চাহিদা (গল্প পোষ্ট)
লিখেছেন লিখেছেন পান্থ নজরুল ২৫ মে, ২০১৩, ১১:০৩:৪৯ সকাল
(চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে যদি misunderstanding হয় তাইলে গন্ডগোল অনিবার্য! চাহিদা এবং যোগানের মধুময় সম্পর্কের ব্যাপারে ইকোনোমিক্স এর ছাত্ররা ভালো বলতে পারবেন, আমার পক্ষে নয়। তবে আমার জানা একটি চাহিদা এবং যোগানের টানাপড়েন থেকে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দৃশ্যপট এ গল্পটিতে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আমার উপস্থাপন হয়তো হৃদয়গ্রাহী হবে না তথাপি হাতে কাজ না থাকলে অর্থাৎ অবসর সময়ে হালকা চোখ বুলানোর সবনিয় অনুরোধ করছি)
মর্জিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে এ কথা শুনে রফিক মাস্টারের মূর্ছা যাবার দশা। রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন - তুমি সত্যি বলছো তো করিম? হ্যাঁ স্যার সত্যি বলছি। আক্ষেপের স্বরে রফিক মাস্টার বললেন - মাত্র সেভেনে পড়ছে মেয়েটা। এতটুকুন মেয়ে সংসার জীবনের কী বুঝবে? জানো করিম? মর্জিনা যদি কোনো শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিতো তাহলে সে বড় কিছু হতে পারতো। আমার শিক্ষকতার দীর্ঘ বাইশ বছরে ওর মতো ট্যালেন্ট শিক্ষার্থী হাতে গনা কয়েকজন পেয়েছি মাত্র।
আচ্ছা করিম, ওর বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া যায় না? কীভাবে স্যার? এই ধরো আমরা কয়েকজন মিলে মর্জিনার বাবাকে যদি বাল্য বিবাহের কুফল বুঝিয়ে বলি তাহলে বোধ হয় কাজ হবে। করিম মাথা নেড়ে বললো, না স্যার কাজ হবে না। কারণ হেমায়েতপুরের মফিজ মেম্বারের ছেলের সাথে মর্জিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। জানেনই তো মেম্বার কি চিজ। এই বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার সাহস মর্জিনার বাপ-চাচারা করবে না।
মেম্বারের প্রভাব প্রতিপত্তির খবর রফিক মাস্টার নিজেও রাখে। মেম্বার কারো দিকে একবার বদ নজর দিলে তাকে হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো তামা না বানিয়ে ক্ষান্ত হয় না। অনেকটা বাঘে ধরলে ছাড়ে হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’র মতো!
মাস্টার মনে মনে ভাবে হায় আল্লাহ মেম্বার যদি জানতে পারে এ বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য আমি কোশেশ করছি তাইলে তো সর্বনাশ। মর্জিনা তো আর আমার আত্মীয় কেউ নয়। ওর জন্য আমি রিস্ক নিতে যাবো কেন? মেম্বারের ভয়ঙ্কর রুদ্র মূর্তির কথা ভেবে বাল্য বিবাহ রোধের শুভ উদ্যোগ থেকে মাস্টার নিজে নিজেই ইস্তফা দেয়। করিমকে লক্ষ করে বলে, করিম - তাইলে বাদ দেও। বেঁচে থাকলে শুভ কাজ বহুত করা যাবে! আপাতত এ শুভ কাজে বাঁধা না দেওয়াটাই উত্তম।
মেম্বারের মেঝো ছেলে সোহাগ মর্জিনার হবু বর। সে বহু বছর বিদেশ করে কয়মাস হলো দেশে এসেছে। তলনামূলক বয়স একটু বেশী। মাশাল্লা গায়ে গতরেও বেশ তাগড়া। হবে না কেন? ওদের তো আর খাওয়া-পড়ার কষ্ট নেই। কয়েক গ্রামের মধ্যে ওরাই বিত্তশালী। তাছাড়া সৌদি থাকাবস্থায় সে প্রচুর রিচ ফুড খেয়েছে। এ্যারাবিয়ান রিচ ফুড যে কতো রিচ তা সোহাগের বডি দেখলেই অনুমান করা যায়!
অগ্রহায়নের মাঝামাঝি সময়ে চাদর গায়ে দিয়ে শীত আসি আসি করছে এমতাবস্থায় মর্জিনার বিয়ের সানাই বেজে ওঠে। মহা ধুমধামে সম্পন্ন হয় তাদের বিয়ে। মর্জিনাকে নিয়ে সোহাগ প্রথমে সিলেট পরে চিটাগাং সপ্তাখানেক চক্কর দিয়ে আসে। এদিকে ধীরে ধীরে মর্জিনার লাজ-শরম একটু আধটু ভাঙ্গতে শুরু করে। লম্বা ঘুমটা খাটো হতে থাকে।
একদিন একটু দেরীতে ঘুম ভাঙ্গায় বড় জা টিপ্পনী কেটে বলে - কী-লা সারা রাইত কি করছস? মর্জিনা চটজলদি জবাব দেয়, কী আর করুম, আপনাদের মইষটার নাক ঢাকার যন্ত্রনায় ঘুমাইতে পারি নাই! মর্জিনার তীর্যক জবাব শুনে বড় জা যেন আকাশ থেকে পড়ে। কিছুটা ইতস্তত এবং আশ্চর্য হয়ে বড় জা স্বরটা টেনে টেনে বলে - ও মা এট্টুখানি মেয়ের কথায় তো ধার আছে!
পানির জগ হাতে নিয়ে কলপাড় চাচ্ছে মর্জিনা এমন সময় বড় জা খপ করে ওর হাত ধরে হেঁচকা টেনে উঠোনের এক কোণে নিয়ে যায়। মর্জিনার চোখে চোখ রেখে বড় জা বলে, মর্জিনা সত্যি করে কও তো সোহাগের কি কোনো সমস্যা আছে? বড় জা কী জানতে চাইছে তা বুঝতে পেরে লজ্জায় মর্জিনার মুখ লাল হয়ে ওঠে এবং মাথা নীচু করে দাড়িয়ে থাকে।
মধ্য রাত বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সোহাগ। এদিকে নির্ঘুমে চটপট করছে মর্জিনা। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সোহাগের গায়ে ধাক্কা দিয়ে মর্জিনা বলে - কী গো বিদেশী কম্বল গায়ে জড়িয়ে এতো শীতেও আমি ঘামতেছি আর আপনি মরা মাইনসের লাহান পইরা আছেন! বাম পাশের মানুষটার কথা একবারও মনে পড়ে না? আপনি মানুষটা দেখতে মইষের মতো হইলেও আস্ত একটা ম্যাদামারা!
পৌষের শেষ দিকে এক কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের তৃতীয়ার্ধে সোহাগ কাঁপা স্বরে তার বড় ভাবীকে ডেকে তুলে বললো - ভাবী মর্জি না নেই। সকাল হতে না হতেই পুরো গ্রামে রটে গেল মর্জিনা পালিয়েছে। মেম্বারের পরিবারের শোকাহত এবং লজ্জাবনত সদ্যসরা এদিক সেদিক গোমড়া মুখে কেউ দাড়িয়ে, কেউ বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বুকটাকে হালকা করার বৃথা চেষ্টা করছে।
মধ্য বয়সের গুটিকয়েক প্রতিবেশী মহিলা বলাবলি করছিল, মেয়েটির না পালিয়ে উপায় আছে? এত বড় তাগড়া জোয়ান পোলার লগে দুধের মাইয়্যাডারে বিয়া দিল কোন আক্কেলে? এই পোলার অত্যাচার বাচ্চা মেয়েটা কেমনে সয়? আমরা আগেই আন্তাজ করছিলাম এমন একটা কেলেঙ্কারী ঘটবে!
মর্জিনার দাদি লালবানু কাক ডাকা ভোরে মর্জিনার ডাক শুনে ভয়ে তটস্ত হয়ে পড়ি মরি অবস্থায় দরজা খুলে দেখে, সুটকেস হাতে মর্জিনা দাড়িয়ে। অজানা শঙ্কায় লালবানুর বুক ধক ধক করতে থাকে। মনে মনে ভাবে, আহারে হাত্তির লাগান মানুষটা না জানি আমার বুবুরে কতো কষ্ট দিছে! লালবানু মর্জিনাকে জড়িয়ে ধরে স্নেহ করতে করতে আদুরে গলায় বলে, বুবু মানুষটা বুঝি তোমারে অনেক কষ্ট দিছে?
মর্জিনা কথা না বলে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে থাকে। লালবানু আবারো মর্জিনার গতরে সোহাগী হাত বুলাতে বুলাতে দরদী গলায় জানতে চাইল - বুবু বল না কেন পালাইয়া আইছ? এবার মর্জিনা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে- দাদি গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু থাকলেই সংসার সুখের হয় না। সুখের জন্য আরো কিছুর দরকার আছে। এই মানুষটার সেই জিনিষ নাই! লালবানু বিস্ময়ের ঘোরে ভাবতে থাকে সপ্ন দেখছি না তো?
বিষয়: সাহিত্য
১৭৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন