। কিন্তু এর পেছনে কিছু কথা আছে। কমিউনিস্টদের বক্তব্য হলো, ক্ষমতার চরিত্রই হচ্ছে এই যে তার উদ্ভব ও প্রয়োগ একনায়তান্ত্রিক হতে বাধ্য। সেটা যেকোনো শ্রেণীর ক্ষমতাই হোক না কেন। অগণতান্ত্রিক শক্তি যে অগণতান্ত্রিক সেটা আমরা জানি। কিন্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের ক্ষমতাও যেমন অগণতান্ত্রিক হতে বাধ্য তেমনি শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে যে বৈপ্লবিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় সেটাও একনায়তান্ত্রিকই হবে। ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক, কৃষক মহেনতি মানুষের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সকল প্রতিক্রিয়াশীর ও অগণতান্ত্রিক শ্রেণীর সঙ্গে জোট বেঁধে যে অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা এতদিন প্রয়োগ করে আসছিল তাকে ধরা যাচ্ছিল না, গণতন্ত্রের লেবাসে সেটা ঢাকা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া শ্রেণী এখন যখন দেখছে যে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তাদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে তখন তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে তারা। অর্থাৎ আঁতাত ভেঙে তাদের শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তারা দেরি করেনি। ক্ষমতার চরিত্র সম্পর্কে একনায়কতান্ত্রিকতার যে তত্ত মার্কস এবং লেনিন পেশ করেছিলেন, সেটাই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এখানে প্রমাণিত হলো। কমিউনিজমের এই কঠিন সময়ে কেউই আর একনায়তন্ত্র সংক্রান্ত তত্ত নিয়ে কথাবার্তা বলতে চায় না। ভারতের ঘটনা থেকে বোঝা যায় ক্ষমতার লড়াই ও শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর সংঘাত বোঝার জন্য একনায়কতান্ত্রিকতার তত্ত্বটা খুবই জরুরি।
জামায়াতে ইসলামী ও সকল অগণতান্ত্রিক শ্রেণী ও শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক শ্রেণীর মৈত্রীর ভিত্তিতে বৈপ্লবিক একনায়তন্ত্রই এখন আমাদের দরকার। তার মানে হচ্ছে গণতন্ত্র শুধু গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও তার চর্চার নিষ্ঠাবান শ্রেণীর জন্য, আর অগণতান্ত্রিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দরকার একনায়কতন্ত্র।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বা, অন্যভাবে বললে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তরের একটা চরিত্রলক্ষণ হবে এই যে সেই রাষ্ট্রে এবং সমাজে কোনো অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের সুযোগ থাকবে না।
ভারতের ঘটনা থেকে এই শিক্ষা লাভ করলে গণতন্ত্রীরা উপকৃত হবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন