একটি সেলাই মেশিন এবং মধ্যবিত্তের চাহিদার বুনন!
লিখেছেন লিখেছেন মেঘ বলেছে চৈত্রে যাব ১৪ মে, ২০১৩, ১১:১২:১১ রাত
আম্মা অনেক আগে থেকেই সেলাই কাজ করে আসছেন। উনি একটা এনজিওর আন্ডারে সেলাই কাজ শিখেছিলেন। সেলাই শিখতে যাওয়ার সময় আমাকে হাতে করে নিয়ে যেতেন। পেপার কেটে সেলাই কাজ শেখানো হত। ক্লাস শেষে সেই প্যাটার্ন গুলো আমি নিয়ে আসতাম। ফেরার পথে দোকান থেকে এটা ওটা খেতে চাইতাম বলে মাইরও খাইতাম আম্মার হাতে। দিন গুলো স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি করে রাখার মতই…
সেলাই কাজ শিখছিলেন আম্মু। কিন্তু প্র্যাক্টিস করার জন্য ছিল না মেশিন। কম বেতনের আমার সরকারি চাকুরে বাপের সেলাই মেশিন কিনে দেয়ার মত সামার্থ্য ছিল না। কিন্তু আম্মার মেশিন চাই ই চাই। আব্বুর সাথে অনেক মুখ কালাকালিও হয়েছিল আম্মার। পরে আম্মা ওনার স্বর্ণের চেইনটা বন্ধক দিয়ে দেন স্বর্ণকারের দোকানে। আব্বুও ভেঙ্গে ফেলেন কয়েক বৎসর ধরে লালন পালন করা মাটির ব্যাংক। বাসায় সেলাই মেশিন এসে গিয়েছিল। সেইদিন আম্মা কি যে খুশি হয়েছিল লিখে বুঝানো যাবে না…
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আম্মা আমাদের নিজেদের কাপড় চোপড়ই সেলাই করতেন। মাঝে মধ্যে পাশের বাসার আন্টিদেরও টুকটাক কাজ করে দিতেন। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েনের সংসার, সাথে তিন ভাই বোনের পড়াশোনা, সবকিছু মিলিয়ে আম্মার এই টুকটাক কাজ সংসারে একটু হলেও ওমদায়ক ছিল। তাছাড়া উনি সেলাই কাজও শেখাতেন। কিছু উঠতি মেয়েদের এবং কিছু ক্ষেত্রে আন্টিদেরও। ঐ আন্টি গুলো কাজ শিখতে আশার সময় এটা ওটা নিয়ে আসতেন খাওয়ার জন্যে। ভালোই লাগত…
ঈদের আগে আম্মার হাতে প্রচুর কাজ থাকত। রমজানে সারা দিনই কাজ করতেন। সেহেরীর আগ পর্যন্তও অনেক সময় কাজ করতেন। ব্লাউজ, পেটিকোট, সালোয়ার, কামিজ, মেক্সি, বাচ্চাদের ফ্রক, লুঙ্গি সেলাই এগুলোই ছিল মূল কাজ। আরও অনেক কাজ করতেন যদিও.…
আমি আম্মাকে টুকটাক সাহায্য করতাম। ববিনে সূতো গেঁথে দেওয়া। নিডেলে সূতো ভরে দেওয়া ( আম্মা কাছের জিনিষ কম দেখেন)। কাপড়ের সাথে সূতো না মিললে দৌড় দিয়ে দোকান থেকে সূতো এনে দিতাম। এগুলো করতে করতে আমিও সেলাই কাজ শিখে গিয়েছিলাম কিছুটা। আম্মা আমাকে বিরক্তিকর একটা কাজ সবার আগে শিখিয়েছিলেন। আর সেটা হল ব্লাউজের বাটনের ঘর করে তার কাছা সেলাই করা। তাছাড়া লুঙ্গি সেলাই আমি এমনিতেই শিখে গিয়েছিলাম। আম্মা যখন ঘ্যাচাং করে কোন কাপড় কাটতেন তখন আমি মেশিনে বসতাম। হয় ব্লাউজের হাতা জোড়া লাগিয়ে দিতাম। হয়ত পেটিকোট কিংবা মেক্সির বর্ডার সেলাই করে দিতাম। আনন্দ নিয়েই কাজ গুলো করত্ম।
কাজ ভুল করে মাইর ও খাইছি প্রচুর। একবার চালাকি করে একটা মেক্সি সেলাই করতে গিয়ে কাপড়ও নষ্ট করে ফেলেছিলাম প্রায়। আম্মা দেখে শলা দিয়ে দিছে কয়েক বাড়ি! ভাগ্যিস ঘ্যাচাং করে কান কেঁটে দেয় নি… হা হা হা…
এসএসসি পরীক্ষার পরে বড় খালার বাড়িতে গিয়ে শার্ট প্যান্ট কাটা শিখেছিলাম। বড় খালাতো ভাইয়ের দুটো টেইলরিং শপ ছিল। কারিগরকে বলে শিখে নিয়েছিলাম। প্র্যাক্টিসের অভাবে হয়ত ভুলেই গিয়েছি। ভবিষ্যতে কি করতে পারি আর না পারি অন্তত একটা সেলাই মেশিন নিয়ে হকার্স মার্কেটের সামনে বসে যেতে পারব। করে খেতে আমার কোনকালেই আপত্তি নেই। সে যে ধরেনের কাজই হোক।
আম্মা এখন তেমন আর সেলাই করেন না। সেলাই মেশিনে সূতো গেঁথে দেওয়ার মত কাউকে পান না। কিছুক্ষন প্যাডেল ঘুরালেই ওনার বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। তাই সেলাই মেশিনটা অনেকটা অযত্নেই আমাদের ঘরের এক কোনে পড়ে থাকে। আমি বাড়িতে গেলে মাঝে মধ্যে খুটখুট করি। মেশিনে তেল দিয়ে হালকা করে নেই। হয়ত আম্মার কোন শাড়ির ফুটো হয়ে যাওয়া আঁচল রিপু করে দেই। হয়ত সেলাই করি আবোল তাবোল…
আমাদের মত অনেক মধ্যবিত্তের সংসারেই এই সেলাই মেশিন অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইট পাথরের খাঁচার বাসিন্দারা রেডিমেড পোশাক কিনে নেয়। আর আমরা থান কাপড় কিনে সেলাই করার পয়সা বাঁচিয়ে দেই। কয়েকবার জোড়া তালি দিয়ে এক প্যান্ট বা এক শার্ট বৎসরের পর বৎসর পড়ে, অনেক কষ্টের মাধ্যমেই আমরা বেড়ে উঠি। বাস্তবতা কি জিনিষ হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাই আমরা। তারপরেও আমরা মিলেমিশে সুখেই থাকি। এই জন্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাজার শুকরিয়া…
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন