বেঈমান মাওলানা
লিখেছেন লিখেছেন ইকবাল মাসুদ ২০ মার্চ, ২০১৩, ০৪:০৬:১২ বিকাল
শাহবাগের মঞ্চে গিয়ে রাজীবসহ ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের জন্য দোয়া করেছেন বিতর্কিত মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ। আবার তিনিই নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি দাবি করে আগামী ২৩ মার্চ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। স্ববিরোধী ভূমিকার এই মাওলানা মাসউদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের নানা তথ্য পাওয়া গেছে। রাজীব হত্যার পর তিনি ছুটে গিয়েছিলেন শাহবাগ। দোয়া করেন রাজীবের জন্য।
শাহবাগের মঞ্চে কেন গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসা করলে মাওলানা মাসউদ বলেন, শাহবাগি ব্লগারদের ইসলামের পক্ষে দাওয়াত দেয়ার জন্যই গিয়েছিলাম। শাহবাগিদের কেন এখন শাস্তি দাবি করছেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আল্লাহ-রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে যারা বেয়াদবি করছে তাদের শাস্তি দাবি করছি। সেদিন মঞ্চে গিয়ে ভুল করিনি, আবার শাস্তি দাবি করেও ভুল করিনি।
ইসলাম ও আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, দুর্নীতি ও বিতর্কিত ভূমিকা এবং শাহবাগিদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আলেম সমাজ এরই মধ্যে তাকে বিভ্রান্ত আলেম বা ‘ওলামায়ে ছু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মাওলানা মাসউদ আওয়ামী ওলামা লীগের উপদেষ্টা। সরকারই তাকে দিয়ে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে এবং আগামী ২৩ মার্চ সমাবেশ করাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসলামবিদ্বেষী চরম প্রতিক্রিয়াশীল এসব ব্লগারের কঠোর শাস্তির দাবিতে সর্বস্তরের আলেম-ওলামারা শীর্ষস্থানীয় আলেম আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী যখন তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন, তখনই আওয়ামী ওলামা লীগের উপদেষ্টা মাওলানা মাসউদ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ব্লগারদের শাস্তি দাবি করেন। পাশাপাশি তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ব্লগারদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যগুলো প্রকাশ করায় দৈনিক আমার দেশ ও দৈনিক ইনকিলাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন এবং নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের তীব্র সমালোচনা করেন। মাওলানা মাসউদের এহেন দ্বিমুখী আচরণ হিসেবে উল্লেখ করে তাকে বিপথগামী বলে উল্লেখ করেছেন দেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামাগণ। তারা বলেন, স্বঘোষিত নাস্তিকদের পাশে দাঁড়িয়ে স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মাসউদ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছেন। তার দ্বিমুখী আচরণ দু’মুখো সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মাওলানা মাসউদের অতীত কর্মস্থল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মাসউদ সরকারের আনুকূল্য নিয়ে ইসলাম ও বিভিন্ন ইসলামি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দুর্নীতির দায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে চাকরিচ্যুতির পর তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মরহুম খতিব মাওলানা ওবায়দুল হককেও খতিবের পদ থেকে অপসারণে নেপথ্য ভূমিকা রাখেন। আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের আপন ভগ্নিপতি জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবরণও করেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মাওলানা মাসউদ আমার দেশ-কে বলেন, যারা আমাকে সহ্য করতে পারে না, তারাই আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে। ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের শাহবাগের মঞ্চে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্লগারদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়া ও হেদায়েতের উদ্দেশ্য নিয়েই আমি সেখানে গেছি। আমি শাহবাগ গিয়ে সঠিক কাজই করেছি। আবার নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি দাবি করেও সঠিক কাজ করেছি।
একজন মাওলানা ফরিদ : ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানান, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সর্বদা একজন মতলববাজ, সুবিধাবাদী এবং উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি হিসেবে সবমহলে চিহ্নিত। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী (প্রুফ রিডার) থেকে চাকরি জীবন শুরু করেন। পরে তিনি তদবির এবং চাতুর্যের কারণে অন্তত ২ ডজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে সংস্থাটির পরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। ২০০১ সালে তার বিরুদ্ধে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে তিনি রাতারাতি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যান।
চাকরির পাশাপাশি তিনি এনজিও ব্যবসাও শুরু করেন। ‘ইছলাহুল মোছলেমিন’ নামক তার একটি এনজিও রয়েছে। এনজিওর অর্থদাতা ছিলেন লন্ডনসহ ইউরোপের কতিপয় অজ্ঞাত ব্যক্তি। ১৯৯৬ সাল-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বায়তুল মোকাররমের খতিব হওয়ার জন্য মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে তদবির শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা তত্কালীন খতিব সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম মাওলানা উবায়দুল হককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায় নিয়ে তিনি পুনরায় বায়তুল মোকাররমের খতিব পদে আসীন হন। মাওলানা মাসউদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাওলানা মাসউদ শোলাকিয়ার ইমাম হওয়ার জন্য তদবির শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তদবির করে তিনি শোলাকিয়ার ইমাম হওয়ার কাজে সফল হন এবং তাকে শোলাকিয়ার ইমাম হিসেবে চিঠি ইস্যু করা হয়। সেখানে শোলাকিয়ার প্রথম ইমামের অধঃস্তন বংশধরদের দিয়ে নামাজ পড়ানোর শত বছরের ঐতিহ্য ধ্বংস করে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ইমাম হলে স্থানীয় জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শোলাকিয়া মুসল্লি পরিষদ নামে একটি সংগঠন দীর্ঘদিন এ নিয়ে আন্দোলন করে।
তারা হাইকোর্টে রিট করলে আদালত ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে বাদ দিয়ে আগের সর্বজন স্বীকৃত ইমামকে বহাল রাখেন। কিন্তু সরকার আপিল বিভাগের চেম্বার জজের মাধ্যমে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে সরকারি আদেশ বহাল রাখার ব্যবস্থা করে। আর এভাবেই ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শোলাকিয়ার ইমাম হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা আরও বলেন, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহ উদ্দিন ‘শারীরিকভাবে দুর্বল’ এ তথ্য পেশ করে মাওলানা মাসউদ এখন ওই পদ দখলেরও চেষ্টা করছেন। এ কারণে তিনি সরকারকে খুশি করতে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের কাতারে নিজেকে বিলীন করে দেন।
মাওলানা মাসউদের বিভিন্ন অপকর্ম তুলে ধরে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। এরই মধ্যে তাকে শোলাকিয়ায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাকে ‘ওলামায়ে ছু’ (বিভ্রান্ত আলেম) হিসেবে চিহ্নিত করে তার পেছনে নামাজ পড়া বৈধ নয় বলে ফতোয়া দিয়েছেন বিশিষ্ট আলেমরা। তবে মাওলানা মাসউদ বলেন, সম্পূর্ণ প্রতিহিংসার কারণেই তার বিরুদ্ধে আলেম-ওলামারা বিষোদগার করছেন। নাস্তিক ব্লগারদের মঞ্চে গিয়ে আপনি নিজেকে সঠিক আলেম হিসেবে মনে করার কারণ কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মহানবী (স.)-এর দাওয়াত ছিল কাফেরদের কাছে। কাফেরদের কাছে না গেলে তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিতেন কিভাবে? আমি নাস্তিক ব্লগারদের মঞ্চে গেছি তাদের দ্বীনের পথে দাওয়াত দিতেই। তাদের মঞ্চে আমার আরোহনের বিষয়ে এরই মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তারা আজানে বিরতি দিচ্ছে। তারা নারায়ে তাকবির বলে স্লোগানও দিয়েছে। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক দিক। নাস্তিক ব্লগাররা মহান আল্লাহ সম্পর্কে যেসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে সেগুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন? এ প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মাসউদ বলেন, আমি অবশ্যই নাস্তিক ব্লগারদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির দাবি করছি। আপনার এ দাবি দ্বিমুখী আচরণের শামিল কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই না। আমি মহান আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে যা সঠিক বলে মনে করেছি, সেটাই করেছি।
বিষয়: বিবিধ
১০৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন