৭২ এর চশমা ও চেতনার ধর্মযাজকদের আবির্ভাব
লিখেছেন লিখেছেন তারিক আলাম ১৪ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:০৭:০৬ সকাল
২০১১ সালে যখন বাংলাদেশে গেলাম তখন দেখলাম আমার কিছু পরিচিত মানুষ ৪৭ পূর্বের চেতনা বুকে ধারণ করে ৭২ এর ধর্মনিরপক্ষ (!) সংবিধানের চশমা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথেমে এটাকে একটা নতুন ফ্যাশন মনে করে মজাই পেলাম। কিন্তু কিছু আলাপ আলোচনা করার পর ৭২-এর চশমা চোখে দেবার সাথে সাথে আতঙ্কবোধ করলাম। ৪৭ -এর পূর্বের চেতনার ভিত্তিতে তৈরীকরা ৭২-এর চশমার এক চোখে ইসলাম ধর্মকে রাজাকার ও পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদ দিয়ে মুড়ে দিছে আর অন্য চোখে ইসলাম ধর্ম বিরোধী কর্মকান্ড ও ভারতীয় বাঙালী জাতীয়তাবাদের সংস্কৃতিকে মুক্ত চিন্তা ও আধুনিকতার কাগজে মুড়ে রেখেছে। ভেবে অবাক হলাম যে বাংলাদেশের এ কোন সরকারের রাজত্ব চলছ। শেখ মুজিবর রহমান জাতিসংঘ ও ওয়াইসির সদস্যপদ লাভ, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনস্থাপন মাধ্যমে এই ৭২ এর চশমা ৭৪ সালেই খুলে ফেলেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর সময় এই চশমার ব্যবহার করার সাহস কাহারও ছিলনা। অথচ ৪০ বছর পর আজ বর্তমান সরকার সংবিধানে ইসলাম ধর্মকে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করে ৭২ এর সংবিধানের কাছাকাছি ফিরে যাবার সাথে সাথে ডিজিটাল ব্যানারে এই ৭২ এর চশমার নীতির ওপর ভিত্তি করে একের পর এক অনলাইন ও অফলাইন ডিজিটাল মিডিয়া তৈরী হতে থাকলো। গত ৫ বছরে বিভিন্ন ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই চশমার প্রচার এবং প্রসার চলতে থাকলো। আর শাহবাগ আন্দোলনের সময় এই চশমার লক্ষ লক্ষ কপি তরুণ প্রজন্মের কাছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিলিবল্টন করা হলো।
৭২-এর চশমার চেতনা অর্থাৎ হিন্দু সংস্কৃতি ও নাস্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মোড়ক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু নাস্তিক ও হিন্দু সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষ ও তাদের সহযোগিতায় এক শ্রেনীর মিডিয়া জোরেশোরে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ৭২-এর চশমার চেতনার কোন সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে অত্যাচারী জুলুমবাজ পাক শাসকের বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেনীর মুক্তি সংগ্রাম বোঝে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈসম্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বোঝে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা থেকে বেচে থাকার সশস্ত্র সংগ্রাম বোঝে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কখনই ইসলাম ধর্ম বিরোধী কর্মকান্ড বোঝে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে বাংলাদেশের বাঙালী বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ বোঝে, সেটা কখনও ভারতীয় বাঙালী জাতীয়তাবাদ বুঝায় না।
আজ এই চশমা পরে চেতনাধারীরা বাংলাদেশের মানুষকে বিভক্ত করছে। এই চশমার চেতনা প্রয়োগের ফলে গত ৪ বছরে নিহত হয়েছে শত শত লোক, আহত, পঙ্গু, নির্যাতিত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, মানবেতরে জীবন কাটছে বহু মানুষ, কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছে। এটা অত্যান্ত দুঃখের বিষয় যে কাগজে ৭২ এর সংবিধানে ফেরা গেলেও চেতনায় যে ৪২ বা ৬৬ বছর পেছনে যাওয়া যায় না, এই সহজ সত্যকে আমাদের এক শ্রেনীর সুশীল, বুদ্ধিজীবী, ও রাজনীতিবিদ উপলব্ধি করতে অক্ষম। তারা ৪৭ এর পূর্বের চেতনা বুকে লালন করে ৭২এর চশমা চোখে দিয়ে দিকভ্রান্তর মত বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনও গোলটেবিলে, কখনও টকশোতে, কখনও মাইক হাতে চিত্কার করছেন। এদের কথাবার্তা এখন এমন উগ্রতায় রূপ নিয়েছে যে, কেই ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করলে সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বলে ঘোষণা দিচ্ছে। আবার কিছুদিন আগে একজনতো বলেই বসলো ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে চললে সে আর বাঙালী হতে পারেনা।
এদের সম্মন্ধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এদের চেতনা স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও উন্নয়ন নয়, এদের চেতনা একটাই আর তাহলো নিজেদের তৈরিকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধর্ম বানায়ে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদেরকে ধর্মান্তরিত করা। এরা হলো নব্য ধর্মযাজক আর এদের কেবলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। এরা কখনো নিজেরা গিয়ে আবার কখনো পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুরোহিত ডেকে এনে চেতনার মোড়কে পুজো-প্রার্থনার দীক্ষা নেয়। এরা নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করে, অথচ এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধর্ম বানায়ে মুসলমানদের ইসলাম ধর্মকে আঘাত করে এক নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছে। এই নতুন ধর্মযাজক চেতনাধারীদের কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে উল্লেখ করলাম, আপনারাও সংযোজন করুন-
১) এদের ভিতর যদি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকত তবে এরা সকলকে সাথে নিয়ে দেশ গড়ার কথা বলত, অথচ এরা দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের কথা বলে বিভক্ত করে।
২) এদের ভিতর যদি মুক্তিযুদ্ধের বৈসম্মের চেতনায় উজ্জীবিত থাকত তবে এরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈসম্মের বিরুদ্ধে কথা বলত, অথচ এরা ইসলাম ধর্মের রীতিনীতির বিরুদ্ধে কথা বলে।
৩) এদের মস্তিষ্কে যদি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের বীজ প্রবেশ করত তবে এরা গঠনমূলক সৃজনশীল সমাজ গড়ার কথা বলত, অথচ এরা বাঙালী সংস্কৃতির মোড়কে হিন্দু সংস্কৃতি উদযাপন করে আধুনিকতা প্রকাশ করে।
৪) এরা যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের মর্ম বুঝতো তবে এরা সমাজে নারীদের প্রতি যে নির্যাতন হচ্ছে সেটা নিয়ে সোচ্চার হত, অথচ এরা ইসলামে নারীদের আবদ্ধ করে রেখেছে সেটা প্রমান করতে অস্থির হয়ে পরে।
৫) এদের ভিতর যদি মুক্তিযুদ্ধের অন্যায়-অবিচারের চেতনা থাকত তবে এরা সমাজে খুন, ধর্ষণ, অন্যায়-অবিচার দেখলে প্রতিবাদ করত, অথচ এরা মসজিদ -মাদ্রাসা থেকে জঙ্গি তৈরী হচ্ছে ফতোয়া দিয়ে সেটা দমন বা নজরদারি করতে বলে।
৬) এদের ভিতর যদি মুক্তিযুদ্ধের হত্যাকান্ডের বিরোধী চেতনা থাকত তবে এরা সমাজের কোনো হত্যাকান্ড দেখলে প্রতিবাদ করত, অথচ এরা ২৮ ফেব্রুয়ারী ও ৫ মে র বহু মানুষের হত্যাকান্ড দেখে প্রতিবাদ তো দুরের কথা, তৃপ্ত বোধ করে।
৭) এরা যদি মুক্তিযুদ্ধের মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডকে ঘৃনা করত তাহলে এরা যে কোনো মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত, অথচ এরা তাদের আদর্শের বিপরীতের মানুষের উপর যখন মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড হয় তখন এটা সঠিক সেটা প্রমান করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
বিষয়: রাজনীতি
২০০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন