রাতের বাস ও নারীর সম্ভ্রম
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন ২৬ মার্চ, ২০১৩, ০২:৪৭:২৮ দুপুর
আমার মা বলেন, “তুই মাঝে মাঝে রাত-বিরেতে ঢাকা থেকে আসিস এটা আমি পছন্দ করি না।” মাকে বোঝালাম, “আমি সপ্তাহের শেষ দিন বাড়িতে আসি । অফিস ছুটির পরে গাড়ি চড়তে হয় বলে আসতে আসতে রাত বেশী হয়ে যায়”। মা বলেন, “তবুও বাবা সবসময় চেষ্টা করবি দিনের মধ্যেই বাড়িতে পোঁছার। জরুরী না থাকলে পরের দিন ভোরে আসবি।” আমার মা রাতের বেলায় ভ্রমনের বিষয়ে নানা রকম অমঙ্গল আশংকা করেন। যখনই দূরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখনই আমার মা'য়ের আদেশ মনে পড়ে যায়।
কয়েকদিন আগে আমি চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। গাড়ি ছাড়ল বিকাল ৬:৩০ টার দিকে। মেঘনা-গোমতী সেতুর রক্ষনাবেক্ষনের কাজ চলছে। বিকল্প পথে ব্রাহ্মনবাড়িয়া হয়ে ঢাকা পৌঁছতে হব। প্রায় ৯ ঘন্টা লাগবে। কুমিল্লা পৌঁছে গাড়ি যাত্রা বিরতী দিল । রাত সাড়ে দশটা। দেখলাম গাড়ি থেকে ৩০-৩৫ বছর বয়সের এক মহিলা যাত্রী নামল। ভদ্র মহিলা আঁটসাট শর্ট কামিজ এবং স্লুইজ পায়জামা পরা। গলায় মাফলারের মতো করে একটা ওড়না ঝুলানো। হোটেলে রাতের খাবার খেতে বসলাম। একটি টেবিলে ভদ্র মহিলা একা খাবার খাচ্ছে। পরে বুঝতে পারলাম এই বাসে তার নিকটজন কেউ নেই। নিশ্চয়ই তার জরুরী কোন প্রয়োজন আছে, নচেত রাতের বাসে একা একজন ভদ্র মহিলার এতদূর পথ ভ্রমন করার কথা নয়।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে “সাভারে চলন্ত বাসে ধর্ষনের চেষ্টা, লাফিয়ে পড়ে গৃহ বধূ নিহত” হওয়ার ঘটনা পত্রিকাগুলোয় শিরোনাম হয়েছিল। আর মাস তিনেক আগে “ভারতের নয়াদিল্লিতে চলতি বাসে মেডিক্যাল ছাত্রী গণধর্ষণ” ঘটনায় ভারতজুড়ে তোলপাড় হয়ে গেল। বাংলাদেশের দৈনিকগুলোতে তা বেশ গুরুত্ব দিয়েই প্রচার করা হয়। উক্ত দু'টো ঘটনাতেই ভিকটিম নারীদের আপনজন তাদের সফরসঙ্গী ছিল। অতি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভদ্র মহিলা নিশ্চয়ই অবগত। খুব জরুরী না হলে কোন মেয়ে বাংলাদেশের বিরাজমান সামাজিক পরিস্থিতি এবং সাম্প্রতিক এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাতে ঘরের বাহির হওয়ার সাহস করার কথা নয়, তাও আবার একা।
ঢাকা পোঁছতে পৌঁছতে ৩টা বেজে গেল। ভদ্র মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তিনি গাইড'কে ডেকেছেন। আমার ধারনা হলো, তার কোন নিকট আত্মীয় বাস স্ট্যান্ডে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু না। তিনি গাইডকে বলছেন বাসের যে কাউন্টারটি খোলা আছে, সেখানে তাকে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়; তিনি বাকি রাত সেখানে অপেক্ষা করে ভোরে বাসায় যাবেন। আমি আঁৎকে উঠলাম। মনে পড়ে কয়েক বছর আগে আমিও দু’তিন বার রাত বেশী হয়ে যাওয়াতে বাসায় ঢুকতে অসুবিধার কথা বিবেচনা করে (রাত ১২টার পর বাড়িওয়ালা বাসার মূল গেটে তালা দিয়ে রাখত, চাবি ভাড়াটিয়াদের দেয়া হতো না) ২/৩ ঘন্টা বাস কাউন্টারের চেয়ার/সোফায় শুয়ে বসে সময় কাটিয়েছিলাম। মনে পড়ে কাউন্টারের দু’একজন লোক ছাড়া আমরা দু’একজন পুরুষ যাত্রী ছিলাম।
গাড়ি সায়েদাবাদ যাত্রী নামানোর জন্য থামল। গাইড ভদ্র মহিলাকে নামতে বললেন। রাস্তার উল্টোপাশে তাদের কোম্পানীর কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। মহিলা বললেন, “কাউন্টারটাতো বন্ধ মনে হচ্ছে”। গাইড বললেন, “দরজা আটকানো আছে। খোলা না থাকলে দরজায় আওয়াজ করলে খুলে দিবে।” রাস্তায় সুনসান নিরবতা। কোন বাস কাউন্টার খোলা নেই। একটি হোটেলের সামনে এক লোককে দেখা গেল তাওয়া পরিস্কার করছে। হোটেল কাউন্টারে ম্যানেজারকে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কোন রিকশা বা জনমানব চোখে পড়ছেনা। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে বোধ হয় রাস্তায় মানুষ চলাচল কম।
আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল। ভদ্র মহিলা দরজা বন্ধ বাস কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাউন্টারের ভিতরে দুই-তিন জন পুরুষ আছে। ভদ্র মহিলা দরজায় টোকা দিবে। ভিতর দিক থেকে দরজা খোলা হবে। ভদ্র মহিলার পোশাক আঁটসাট।
একটা অমঙ্গল আশংকায় মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। মনে মনে ভদ্র মহিলাকে অনেক ভৎসনা করলাম, রাত করে ঢাকায় আসার এমন কি দরকার ছিল! যত দরকারই থাকুক তা নিজের সম্ভ্রম বা জীবনের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশী নয়! একান্তই যখন আসতে হলো শালীন (পুরুষের মনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সহায়ক নয় এই ধরনের) পোশাক-আশাক পরলে ক্ষতি কী হতো?
পরদিন সকালে পত্রিকা পড়তে গিয়ে মনের অজান্তে একটা দুঃসংবাদ খুঁজতে লাগলাম। কোথাও সেরকম কোন খবর পেলাম না। হঠাৎ মনে হলো রাত তিনটার পর ঘটে যাওয়া ঘটনা আজকের পত্রিকায় আসার কথা নয়। মনকে বোঝালাম, আমার মতো ঐ ভদ্র মহিলাও সুস্থ স্বাভাবিকভাবে দিনের কাজ কর্ম করছে।
আরেকটি ঘটনা: ৬/৭ বছর আগে আমি শোয়েব নামের এক বড়ভাইসহ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলাম। রাত সাড়ে বারোটার বাস। আমাদের সামনের আসনগুলোতে পাশাপাশি এক ভদ্রলোক (?) ও এক ভদ্র মহিলা বসলেন। ফেনী পার হওয়ার পর দেখা গেল ভদ্র মহিলা একটু পর পর উঠে দাঁড়াচ্ছেন, আবার বসছেন। কিছুক্ষন পর আবার নড়েচড়ে বসছেন। মৃদু গলায় পাশের ভদ্র লোকের উদ্দেশ্যে বিরক্তস্বরে কিছু বলছেন। আমরা ধারনা করলাম তারা স্বামী-স্ত্রী। কুমিল্লা পার হলাম। ভদ্র মহিলা একই রকমের আচরণ করছেন। হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। শোয়েব ভাই অন্য কিছু একটা আঁচ করলেন। তিনি ভদ্র মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন, “মাফ করবেন, এই ভদ্র লোক কি আপনাকে বিরক্ত করছে?” এবার ভদ্র মহিলা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “দেখুন না ভাই, সেই গাড়িতে ওঠার পর থেকেই লোকটা আমাকে ডিসটার্ব করছে”। গাড়িতে যে কয়জন যাত্রী জেগে ছিলেন তারাও মহিলার কথা শুনতে পেল। শোয়েব ভাইসহ অনেকেই লোকটাকে মারতে উদ্ধত হলেন। গাড়ির ঘুমন্ত যাত্রীরাও জেগে গেল। গাড়ির বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। সবাই বদ লোকটার চেহারা দেখল। ভদ্র মহিলা আঁচলে মুখ ঢাকলেন। সবাই বিষয়টা বুঝতে পেরে লোকটাকে গালাগালি করতে লাগল। বদ লোকটা আত্মরক্ষার জন্য সবার সামনে হাতজোড় করে মাপ চাইল। রাত চারটা। তাকে গাড়ি থেকে মাঝরাস্তায় নামিয়ে দেয়া হলো।
এটা সত্য যে, আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মেয়েরাই নিজেদের যৌন হয়রানি বা সম্ভ্রম হানির কথা প্রকাশ করে না। প্রতিবাদ বা বিচার দাবিতো আরও পরের কথা। ফলে, সমাজে পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না।
কর্মক্ষেত্রেও নারীরা ব্যাপক যৌন হয়রানি ও অমর্যাদার শিকার হন। জীবীকার খাতিরে অথবা লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই নিরব থাকেন। অনেক নারীকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মূলত অফিসের অলংকরনের জন্য নিয়োগ দেন। আবার অনেক অফিস প্রধান নারী সহকর্মীদের টেবিলের সামনে বসিয়ে রেখে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় গল্প করতে বাধ্য করে। অন্যান্য সহকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে কানাঘুষা হয়। কোনটাই নারীর মর্যাদা রক্ষার সহায়ক নয়। নারীর নিজের মর্যাদা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব তার নিজেরই। রুচিশীল ও শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা, যে কোন বিষয়ে পুরুষের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে কৌশল অবলম্বন করে চলা (যেমন: উর্ধ্বতন কর্মকর্তা অপ্রয়োজনীয় গল্প করতে চাইলে কোন অজুহাতে তা থেকে বিরত থাকা), প্রয়োজনে নিশ্চুপ না থেকে প্রতিবাদ করা তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য খুবই জরুরী।
বিষয়: বিবিধ
১৭০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন