জনাব মনমোহন সিং এর কাছে আবদুল্লাহ বাংলাদেশীর খোলা চিঠি
লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লাহ বাংলাদেশী ২৯ নভেম্বর, ২০১৩, ০৫:২৯:৫২ বিকাল
জনাব মনমোহন সিং,
আপনার উপর আমাদের সৃষ্টিকর্তার শান্তি বর্ষিত হোক। আশা করি, ভালো আছেন। আমি একজন বাংলাদেশী। খুব উদ্বেগ নিয়ে এই চিঠি লিখতে হোল কারণ এতে আপনার দেশ ও আমার দেশের মানুষের সুখ-শান্তির প্রশ্ন জড়িত। আপনি একজন ভারতীয় হিসেবে অবশ্যই চাইবেন যেন আপনার দেশের মানুষ শান্তিতে থাকে, তেমনি একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমিও চাইবো আমাদের দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। আপনি আপনার পররাষ্ট্র দপ্তর ও বৈদেশিক গোয়েন্দা দপ্তরের মাধ্যমে অবগত আছেন যে বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে; এবং এই ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশে প্রায়ই হয়ে থাকে, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে। বর্তমান যুগের পররাষ্ট্রনীতির ফ্যাশন হচ্ছে সবল রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রের উপর বল প্রয়োগ/চাপ প্রয়োগ করে। আমি এখানে বল প্রয়োগ ও চাপ প্রয়োগ শব্দ দুটোয় পার্থক্য করছি। আমি চাপ প্রয়োগ মানে “মৌখিক ভাবে কোন কাজ করতে বলা” বুঝাচ্ছি আর বল প্রয়োগ মানে “সরাসরি হস্তক্ষেপ করা” বুঝাচ্ছি।
এবার আমি আপনাকে বর্তমান বাংলাদেশের মানুষদের ব্যাপারে কিছু তথ্য দিতে চাই। একথা অনস্বীকার্য যে “বৃহৎ জনগোষ্ঠী একটি দেশের বোঝা” পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এটা যতই প্রচার করুক না কেন, ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে বৃহৎ জনসংখ্যা কখনই বোঝা হতে পারে না। সার্বিকভাবে জনসংখ্যা সবসময় একটা দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ঠিক এই কারণেই চীন এবং আপনার দেশ ভারত আজ বিশ্বে এতো গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে।
জনাব মনমোহন সিং, জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এই বিশ্বে অষ্টম স্থান দখল করেছে। যদিও এই দেশের ভুমি অনেক কম কিন্তু এই দেশের প্রায় সব মানুষই অনেক বেশী পরিশ্রমী। বাংলাদেশ পুরোপুরিই চাষের জন্য উর্বর ভুমি। আপনার পররাষ্ট্র দপ্তর ও বৈদেশিক গোয়েন্দা দপ্তর বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনাদের যে তথ্যগুলো দেয় সেগুলো শহর কেন্দ্রিক কিছু মানুষ ও পরিবেশের তথ্য, কিন্তু বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে, তাদের চিন্তা চেতনা, তাদের পরিশ্রম, তাদের ভাবধারার ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য আপনাদের কাছে নেই এটা আমি একেবারেই নিশ্চিত। তাছাড়া যেসব মানুষ শহরে থাকে তাদের বেশীরভাগের মন কিন্তু গ্রামেই পড়ে থাকে।
জনাব সিং, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশী শিক্ষিত, অনেক বেশী জ্ঞানী। এদেশের প্রায় সবাই মুসলিম। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম হওয়ার কারণে আমাদের পূর্বপুরুষদের শিক্ষা ও চাকুরী থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো। ফলে বিরাট সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী একেবারেই নিরক্ষর থেকে যায় (আল্লাহ তায়ালা যেন তাদের জান্নাত দান করেন)। তাই তৎকালীন সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যেমন জুলুম(অত্যাচার) করা হয়েছিলো, এই একবিংশ শতাব্দীতে তাদের বর্তমান প্রজন্মের উপর তা প্রয়োগ করা যাবে না।
আপনারা যদি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের তুলনা করেন তাহলেও আপনাদের ভুল হয়ে যাবে। তখনও বাংলাদেশের শিক্ষার হার এতো বেশী ছিল না, অর্থনীতি এতো সমৃদ্ধ ছিল না। এখন বাংলাদেশে প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আসে। প্রচুর প্রবাসী বাংলাদেশীগণ দেশে টাকা পাঠান, এদেশের গার্মেন্টস শিল্প অচিরেই বিশ্বে প্রথম হতে যাচ্ছে, এদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ বিদেশের ভালো ভালো স্থানে চাকুরী ও ব্যবসা করছে, এদেশের সামরিক বাহিনী বিশ্বে শান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভুমিকা রাখছে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনি হয়তো জানেন, গত বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশের অর্থনীতির কোন ক্ষতি হয়নি; কারণ, এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনার দেশের আয় বৈষম্য বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশী। বাংলাদেশের শিশু মৃত্যুর হার ভারতের চেয়ে কম, মাতৃমৃত্যুর হার কম, ভারতের তুলনায় নারী শিশু হত্যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে এইডস রোগী নেই বললেই চলে।
জনাব মনমোহন সিং, আমার কথায় কষ্ট নেবেন না। উপরের কথাগুলো বলে আমি আপনাকে আহত করতে চাই নি, আমি চেয়েছি বাংলাদেশের ব্যপারে আপনাকে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে, কারণ আমার ভয় হচ্ছে যে আপনার পররাষ্ট্র দপ্তর ও বৈদেশিক গোয়েন্দা দপ্তর আপনাদের নীতিনির্ধারকদের সঠিক ধারণা দিচ্ছে না।
অর্থাৎ বাংলাদেশ তত দুর্বল রাষ্ট্র নয় যতটা আপনারা ভাবছেন। বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করা হলে এদেশের সাধারণ মানুষ কোনভাবেই মেনে নিবে না কারণ তারা যথেষ্ট শিক্ষিত ও শক্তিশালী। কিন্তু বোকামি করে আপনারা বাংলাদেশে কিছুটা "বলপ্রয়োগ" করে ফেলেছেন, যার পরিনতি আপনারা কিছুটা টের পাচ্ছেন এবং কিছুদিন পরে আরও টের পাবেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন ভারতের উপর যথেষ্ট অসন্তুষ্ট। ১৬ কোটি মানুষের অসন্তুষ্টি নিয়ে তার প্রতিবেশী দেশও কি শান্তিতে থাকতে পারে? পারেনা। বাংলাদেশের মানুষ এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই দেখাবে। খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দেই, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মাঝে আস্থা কমে গিয়েছে। ফলে ভারত অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ভারতের বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য এখন হুমকির সম্মুখীন।
তাই বর্তমান বাংলাদেশের মতো একটা দেশে “বল প্রয়োগ” করা ভারতের নিজের স্বার্থেই ক্ষতিকর এটা আপনাকে বুঝতে হবে এবং আপনাদের নীতিনির্ধারকদেরও বুঝাতে হবে। তা নাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ শান্তিতে থাকতে পারবে না। যে জাতিগত বিদ্বেষ আপনারা ভুল করে জাগিয়ে তুলতে যাচ্ছেন তা নেভানোর মতো পানি আপনাদের কাছেও নেই। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যা সমৃদ্ধ ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে বিপদে ফেলে ভারতের জনগণের বিপদ ডেকে আনার মতো চরম ভুল করবেন না। এজন্য ভবিষ্যতে আপনাদের দেশের জনগণই আপনাদের দোষারোপ করবে। বাংলাদেশকে শান্তিতে থাকতে দিন, ভারতের জনগণকেও শান্তিতে রাখুন। এতে বাংলাদেশের লাভ ভারতেরও লাভ।
জনাব মনমোহন সিং, আপনার পররাষ্ট্র দপ্তর ও বৈদেশিক গোয়েন্দা দপ্তর ইতিহাসকে মূল্যায়ন না করেই যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে তা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে ভারতীয় জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা রইল। আপনার উপর আমাদের সৃষ্টিকর্তার শান্তি বর্ষিত হোক।
আবদুল্লাহ বাংলাদেশী
বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক
বিষয়: রাজনীতি
১৮৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন