সিরাহর উদ্দেশ্য; সিরাহ নাকি ফিকহুস সিরাহ? কোনটি প্রায়োগিক, বাস্তবসম্মত ও প্রাসঙ্গিক?- আহমাদ আল-সাবা
লিখেছেন লিখেছেন সঠিক ইসলাম ৩১ আগস্ট, ২০১৫, ০১:৫৬:০৪ রাত
সিরাহ কি?
سار Saara – শব্দের অর্থ পথ অনুসরণ করা।
‘Seerah’ (سيرة) – এমন প্রস্তুত পথ যা গমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
সিরাহ অর্থ ভ্রমণ করাও হয়। কারণ একজন ব্যক্তি যে পথ দিয়ে চলে গেছে সেই পথ দিয়ে আপনি তাঁর জীবনী পড়ছেন, তার মানে আপনিও তাঁর পথ দিয়ে ভ্রমণ করছেন। মানে আমরা রাসূল ﷺ এর জীবনী পড়ছি মানে তাকে অনুসরণ করছি, তাঁর জীবনের পথে ভ্রমণ করছি।
সিরাহ অর্থ পথ; এমন পথ যেদিক দিয়ে মানুষ চলাচল করে। এজন্য সিরাহ বলতে জীবনী বুঝায় অর্থাৎ যে পথ দিয়ে একজন ব্যক্তি চলে গিয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ
“…আমরা একে প্রথম সিরাহয় বা পূর্ব পথে ফিরিয়ে দেবো”। – সূরা ত্বহা – ২১
কাজ বা একজন ব্যক্তি কেমন- সেটাও বুঝায়।
পারিভাষিক অর্থে বুঝায় – জীবনী বা বায়োগ্রাফি। অর্থাৎ যেকারো জীবনীকেই সিরাহ বলে। কিন্তু আমরা সিরাহ বলতে বেশিরভাগ সময়-ই রাসূল ﷺ এর জীবনীকেই বুঝাই।
সিরাতুন নাবাবীয়াহ হলো- রাসূল ﷺ এর জীবনে যা কিছু ঘটেছে, তাঁর সাথে সম্পৃক্ত, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে, তাঁর সকল দিক- শারীরিক দিক, চারিত্রিক দিক, পারিবারিক জীবন, মিলিটারী দিক – সবই সিরাহর অন্তর্ভূক্ত।
সালফে-সালেহীনদের ইসলাম শিক্ষার উপকরণ
সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলতেনঃ
“আমরা আমাদের শিশুদেরকে রাসূল ﷺ জীবনী শিক্ষা দিতাম যেরুপ কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতাম”।
অর্থাৎ তাদের শিশুদেরকে গড়ে তুলার জন্য সিরাহ ও কুরআন শিক্ষা দিতেন। এটাই ছিল তাদের ইসলামী সিলেবাস।
এজন্য শিশুদেরকে ভূত-পেত্নি বা গোপালভাড়ের গল্প না শুনিয়ে কুরআনের পাশাপাশি তাদেরকে নবী-রাসূলদের গল্প ও শিক্ষা দেওয়া দরকার। কারণ আমরা এর মাধ্যমে শ্রেষ্টদের শ্রেষ্ট ব্যক্তি ও শ্রেষ্ট যুগের শ্রেষ্ট সাহাবাদের পবিত্র জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করে আমাদের শিশুদেরকে সুন্দরতম চরিত্রের ওপর গড়ে তুলার প্রয়াস পাবো।
আমরা পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনী কোথায় পড়ি? কোরআনে। তেমনি আমরা আমাদের নবীর জীবনী ও অন্যান্য শিক্ষা কুরআন ছাড়াও বিস্তারিত পড়ি সিরাহতে। সকল নবীর জীবনী পড়ি কুরআনে কিন্তু আমাদের নবীর সিরাহ পড়ি সিরাহ গ্রন্থেই।
তাবেয়িরা (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলতেন:
“আমরা শিশুদের প্রথম যে জিনিসটি শিক্ষা দিতাম সেটা হলো রাসূল ﷺ এর জীবনী; যেন তাঁর জীবনের সাথে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারে”।
এজন্য ছোটদের উপযোগী করে সুন্দর গল্পাকারে সিরাহকে তুলে ধরে শিক্ষাগুলোকে আদর্শীয় আকারে ভিডিও ও বই বের করা দরকার।
পবিত্র কুরআনঃ সিরাহ ও হাদীস
অনেকেই হাদীস মানেন না। এক্ষেত্রে সিরাহ তো প্রামাণিকতার দিক থেকে আরো দূর্বল মনে হতে পারে তাদের নিকট। আমরা কুরআন থেকে দেখার চেষ্টা করবো হাদীস ও সিরাহর ব্যাপারে এটি কি বলে।
যারা হাদীস অস্বীকার করে, তারা কুরআনও যদি পড়ত গভীরভাবে, এই কুরআনেই ডাইরেক্ট হাদীস উল্লেখ পেতো!! আল্লাহ নিজেই কুরআনে হাদীস উল্লেখ করেছেন!! আর তারা বলে আমরা কেবল কুরআন মানি হাদীস, মানি না…আসলে তারা কুরআন-ই কতটুকু বুঝে সেটা কুরআনের গভীর উপলব্ধি দিয়ে জানা দরকার।
হিজরতের কথা মনে আছে? আবু বাকার (রাজিয়াল্লাহু আনহু) যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নিয়ে শংকিত হলেন তখন তিনি কি বলেছিলেন? – “যখন তিনি তার সাথীকে বললেনঃ… ভয় পেয়ো না, নিশ্চয় আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন…।” (সূরা তাওবাহ ৪০). আয়াতে আবু বাকার রাজিয়াল্লাহুর কথা উল্লেখ করেছেন সর্বনাম দিয়ে। কেবল আল্লাহর রাসূলের হাদীসই নয়, বরং যে একজন ব্যক্তির কারণে এই কথা কুরআনে এসেছে তাকেও উল্লেখ করেছেন আল্লাহ। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো এইটা ছিল মাক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় অথচ তখনো মাদানী সূরা নাযিল হয়নি এবং এই মাক্কী হাদীসটির ঘটনা আল্লাহ মাদানী সূরায় দীর্ঘ সময় পরেও উল্লেখ করেছেন!!
আর কুরআন আসছে কার মাধ্যমে? এইটাই বা জানবে কিভাবে? …সাহাবাদের মাধ্যমে নাকি আপনার কাছে সরাসরি আকাশ থেকে আসছে?…রাসূল ﷺ থেকেই তো…তিনি কি আপনাকে সরাসরি দিয়েছেন? না। তাহলে কাদের মাধ্যমে আসছে? সাহাবাদের মাধ্যমে?…তারা কি আপনাকে সরাসরি দিয়েছেন?…না। আল্লাহ কুরআনের বাহকদের হৃদয়ের কথা বলেছেন আর যেই কুরআন সাহাবাদের হৃদয় দিয়ে এসেছে আমাদের কাছে সেই একই হাদীসও এসেছে সেই আল্লাহর বর্ণনা করা হৃদয় থেকে। তাহলে হাদীস অস্বীকার করতে হলে তো কুরআনও অস্বীকার করা দরকার!! কারণ একই হৃদয় থেকে দুটিই এসেছে। আর কোরআন ও হাদীস – দুটোই তো একই ব্যক্তি রাসূল থেকে, একই হৃদয়বাহী সাহাবাদের মাধ্যমে, একই ধারায়, ক্রমান্বয়ে আমাদের কাছে পৌছেছে। অথচ আমরা একটিকে স্বীকার করছি আরেকটিকে সুন্দরভাবে না জানার ফলে অস্বীকার করছি।
সূরা তাবাগুনে দেখবো কীভাবে নবী-রাসূল ও আল্লাহর বাণী দুটিই একই সূত্রে গাঁথা এবং একটিকে ছেড়ে দিলে অন্যটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
আল্লাহ পূর্ববর্তী কাফিরদের মন্দ ফল ও শাস্তির কথা উল্লেখ করে সূরার ৬ নং আয়াতে বলেনঃ
(মন্দ ফল ও শাস্তির কারণ) এজন্য যে, তাদের নিকট তাদের রাসূল আসতেন স্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ। অতঃপর তারা বলতোঃ মানুষ-ই কি আমাদেরকে সৎ পথের সন্ধান দেবে? তারা কুফুরী করলো ও মুখ ফিরিয়ে নিল কিন্তু আল্লাহর কিছু আসে যায় না। আল্লাহ অভাবমুক্ত, অতি প্রশংসিত।
আয়াতটি সুক্ষ্ণ ও গভীর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করুন;
১। কাফিরদের মন্দ ফল ও শাস্তির কারণ বলা হয়েছে।
২। কারণ ছিল কুফুরী করা ও মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
৩। কিন্তু কি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল?— তাদের রাসূল থেকে, যিনি একজন মানুষ, সৎ পথের সন্ধান দেন।
৪। কিসের প্রতি কুফুরী করলো?—স্পষ্ট নিদর্শনাবলী বা আল্লাহর আয়াতসমূহ।
সুতরাং ইসলাম বা দ্বীন দুইটি জিনিস – (১) আল্লাহ বা ওহী আর (২) রাসূল বা বার্তাবাহক যা আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে এবং একটিকে অস্বীকার করা মানেও কিন্তু দ্বীনের অস্বীকার করা এবং তাঁরা কিন্তু এখানেই প্রথম অস্বীকারের প্রশ্ন করেছিল(মানুষ-ই কি আমাদেরকে সৎ পথের সন্ধান দেবে?)।
আর এই রাসূল তো কুরআন নয়—কোরআন তো স্পষ্ট নিদর্শনাবলী বা আল্লাহর বাণী।
তাহলে রাসূল কোথায় পাবো?
ইসলাম যে আল্লাহ ও রাসূল বা ওহী ও বার্তাবাহক এর সমন্বয় সেটাও আল্লাহ বলে দিলেন সূরার ১২ নং আয়াতেঃ
তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসুলের অনুসরণ করো। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমার রাসূলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্ট পৌছিয়ে দেওয়া।
ইসলাম কেবল যদি কোরআন-ই হতো তবে আরবীতে ‘ওয়াও’ বলা ও ‘আতিয়ূ’ ক্রিয়া দুইবার বলাটাও ভুল হবে। কিন্তু কোরআনে কোনো ভুল নেই। এজন্য রাসূল ও বার্তা দুই – একটি কুরআন বা সরাসরি ওহী আরেকটি সুন্নাহ (যা হাদীস ও সিরাহ) থেকে আসে। এজন্যই ইসলাম দুইটি জিনিস – বার্তা ও বার্তাবাহক এবং একটিকে ব্যতীত অন্যটি ইসলাম হয় না আর আল্লাহ বলেও দিলেন ‘রাসূল এর দায়িত্ব’ (বার্তাবাহক) স্পষ্ট পৌছানো (ওহী)।
“হে আহলে কিতাব! রসূলদের আগমনের ধারাবাহিকতা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর তোমাদের নিকট আমার রসূল এসে গেছেন সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্যে। যাতে তোমরা এ কথা না বলতে পারো যে, তোমাদের কাছে কোনো সুসংবাদদাতা ও কতর্ককারী আসেননি। কাজেই দেখ, এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসে গেছে”।–(সূরা আল মায়েদাহঃ ১৯)
(সুসংবাদ)দাতা ও (সতর্ক)কারী তো ব্যক্তিবাচক আর ওহী তো ব্যক্তি নয় বরং সেটা ভিন্ন; ওহী। এই রাসূলের মাধ্যমেই কোরআন এসেছে। যদি রাসূল এবং তাঁর সত্যতা নাই থাকে তব তো ওহী বা কোরআনের আগমন-ই হুমকির মুখে পড়বে অবশ্যই। কারণ কোরআন তো আকাশ থেকে আসেনি আর আসলেও আমাদের কাছে আসেনি…আর আসলেও সেটা স্পষ্ট হবে কিভাবে একজন শিক্ষক ছাড়া? অথচ এটাকে স্পষ্ট পৌছানো হলেই না তখন কুফুরীর কথা আসে।
সুতরাং রাসূল বা নবী যে ওহী থেকে ভিন্ন এবং এই দুইটা মিলেই ইসলাম সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর ওহী, ব্যক্তি বা রাসূলও নয় যে ওহীকে আল্লাহর কাছ থেকে না পাঠিয়ে কুরাইশ থেকে পাঠানো হবে!!!
এজন্য রাসূলকে কুরআনের মাঝে যতটুকু পাওয়া যাবে সেটুকু নিতে হবে এবং এর বাইরেও হাদীস ও সিরাহ থেকে নিতে হবে অবশ্যই এবং এটা নেওয়ার কারণও কোরআনের নির্দেশ—কেননা তিনি কুরআন থেকে ভিন্ন সত্ত্বা আর এজন্য উনাকে না নেওয়া মানে ইসলাম অস্বীকার করা, ইসলামের অর্ধেক না নেওয়া, ইসলাম-ই না বোঝা; কুরআন স্পষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, এগুলো একজন মানুষের মাধ্যমে হেদায়েত দেওয়াও (সূরা তাবাগুন) দূরের কথা আর এগুলো কুরআন, হিকমাহ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়াও (সূরা বাকারাহ-১২৯, সূরা জুমুআ-২) দূরার কথা। কারণ এগুলো করতে হয় একজন মানুষ দিয়ে, একজন রাসূল দিয়ে—যিনি ভিন্ন সত্ত্বা। এটা কুরআন নিজেই করতে পারে না। সুতরাং ওহী ও রাসূল দুইজন ভিন্ন সত্ত্বা। ওহী হলো কুরআন, আর রাসূল? রাসূল হলো সুন্নাহ (হাদীস ও সিরাহ)
–হে আমাদের রব। তুমি এদের মধ্যে স্বয়ং তাদেরই কওম থেকে এমন এক রসূলের আবির্ভাব ঘটাও যে তাদেরকে তোমার আয়াত শুনাবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দেবে এবং তাদের জীবন পরিশুদ্ধ পরিমার্জিত করবে। (বাকারা: ১২৯)
কোরআন তো নিজেই আকাশ থেকে এসে কাউকে সতর্ক করে না, সুসংবাদ দেয় না, হিকমত শিক্ষা দেয় না। এগুলো তো একজন ব্যক্তিকেই করতে হয়।
এ দিক থেকে পশ্চিমারা ও ইসলাম বিদ্বেষীরা যেসব সমালোচনা করতেছেন রাসুল ﷺ এর – সেগুলোর কারণে তো পূর্ণ ওহী-ই প্রশ্নের মুখে থুবড়ে পড়ছে। তারা রাসূল ﷺ কে ধুয়ে দিয়ে গ্রন্থ তৈরি করছে ইতিহাসের আলোকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আর আপনি কেবল কুরআনের একটা দুইটা আয়াত দিয়ে বললেন দেখো আল্লাহর রাসূলের চরিত্র সর্বাপেক্ষা উত্তম, খুলুকুন আজিম।
আরে ভাই, তারা তো কুরআনই মানে না, আর যেই ব্যক্তির মাধ্যমে সেই আসছে তাকেই তো গ্রহণযোগ্য মনে করছে না…সুতরাং কোরআন তো অনেক পরের বিষয়…শিকর-ই তো তাদের নিকট ঠিক নেই।
সুতরাং কোরআন সঠিক এইটা প্রমাণের আরেকটি বিষয় হলো রাসুল ﷺ কেমন ছিলেন এইটা প্রমাণ করা। আর আপনি এমন মানুষ যিনি কুরআন বোঝওয়ালা দাবি করেও কুরআনও যে বুঝেন না সেটা তো আয়াত দিয়েই প্রমাণিত হলো আর আপনি সিরাহর চাইতে বেশি প্রামাণিক (রিজাল শাস্ত্র ও সনদের ধারাবাহিকতা) হাদীসকেই অস্বীকার করেন আর সিরাহ তো আরো দূরে। সুতরাং আপনার ইসলামের গোড়াই তো ভুল প্রমাণিত হচ্ছে, যে ব্যক্তির মাধ্যমে কোরআন এসেছে তাঁর চারিত্রিক অসাধুতার কারণে; পশ্চিমাদের অভিযোগের ভিত্তিতে।
আপনি কি আপনার বোনকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেবেন? কেন দেবেন না? চরিত্র খারাপ। আপনি কি একজন প্রতারকের সাথে লেনদেন করবেন? লোভী ব্যক্তির সাথে চলাফেরা করবেন? না। কিন্তু এই অভিযোগই তো আপনার বার্তা-র বাহককে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং যেই বার্তাবাহক-ই রিলায়েবল না, তাঁর বার্তা (কোরআন) কীভাবে রিলায়েবল হতে পারে? ইসলাম সত্য হয় কিভাবে?
সুতরাং ইসলামের মৌলিকতা, এর সত্যতা পুরোটাই প্রাথমিকভাবে রাসূলের সত্যতা, পবিত্রতা, রাহমাহ, চরিত্রর ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এজন্যই তাঁর সিরাহ এতো এতো গুরুত্বপূর্ণ।
আর এদিকটা লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেছেন সূরা ইয়াসিনে ১-৫ নং আয়াতে কুরআন এবং রাসূল- উভয়ের কথাই বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কোরআন প্রজ্ঞাময়, আল্লাহর থেকে আসছে আবার বলা হচ্ছে রাসূল অবশ্যই সৎ পথের উপর আছে। সুতরাং দুইটার সার্টিফিকেটই লাগবে।
বার্তাবাহক যদি অসৎ হয় তবে তাঁর বার্তাও কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমরা সেই বার্তাবাহক সম্পর্কেই বিস্তারিত জানি না আর এই সুযোগেই বার্তাবাহককে অসৎ, চরিত্রহীন, লম্পট ইত্যাদি প্রমাণ করে ইসলামের মৌলকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পশ্চিমারা আর আমরা নিজেরাও বাস্তব শিক্ষা পাচ্ছি না যেভাবে আল্লাহর রাসূল ﷺ তাঁর জীবনের পর্যায়গুলোতে ইসলাম কায়েম করেছিলেন সেভাবে। সুতরাং সবগুলো লেভেলে আমাদেরই ক্ষতি।
কুরআন হলো পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাবের নির্যাস। এখানে যত কিছুই বর্ণিত হয়েছে সেগুলো আমাদের হেদায়েতের উৎস, সবই। একারণে ইহুদি-খৃষ্টানদের বর্ণনা মানে তাদের বর্ণনাই কেবল নয় বরং আমাদের জন্য তাদের ভুল থেকে সৎ পথে থাকার শিক্ষা ও সতর্ক বার্তা। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরা তাদের গোত্রের নিকট কীভাবে দাওয়াত দিয়েছেন সেটা আমাদের কুরআনে আনা মানে এমনিতেই ইতিহাস পড়ানো নয়, বরং সেগুলো থেকে ঠিক শিক্ষাগুলো নেওয়া।
এবার সূরা নূহ-তে হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম) এর দিকে একটু তাকানো যাক।
২ নং আয়াতে বলা হচ্ছে নূহ (আলাইহিস সালাম) – সতর্ককারী হিসেবে এসেছেন।
৩ নং আয়াতে বলা হচ্ছে – আল্লাহর ইবাদাহ কর, তাকে ভয় করো কিন্ত…এরপরে?…”আমার অনুসরণ কর”। তার মানে এখানেই স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তাঁর ধর্ম ছিল আল্লাহর ওহী এবং তিনি বা বার্তাবাহক। এর মাধ্যমে আমাদেরকেও একই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে—আল্লাহর ওহী ও সতর্ককারী হিসেবে আল্লাহর রাসূল ﷺ. এরপর চলতে থাকুন অন্যান্য কথায়…
চলে আসলেন সূরার ২১ নং আয়াতে – নূহ (আলাইহিস সালাম) বললঃ হে আমার রব, নিশ্চয় তারা আমাকে অস্বীকার করেছে…। এরপর?…এরপর আল্লাহ তাদের সমস্ত পাপের জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন…এ পাপ সমূহের মাঝে ‘তারা আমাকে অস্বীকার করেছে’ও রয়েছে। অর্থাৎ নবীকে অস্বীকার করাটাও শাস্তির কারণ; কারণ তিনিও দ্বীনের অংশ এবং অস্বীকারের শাস্তি তো হবেই।
সুতরাং আল্লাহর দ্বীন হলো আল্লাহর ওহী ও বার্তাবাহক।
আল্লাহ কুরআনে রাসূল এর নবুওয়াতপূর্ব জীবনকে উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ আল্লাহ রাসূল ﷺ এর সিরাহকে উল্লেখ করেছেন, নবুওয়াতের দাবির সত্যতার পক্ষে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো এখানে রাসূল ﷺ বলেননি বরং আল্লাহ-ই রাসূল ﷺ কে আদেশ দিচ্ছেন ‘তুমি বল’ অর্থাৎ আল্লাহই তাঁর নবুওয়াতের ভিত্তিকে রাসূল ﷺ এর সিরাহর উপর রেখে দিলেন!! সুতরাং এই সিরাহকে উপলব্ধি করেননি মানে নবুওয়াত-ই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ
তুমি বল, আল্লাহ চাইলে আমি তোমাদের নিকট এটি পাঠ করতাম না আর না এটা জানাতাম তোমাদেরকে। কেননা এর পূর্বেওতো আমি তোমাদের মাঝে জীবনের এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছি; তবে কি তোমরা এতটুকুও আকল/জ্ঞান খাটাও না?
– ইউনুস: ১৬
অর্থাৎ এখানে দ্বীনের ভিত্তিকেই নবুওয়াতপূর্ব জীবনের সমস্ত চারিত্রিক দিককে লক্ষ্য করেই আবির্ভূত হচ্ছে। আর আমরা যদি এই নবুওয়াতপূর্ব জীবন বা সিরাহকে ভালো করে নাই জানি, তবে আমরা নবুওয়াতের বাণীসমূহকে কীভাবেই বা পৌছাবো অথবা যে ইসলাম বিদ্বেষীরা রাসূলের জীবনকে কলোষিত করে রাসূলের জীবনের ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে, ইসলামের মূলকে আছড়ে ফেলছে, সেগুলোকেই বা কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ঠেকাবো।
সুতরাং সিরাহর উপলব্ধি না জানলে আমরাই কীভাবে সেই ভিত্তি-মূলের মত হতে পারবো, অথবা কীভাবেই বা আমরা নিজেরাই ইসলাম সঠিকভাবে বুঝতে ও পালন করতে পারবো বা তাঁর মত করে নবুওয়াতের বাণী পৌছাবো অথচ আমরা তাঁর মত হবো সেটা তো অনেক দূরে, তাঁর ব্যাপারেই জানি না।
আল্লাহ ইসলামকে গ্রহণের রেফারেন্স হিসেবে এনেছেন তাঁর জীবনী—সুতরাং তাঁর পূর্ব জীবনের সমস্ত বিস্তারিত না জানা মানে হেদায়েত ও পূর্ণ ইসলাম না বোঝার শামিল।
সিরাহ কেন পড়ব? প্রয়োজনীয়তা কী?
আমরা এখন সালফে-সালেহীন, স্কলার, বিভিন্ন দাঈ এবং সিরাহর উপর কাজ করেছেন এমন আলেম ও বিশেষজ্ঞদের থেকে সিরাহর উদ্দেশ্যগুলো তুলে ধরব। তাদের মধ্যে – ড. শাইখ ইয়াসির কাদি, ড. তারিক রামাদান, শাইখ আব্দুর নাসির জাংদা, ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকী (রাহিমাহুল্লাহ), শাইখ ড. সাঈদ রামাদান আল-বুতি (রাহিমাহুল্লাহ), ড. জামাল বাদাওয়ী, নুমান আলী খান, ড. আলী সাল্লাবি, ড. মোস্তফা হুসনী আস-সিবাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), ইত্যাদি।
বিখ্যাত আলেম ড. সাঈদ রামাদান আল-বুতী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সুবিখ্যাত বই ‘ফিকহুস সিরাহ’ গ্রন্থে বলেনঃ
“রাসূলের জীবনী অধ্যয়ন মানে কেবল ইতিহাস বা ঘটনা পড়া নয় বরং রাসূলের জীবনে অন্তর্ভূক্ত জীবন্ত ইসলামকে অধ্যয়ন করা; কেবল একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি, নেতা বা বিচারক হিসেবে নয়, এগুলো একজন ব্যক্তির জন্য মুখরোচক হতে পারে কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। সবার উপরে আল্লাহর নবী ও বার্তাবাহক হিসেবেই তাঁর জীবনী অধ্যয়ন করতে হবে”।
শাইখ মুহাম্মাদ আল-গাযালি (মিশর)(ইনি কিন্তু ইমাম গাজ্জালি রাহিমাহুল্লাহ নয়) এর বর্ণনা এরকম –
“অনেক ঐতিহাসিক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী লিখেছেন। তারা রাসূল ﷺ এর জীবনের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ‘ফিকহুস সিরাহ’র উদ্দেশ্য হলো কোনো কিছু কোন উদ্দেশ্যে ঘটেছিল তার বর্ণনা থাকে যাতে সেগুলোকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে বাস্তবে আমরাও প্রয়োগ করতে পারি। এটা যেন প্রাচীন ইতিহাসের জীবন্ত ও আধুনিক ব্যাখ্যার সমন্বয় ও সমসাময়িক প্রায়োগিক দিক। এটি করার উদ্দেশ্য হলো বর্তমানে ঈমানকে জীবন্ত রাখা, চারিত্রিক পবিত্রতা বজায় রাখা, আধুনিক সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করা ও ঈমানের প্রতি দৃঢ় থাকা। বাস্তবতা হলো রাসূল ﷺ এর জীবনী সংরক্ষণের উদ্দেশ্য বাস্তবিক প্রয়োগ; বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা বা আনন্দ দান করা নয়”।
শাইখ মুহাম্মাদ আল-গাজালি আরো বলেনঃ
“আপনি হয়তো ভেবেছেন ইতিহাসের আলোকে রাসূল ﷺ এর জীবনী পড়েছেন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কিন্তু এটা মস্ত বড় ভুল। আপনি আসলে রাসূল ﷺ এর জীবনী ততক্ষণ পর্যন্ত পড়েন নি যতক্ষণ না কুরআন মাজীদ ও বিশুদ্ধ সুন্নাহ অধ্যয়ন করেছেন। এই দুটি উৎস থেকে যতটুকু আপনি উদঘাটন করতে পেরেছেন সেগুলোই আপনাকে রাসূল ﷺ এর জীবনের সাথে শক্ত অবস্থানের ইঙ্গিত দেবে (যে আপনি আসলেই কিছু জেনেছেন ও সে মতে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন)”।
প্রকৃতপক্ষে আমরা যেই সমস্যাগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং এগুলোর যে সুনির্দিষ্ট সমাধান পাচ্ছি না, সেটা হয়েছে প্রধানত সিরাহর উদ্দেশ্যগুলো না জানার কারণে এদিকে আগাতেও পারিনি এবং সমস্যাগুলোর সমাধানও হয়নি।
অবাক করা বিষয় হলো সালফে-সালেহীনদের প্রাথমিক জীবন থেকে কুরআনের সাথে সিরাহ পড়ার অভ্যাস ছিল—দুটি একই সাথে যেতো। অর্থাৎ তাদের ইসলামের প্রাথমিক ও মৌলিক সিলেবাস কুরআন ও সিরাহ।
কিন্তু পরবর্তীতে এটি হারিয়ে গেছে নানাবিধ কারণে।
কারণ পূর্ববর্তী লোকেরা সিরাহ পড়ত এ থেকে আমল করার জন্য, সুন্দর চারিত্রিক এবং অন্যান্য জিনিস নেওয়ার জন্য। কিন্তু যখন থেকে সিরাহ বলতে একটি বই, এর কিছু ঘটনা, কিছু ফ্যাক্ট এর বর্ণনা মৌলিক হয়ে দাঁড়ায়; শিক্ষা চাপা পড়ে যায়, তখন থেকেই এটি যেন শুকনো পাতার মত হয়ে পড়েছে—এর কার্যকারিতা শেষ।
অথবা এটি যেন গল্পাকারে তুলে ধরা হচ্ছে কিন্তু শিক্ষাগুলোকে ভুলে গিয়ে ইতিহাসনির্ভর করে তুলা হয়েছে যেন অতীতকালীন কোনো ঘটনা পড়ছি যেগুলোর সাথে আমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ এগুলোকে প্রাচীনকালের রুপকথায় রুপান্তরিত করা হয়েছে।
অথবা সিরাহকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যার মাধ্যমে হয়তো বর্ণনার সময় পর্যন্ত খুবই অভিভূত থাকি কিন্ত এটি শেষ হওয়ার পর আর কোনো প্রভাব থাকে না। কারণ এগুলো আমাদের কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যার সাথে আমাদের বর্তমান জীবনের সাথে কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাই না। আমরা অভিভূত কিন্তু ১৪০০ বছর পর বর্তমানে আমাদের জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা বা উপকারিতা কি?
এটি যেন ইতিহাসের ধারাবাহিক আলোচনা এবং কিছু ফ্যাক্ট এর রুপের বর্ণনা হয়েছে। এই দুটি উপাদানই দরকার কিন্তু সেই সাথে এই দুটির সাথে আরেকটি উপাদানও দরকার এবং এটিই আমাদের জন্য সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজন। আর সেটিই হলো – ফিকহুস সিরাহ বা সিরাহর উপলব্ধি।
প্রকৃতপক্ষে সিরাহর উদ্দেশ্য ছিল আমি আসলে এ থেকে কি নিতে পারি, কিরকম উপকারিতা পেতে পারি।
আমাদের দরকার ছিল সিরাহর বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতা। কীভাবে আমাদের জীবনে এটি প্রয়োগ করতে পারি, কি শিক্ষা নিতে পারি এই সিরাহ থেকে। এই বাস্তবতা থেকেই প্রশ্ন আসে এগুলো পেতে হলে আমি কীভাবে সিরাহ পড়বো, কোন পন্থায় এই বাস্তবতা, প্রাসঙ্গিকতা ও উপকারিতা পাওয়া যাবে।
আমরা অনেকেই যেমন কোরআনের অনুবাদ পড়ে থেমে থাকি কিন্তু এর থেকে প্রকৃত যে উপকারিতা পাওয়ার কথা ছিল সেটা নেই না। সিরাহর ক্ষেত্রেও আমাদের যেন সেরুপ না হয় যে আমরা সিরাহ পড়লাম, কিছু ইতিহাস, ফ্যাক্ট ও ঘটনার ধারাবাহিকতা পড়লাম কিন্তু এর থেকে আসল উদ্দেশ্য যে শিক্ষা সেটাই নিতে পারলাম না।
ড. জামাল বাদাওয়ী বলেন ইসলামী স্কলার ড. রাজেহ আল-কুরদী বলেছেনঃ
“সিরাহ মুসলিমদের ঈমান ও আকীদার সাথে সম্পর্কযুক্ত। কারণ মুসলিমদের আকীদা দুইটি বিষয়ের সাথে যুক্ত- এই দুটোর স্বীকৃতি দেওয়া (১) আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং (২) মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়া এবং এই স্বীকৃতি তাঁর জীবনী, শিক্ষা ও পথ প্রদর্শনকে অধ্যয়নের জন্য নির্দেশ করে, দাবি করে। কারণ একজন ব্যক্তি এভাবেই আল্লাহর রাসূলের উদাহরণ দেখে আল্লাহর ইবাদাহর সব কিছুকে বাস্তবায়ন করে। এজন্য-ই আল্লাহ তাকে ‘উসওয়াতুন হাসান’ বলে উল্লেখ করেছেন”।
কেন সিরাহ পড়বো সেগুলোর বিস্তারিত নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট জানা দরকার, তবে সিরাহর প্রতি আমাদের দৃষ্টি গভীর হবে আর আমরা একে গুরুত্বসহকারে নিতে পারবো।
রাসূল ﷺ কে জানা ফরজ – বাধ্যতামূলক
রাসূল ﷺ কে জানতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। এটা আমাদের প্রতি আলাহর নির্দেশ। কুরআনে প্রায় ৫০টির বেশি আয়াত রয়েছে যেগুলোতে কুরআন বা আল্লাহ আমাদেরকে নবী ﷺ কে অনুসরণীয় আদর্শ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেনঃ তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ – যারা কামনা করে আল্লাহ (এর সাক্ষাৎ) ও আখিরাতকে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে (কুরআন ৩৩:২১)
আমরা সিরাহ থেকে ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করতে পারি, পারি ব্যবহার ও মূল্যবোধ শিখতে। সিরাহ থেকে আরো শিখতে পারি রাসূল ﷺ কেমন নেতা ছিলেন, কেমন পিতা বা স্বামী ছিলেন। এমন কোনো দিক নেই যেখানে রাসূল ﷺ কে অনুসরণীয় আদর্শ নমুনা পাবো না।
রাসূলের অনুসরণ ও ভালোবাসাঃ সর্বোচ্চ সফলতা পথ
আল্লাহ যখন কোরআনে রাসূল ﷺ এর কথা উল্লেখ করেন, সেখানে অবশ্যই তিনি তাঁর জীবনী বা বায়োগ্রাফিকে রেফার করেন। একারণে দেখবেন সূরা আহযাব ২১ নং আয়াতে আল্লাহ যখন বলতেছেনঃ “যে আল্লাহকে ও আখিরাতকে কামনা করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণ করে তাঁর জন্য অবশ্যই রাসূল ﷺ এর মধ্যেই উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে চিরন্তন” – আয়াতের দিত্বীয়াংশে আল্লাহর সাক্ষাত ও সন্তুষ্টিকেই রাসূল ﷺ এর জীবনের আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করলেন। এ থেকেই বোঝা যায় আল্লাহ রাসূল ﷺ এর জীবনীকে এবং এর আদর্শকে কত বিশাল গুরুত্ব দিলেন যে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁর সাক্ষাত ও আখিরাতের মুক্তি এই জীবনীর আদর্শের মাঝেই নিহিত, এটি চিরন্তন আদর্শ, এটি বহমান আদর্শের পূর্ণ নমুনা। এ কারণেই এখানে ভাষাতাত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। লাম, লাকাদ, ফি এমার্জ, একই জুতা,। একারণে রাসূল ﷺ এর জীবনী থেকে প্রত্যেকটা লেভেলে আদর্শ নিতে হলে অবশ্যই অবশ্যই বিস্তারিত জীবনী পড়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটা লেভেলে আদর্শ নিতে হলে অবশ্যই প্রত্যেকটা লেভেলের আদর্শ জানতে হবে এবং এটি বিস্তারতি পাঠ ব্যতীত কখনই সম্ভব।
“আল্লাহর রাসূলের জীবনীতে” উত্তম আদর্শ। রাসূল ﷺ এর জীবনী মানে তো কুরআন নয়, বা হাদীসও নয়। কুরআন মানে তো আল্লাহর বাণী; এটি রাসূলের বা কারো জীবনী নয়। আর হাদীসও তো ‘জীবনী’ নয়; সেগুলো বর্ণনার সংকলনমাত্র ও জীবনের খন্ড খন্ড চিত্র। আর প্রত্যেকটা হাদীসের কিতাবগুলোর সকল বর্ণনাও যদি আলাদা আলাদাভাবে একত্রিত করেন তবুও ধারাবাহিক ও পূর্ণাঙ্গ বায়োগ্রাফি বা জীবনী পাবেন না। আর আল্লাহ রাসূলের জীবনীকেই উল্লেখ করলেন এবং এও বলে দিলেন যে তোমাদের যেই এই জীবনের যেই সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য, আল্লাহর সন্তুষ্টি, তাঁর সাক্ষাৎ, আখিরাতে ভালো অবস্থানে যাওয়া—এসব কিছুর নমুনা বা উত্তম আদর্শের জন্য আমার রাসূলের জীবনীতে যাও, তাঁর বায়োগ্রাফিতে যাও, তাঁর জীবনীতেই রয়েছে সব কিছুর প্র্যাক্টিকাল বা বাস্তবিক নির্দেশনা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেনঃ বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো- আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন ও সমস্ত পাপকে ক্ষমা করে দেবেন।আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময় (সূরা আলে-ইমরান- ৩১)
আর এই ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও ক্ষমা পাওয়ার জন্য রাসূল ﷺ কে জানার কোনো বিকল্প নেই, যা আমরা পাবো রাসুল ﷺ এর সিরাহতে।
রাসূল ﷺ এর জীবন একটি মু’জিযা
সিরাহ অধ্যয়নের মাধ্যমে আরেকট অসম্ভব উপকারিতার দিক আমরা জানতে পারি যা অনেকেই ভাবি না আর সেটা হলো রাসূল ﷺ এর সমস্ত জীবন- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত-ই পূর্ণাংগ মু’জিযা। তাঁর পূর্ণাংগ জীবন নির্দেশ করে যে তিনি একজন আল্লাহর রাসূল। তিনি এমন জায়গা থেকে এসেছেন, শিক্ষাসহ বা ব্যতীত, একটি বার্তা নিয়ে আসলেন, গভীরতাময়, একটি কিতাব, কুরআনের বাগ্মীতা – সবই এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। এসব দিকের সাথে ঐ সময়ে এতো ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং তাঁর জীবনকালেই আরবের কিছু ছিল না এমন এক সভ্যতাহীন মরুর বুকে সভ্যতার আলো জ্বালিয়ে দিলেন সমস্ত পৃথিবীর বুকে।
যেই আরব বাসীরা ছিল অজ্ঞ, ছিল না কোনো লাইব্রেরী, না কোনো সভ্যতা, না দুতলা বিল্ডিং আর না কোনো কিতাবাদি, এমনকি তারা লিখতে বা পড়তেও জানতো না।
এক অনুন্নত, অজ্ঞ ও বর্বর জাতির মধ্য থেকে তিনি আসলেন। তারা প্রকৃতই বর্বর ছিল। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র ২০ বছরের ব্যাবধানে কি ঘটল? ৫০ বছরের ইসলাম প্রচারিত হয়ে লাগল আর ১০০ বছরের মাথায় সমস্ত বিশ্বকে শাসন করল। এটাই আল্লাহর ম’জিযা যা শুরু হয়েছিল রাসূল ﷺ এর জীবন দিয়ে।
এতো সমস্ত ক্ষমতা পেয়েও তিনি ছিলেন অনাড়ম্ব, সহজ-সরল জীবনের অধিকারী। সমস্ত সাহাবারা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতেন অথচ তিনি সেটা কাউকে নির্দেশও দিতেন না। কোনো ব্যক্তি ক্ষমতা, সম্পদ ও বিলাশিতার ছোঁয়ায় পড়াটা অসম্ভব কিন্তু তাঁর মাঝে ঐশী প্রভাবের কারণে বিশুদ্ধ চিত্তের অধিকারী ছিলেন আল্লাহর রাহমাতে।
আন্দালুসিয়ার বিখ্যাত ইসলামী স্কলার ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
“আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ ﷺ কে যদি তাঁর জীবন এবং যুগ- এর মু’জিযা ব্যতীত অন্য কোনো মুজিযা নাও দেওয়া হতো, তবুও তিনি যে আল্লাহর রাসূল এটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো। মুহাম্মাদ ﷺ যে আল্লাহর নবী এটা প্রমানের জন্য সিরাই শ্রেষ্ট ঈংগিতবাহী”।
তাঁর সময়, যুগ এবং সেই অজ্ঞ ও বর্বর জাতি থেকে তিনি এতটাই বৈপ্লবিক পরিবর্তন করলেন যিনি এসেছিলেন একটি ভদ্র পরিবার থেকে, মক্কার একজন রাখাল, তাঁর বার্তা কি ঘটিয়েছিল যে মাত্র ২০ বছরেই একটি জাতির সমস্ত কিছুই পরিবর্তিত করে দিয়েছিল; চিন্তা-চেতনা থেকে শুরু করে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, খাদ্যাভাস, মূল্যবোধ, আচার-ব্যবহার, শিক্ষা, ভদ্রতা সবই।
কেউ ভাবতেও পারে নি যে একজন আরবের লোক পার্শিয়ান সভ্যতা ধ্বংস করে রোমান সভ্যতায় করাঘাত করবে, তাকেও উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বের দরবারে আসীন হবে।
কেউ ভবিষ্যতবাণী করতে পারেনি যে মক্কার একদল লোক, নতুন এক ধর্ম নিয়ে, যা রোমান বা পার্শিয়ার সমতুল্য হওয়ার কোনো যোগ্যতা-ই রাখে না। কিন্তু আল্লাহ রাহমাতের দরজা খুলে দিলেন, এই কম শিক্ষিত, সভ্যতাহীন এক ক্ষীণ সভ্য মানুষদেরকে বিজয় দিলেন এবং আরবের মরুভূমি থেকে উঠে আসল এক বিশ্বময় সভ্যতা। এটাই রাসূলের জীবনী, এটাই মু’জিযা। রাসূলের সিরাহ পড়ে এটাই বুঝতে পারি যে আল্লাহর রাসূল ছিলেন আল্লাহর এক মু’জিযা।
নবুওয়াতের সত্যতার দলীল
রাসূল ﷺ এর নবুওয়াতের সত্যতা ও ইসলাম যে আল্লাহ সত্য দ্বীন এর সত্যতা ও বাস্তবতা রাসূল ﷺ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। পশ্চিমারা সেই প্রথম থেকেই ঠিক এই গোড়াতেই আঘাত করেছে। এভাবে কাফির মুশরিকদের মতই তাকে পশ্চিমারা চরিত্রহীন, লম্পট, নারীলোভী, যুদ্ধবাজ, ক্ষমতালোভী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে এটা বুঝাতে চাচ্ছে যে যেই নবীর চরিত্র এরকম, সেই ধর্ম মানবতাময় হয় কীভাবে, সেটা সত্য ধর্ম হয় কীভাবে। অর্থাৎ পূরো দ্বীনের সত্যতা রাসূল ﷺ এর জীবনীর নিষ্কলুষতার উপর নির্ভর করছে। এজন্য ইসলামকে রক্ষা করার প্রথম ধাপ হয় রাসূলের জীবনীর নিষ্কলোষতাকে তুলে ধরা, তাকে ডিফেন্ড করা।
পৃথিবীর শ্রেষ্ট স্থান
আমরা সিরাহ অধ্যয়নের মাধ্যমে আরো পড়ি পৃথিবীর শ্রেষ্ট ব্যক্তি, সাহাবাদের শ্রেষ্ট যুগ এবং শ্রেষ্ট স্থান- মাক্কা ও মদিনা। এদুটি পৃথিবির শ্রেষ্টতম পবিত্র স্থান। রাসূলের সিরাহ-ই এই দুটি স্থানকে মর্যাদায় উন্নিত করেছে। মক্কা পবিত্র ভূমি ছিল কিন্তু সেটা কয়জনে জানতো? কে এর পরিচর্যা করেছে? কয়জনে এটা বিশ্বাস করতো? – যতদিন না রাসূল ﷺ আসলেন। আর মদিনাকে নবীর শহর বলে কে পবিত্র করলো? কে এতো বিখ্যাত করল?
রাসূল ﷺ বললেনঃ আমি আজকে মদিনাকে পবিত্র করলাম যেরুপ ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) মক্কাকে পবিত্র করেছিলেন, আল্লাহর অনুমতিতে।
বাস্তবিক মানব ও আদর্শ
আপনি যখন কিছু ফ্যাক্ট পড়েন তখন যেন কিছু তথ্যের সমষ্টি দেখতেছেন। আবার যখন ধারাবাহিক আকারে ঘটনাগুলো পড়েন তখন মনে হয় রুপকথা পড়তেছেন। একারণে যখন হাদীসগুলো বিচ্ছিন্ন আকারে পড়বেন একেকটা টপিক আকারে, সেগুলো খুবই টেকনিক্যাল ইস্যু হয়ে যায়। অথচ আমাদের দরকার ছিল একজন ‘মানুষ’ এর জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়া, কোনো টেকনিক্যাল জটিল বিষয় নয়; কারণ টেকনিক্যাল বিষয় থেকে শিক্ষা সব সময়ই সাধারণের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমাদের সামনে রাসূল ﷺ এর জীবনীকে যখন এমন আকারে তুলে ধরা হয় যেমন ‘অতি মানব’ বা ‘সুপারম্যান’ বা লিজেন্ডারি টাইপের কিছু…তখন আমাদের জীবনের সাথে এই ‘অতি মানব বা সুপারম্যান’ বা লিজেন্ডারি অতি মানব এর কোনো সম্পর্ক থাকে না। কারণ আমরা হলাম সাধারণ মানুষ আর উনি হলেন ‘অতি’ ধরণের কিছু যা আমাদের হওয়া সম্ভব নয় বা আমাদের ঐ গুণগুলো আনা সম্ভব নয়। একারণে এই ‘অতি মানব বা সুপারম্যানের কাহিনী শুনে আমরা হাত তালি দেই ঠিকই, প্রশংসা করি ঠিকই কিন্তু দিন শেষে ‘অতি মানব বা সুপারম্যান’ টাইপের কিছু হওয়ার কারণে কিছু নেওয়ার থাকে না। একারণে আমাদেরকে রাসূল ﷺ কে ‘মানবিক’(Humanize) করা দরকার; শিক্ষা নেওয়ার জন্য। আমাদেরকে বুঝতে হবে তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তাঁর পরিবার ছিল, তাঁর দুংখ-কষ্ট ছিল, তিনি হাসি-খুশিও থাকতেন। এইসব মানবিক দিকগুলো আনতে পারলেই আমরাও এসব জীবনীর ভেতর থেকে আদর্শ নিতে পারবো।
হেদায়তেঃ হাদীসের একাডেমিক জটিলতা ও সিরাহর সহজতা
আরেকটি বিষয় হল হাদীস নিয়ে। হাদীস একটি টেকনিক্যাল ইস্যু। এ থেকে মুহাদ্দিস এবং ফুকাহাগণ শিক্ষা আনেন। তবে হাদীস যেহেতু আলাদা আলাদা এবং বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিক আকারে আসে এবং এভাবে আলাদা আলাদা শিক্ষা, রুলিংস আনা হয়, একারণে এর হাদীসের বর্ণনাগুলো ‘সার্বিক বর্ণনা’(Overall Narrative)থাকে না । একারণে অনেক সময় রাসূল ﷺ কে ‘মানবিক’তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। একারণে হাদীসের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে রুলিংস এর ক্ষেত্রে কিন্তু এটি সিরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন অধ্যয়ন করা মানে রাসূল ﷺ এর ‘মানবিক’তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে যা সমস্যার একটি শুরুও হয়।
বাস্তবায়নযোগ্য শিক্ষা উদঘাটন ও আমাদের অদূরদর্শিতা
সিরাহ পাঠের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো এ থেকে শিক্ষা বের করা, রাসূল সা এর জীবনীকে প্রাসংগকি করা, আমাদের সমকালীন জীবনে প্রায়োগিক করে তুলা। এর মানে দুটি জিনিস ভালোভাবে আসে। এক- আমরা কীভাবে রাসূল ﷺ এর জীবনী পড়বো এবং এ থেকে কি শিক্ষা নেবো, আমাদের জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিকতা কোথায়। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো রাসূল ﷺ এর জীবনের মাক্কী জীবন ছিল ১৩ বছর আর মাদানী জীবন ছিল ১০ বছর কিন্তু সিরাহর কোনো বই পড়তে গেলে দেখবেন এই ১৩ বছরের বর্ণনা করা হয়েছে ৫০-৬০ পৃষ্টাতে আর ১০ বছরের বর্ণনা করা হয়েছে ২০০-৪০০ পৃষ্টাতে!!! এটা কি করে হলো? কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।
মাক্কী জীবনের চাইতে মাদানী জীবনে মুসলিম বেশি ছিল এবং একারণে সেখানে ইসলামের প্রয়োগও বেশি হয়েছে। মাদানী জীবন ছিল অনেকটা খোলা, প্রকাশ্য আর মক্কার প্রায় ৩ বছর ছিল গোপনে। মাসজিদুন নাবাবীও ছিল চর্চার একটি বড় কেন্দ্র। মাদানী যুগে সকল যুদ্ধ ছিল মাদানী যুগে, এগুলোর বর্ণনা, এসকল যুদ্ধের সাথে জীবনের অনেকটা সময়ই জড়িয়ে আছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো মাক্কার জীবনেও অনেক ঘটনা রয়েছে। কিন্তু কম আসার কারণ হলো মাদানী জীবন ছিল বাস্তবিক প্রয়োগের সময় আর এর জন্য এখান থেকে হাদীসের বর্ণনার ধারাবাহিকতাও বেশি এসেছে এবং সিরাহর বর্ণনাও বেশি এসেছে। কিন্তু মাক্কায় যেহেতু শরীয়াহর বাস্তবিক প্রয়োগ ছিল না এবং হাদীসও কম এসেছে, তাই মাক্কী জীবনের অসংখ শিক্ষা থেকে আমরা নিজেরাই বঞ্চিত হয়েছি। অথচ আমাদের জানা দরকার ছিল হাদীস এবং সিরাহর দুটোর দুই প্রায়োগিক শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। একারণে মাক্কী জীবন বিস্তারিত জানা ও শিক্ষা আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা সবাই কম-বেশি রাসূল সা যেভাবে গিয়েছেন জীবনের ধাপে, ঠিক সেভাবেই যাই আর এসব ধাপে আদর্শের শিক্ষাহীনতা ও অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ না পাওয়া মানে পা পিছলে পথভ্রষ্টতাময় গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
সামগ্রিক জীবনের প্রাসঙ্গিক দৃষ্টপট
আমাদের বাস্তবিক জীবনে চাতুর্মুখিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বের আরব মরুভূমির একজন মানুষের জীবন আমাদের এসব সমস্যার সমাধান দেবে কীভাবে? কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা যখন রাসূল ﷺ এর জীবনীকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করবো, তখন উপলব্ধি করতে পারবো যে তাঁর জীবনে আমাদের জীবনে আসা ছোট্ট থেকে শুরু করে যত বড় ঘটনাই আসুক না কেন, তিনি এগুলোর আল্টিমেট বিষয় পাড়ি দিয়ে গেছেন। দরকার কেবল গভীরভাবে সিরাহকে উপলব্ধি করা। সুতরাং ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংগঠনিক, আন্দোলনগত, যুদ্ধ-জিহাদ, বিনিময়, আচার-ব্যবহার সকল দিকের সমস্যার সমাধান, সুন্দরতম পন্থা, সুন্দরতম ফল সবই উপস্থিত পাবো রাসূল ﷺ এর জীবনীর গভীর উপলব্ধিতে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ২০০ বছর যেহেতু বড় ধরণের কোনো ধাক্কা খায়নি, তাই এই ইস্যুতে রাসূল ﷺ এর জীবনীকে নতুন আঙ্গিকে সমকালীন প্রাসঙ্গিক হিসেবে তুলে আনার প্রয়োজনও বোধ করা হয়নি এবং এই ভুল রয়ে গিয়েছিল গত শতাব্দির অনেকটা বছর জুড়ে।
আধ্যাত্বিক সমস্যা ও হাদীস অস্বীকার
সিরাহ উপলব্ধির আরেকটি দিক হলো হাদীসের বিশুদ্ধতা নিরুপন। হাদীসের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে যে হাদীসগুলো উপযুক্ত অবস্থায় এসেছে কিনা। এগুলোর একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে ট্যাকল দেওয়া হয়েছে অবশ্যই। রিজাল শাস্ত্র একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কুরআনে যেখানে বলা হচ্ছে – “তোমাদের রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ করো আর যা থেকে বিরত রাখে তা থেকে বিরত থাকো”- সূরা হাশর-৭। এ থেকে বোঝা যায় কুরআন যেরুপ ও যেই সাহাবাদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আসছে ঠিক একই বর্ণনার ধারাবাহিকতা দিয়েই রাসূল ﷺ এর হাদীসগুলোও আসছে। এই একাডেমিক বর্ণনা অবশ্যই ঠিক আছে। কিন্তু মূল কথা হলো হাদীস অস্বীকারের বিষয়টা আধ্যাত্বিক সমস্যার কারণে হয়েছে, একাডেমিক কারণে শুরু হয়নি।
এই আধ্যাত্বিক সমস্যা কী?
আমাদেরকে বলা হয়েছে রাসূল ﷺ কে ভালোবাসতে(সূরা আলে-ইমরান-৩১)। কিন্তু এই ভালোবাসা মানে কী?
যা রাসূল ﷺ কে আনুগত্য করতে বলে, তাকে গ্রহণ করতে বলে, যা তাঁর জীবনীকে পড়তে বলে, তাকে অনুসরণ করতে বলে — এগুলোই তাঁর জন্য ভালোবাসা।
আপনি রাসূল ﷺ কে ভালবাসতে পারবেন না যখন আপনি তাকে চেনেনই না, জানেন না তাঁর জীবনী, তিনি কেমন ছিলেন, কীভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। একজন ব্যক্তি পরিচিত হলেই না তাকে ভালোবাসার প্রশ্ন আসে। পরিচিতির সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক। ভালোবাসার সম্পর্কগত মনস্তত্ব এভাবেই কাজ করে। একারণেই সিরাহর উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এভাবে তাঁর জীবনের পূর্ণ ধারাবাহিক পরিচিত উন্নয়ন হতে হতেই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এভাবে পূর্ণ জীবনের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠলে হাদিসের ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা থাকবে না সেগুলো বিচ্ছিন্নতা আকারে পড়ার জন্য।
হাদীস অস্বীকার করার কারণ ধারাবাহিক আকারে যখন সিরাহ না পড়া হয়, অনুপলব্ধি থাকে, তখন বিচ্ছিন্ন হাদীসের সাথে জীবনের প্রাসঙ্গিকতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং এভাবে শত শত প্রশ্ন চলে আসে এবং হাদীস অস্বীকার করে থাকে।
হাদীসের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা, হাদীস শাস্ত্রের জটিলতা, নাযিলের প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি না জানার কারণে একটি বা দুইটি হাদীস বা একটা টপিকের হাদীস জানার কারণেও জীবনের সাথে ধারাবাহিক প্রাসঙ্গিকতা না থাকার কারণে রাসূল ﷺ এর জীবনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে না এবং বিপরীতে হাদীস অস্বীকার করার নমুনা আসে। বিপরীতে যখন সিরাহ পড়বেন তখন সিরাহতে রাসূল ﷺ এর ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো জটিলতা নেই, ঘটনার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান, প্রসঙ্গের সাথে ঘটনাগুলো বর্ণিত, জীবনের প্রত্যেকটা অংশ এর পরের অংশের সাথে ধারাবাহিক ঐক্য বজায় রেখে চলেছে…এবং এভাবে বোঝার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না, এভাবে ভালবাসার ক্ষেত্রেও কোনোরুপ সমস্যা হয় না আর শিক্ষাগুলোও নেওয়া যায়। একারণে হাদীস অস্বীকারকারীরা মূলত কোরআনের নির্দেশ অনুসারে রাসূল ﷺ এর জীবনী পাঠ করেনি আর তাই কুরআন ও হাদীস দুটো ক্ষেত্রেই তাদের সমস্যা হয়। কারণ রাসূলের জীবনী ছাড়া উত্তম আদর্শের নমুনা কোথায় পাবো? অথচ আল্লাহ বলেছেন তাঁর জীবনেই উত্তম আদর্শ নমুন রয়েছে এববং আল্লাহ সেখানে কত তাকিদ দিয়েছেন শব্দের মাঝে।
ইসলামের বাস্তব প্রয়োগ ও উপলব্ধির শ্রেষ্ট পাঠ
রাসূল ﷺ এর জীবনী কুরআন উপলব্ধির উত্তম সহায়ক মাধ্যম। যেকোনো জটিল টেকনিক্যাল বস্তুর সাথে একটি প্র্যাক্টিক্যাল মান্যুয়াল থাকে। এটিই কুরআনের সাথে রাসূল ﷺ এর জীবনের প্র্যাক্টিকাল মান্যুয়াল। একারণেই মা আয়েশা(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলতেনঃ তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন। অর্থাৎ বাস্তবিক উদাহরণ ও উত্তম আদর্শের নমুনা বা মান্যয়াল ছিল তিনি এবং সাহাবারা ও তাবেয়ীরা এভাবেই বুঝতেন। গত কয়েকশত শতাব্দীর যদি বড় ধরনের কোনো ধংসাত্বক বিষয় থাকে তাহলো দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া। বিদায় হজ্জ্বে রাসূল ﷺ বলেছিলেনঃ…তোমরা কষ্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হবে না যদি এই দুটি জিনিসকে দাত দিয়ে শক্তভাবে আকড়ে ধরোঃ তাহলো কিতাবুল্লাহ ও তাঁর নবীর সুন্নাত”। এটাই সিরাহর উপলব্ধি যা কুরআন উপলব্ধির প্র্যাক্টিকাল মাধ্যম। এখানেও আশ্চর্য বিষয় হলো ‘নবীর হাদীস’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘নবীর সুন্নাত’। আর এই সুন্নাহ কেবল হাদীস থেকে পাবেন না, কারণ সেগুলো বর্ণনামাত্র। এই সুন্নাহ পেতে হলে হাদীসের সাথে রাসূল ﷺ এর বাস্তবিক জীবনীর ঘটনাপ্রবাহগুলো অবশ্যই নিতে হবে। কারণ জীবনের ঘটনাপ্রবাহ সুন্নাহ মোতাবেক চলেছে এবং এগুলো ধারাবাহিক ও পূর্ণাঙ্গরুপে।
পূর্ণাংগ অনুসরণীয় আদর্শের চূড়ান্ত রুপ
রাসূল ﷺ এর হাদীসগুলো যখন আলাদা আলাদা আকারে পড়া হয়, তখন্ন আলাদা আলাদা কিছু ফিকহী রুলিংস বা নিয়ম-কানুন আসে। এগুলো প্রত্যকের জন্য প্রত্যেক অবস্থায় প্রযোজ্য নাও হতে পারে বা কেউ নাও খুঁজতে পারে। কিন্তু আপনি যখন ধারাবাহিকভাবে তাঁর জীবনী পড়বেন, তখন তাঁর জীবনের ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রত্যকেই প্রত্যকের জীবনের সকল অবস্থায়ই সব ধরণের হেদায়েত পাচ্ছে!! এমন কেউ থাকছে না যিনি রাসূল ﷺ এর জীবনীকে অপ্রাসঙ্গিক, অনর্থক বা তার জীবনের সাথে বাস্তবতা বিবর্জিত মনে করছে। বরং প্রত্যকেই রাসূল ﷺ এর জীবনী থেকে শিক্ষা নিতে পারছে, তার জীবনের সমস্যার সমাধানে প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ মনে করছে এবং এভাবে সিরাহকে জীবন্তরুপে পাচ্ছে। এভাবে একজন যুবক পাবে তার যৌবন বয়স যাপনের সকল দিধা-দ্বন্দের উত্তর, একজন স্বামী পাবে তার বিবাহিত জীবনের সুখের চাবিকাঠি, সকল বিবাহিত জীবনের সমস্যার সমাধান, একজন শাসক পাবে কীভাবে সকলের কল্যাণকামিতা দেখাশুনা করতে হয়, একজন দাঈ পাবে কীভাবে দাওয়াত দিতে হয়, একজন রাষ্ট্রনায়ক পাবে কীভাবে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, একজন ব্যক্তি পাবে কীভাবে সৎ হতে হয়, একটি পরিবার দিশা পাবে কীভাবে পরিবারকে তাকওয়ার উপর ভিত্তি করতে হয়, একটি রাষ্ট্র পাবে কীভাবে সুন্দরতম পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এভাবে সকলের হেদায়েতের দিশা পাবে সিরাহর গভীর উপলব্ধিতে এবং যা হবে সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য।
রাসূল ﷺ বলেছেনঃ নিশ্চয় আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। তার মানে তিনি তাঁর সমস্ত জীবনের মাধ্যমে বাস্তবিক সব শিক্ষাই দিয়ে গেছেন অথচ আমরা সেই শিক্ষাগুলো না নিলে কীভাবে নাজাত পাবো? জীবনের প্রত্যেকটা দিকে পথ নির্দেশনা পাবো কীভাবে?
রাসূল ﷺ এর পথ অনুসরণ করার জন্য। রাসূল সা এর চরিত্র ছিল সর্বাপেক্ষা পূর্ণতাসমৃদ্ধ। এজন্য আখিরাতের সাফল্য পেতে হলেই এই চারিত্রিক মাধূর্যের মাধ্যমেই নাজাতের পথ অনুসরণ করতে হবে।
সিরাহ আমাদেরকে রাসূল সা এর হেদায়েতপ্রাপ্ত জীবনের সাথে আমাদের ঈমান, আখলাক ও আদব ইত্যাদির সাথে অবিরত সংযুগ প্রতিষ্ঠিত করে। সিরাহ আমাদেরকে পিতা, স্বামী, নেতা, ন্যায়বিচারক, বন্ধু, শিক্ষাবিদ, দাঈ, ব্যবসায়ী, ভ্রমণকারী, যোদ্ধা, শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী- এসবের জীবন্ত ও শক্তিশালী আদর্শ নমুনার পথ দেখায়। প্রকৃতপক্ষে এটি আমাদের প্রাত্যহিক মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় আদর্শ দেখায়। তাঁর জীবনের প্রত্যেকটা খুটি-নাটি বিস্তারিতই আমাদের কাছে সংরক্ষিত এবং এগুলো আমাদের সবারই অনুসরণের জন্য আদর্শ উদাহরণ।
সর্বশ্রেষ্ট যুগ
আমরা সিরাহ অধ্যয়নের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ট যুগ ও সময়ের সাহাবাদেরকে দেখি যাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন ‘আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট’
রাসূল ﷺ বলেছেন খাইরুল উম্মাতি কারনি, আমার উম্মাত-ই শ্রেষ্ট উম্মাহ, অর্থাৎ সাহাবারা। তিনি সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের লোকদেরকে সাহাবা হিসেবে পেয়েছিলেন। এভাবে আমরা সিরাহ পড়তে গিয়ে সর্বশ্রেষ্ট মানুষদের শিক্ষাগুলো পড়ি – আবু বাকার, উমার, জুবায়ের, তালহা, সা’দ, মু’য়াজ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) এবং এই শ্রেষ্টদের জীবনী আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়, আমাদের ঈমানী শক্তিকে দৃঢ় করে – তাদের ধৈর্য, আত্মত্যাগ, অধ্যবসায়। এরা প্রত্যেকেই আমাদের অনুসরণীয় মডেল হিসেবে সম্মুখে থাকে।
জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় আদর্শ
মানব ইতিহাসে কারো জীবনী এত বিস্তারিত, সুক্ষাতিসুক্ষ্ণ, জীবনের প্রত্যকেটি দিক প্রামাণিকভাবে লেখা হয়নি। ইমাম আত-তিরমীযী (রাহিমাহুল্লাহ) এর শামায়েলে তিরমীযী- তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর শোয়ার ধরণ, তাঁর শরীরের রঙ, কপালের বর্ণনা, চোখের বর্ণনা, চুলের পরিপাটি, হাটার ধরণ, খাওয়ার পদ্ধতি, কথার টুন, অন্যের সাথে আচার-আচরণ থেকে শুরু করে পারিবারিক, আত্মীয়সজনের সাথে চলাফেরা, বন্ধু, স্ত্রী, সাহাবী, সবার সাথে কেমন চলতেন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব দিক—-এভাবে সকল দিক প্রামাণিকভাবে এতো সুক্ষাতিসুক্ষ্ণ রক্ষণাবেক্ষন ইতিহাসে জীবন্ত হয়ে আছে রাসূল ﷺ এর জীবনীতে। অথচ তিনি কোনো জীবনী নিজে লেখননি। আজকের দিনেও যাদের নিজেদের হাতে নিজেদের অটোবায়োগ্রাফি লিখেছেন, তাদের জীবনী পড়ে দেখেন দেখবেন কত কিছু মিস!!
একারণেই আল্লাহ বলেনঃ আমি আপনাকে অবশ্যই সমস্ত মানব জাতির জন্য প্রেরণ করেছি।
অন্য জায়গায় আল্লাহ রাসূল ﷺ এ ঘোষণা দিতেই বলে দিয়েছেঃ বলুন, আমি আল্লাহর রাসূল এবং আমাকে সবার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
আরো বলেনঃ অবশ্যই আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্বের জন্য রাহমাতস্বরুপ প্রেরণ করেছি।– রাসূলকে রাহমাতস্বরুপ, কুরআন বা হাদীসকে নয়। সুতরাং এই রাহমাতের স্বরুপ, বিশজনীনতা, উপকারিতা জানতে হলে অবশ্যই তাঁর জীবনী জানা আবশ্যক।
মুসলিম উম্মাহর পূনর্জাগরণের নির্ভুল মেথডলজি
মুসলিম বিশ্ব প্রায় কয়েকশ বছর ধরে পতনের মাঝে নিমজ্জিত। এখন ইসলামি শিক্ষার উপকরণ নেটে প্রচূর পরিমাণে পাওয়া যায়। সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ বলেছেনঃ “কুরআন পাঠানো হয়েছে পূর্বে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে যেন সতর্ক করা হয়”। কারণ তারা অসতর্ক ছিল, তাদের চিন্তা-ভাবনা ছিল না। কিন্তু এখন আমরা এই সতর্কতাকে কাঠিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যদি সফলতার দিকে ধাবিত হতে চাই। আমাদের দরকার গভীর পরাশোনা ও তারবিয়্যাহ। তাঁরবিয়্যার দুটি জিনিসের প্রতি খুবই গুরুত্ব দেওয়া দরকার।। এক- কুরআনের শিক্ষা। এখানে প্রাথমিকভাবে দরকার ঈমানের বিষয়াবলী বোঝা, ফরজ বিষয়গুলো ভালো মত পালন করা, তাওবাহ, আখলাক ইত্যাদি ব্যাসিক বিষয়াবলীর উপলব্ধি এবং জীবনে প্রয়োগ। দুই- তারবিয়্যার দিত্বীয় দিক হলো রাসূল ﷺ এর জীবনী অধ্যয়ন যা একজন ব্যক্তিকে রাসূল ﷺ এর সাথে সম্পৃক্ত করবে, যিনি শুণ্য থেকে শুরু করে জীবদ্দশাতেই কি পূর্ণতার রুপকে সাজিয়েছিলেন আল্লাহর রাহমাতে।
রাসূল ﷺ এর জীবনী ইসলামী আন্দোলনের মেথডলিজিক্যাল পদ্ধতি। তিনি ধারাবাহিকভাবে স্টেজ বাই স্টেজ গিয়েছে জীবনের মধ্য দিয়ে। তিনি শূণ্য থেকে শুরু করে তাঁর বেঁচে থাকাকালীন সময়েই দেখে গেছেন তাওহীদি বিজয় পতাকা। এগুলো অবশ্যই আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই হয়েছে; বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এই পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়েই আবারো ইসলামের সফলতা আসবে। আমাদেরকেও ঐ পদ্ধতিতেই আগাতে হবে। সুতরাং তিনি কোন কোন ধাপে এগিয়েছেন এবং দাওয়াতের পদ্ধতি কীভাবে এগিয়েছে সেগুলো দেখা দরকার।
বিভিন্ন ইসলামী গোষ্টি ইসলামী পূনর্জাগরণের ব্যস্ত কিন্তু তাদের মেথডলজি ভিন্ন ভিন্ন ও নিজদের তৈরি। আমরা রাসূল ﷺ এর মেথডলজি-ই অনুসরণ করি না কেন যিনি ছিলেন শ্রেষ্ট মানুষ, যিনি একদম শুণ্য শুরু করে পুরো এক ইসলামী সভ্যতার বিজয়ের বাস্তব ধারক হিসেবে সফলতা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন আল্লাহর মেথডলজি দিয়ে।
রাসূল ﷺ যেই ধারায় বা পর্যায়ক্রমে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন সেগুলো আল্লাহর ওয়াহীভিত্তিক ছিল, কিয়াকশনারী ছিল না। গোপন দাওয়াহ থেকে উন্মুক্ত দাওয়াহ এবং শেষে জিহাদ। এই ধারা বিচ্ছিন্ন ও রিয়াকশনারী বা পরিস্থিতির আলোকে নয় বরং আল্লাহর প্ল্যান-পদ্ধতিতেই ছিল।
আল্লামা রশিদ রিদা (Rasheed Rida) বলেনঃ
“এগুলো যদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য নাই হতো, তবে কেবল শাব্দিক কথার নির্দেশনা যথেষ্ট হতো না। কারণ সিরাহ-ই তাদেরকে শিখিয়েছিল কীভাবে কুরআনের মাধ্যমে সঠিক পথ পেতে হবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থায় চলতে হবে। সুতরাং আমাদের কাছে শাব্দিক শিক্ষার কুরআন ও সুন্নাহ রয়েছে, কিন্তু এসব কথার শিক্ষা আমরা কিভাবে প্রয়োগ করবো? রাসূল ﷺ ও সাহাবাদের জীবনের বাস্তব প্রয়োগ দেখে। কেননা, তারা আল্লাহর কথার নির্দেশনাগুলোকেই বাস্তবে কাজে পরিণত করেছিল। আমরা দেখতে পাই যে অন্যান্য নবী-রাসূলদের জীবনী হারিয়ে গেছে কিন্তু আমরা জানতে পারি কুরআন কীভাবে প্রয়োগ হয়েছিল, আমরা আরো জানতে পারি কীভাবে রাসূলের সুন্নাহ বাস্তবায়িত ও প্রয়োগ হয়েছিল”।
মানুষ প্রশ্ন করে আমরা কীভাবে উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনবো? – আমরা বলি সিরাহ-তে সেই প্রশ্নের পূর্ণাংগ সমাধান আছে।
ইসলামের শ্রেষ্ট ইতিহাস
মুহাম্মাদ সা এর জীবনী-ই হলো ইসলামের শ্রেষ্ট ইতিহাস। আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি দিকের সমস্যা ও সমাধান রয়েছে এই জীবনীতে। আমরা কেবল জীবনী পড়তেছি না, আমরা পড়তেছি ইতিহাস এবং আমাদের জীবনের জন্য বাস্তব শিক্ষা। ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা হলো; যে যত বেশি পেছনে দেখতে পারে, সে ততো বেশি সামনে দেখতে পারে। কেননা ইতিহাসের চিরন্তন শিক্ষা নিয়ে আগানো আর ভুলগুলোকে সঠিকে রুপান্তরিত করার আয়না হিসেবে কাজ করে। এভাবে উন্নতির শিখরের দরজা আমাদের পূর্বেই বপিত হয়ে আছে রাসূলের জীবনীতে।
কুরআন উপলব্ধিতে সিরাহ অপরিহার্যতা
কুরআনের অনেক আয়াত স্বাধীনভাবে ব্যবহার হতে পারে (আকীদা ও আখিরাত)। কিন্তু যেসব বিষয়াবলী রাসূল ﷺ এর সাথে, ঐ সময়ের কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত, সেগুলো বোঝার জন্য অবশ্যই সিরাহ দরকার, নতুবা কুরআনের উপলব্ধিও সম্ভব নয়। কারণ মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর, তাঁর ঘটনার সাথে বা প্রসংগেই তো নাযিল হয়েছে, তাহলে তাকে ছাড়া এসব আয়াতের উপলব্ধি কীভাবে সম্ভব? অর্থাৎ কুরআন যেহেতু রাসূল ﷺ এর উপর নাযিল হয়েছে এবং তিনিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ হয়েছেন, তাই তাঁর জীবনী না জানলে প্রসঙ্গহীনভাবে কুরআনের উপলব্ধি সম্ভব নয়। সূরা আহযাবের অনেক আয়াত আহযাবের যুদ্ধ নিয়ে, সূরা আলে-ইমরান রাসূল ﷺ এর সাথে খৃষ্টানদের সাথে আলোচনা। কিন্তু এগুলো বিস্তারিত কুরআনে পাওয়া যাবে না আর তাই সেগুলো বুঝতে সিরাহর কাছে যেতেই হবে। এ ছাড়া কুরআনে বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্ন জিহাদের কথা এসেছে কিন্তু কোন আয়াতগুলো কোন জিহাদের প্রেক্ষাপটে সেগুলোর নাম নেই। এক্ষেত্রে অবশ্যই সিরাহ নিতেই হবে কুরআন উপলব্ধির জন্য।
সূরা ইনশিরাহতে বক্ষ বিদীর্ণ করার কথা এসেছে। অথচ এটি ছিল রাসূল ﷺ এর ৫ বছর বয়সের ঘটনা। অর্থাৎ আল্লাহ ৫ বছর বয়সের সিরাহকে উল্লেখ করলেন আর আমরা যদি সিরাহ নাই জানি, তবে সূরা বা আয়াতের শিক্ষাও বুঝতে পারবো না।
অথবা সূরা দুহা(আয়াত-৩)-তেও এসেছে “তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেনি আর তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হয়নি”।
সিরাহ অধ্যয়ন ব্যতীত এই আয়াত বুঝবেন না। কখন এটি নাযিল হয়েছিল, কেন এটি নাযিল হয়েছিল, নাযিলের প্রসঙ্গ কী ইত্যাদি।
কুরআনের যত জায়গায় নবী বা রাসূল শব্দ দিয়ে উল্লেখ করেছেন, সবগুলো জায়গায়ই আপনার সিরাহর ঐ অংশ জানা দরকার। একজন সুসংবাদদাতা হিসেবে উল্লেখ করলে আপনার সিরাহ থেকে জানা উচিৎ তিনি সুসংবাদদাতা হিসেবে কেমন ছিলেন। আল্লাহ যখন তাকে দাঈ হিসেবে উল্লেখ করছেন, তিনি কেমন দাঈ ছিলেন সেই প্র্যাক্টিকাল দিক জানতে সিরাহ পড়তেই হবে। কেমন আদর্শ স্বামী বা পিতা ছিলেন সেটা সিরাহ থেকে জানতে হবে।
এভাবে কুরআনের সাথে সিরাহর অংঙ্গাংগিভাবে জড়িত।
আশার আলোঃ ঈমানী দৃঢ়তা
সিরাহ আমাদের আশার উৎস। এটা আমাদেরকে উজ্জীবিত করে, আশার মাধ্যমে আমাদেরকে জাগ্রত করে। সিরাহ অধ্যয়নের মাধ্যমে জানতে পারি আমাদের পূর্বে আমাদের চাইতে বেশি কষ্ট করে গেছেন অনেক ব্যক্তি কিন্তু সেই কষ্টসমূহের জায়গায়ও তারা সৎ পথে অটল থেকেছেন, হেদায়েতের চূড়ান্ত রুপ দেখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ কুরআনে নবীকে পূর্ববর্তী নবীদের সিরাহ বর্ণনার উদ্দেশ্যে বলেনঃ
“আমি তোমার কাছে ঐসব নবীদের মধ্য থেকে রাসূলদের বৃত্তান্ত বর্ণনা করি যাতে তোমার অন্তরকে ঐগুলো দ্বারা দৃঢ় করতে পারি। এর মাধ্যমে তোমার কাছে এসেছে সত্য আর মুমিনদের জন্য এসেছে শিক্ষণীয় বাণী ও উপদেশ” – সূরা হুদ-১২০
এজন্য আমরা পূর্ববর্তী নবী-রাসুল, আমাদের নবী ও সাহাবারা যেই সর্বোচ্চ লেভেলের কষ্ট থেকে দৃঢ়তা, সততা ও সাফল্যের পথের নির্দেশনা পেয়েছেন, সেখানে তাদের চাইতে খুবই কম কষ্টের মাঝেও আশার সঞ্চারণ ধ্বনি দেখতে পাই, দেখি অন্ধকারের মাঝে জোনাকির ঝিলিকের আলোকছটা যা আমাদেরকে ঈমানের দৃঢ়তায় ফিরতে সাহায্য করে, আলো দেখায় ভবিষ্যতের; সাফল্যের।
ইসলামিক আইডেন্টিটি
সারা বিশ্বে গ্লোবাল কালচার চলছে কিন্তু এর মাঝে যদি আমরা যদি রাসূল ﷺ এর আখলাকের আলোকে উন্নত কালচার তৈরি করতে না পারি তবে আমাদের আইডেন্টিটিই নষ্ট হবে আর আমরা বিপন্নতার মুখে পড়বো। কারণ কোনো উন্নত কালচার তাঁর চেয়ে নিম্ন কালচার বা নিষ্ক্রিয় কালচার ও আইডেন্টিটিকে থমকে যেতে বাধ্য করে এবং এভাবে হারিয়েও যাবে। আমরা নবীদের ইতিহাস ও শিক্ষা জানি না কিন্তু শার্লক হোমস বা ইংলিশ মুভির সবই বলে দিতে পারি। এভাবে আমাদের শিকড়কে হারিয়ে ফেলছি। এজন্য আমাদের নবীর সিরাহ পড়লে বুঝতে পারি কীভাবে সমস্ত জায়গায় তিনি ইসলামের আইডেন্টিটিকে সুন্দরতম আখলাকের দ্বারা তুলে ধরতেন। এজন্য আমাদের সিরাহ পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সিরাহর উৎস কী কী?
প্রায় সারে চৌদ্দশত বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু আমি সিরাহর সোর্স পাবো কোথা থেকে? কোথা থেকে সিরাহর অধ্যয়ন নেবো? সিরাহর প্রাথমিক সোর্স কোনগুলো? আমি কীভাবে জানবো কী ঘটেছিল রাসূল ﷺ এর জীবনে?
উস্তাদ নুমান আলী খান বলেনঃ একজন ভালো মুসলিম হতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ জীবনের প্রাত্যহিক পরিকল্পনায়।
১। প্রাত্যহিক ইবাদাহর উন্নতি করা। রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে গিয়ে সালাত ঠিকমত আদায় করা, কুরআন মুখস্ত করা ইত্যাদি।
২। জ্ঞানার্জন করা। আপনি প্রচূর জ্ঞানার্জন করলেন কিন্তু ইবাদাহ করলেন না, আপনার জ্ঞানের কোনো উপকারিতা নেই। এর মাঝে কমপক্ষে প্রতি বছর একটি করে সিরাহ অধ্যয়ন করা এবং প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন সিরাহ অধ্যয়ন করা- এবং সিরাহ অধ্যয়নকে খুবই গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। এভাবে সবগুলো সিরাহ পড়তেই থাকুন প্রতি বছর বারবার। কেননা রাসুলের সেই জীবনই আমাদের ভিশন, তিনি-ই আমাদের অনুপ্রেরণা। সুতরাং আমাদেরকে তাঁর কাছে বারবার ফিরে যেতে হবে। এটা জ্ঞানের অপরিহার্য অংশ। এটা আপনাকে জীবনের জন্য লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে, উপলব্ধির গভীরতা আনবে। জ্ঞানার্জনের আরেকটি ধারাবাহিক অপরিহার্য অংশ রাখুন কুরআনের জন্য। হতে পারে একটি সূরা এক বছরের জন্য রাখুন এবং একে গভীরভাবে বিভিন্ন তাফসির থেকে পড়তে থাকুন, সম্ভব হলে একই সাথে এক বছরে ঐ সূরাটি মুখস্ত করে ফেলুন। প্রাত্যহিক জীবনের জন্য কিছু কিছু দোয়া মুখস্ত করুন। জ্ঞানকে বাস্তবের রুপান্তরিত করুন।
৩। সেবামূলক কাজ করা। অন্যকে সাহায্য করা। এটি ইসলামের ব্যাপারেই যে করতে হবে তা নয়। কিন্তু এটি করতেই হবে। আরো ভালো হয় অমুসলিমদের সাথে কাজ করা যেন তারা বুঝতে পারে মুসলিমরা কতটা কেয়ারফুল। এতে তারাও ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করবে, জানবে, ইসলামের ছোঁয়ায় আসবে। এটি ম্যাচিউরিটি তৈরি করবে।
তাহলে চলুন সিরাহর কিছু সোর্স দেখি।
প্রথম উৎসঃ কুরআন
সিরাহর প্রথম সোর্স অনেকেই ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশাম বলে। আসলে সিরাহর প্রথম সোর্স হবে কুরআন। কারণ কুরআন তো রাসূলের সিরাহর সময় নাযিল হয়েছিল, তাঁর উপর নাযিল হয়েছিল, তাকে প্রসংগকে করে। কুরআনের বড় বড় ঘটনাগুলোই রাসূলকে কেন্দ্র করে, তাঁর সময়ে ঘটেছিল।
যেমন সূরা ইনশিরাহর ঘটনা তাঁর জীবনের ৫ বছর বয়সে ঘটেছিল যখন জিব্রাইল (আলাইহিস সালাম) প্রথম তাঁর নিকট এসেছিল।
এমনকি কুরআন তাঁর জন্মের পূর্বের কাহিনীও বর্ণনা করেছে। সূরা ফিল তাঁর উদাহরণ। অর্থাৎ আমরা দেখি কুরআন তাঁর জন্মের পূর্ব থেকে তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত বলে দিচ্ছে যা সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াতের অংশ বিশেষ – “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম…”
কুরআন সিরাহর শ্রেষ্ট সোর্স হওয়ার কারণ অনেকগুলো। প্রথম হলো এটি আল্লাহর কথা এবং আল্লাহ-ই আমাদেরকে সব কিছু বলতেছেন। আরেকটি বিষয় হলো আল্লাহর কালামের অসাধারণ অনিন্দ বাগ্মীতা যা অন্যকিছুর তুলনায় অতুলনীয়। আল্লাহ কত সুন্দরভাবে বদর, ওহুদ যুদ্ধের এবং সাহাবাদের হৃদয়ের অনুভূতির বর্ণনা দিলেন। কুরআনের অনন্যতা হলো যেখানে ঐতিহাসিকরা ঘটনার বাহ্যিক দিক তুলে ধরেন সেখানে আল্লাহ অভ্যন্তরীরণ ও অন্তরস্থা বিষয়াবলীকে ফুটিয়ে তুলেন।
কুরআনের ব্যাপারে একটি বিষয় হলো কুরআনে সিরাহ ধারাবাহিকভাবে আসেনি। কুরআনের সাজানি কুরআনের নিজস্ব স্টাইলে (‘তাফসীর তাদাব্বুরে কুরআন’ দেখুন- আল্লামা আমীন আহসান ইসলাহী), সিরাহর ধারাবাহিকতা অনুসারে নয়। আবার কুরআনে একটা ঘটনা বর্ণিত হয়েছে কিন্তু কোন বিষয়ের ঘটনা সেটার রেফারেন্স নেই।
এজন্য কুরআন বুঝতে সিরাহর অপরিহার্যতা অবশ্যই রয়েছে। এটা সিরাহর প্রথম সোর্স যার ভাষার বর্ণনাভঙ্গি অতুলনীয় এবং সর্বাপেক্ষা জ্ঞানসমৃদ্ধ।
দ্বিতীয় উৎসঃ হাদীস
সিরাহর দ্বিতীয় উৎস হাদীস। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটা হাদীস-ই কিন্তু সিরাহর একেকটা অংশ। হাদীস কি? রাসূলের কথা। রাসূলের কথা কি? কোনো ঘটনার সাথেই তো কথার সম্পৃক্ততা, তাই না? এভাবে প্রত্যেকটি ঘটনা-ই তো সিরাহ। এভাবে হাদীসগুলো সিরাহর এককটা অংশ হয়ে আছে।
কিন্তু হাদীসের ব্যাপারেও আরেকটি বিষয় হলো হাদীসও কুরআনের মত ধারাবাহিক আকারে নেই যদিও রেফারেন্স আছে পূর্ণাকারে। এর কারণ হলো হাদীসের সংকলন মূলত সুন্নাহ ভিত্তিক হওয়ার কারণে বিষয়ভিত্তিক বা সনদগতভাবে সাহাবাভিত্তিক হয়েছে, ঘটনার ধারাবাহিকতা অনুসারে না হয়ে। আরেকটি দিক হলো হাদীসের ক্ষেত্রে একাডেমিক জটিলতা থাকার কারণে ঘটনার পূর্ণাংগতা আসেনি এবং একারণে ধারাবাহিকতাও রক্ষা হয়নি। কিন্তু বিশুদ্ধতার উৎস হিসেবে হাদীস অবশ্যই দ্বিতীয় উৎস হিসেবে দন্ডায়মান তাঁর মানের কারণে।
তৃতীয় উৎসঃ সিরাহর ক্লাসিকাল বই
সিরাহর বইগুলো মূলত লেখা হয় সিরাহকে কেন্দ্র করে। সাহাবাদের সন্তানগণ প্রথম সিরাহর বই লেখা শুরু করেন। চিন্তা করতে পারেন সাহাবারা যারা নিজের চোখে রাসূল ﷺ কে দেখেছেন, চলেছে, জীবনের কথা ঘটনা ছিল তাদের সাথে এবং এরাই তাদের সন্তানদের এরকম জীবনের সেই শ্রেষ্ট মূহুর্তগুলোকে বর্ণনা করেছেন এবং তারা এগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন।
উরওয়াঃ যিনি ছিলেন জুবায়ের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর) ছেলে। তিনি একজন সাহাবীর সন্তান। তিনি রাসূলের ﷺ এর জন্মের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাসূল ﷺ এর স্ত্রী আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ছিলেন তাঁর আন্টি এবং একারণে আন্টির কাছে তাঁর মাহরাম হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকার ছিল। একারণে আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর বর্ণনাগুলো উরওয়া থেকে বিস্তারিত আমরা পাই। এভাবে উরওয়া সিরাহর একটা গ্রন্থ লিখেছিলেন।
আব্বানঃ ইনি ছিলেন উসমান(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর ছেলে। তিনি ১০৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও সিরাহর উপর বই লিখেছিলেন।
ইবনে শিহাব যুহরীঃ তিনি ১২৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও সিরাহর উপর একটা গবেষণামূলক বই রচনা করেছিলেন।
এসব বই এখন আর অস্তিত্বে নেই।
সিরাতে ইবনে ইসহাকঃ সিরাতের উপর সর্বাপেক্ষা বিস্তারিত বই হিসেবে এটিই নির্ভরযোগ্য। তিনি ৮৫ হিজরীতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মদিনাতেই বসবাস করতেন। এই সেই মদিনা যেখানে রাসূল ﷺ বসবাস করতেন, এখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন, যেখানে সাহাবাদের ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। ইবনে ইসহাক এখানেই সাহাবাদের বংশধরদের আশে পাশে থেকেই বর হয়েছে। বিশেষত ৮৫ হিজরী অনেক কাছের সময়। কারণ সাহাবারা ১০০ বা ১১০ হিজরী পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
সুতরাং ইবনে ইসহাক সাহাবাদের সন্তানদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, আর হতে পারে কোনো সাহাবার সাথেও। কিন্তু তিনি যা শুনতেন সবই লিখে রাখতেন কারণ সিরাহর প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহবোধ ছিল। তিনি সিরাহকে ধারাবাহিক অনুসারের সাজাতে শুরু করলেন যেখানে পূর্ববর্তী সিরাহগুলো ক্রমানুসারে সাজানো ছিল না।
তিনি বলতেন কোনটা মক্কায় ঘটেছিল, কোনটা মদিনায় বা কোনটা মক্কার মধ্য সময়ে বা কোনটা হিজরাতের পর। এমনকি তিনি এভাবে সংকলনের সময় অন্যান্য জায়গায় যেসব সাহাবাদের সন্তানগন ছিলেন, তাদের কাছেও ভ্রমণ করেছে যেমন বসরা, কুফা ইত্যাদি। এভাবে তিনি এক মস্ত বড় সিরাহর সংকলন করলেন। তাঁর প্রাইমারি সোর্স ছিল আব্দল্লাহ ইবনে মাসউদ মদিনায় ছিলেন এবং সেখানেও তিনি ভ্রমণ করে সব নিয়েছিলেন।
সিরাতে ইবনে ইসহাকের অন্যতম সেরা যে দিকটি ছিল সেটা হলো তাঁর সিরাহ সংকলনের সাথে বর্ণনার ধারাবাহিকতা ছিল যাকে সনদ (chain of narrators) বলা হয়। ইসনাদের সৃষ্টি-ই ইসলামের ইতিহাস থেকে। এটা অন্য কোথাও নেই। এই ইসনাদের কারণে সিরাতের প্রত্যেকটা ঘটনাই রাসূল পর্যন্ত বর্ণনাকারী রয়েছেন!! অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের মাধ্যমেই তাঁর সিরাহ সংকলিত হয়েছিল। কারণ আমরা উপকথা বা কুসংস্কারের উপর নির্ভর করি না।
এভাবে তিনি সিরাহর উপর প্রায় ১০-১৫ খন্ডের মত বিরাট বই লিখেন। ইবনে ইসহাক ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন যা খুবই কাছাকাছি সময়।
এছাড়া সিরাহ নিয়ে আধুনিককালেও অনেক কাজ হয়েছে যা এখানে উল্লেখ করা হলো না। আপনারা সিরাহর উদ্দেশ্য পড়তে গিয়ে স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের নাম দেখেছেন।
সিরাতে ইবনে হিশামঃ ইবনে ইসহাক যেই বই লিখেছিলেন সেই সময়ে সেটি অনুলিপি করা দূরহ ছিল প্রিন্টিং মেশিন না থাকার কারণে। কারণ কেউ কোনো কপি করতে চাইলে তাকে অক্ষর বাই অক্ষর নিজ হাতে লিখে কপি করতে হতো। ইবনে ইসহাকের ছাত্রের ছাত্র এগিয়ে আসলেন এদিকটা সহজীকরণে। ইবনে হিশামের মৃত্যু ২১০ হিজরীতে। সিরাতে ইবনে ইসহাক ও সিরাতে ইবনে হিশামের মাঝে পার্থক্য কি? পার্থক্য হলো সিরাতে ইবনে ইসহাক থেকেই সিরাতে ইবনে হিশাম করা হয়েছে কেবল ছোট করে। তিনি ভাবলেন সিরাতে ইবনে ইসহাক অনেক বড়, ১০-১৫ খন্ডের মত। তাই তিনি একে সারসংক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি সিরাতে ইবনে ইসহাকে কোনো কিছুই যোগ করেন নি, বরং তিনি এটা থেকে কাট-ছাট করেছেন। তিনি একে সাজানোও নি, বরং অনেক কিছু বাদ দিয়েছেন। সহজ কথায় তিনি একে অনেক কিছুই বাদ দিয়েছেন এবং একে সংক্ষিপ্তাকারে সামারি করে সকলের উপযোগী করেছেন। এখন সিরাতে ইবনে হিশাম ৪ খন্ডে পাওয়া যায়। সুতরাং তিনি একে প্রায় মূল বই এর অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ করেছিলেন।
প্রশ্ন আসতে পারে কেন তিনি এত বড় বই রাখলেন না। সহজ কথায় তখন প্রিন্টিং মেশিন ছিল না, যা আগেই বলেছি এবং সবার এত বড় বই কপি করে পড়ার মত অবস্থাও ছিল না।
কারণ ইবনে ইসহাক আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করেছিলেন রাসূলের সিরাত লিখতে গিয়ে। তিনি নূহ, ইবরাহীম (আলাইহিমুস সালাম) এবং রাসূল ﷺ এর বংশধর পর্যন্ত রেফারেন্স দিয়ে শুরু করেছিলেন। ইবনে হিশাম এগুলোকে কাটছাট করেন, রাসূল ﷺ থেকে শুরু করেন এবং অন্যান্য অনেক বিষয় বাদ দেন যেগুলোকে তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন এবং সকল সনদকেও কেটে দেন এবং বইকে ছোট করে সবার উপযোগী করেন।
আজকের প্রিণ্টিংয়ের যুগে নিশ্চয় সিরতে ইবনে ইসহাক চাইবেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো সেই যুগে ইবনে হিশামের সহজতার কারণে যুগে যুগে ইবনে ইসহাক হারিয়ে গেছে।
কারণ যেকেউ কপি করলে ইবনে হিশাম কপি করত এবং এভাবে বড় কিতাব হারিয়ে যায় ইতিহাস থেকে।
কিন্তু একটা দারুণ বিষয় লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয় যে হাদীস সংকলিত হওয়ার অনেক আগেই সিরাহ সংকলিত হওয়া শুরু করেছে এবং পূর্ণও হয়েছে!! এ থেকেই উপলব্ধি করা যায় তারা সিরাহর উপর কত বিশাল গুরুত্ব দিতেন। কারণ তাদের নিকট সিরাহ ছিল রাসূলের হেদায়েতপূর্ণ জীবনের ধারাবাহিক বিবরণের পূর্ণ বর্ণনা।
সিরাহর শ্রেষ্ট স্কলার হলো ইবনে ইসহাক যিনি মাত্র ১৫০ হিজরীর পূর্বেই এত বড় কিতাব লিখেছিলেন সনদের ধারাবাহিকতা অনুসারে এবং এ থেকেই আমরা এখনও সিরাতে ইবনে হিশাম পাচ্ছি।
এখন আমরা যে ইরাতে ইবনে হিশাম পাচ্ছি সেটা যে আসলেই ইবনে ইসহাকের কপি সেটা বুঝবো কীভাবে? এর ব্যাখ্যা আসবে সিরাতের বিশ্বাসযোগ্যতা অধ্যায়ে।
চতুর্থ উৎসঃ শামাইল
রাসূল ﷺ এর চারিত্রিক সকল দিকের সুন্দরতম বর্ণনাগুলোর সমষ্টি – একে শামাইল বলে। এগুলোতে জীবনের বিভিন্ন দিকের বর্ণনা থাকে। এদের মাঝে ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) এর ‘শাইমায়েলে তিরমিযী’-ই বিখ্যাত।
পঞ্চম উৎসঃ দালাইল
দালাইল হলো রাসুল ﷺ এর সকল মু’জিযার সংকলন। রাসূলের ﷺ এর জীবনের মু’জিযার উপর অনেক বই রচিত হয়েছে। এটি সিরাহর অন্যতম উৎস ও নবুওয়াতের দালিলিক সত্যতার বলিষ্টতা প্রকাশ করে। দালাইলের সেরা কিতাব হলো ইমাম বায়হাকী (রাহিমাহুল্লাহ) এর “দালাইল আন-নবুওয়াত আল-বায়হাকী”। এটি প্রায় ১২ খন্ডের বিশাল এনসাইক্লোপেডিয়া!।
ষষ্ঠ উৎসঃ সাহাবাদের জীবনী
সিরাহর আরেকটি উৎস সাহাবাদের জীবনী এবং এখান থেকে রাসূলের জীবনীকে আলাদা করে শিক্ষা বের করা।
সপ্তম উতসঃ তারিখ বা ইতিহাস
অনেকেই মক্কা-মদিনার ইতিহাস লিখেছেন এবং সেখানেও সিরাহর অনেক অংশ রয়েছে সেগুলো থেকেও সিরাহ নেওয়া হয়। এ ইতিহাসের মাঝে অনেক নন-মুসলিমও রয়েছে সেই প্রাচীনকালেও। রাসূলের জীবনের সেই ১০০ বছরেই প্রায় তারা রাসূলের কথা লিখেছে তাদের বইতে।
অষ্টম উৎসঃ আধুনিক বই ও ভিডিও
আধুনিককালে সিরাহর উপর অনেক ভালো কাজ হয়েছে। এর মাঝে আমরা সিরাহর উদ্দেশ্য এর জায়গায় অনেক আলেম-স্কলারদের নাম উল্লেখ করেছি এবং এদের রেফারেন্স আমরা রিসোর্সের মধ্যে দেব
সিরাহর বিশ্বাযোগ্যতা
সিরাহর ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে হাদীস সংকলনের আগেই এটি সংকলনের যে তীব্র বাসনা ছিল, সেটি প্রমাণ করে সিরাহর গুরুত্ব। এর আগেও আমরা দেখেছি কুরআনে আল্লাহ রাসূলের সিরাহর কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ তাঁর রাসূলের সিরাহকে রক্ষা করবেনই। অর্থাৎ তাঁর সিরাহ যদি রক্ষিত নাই হয় বিশুদ্ধভাবে, তবে কুরআন-ই ভুল প্রমাণিত হবে। এমনকি আমরা দেখেছি রাসূলেওর জন্মের পূর্ব থেকেই এসব লিপিবদ্ধ হচ্ছে কুরআন ও হাদিসে।
এখন প্রশ্ন, সিরাহর বই হিসেবে যে আমাদের কাছে যেই ইবনে হিশাম এসেছে ইবনে ইসহাক থেকে, সেই ইবনে ইসহাক তো হারিয়ে গেছে যা সনদ আকারে ছিল বলে বিশুদ্ধ বলতে পারি কিন্তু ইবনে হিশামে তো সেটা নেই। তাহলে এখন এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশুদ্ধতা কীভাবে নিরুপন করবো?
ড. হামিদুল্লাহর গবেষণাঃ এই প্রশ্নের উত্তর এসেছে ড. হামিদুল্লাহর গবেষণা থেকে। তিনি সিরাহর ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর গবেষণা পরিচালনা করে ইবনে ইসহাকের একটা খন্ড কপি আবিষ্কার করেন ফ্রান্সের পুরাকীর্তির জাদুঘর থেকে। তিনি এমনই স্কলার ও রিসার্চার ছিলেন যে ২০টি ভাষা জানতেন অনর্গল। তিনি অনেক প্রাচীন ম্যানু্স্ক্রিপ্ট আবিষ্কার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তিনি ইবনে ইসহাকের ম্যানুস্ক্রিপ্ট পেলেন কিভাবে? এর একটি উত্তর সাম্রাজ্যবাদ ও কলোনিয়ালিজম। কারণ সাম্রাজ্যবাদীরা এসব পূরানো ম্যান্যুস্ক্রিপ্টের মর্যাদা বুঝতেন, তারা শিল্পপ্রিয় ছিল। এজন্য হয়তো শিল্প ও ম্যান্যস্ক্রিপ্ট এর কিছু কিনে নিয়েছিলেন আর কিছু জোড় করে নিয়েছিলেন। এভাবে এগুলো কলোনিয়ালদের হস্তগত হয়। এজন্য আমরা কুরআনের প্রাচীন কপি এখনো প্যারিস ও লন্ডনে দেখতে পাই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে অনেক ইসলামিক ম্যান্যুস্ক্রিপ্ট ধনি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রিও করে দিয়েছিল। এগুলোর অনেক কিছুই জার্মানিতে দেখতে পাওয়া যায়। জার্মানিদের ইসলামের প্রতি আগ্রহবোধ ছিল সেই ১৮শ শতাব্দী থেকেই। সুতরাং হামিদুল্লাহ যেহেতু এরাবিক ভাষায় দক্ষ ছিলেন, তাই তিনি প্যারিস, লন্ডন ও অন্যান্য জায়গায় এসবের অনেক কিছুই আবিষ্কার করেন। এর মাঝে সিরাতে ইবনে ইসহাকের একটা খন্ড কপিও ছিল!! মুসলিম উম্মাহ মনে করেছিল সিরাতে ইবনে ইসহাক হারিয়ে গেছে কিন্তু তিনি এক-চতুর্থাংশ আবিষ্কার করেন।
তিনি এটাকে এডিট করে প্রকাশ করেন। এজন্যই আমরা যখন সিরাতে ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামকে তুলনা করে দেখি, তখনই একই দেখতে পাই। কারণ সিরাতে ইবনে হিশাম নেওয়া হয়েছিল সিরাতে ইবনে ইসহাক থেকে। হামিদুল্লাহ যখন এ দুটোকে তুলনামূলক দেখতে লাগলেন, তিনি সিরাতে ইবনে হিশামকে খুবই নিখুঁত পেলেন। কারণ তিনি তিনি সিরাতে ইবনে ইসহাক থেকে অনেকাংশই বাদ দিয়েছিলেন প্রয়োজনের ভিত্তিতে।
ইবনে হিশাম কি বাদ দিয়েছিলেন?
ইবনে হিশাম তাঁর সিরাহ থেকে বড় বড় কবিতা ও আরবের বংশ তালিকা বাদ দিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি যখনই ইবনে ইসহাক একটি নাম উল্লেখ করতেন, তিনি একে নূহ (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত ৫০-৬০টি বংশধরের তালিকা দিতেন। এখানে ইবনে হিশাম যখন তিনি কাট-ছাট করে সংক্ষিপ্ত করলেন, তিনি এখানে প্রত্যেকবারই এই যতবারই এই বংশ তালিকা আসত, তিন মাত্র ৪-৫ জনের নাম উল্লেখ করে রাসূল ﷺ নাম পর্যন্ত তালিকা দিতেন সিরাহ লিখতে গিয়ে। এভাবে সিরাহতে যতগুলো নাম আসত এবং তাদের বংশ তালিকা আসতো, সবগুলোই তিনি কেটে সংক্ষিপ্ত করতেন। হামিদুল্লাহ যখন তাঁর পাওয়া কপির সাথে ইবনে হিশামকে তুলনা করলেন, তিনি একে বিশুদ্ধ পেলেন এবং এখন আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারি আমরা বিশুদ্ধ সিরাহ পাচ্ছি যা সনদের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল সিরাতে ইবনে ইসহাক এবং এটি থেকেই সংক্ষিপ্তাকারে সিরাতে ইবনে হিশাম পাচ্ছি। আমরা এখন বলতে পারছি যে আমরা রাসূলের মৃত্যুর মাত্র ১০০ বছর পর যে সিরাহ রচিত হয়েছিল, সেটি পড়ছি!!
হাদীসের সাথে তুলনা করলে দেখেন হাদিস সংকলিত হওয়ার কত আগেই সিরাহ সংকলিত হয়েছে। ইমাম বুখারি মৃত্যুবরণ করেন ২৫৬ হিজরীতে, ইমাম মুসলিম ২৬১ হিজরীতে কিন্তু ইবনে ইসহাক মৃত্যুবরণ করেন ১৫০ হিজরীতে। তিনি সিরাহর বইটি ১৩০ হিজরীর দিকে লিখেন। তাঁর মানে রাসূলের মৃত্যুর মাত্র ১০০ বছরের মাঝেই এটি পুরো সংকলিত হয়ে যায় আর আমরা এর বিশেষ অংশ ও কিতাবাকারে পাচ্ছি সিরাতে ইবনে হিশামের মাধ্যমে।
এছাড়া বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে আর বলা যায় আমাদের নতুন যারা ফিকহুস সিরাহ লিখতেছেন বা নতুন করে কোনো সিরাহ লিখতেছেন, তারা সবাই কিন্তু ক্লাসিকাল সোর্স বা হাদীস থেকেই রেফারেন্স নিচ্ছেন। সিরাহ গ্রন্থ হিসেবে যে সনদের বিশ্বাসযোগ্য ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেই এসেছে সেটার প্রমাণ আমরা দেখেছি।
এছাড়া অন্যান্য যেসব সিরাহ আমরা পাই মুহাদ্দিস ও ইসলামী আলেম থেকে, সেগুলোতেও বিশ্বস্ত হওয়ার কারণ তারা প্রত্যেকেই সনদ ও বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিল। এরকম আমরা পাই ইবনে কাসির, ইমাম নববী বা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) এর সিরাহ। এদের প্রত্যেকেই কিন্তু সনদ ও বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সতর্ক-ই ছিল। সুতরাং এগুলোর বিশুদ্ধতার জন্য এদের থেকে বর্তমানে যেসব সিরাহ বা ফিকহুস সিরাহ আসতেছে, সেগুলোর ব্যাপারেও আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে এগুলোও বিশুদ্ধ হিসেবেই আছে।
সিরাহর কয়েকটি ধারা ও বৈশিষ্ট
১। কুরআন-হাদীস-সিরাহ থেকে সিরাহ – সিরাতে ইবনে কাসির।
২। ফিকহুস সিরাহ – আধুনিক ধারার অনেক সিরাহ-ই রয়েছে।
৩। সিরাতের কিতাব – সিরাতে ইবনে হিশাম
৪। কুরআন-হাদীস থেকে সিরাহ
সিরাতে ইবনে কাসিরের বৈশিষ্ট হলো এটি ইউনিকলি কুরআন এবং হাদীস থেকে নেওয়া হয়েছে এবং সিরাতের কিতাব থেকে কেবল ঐ জায়গায় নেওয়া হয়েছে যেখানে কুরআন বা হাদীসে স্পষ্ট ও বিস্তারিত নেই। ইসলামী স্কলার বা আলেমরা প্রায় প্রত্যেকেই একে রেফারেন্স হিসেবে আনেন এবং স্কলাররা যেহেতু ভালো জ্ঞান রাখেন সেজন্য এসব রিসোর্স থেকে নিয়ে তারা আমাদেরকে ফিকহুস সিরাহ হিসেবে আধুনিককালের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাগুলোকে তুলে ধরেন। যেমন অডিও আকারে করেছেন ইমাম আনওয়ার আল-আওলাকী (রাহিমাহুল্লাহ), শাইখ আব্দুন নাসির জাংদা ও ভিডিও করেছেন শাইখ ড. ইয়াসির কাদি।
এছাড়া আমরা যতগুলো নাম উল্লেখ করেছি পূর্বে, সেগুলোর অধিকাংশ-ই সিরাহর শিক্ষাগুলো নিয়ে আধুনিক সময়ের প্রয়োজনের ভিত্তিতে সাজানো অর্থাৎ ফিকহুস সিরাহ।
ফিকহুস সিরাহ-ই এক্ষেত্রে আমাদের মত আম জনতার জন্য সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ট। সিরাত পড়ে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলবে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের সাথে একে সম্পৃক্ত করতে পারবো না। এজন্য আমাদেরকে সিরাহকে যখন বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়, এ থেকে শিক্ষাগুলোকে সমকালীন যুগের সমাধানের উপযোগী করা হয়, তখন এটি আমাদের জন্য জীবন্তরুপে ধরা দেয়। আধুনিককালের এই ট্রেন্ড আমাদেরকে রাসূলের তথা ইসলামের জীবন্তরুপ এনে দিয়েছে।
পশ্চিমা মুসলিম ও অমুসলিমদেরও লেখা কিছু সেরা সিরাহগ্রন্থ রয়েছে। যেমন একটি মার্টিন লিংকস এর (ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন)। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শেক্সপিয়রের উপর প্রফেসর ছিলেন। এজন্য তাঁর লেখা সিরাহ ইংরেজিতে সর্বাপেক্ষা অলংকার ও বাগ্মীতাপূর্ণ। কিন্তু এর মাঝে ২-৩টি ঘটনায় সমস্যা রয়েছে। গুগুলে দেখে নেওয়া দরকার। যেমন একটি ঘটনা নবীকে তিনি যায়নাবের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে দিয়েছেন। এটি ভুল ঘটনা। এ নিয়ে শাইখ ইয়াসির কাদি লেকচারও দিয়েছেন ইয়েল ইয়নিভার্সিটিতে।
ড. আলী মুহাম্মাদ আস-সাল্লাবী তাঁর বিখ্যাত সিরাহর বই Noble Life of The Prophet তে বলেনঃ
“প্রত্যেক মুসলিমের উচিৎ আল্লাহর রাসূলের জীবনী অধ্যয়ন করা। প্রকৃপক্ষে আমাদের জীবনের অনেক ইসলামী দায়িত্ব-ই রাসূলের জীবনের কেন্দ্রবিন্দুর ওপর নির্ভরশীল। যেমন প্রত্যেকের উচিৎ রাসূলকে ভালোবাসা কিন্তু তাকে না তাঁর সম্পর্কে না জেনে কিভাবে সেটা করবো? রাসূল যখন কুরাইশদের কাছে দাওয়াত পৌছাচ্ছে তখন আমরা জন্মগ্রহণও করিনি। সুতরাং রাসূলের সাথে পরিচিত হবার ও তাকে ভালোবাসার একটি মাত্র পথ বাকী থাকে, সেটা হলো তাঁর কথা ও কাজ অধ্যয়ন করা। আমরা কথা ও কাজ না জানলে কিভাবে তাকে অনুসরণ করবো। এক্ষেত্রে তাঁর জীবনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো “প্রসঙ্গ”- কোন প্রসংগে তিনি কোন কথা বলেছিলেন বা কাজ করেছিলেন”।
নন-মুসলিম লেখকদের সিরাহ থেকে তিনটি সাবধানতা
নন-মুসলিমদের সিরাহ থেকে উপকৃত হতে পারি কিন্তু সতর্কতার সাথেই নিতে হবে। এর কারণ হলো – নন-মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই বিকৃত করে রাসূলকে উপস্থাপন করে। অনেকেই অনেক ভালো লেখে কিন্তু সেটা ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করে না, তারা করে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে।
ড. রাজেহ আল-কুরদী তিনটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন কেন নন-মুসলিম লেখদের উপর বেশি ভরসা করা উচিৎ নয়।
১। তাদের রিসার্স ও রেফারেন্স মুসলিমদের জন্য ব্যবহারিক বা প্রয়োগযোগ্য নয়। কেননা তারা বেশিরভাগ সময়েই দার্শনিক বা যৌক্তিক দিক তুলে ধরেন। অথচ এগুলো কাউকে ঈমানের কাছে আনার জন্য বেশি কার্যকরী নয়। এই ধরণের অ্যাপ্রোচ কাউকে ইসলাম উপলব্ধি করতে সাহায্য করে না বরং ইসলাম উপলব্ধির ধারা থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে রাখে।
২। অনেকেই অনেক ভালো লেখেছেন এবং এগুলোর গ্রহনযোগ্যতাও রয়েছে আমাদের মাঝে। কিন্তু এইসব লেখাও ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে হয়নি এবং এজন্য রাসূলের জীবনীকে ইসলামকে উপস্থাপনার জন্য যেভাবে তুলে ধরা দরকার, সেভাবে হয়নি। এজন্য এই জীবনীর মাধ্যমে ইসলামের উপলব্ধি বা প্রকৃত দৃষ্টান্ত আসে না।
৩। অনেক লেখকের নিজের ফিলোসফি, ধারণা, বুদ্ধিবৃত্তি ও আদর্শ রয়েছে। তারা জীবনী লিখতে গিয়ে নিজেদের এইসব আদর্শকে রাসূলের জীবনীর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলে ধরে। এভাবে তারা রাসূলের জীবনীকে কিছু দিককে প্রাধান্য দেয় দেয় আর অন্যগুলোকে ছেড়ে দেয়। যেকারণে ইসলামের একটা দিক না আসার কারণে অন্যদিকগুলোও সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয় না আর এভাবে ইসলামকেও তারা কিছুটা অপূর্ণ ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে।
ড. জামাল বাদাওয়ী বলেনঃ আমি ড. কুরদীর তিন পয়েন্টেইর সাথেই একমত। কারণ নন-মুসলিমরা অনেক সময়েও ইসলামের একপেশে উপস্থাপন করে রাসূলের জীবনীকে তাদের নিজেদের আদর্শের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করে। অনেকেই আবার প্যাগানিস্টিক ধারায় জীবনীকে উল্লেখ করে। এজন্য নন-মুসলিমদের সোর্স নেওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবেই সতর্ক থাকা দরকার যেন ইসলামের উদ্দেশ্যসমূহ থেকে আমাদের দৃষ্টি কোনোভাবেই সরে না যায়।
ফিকহুস সিরাহ
অনেকেই হয়তো জীবনী পড়েই নি-তারা হয়তো ইসলামের এইখান থেকে একটু, ঐখান থেকে একটু নিতে নিতে ইসলামকে পূর্ণভাবে মিলাতেই পারছে না…মনে হয় ইসলাম পরিপূর্ণ নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আপনি রাসূল (সা)এর একটা বা দুইটা জীবনী পড়ে ভাবছেন যাক, রাসূল(সা)এর জীবনী জানতে পারলাম।
অনেকেই জীবনী পড়েছেন কিন্তু বাস্তবিক জীবনে এখন কীভাবে প্রয়োগ করবেন সেটা খুঁজে পাচ্ছে না।
1 নং পয়েন্টে – এসব বিবেচনায় এনেই স্কলাররা কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক খোঁজে পেলেন। রাসূল (সা) এর পূর্ণাংঙ্গ জীবনী না পড়লে তাঁর পক্ষে ইসলামকে পূর্ণাংঙ্গ ও ধারাবাহিকতা খোঁজে পাবেন না-বলতে পারেন তাঁর কাছে ইসলামের অনেক অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়বে-যেহেতু কোরআন-সুন্নাহতে ধারাবাহিকতা নেই আর সেইজন্য রাসূল (সা) এর জীবনীই এই কোর’আন-সুন্নাহর ধারাবাহিক দলীল হওয়ায় এটি পড়ার মধ্য দিয়েই ইসলামের প্রাথমিক সূচনা হতে পারে, হতে পারে পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাথমিক ও মৌলিক সিলেবাস।
2 নং পয়েন্টে – একটি বা দুইটি জীবনী যারা পড়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। সুন্নাহ অনুযায়ী রাসুল (সা) এর জীবনীকে প্রায় ১১-১৩ বিভিন্ন ভূমিকায় ভাগ করা যায়। নবী হিসেবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, মানব হিসেবে, কনসালট্যান্ট হিসেবে…। এভাবে প্রত্যকটি ডাইমেনশন যদি না জানেন তবে রাসূল (সা) কে কীভাবে পূর্ণাংঙ্গভাবে জানতে পারলেন? মানে ইসলামকে কীভাবে পূর্ণাংঙ্গরুপে জানতে পারলেন? কেবল এদিক থেকেই নয়, বরং ১১-১৩ ভূমিকার সাথে বর্তমানকালের জীবনী লেখাতে আরো কিছু বিষয়যুক্ত হয়। এর মাঝে আধ্যাত্বিক জীবনী, যুক্তিভিত্তিক জীবনী, তুলনামূলক জীবনী, পশ্চিমাদের অভিযোগখন্ডনমূলক জীবনী। এভাবে কেউ লিখেছেন রাসূল(সা)কে ভালোবেসে, কেউ লিখেছেন যুক্তি দিয়ে, কেউ লিখেছেন পূর্ণাঙ্গ জীবনের শিক্ষাগুলো নিয়ে।
এসবগুলো ডাইমেনশন জানার মধ্য দিয়েই আপনি রাসূল(সা)এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী তথা ইসলামের পূর্ণাংঙ্গ রুপ দেখতে পারবেন বিশাল আকাশের মত রুপ হওয়া সত্বেও।
3 নং পয়েন্টে – রাসূল (সা) এর জীবনী এযাব অনেক সিরাহ লেখা হয়েছে। এ সিরাহগুলো ছিল ইতিহাস এবং সনদ নির্ভর। কিন্তু পরবর্তীতে যখন উম্মাহর মাঝে ইসলামী কর্মী থাকা সত্বেও তাদের মাঝে প্রাণ খোঁজে পাওয়া গেল না, তখন স্কলাররা নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন, কেন এই সমস্যা হচ্ছে? তখন তাদের মাঝে অনেকেই বুঝতে পারলেন যে সমস্যা ইসলামের নয়, সমস্যা আমাদের উপলব্ধিতে, সমস্যা ইতিহাসকে জীবন্ত না করার মাঝে, আজকের দিনের মুহাম্মাদ (সা) এর অভাব। আজকের দিনে মুহাম্মাদ (সা) থাকলে কি করতেন? এখন তো আর মক্কা-মদিনার সেই সহজ সামাজিক জীবন-ব্যবস্থা নেই। তাই এই জটিল সামাজিক জীবন-ব্যবস্থায় তিনি কি করতেন? অর্থাৎ ইতিহাস নির্ভর জীবনী নয়, আমাদের দরকার সেই জীবনীর বর্তমানের বাস্তবিক প্রয়োগের দিক-নির্দেশনা। সেখান থেকেই স্কলারদের অবদানে উঠে আসে নতুন জীবনী, ইতিহাসের অতীতকালের সাথে লেগে থাকা জীবনী নয় বরং বাস্তবিক জীবনে আজকের দিনে কীভাবে রাসূল(সা) কে এর শিক্ষাগুলোকে উপলব্ধি করব ও প্রয়োগ করবো- সেই থেকে ‘ফিকহুস সিরাহ’র যাত্রা।
রাসূল ﷺ এর সমাজের সাথে আজকে উত্তরাধুনিক ও জটিল প্রাযুক্তিক সমাজকে তুলনা করেন হয়তো বেশিরভাগ অংশই মিলাতে পারবেন না কিছু ব্যবহারগত পারিভাষিক শব্দ ছাড়া। আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস যদি মাত্র ৪০ বছর আগে দেখতেন তবে দেখতেন ঐ সময় এ দেশ কত সহজ ছিল, ছিল না আধুনিক প্রযুক্তি, এত বুরুক্রেটিক জটিলতা বা আইনের এত বিভাগ। অথচ এর তুলনায় রাসূল ﷺ এর যুগ কত আগের ছিল? প্রায় প-নে-র শত বছর আগের!! চিন্তা করতে পারেন সেই যুগ আর আজকের যুগের মাঝে কত বিশাল পার্থক্য রয়েছে?
আজকের যুগে যদি মসজিদে বসে দেশ পরিচালনা করতে যান তবে স্কলাররা এটা শুনে হাসতে বাধ্য হবে আর আপনি ভাববেন এটাই তো রাসূল ﷺ করে গেছেন। পার্থক্য? না, রাসূল ﷺ ভুল করেন নি। তিনি দুনিয়াকে পরিচালনা করেছেন মূলনীতির আলোকে যা আজকের যুগের বাস্তবতার সাথে ঐসব মূলনীতি দিয়ে এই জটিল প্রাযুক্তিক উত্তরাধুনিক সমাজকেও পরিচালনা করা সম্ভব। হ্যা, এই সম্ভব হওয়ার কারণেই ইসলাম বৈশ্বিক ও সর্বশেষ ধর্ম। এর জন্য দরকার ফিকহুস সিরাহ। শুধু সিরাহ পড়ে আপনি অনেক কিছুই এবং বেশির ভাগ অংশই আজকের যুগের চিন্তার সাথে মেলাতে পারবেন না। মনে হবে কোনো এক প্রাচীন ইতিহাস পড়ছি যার সাথে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, এত যুক্তি-মতবাদ, এত জটিল সমাজের সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই। এ কারণেই ইসলাম বিদ্বেষীরা বা নাস্তিক-সেক্যুলাররা ইসলামকে বৈশ্বিক মানতে নারাজ। তারা এটাকে আরবীয় ইতিহাসের ধর্ম মনে করে যার সাথে আজকের যুগের কোন সম্পর্ক নেই। আজকের যুগের এই জটিলতম পৃথিবীতে এই ধর্ম অচল। এটি ছিল আরবের প্রাচীনকালে ধর্ম যা আমাদের এই উত্তরাধুনিক যুগে এলিয়েন বা মিথের মত।
সমস্যা তাদের নয় বরং এর দায় আমাদেরই; যুগের সাথে আমাদের প্রাসঙ্গিক উপলব্ধিহীনতা। আমরা তাদেরকে রাসূল ﷺ কে এমন কোনো জীবনীগ্রন্থ দিতে পারিনি যা দেখে সে অভিভূত হবে; বুঝতে পারবে যে আজকের যুগের এত এত সমস্যাকে কীভাবে সেই পনের শত বছর আগের সেই মুহাম্মাদের জীবনীর মাধ্যমে নিশ্ছিদ্র সমাধান দেওয়া হয়েছে!!
তবে বাংলাদেশে দুংখ ও দূর্ভাগ্য এটাই যে ফিকহুস সিরাহর ধারণা স্কলাররাও কম দিয়েছেন আমাদের- ফিকহুস সিরাহর অনুবাদ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে একটা পাওয়া যেতে পারে, তাও পূর্ণাঙ্গ নয় বা সব কিছুকে কাভার করেনি বা সম্ভব হয়নি!! এর ফলে আমরা ইসলাম নিয়ে কথাও বলি আবার ফেইসবুকের কমেন্টে, মতবিরোধে, অন্য দলের লোকদের প্রতি…যাক আর না বলি; এগুলো সবাই মোটামুটি জানে। মূল কথা হলো আমরা এখনো রাসূল (সা) কে বুঝতে পারিনি, উপলব্ধি করতে পারিনি, ইসলামকে হৃদয়ংগম করতে ব্যর্থ হয়েছি।
এখানে এই তিনটা ডাইমেনশনকে লক্ষ্য রেখেই রিসোর্সগুলো দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যদি ১০-১৫টি ফিকহুস সিরাহ অনুদিত থাকত- কত বড় রিসোর্স-ই না হতো!!…একজন সেকুলার বা নাস্তিক বা অমুসলিমকে দেওয়ার মত কোন ভালো জীবনী আছে? যা দেখে মনে করবে আজকের দিনের এই মুহাম্মাদ (সা) এর শিক্ষাই পারে দুনিয়ায় ন্যায়বিচার, সুস্থ সমাজ ও প্রশান্তি আনতে। বোধ হয় নেই, আরবের একজন মানুষের ইতিহাস আজকের উন্নততর ও জটিল প্রাযুক্তিক সমাজে সেকেলেই মনে হয়, তাঁর প্রাসঙ্গিকতা খোঁজে পাওয়া দুষ্কর…কিন্তু অনেক স্কলার কাজ করে গেছেন, দূর্ভাগ্য বাংলাদেশে আলেম সম্প্রদায় ও ইসলামের কর্মীদের, যে তারা সবগুলো ডাইমেনশনগুলোর ফিকহুস সিরাহ অনুবাদে আনতে পারনি!! আমরা নিজেরাই ইসলামের শিক্ষা বুঝতে এখনও বহুত বাকি, তো সমাজে কায়েমের চিন্তা আরো বহুত দূর রাখলেই ভালো হয়!!
অথচ স্কলারদের উচিৎ ছিল জ্ঞানের জগতে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্রিটিকাল মনন তৈরি করে সচেতনতা বাড়ানো এবং এবং ইসলামিক স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখা, কোনো দেশে কোনো স্কলারদের ভালো বই বের হলেই সেটিকে অনুবাদ করা…আমাদের দেশের এরকম বৈশ্বিক যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম আছে কি?!!
ড. মোস্তফা হুসনি আস-সিবাই (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর অসুস্থতা থাকা অবস্থায়ও এত চমৎকার ফিকহুস সিরাহ লিখেছেন এবং তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলে গেছেন যেন সবাই সিরাহকে ভালোবেসে অধ্যয়ন শুরু করে – এই অনুপ্রেরণা দান করা। তিনি যে এই ক্ষেত্রে অকেব বড় সফলতা পেয়েছেন তা বলা বাহুল্য-ই হবে। কারণ তিনি দেখিয়েছেন রাসূলের শিক্ষা, আদর্শ, উদাহরণ, সংস্কার- সবই জীবন্ত এবং এটি সকল দাঈ ও সংস্কারকদের জন্য অভিজ্ঞতার ঝুড়ি, অনাদিকাল পর্যন্ত, সকলের জন্য।
ড. তারিক রামাদান মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার জন্যই উপন্যাসধর্মী কিন্তু ইসলামের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই লিখেছেন অসামান্য সিরাহর বইটি। সেখানে তিনি বলেনঃ
“আমাদের প্রধান ফোকাস থাকবে রাসূলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান, আচার-ব্যবহার অথবা কথার ওপর জোড় দেওয়া এবং দেখবো এগুলো মুহাম্মাদের ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে সমকালীনযুগে আমাদের জন্য কি শিক্ষা বয়ে নিয়ে আসে।…এজন্য আমাদের প্রাথমিক চিন্তা হলো মুহাম্মাদের জীবনের গভীরে ডুব দেওয়া এবং এ থেকে চিরন্তন শিক্ষাগুলোকে তুলে আনা। তাঁর জীবনের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, ঘটনায় জর্জরিত, বিভিন্ন অবস্থা ও দিক- সবই আধ্যাত্বিক উন্নতির চরম শিখরে অবস্থিত…আমরা মুহাম্মাদের জীবনকে আমাদের সময়ের অ্যাপ্রোচে নিয়ে দেখবো আমাদের সমসাময়িক সময়ে কি শিক্ষা নিয়ে আসে…”
ফিকহুস সিরাহ ও সিরাহ রিসোর্স
আমরা এখানে সিরাহর ক্ষেত্রে বিখ্যাত ও সিরাহর গভীর উপলব্ধিসম্পন্ন রিসোর্সসমূহ-ই দেবো যেগুলো আমাদের জীবনকে আরো উন্নত করতে সাহায্য করবে, ভালো মুসলিম হওয়ার পথ দেখাবে, ইসলামের এবং সিরাহর উদ্দেশ্যগুলোকে তুলে ধরবে। এজন্য বিখ্যাত স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের সিরাহ ও ফিকহুস সিরাহর রিসোর্স দেবো এখানে। যেগুলোর সফট কপি পেয়েছি, সেগুলোর লিংক দিয়ে দিয়েছি। আর যেগুলোর পাইনি সেগুলোর লিংক দিয়ে দিয়েছি যাতে কোনো মাধ্যমে পেতে পারেন। যেসব স্কলার ও বিশেষজ্ঞদের রিসোর্স দিয়েছি, সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়, রিসোর্সের নামগুলোকে গুগুলে সার্চ দিয়ে তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবেন। তবুও এখানে কিছু উল্লেখ করে দিচ্ছি। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত যে কয়জন শ্রেষ্ট ইসলামী আলেম ছিল, তাদের মধ্যে সর্বাজ্ঞেই রাখা যায় ড. সাঈদ রামাদান আল-বুতীকে (রাহিমাহুল্লাহ, মৃত্যু-২০১৩)। তাঁর সিরাহ-ই এযাবতকালে ফিকহুস সিরাহর জন্য সর্বাজ্ঞে থাকবে। উনার আগে কি কেউ এত গভীরভাবে ভাবতে পেরেছেন? বোধ হয় সেভাবে কেউ পারেনি। উনার নিজেও সেই স্বীকৃতি যে এই ফিকহুস সিরাহর উপর উনার সর্বাপেক্ষা বেশি মনোযোগ দিয়ে শিক্ষাগুলোকে অতুলনীয়ভাবে তুলে এনেছেন রাসুলের জীবনীর মধ্য দিয়ে। ড. তারিক রামাদান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইসলামী স্টাডিজের চেয়ারম্যান ও প্রফেসর। ইসলাম ও নিৎসে (ফিলোসফি) – দুই দিকেই পিএইচডি রয়েছে। বিশ্বের ১০০ জন বিজ্ঞানী ও চিন্তাবীদের একজন। ফ্রান্সের নিকোলাস সার্কোজী প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার সাথে ডিবেট করেছেন – সে দিক থেকে বুঝতেই পারছেন তিনি কতটা উচূ লেভেলের লোক হলে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে ডিবেট করে। সত্যের প্রতি অকোতোভয় থাকার কারণে বুশের ইরাক যুদ্ধের সমালোচনা করার জন্য তাকে অক্সফোর্ড থেকে কয়েকবছর দূরে থাকতে হয়। তাঁর ফিকহুস সিরাহটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্বিক ভ্রমণের চূড়ান্ত উদাহরণ এবং একারণেই মুসলিম-ননমুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে এটি সারা ফেলে দেয়। শাইখ ড. মোস্তফা হুসনি আস-সিবাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)। রামাদান আল-বুতীর মত ইনিও সিরিয়ার প্রফেসর ছিলেন। উনার সুন্নাহর উপর পিএইচডি (কালামুল্লাহতে পাওয়া যায়) তো সারা বিশ্বেই রেফারেন্স হিসেবে আনেন। উনার ফিকহুস সিরাহ থেকে দাঈ ও সংস্কারকদের জন্য অতুলনীয়ভাবে রাসূলের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে তুলে এনেছেন। বর্তমানে আরব বিশ্বের প্রথম শ্রেষ্ট বক্তা হিসেবে রয়েছেন ড. আমর খালেদ (দ্বিতীয় ড. তারেক আল-সুয়াইদান – Dr. Tareq Al-Suwaidan) । তিনি মসজিদ উন-নববীর পাশেই দীর্ঘ একমাস রাসূলের জীবনীর উপর লেকচার দিয়েছেন এবং তাঁর জীবনী থেকে এত সুনিপুনভাবে শিক্ষাগুলোকে এনে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন বর্তমানের আলোকে, ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের মাঝে রকম গভীর পান্ডিত্বসম্পন্ন লোক রয়েছেন!! পাকিস্তানের নঈম সিদ্দকী (রাহিমাহুল্লাহ) সিরাহটিও মানবতা, রাষ্ট্রনায়ক ও ডিফেন্ডের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবে থাকবে। বর্তমানে মুসলিম দার্শনিকদের মাঝে একজন বেঁচে আছে যিনি সারা পৃথিবীতে গ্রহণীয় এবং পশ্চিমাবিশ্বে ইসলামিক মিউজিয়ামসহ অনেক কাজ করে গেছেন মাওলানা রুমি, সুফি ট্রেডিশন, সাইন্স, আর্ট, ইন্টারফেইথ ডায়ালগ, ফিলোসফি ইত্যাদি নিয়ে। তিনি ড. সাইয়্যেদ হুসেইন নাসর। যিনি বার্ট্রান্ড রাসেলকে ইরানে নিয়ে গিয়েছিলেন ফিলোসফির উপর কথা বলতে। তিনি রাসূলেকে একজন মানুষ হিসেবে ইসলামের অসাধারণভাবে পরিচিতি তুলে ধরেছেন।
এভাবে লেখতে গেলে অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে…তাই এখানেই থেমে যেতে হলো। উনাদের অনেককেই চেনে আবার অনেককে হয়তো চেনেন না। যাদের না চেনেন উনাদে নামগুলোকে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন, সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন তাদের চমৎকার পান্ডিত্বময় জীবনের ইতিহাস।
Abdul Nasir Jangda – Getting to Know the Prophet | Halal Tube
http://www.youtube.com/watch?v=igpuDsnBXJ8
2. Honoring Prophet Muhammad (PBUH) – Nouman Ali Khan
https://www.youtube.com/watch?v=5mHpAlybFY8
3. Suhaib Webb – Synchronized Seerah
http://www.halaltube.com/suhaib-webb-synchronized-seerah
ফিকহুস সিরাহ ও সিরাহর বইসমূহ
1. Fiqh us-Seerah – Sheikh Muhammad al-Ghazali
http://www.kalamullah.com/fiqhus-seerah.html
2. In the Footsteps of the Prophet – Dr. Tariq Ramadan
http://tinyurl.com/m6cc6xw
http://tinyurl.com/p87oyc4
The Jurisprudence of the Prophetic Biography & A Brief History of Rightly Guided Caliphs – Dr. Muhammad Said Ramadan Al-Buti
http://tinyurl.com/pj8vb7c
http://tinyurl.com/pqw524j
4. The Life Of Prophet Muhammad: Highlights and Lessons – Dr. Mustafa As Sibaa’ie
http://tinyurl.com/mp5db3v
5. ‘মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সা. – নঈম সিদ্দিকী
http://tinyurl.com/qjg5444
http://tinyurl.com/nklz2ja (English)
The Messenger of God Muhammad – M. Fethullah Gulen
http://en.fgulen.com/gulens-works/prophet-muhammad
Wisdom of Holy Prophet – Muhammad Zafrullah Khan
https://www.alislam.org/library/books/WisdomOfHolyProphet.pdf
সিরাতে সারওয়ারে আলম – মাওলানা আবুল আলা মওদুদী(র)
সীরাতে সরওয়ারে আলম – ১ম খণ্ড
http://tinyurl.com/lp2jpwz
সীরাতে সরওয়ারে আলম – ২য় খন্ড
http://tinyurl.com/lvfy6bp
সীরাতে সরওয়ারে আলম – ৩য় ও ৪র্থ খন্ড
http://tinyurl.com/nxkw4dz
সীরাতে সরওয়ারে আলম – ৫ম খন্ড
http://tinyurl.com/kfpuyc7
Muhammad: Man of God – Seyyed Hossein Nasr
http://bookzz.org/dl/1183311/cb863f
Misquoting Muhammad: The Challenges and Choices of Interpreting the Prophet’s Legacy by Dr. Jonathan A C Brown
http://tinyurl.com/oc59n7y
Sirat Al-Nabi (PBUH) and the Orientalists (Vol-1) – Muhammad Mohar Ali
1st part http://tinyurl.com/lv847sb
2nd Part – http://tinyurl.com/pvcnmsy
12. Muhammad (pbuh) the Natural Successor to Christ (pbuh) by Ahmed Deedat
https://archive.org/details/MuhammedTheNaturalSuccessorToChrist.pdf
https://www.youtube.com/watch?v=0dDg1myyfJ8
মুহাম্মাদ(সা), ঈসা(আ)এর উত্তরসূরী এবং বাইবেলে মুহাম্মাদ (সা)- শেখ আহমাদ দীদাত
http://tinyurl.com/onl7fso
The Characteristics of Prophet Muhammed (pbuh) – Imam Abi Iassa Muhammed At Tirmidhi
http://www.islamwb.com/books/Shamaail-e-Tirmidhi.pdf
Muhammad A Biography of The Prophet by Karen Armstrong
http://tinyurl.com/npqrok
http://www.rokomari.com/all-reviews/4624
https://www.youtube.com/watch?v=iVw6RY1cQrg
MUHAMMAD – his life based on the earliest sources by Marin Lings
http://www.alfateh.gov.bh/pdffile/muhammad_martin_Lings.pdf
http://www.kalamullah.com/muhammad-audio-book.html (Audio Book)
Noble Life of The Prophet (Vol-1) – Dr. Ali Muhammad As-Sallaabee
http://www.kalamullah.com/noble-life-of-the-prophet.html
নাবি-এ রহমত (সিরাতুন নাবাবীয়া)– সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহিমাহুল্লাহ)
http://abulhasanalinadwi.org/books/BN_12.pdf
Muhammad Man and Prophet: A Complete Study of the Life of the Prophet of Islam– Adil Salahi
http://www.amazon.co.uk/Muhammad-Man-Prophet-Complete-Study/dp/0860373223
20. On the Path to the Beloved 5 DVD Set : English Series by Dr. Amr Khaled
http://www.islamicbookstore.com/a5167.html
সিরাতে ইবনে হিশাম
http://tinyurl.com/njfdphy
আর রাহিকুল মাখতুম – আল্লামা সফিউর রহমান মোবাকরপুরী (রাহিমাহুল্লাহ)
http://tinyurl.com/njfdphy
23. Muhammad : Critical Lives Series (Yahiya J. Emerick)
http://www.amazon.com/Muhammad-Critical-Lives-Yahiya-Emerick/dp/0028643712
Introducing Muhammad by Ziauddin Sardar (Author), Zafar Abbas Malik (Contributor)
http://tinyurl.com/phl5pf5
Al-Sira al Nabawiyya by Imam IBN KATHIR (Rahimahullah)
http://tinyurl.com/nvyf6do (English)
http://www.quraneralo.com/al-bidaya-wan-nihaya/ (বাংলা)
THE LIFE AND WORK OF THE PROPHET OF ISLAM,. Dr. M Hamidullah
http://tinyurl.com/qamq3l5
http://tinyurl.com/qj9kaxt
মোস্তফা চরিত – মোহাম্মদ আকরম খাঁ
http://www.rokomari.com/book/9446
Zad al Maad –Imam Ibnul Qayyim (Rahimahullah)
http://tinyurl.com/p73v627
বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা
http://www.rokomari.com/book/14956
ফিকহুস সিরাহ লেকচার (Extensive)
The Life of prophet Muhammad (PBUH) English subtitled By Dr. Amr Khaled
https://www.youtube.com/playlist?list=PLD921C96C24943A09
Seerah – Life of the Prophet By Shaykh Abdun Nasir Jangda
http://www.qalaminstitute.org/seerah/#.VSdR5KHo42M
http://tinyurl.com/nkeb4w9
Seerah of Prophet Muhammed (pbuh) by Shaykh Dr. Yasir Qadhi
https://www.youtube.com/playlist?list=PLAEA99D24CA2F9A8F
The Life of the Prophet Muhammad- Imam Anwar Al-Awlaki
http://www.kalamullah.com/anwar-alawlaki.html
5. Honoring the Messenger – Ustadh Nouman Ali Khan (Themes from the Qur’an, Bayyinah.tv)
6. Life of Prophet Muhammad by Mufti Ismail Ibn Musa Menk
http://tinyurl.com/pfwlj8p
7. On the Path to the Beloved 5 DVD Set : English Series (Amr Khaled)
http://www.islamicbookstore.com/a5167.html
http://tinyurl.com/qdaaug8
9. নবীজির (সা) জীবন [Life of Muhammad SAW by Banda Reza]
http://tinyurl.com/ojxt5v5
10. Fiqh Us Seerah By Abdul Hakim Quick
http://kalamullah.com/abdullah-hakim-quick.html
অন্যান্ন কিন্তু খুবই প্রয়োজনীয়!!
Yasir Qadhi – A Mercy to Mankind
http://tinyurl.com/q9md9la
Defending the Prophet Against Orientalist Critique – Pt. 1 of 2 – Yasir Qadhi
https://www.youtube.com/watch?v=gSyDliiGI1I
Defending the Prophet Against Orientalist Critique – Pt. 2 of 2 – Yaser Birjas
https://www.youtube.com/watch?v=UiEMnv5j3dc
Our reaction Beware to insults To Prophet Love Nouman Ali Khan
https://www.youtube.com/watch?v=dmU92Gvgs0M
https://www.youtube.com/watch?v=xH3HPkDvA-k
“In The Footsteps of the Prophet; How Muslims should Contribute to the World” – Prof. Dr. Tariq Ramadan
https://www.youtube.com/watch?v=1roj2Oi4s3Y
Ahmad Deedat – Muhammad the Greatest
https://www.youtube.com/watch?v=Klx9lzzGjcw
Workshop: Personal Life of the Prophet (S) pt. 1 – AbdulNasir Jangda
https://www.youtube.com/watch?v=_vNcFkIvGj8
https://www.youtube.com/watch?v=TKhhDAomRPo
Can I ever be like the prophet? by Sh. Abdul Nasir Jangda
https://www.youtube.com/watch?v=POZeW-ow9ZA
9 . Jonathan Brown – Abiding Stereotypes About the Prophet Muhammad in the Medieval and Modern West
https://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=NCA8uqXW-rs
10. Dr. Jonathan AC Brown – Book: “Misquoting Muhammad” | Princeton University
https://www.youtube.com/watch?v=btR24dfcEKI
11. রাসুল (সাঃ) এর জীবনী – আল্লামা দেলোয়ার হুসাইন সাঈদী
https://www.youtube.com/watch?v=_yI67U4D3xA
Documentary:
1. The Life of Prophet Mohammed (Peace Be Upon Him)
https://www.youtube.com/watch?v=gXTZDBNVmIo
[TRAILER] Muhammad in Mecca: Transformation through Tribulation
& [TRAILER] Muhammad’s Migration – Hope after Hardship
– 25 Speakers: Nouman A. Khan, Yasmin Mogahed, Amr Khaled, Habib Ali al-Jifri
https://www.youtube.com/watch?v=5wOxQbqzBVE
https://www.youtube.com/watch?v=CciYAkHwKww
3. History Channel – Muhammad The Prophet
https://www.youtube.com/watch?v=7w4TH-giaps
4. BBC DOCUMENTARY on The life of The last Prophet Muhammad pbuh
https://www.youtube.com/watch?v=8NWByzkxy5E
5. The biography of Prophet Muhammed part 1 ( English Subtitled)
https://www.youtube.com/watch?list=PLD921C96C24943A09&v=LmOoTgL6jd0
Movie:
The messege
English – https://www.youtube.com/watch?v=7BPYcaDiajc&feature=youtu.be
বাংলা – https://www.youtube.com/watch?v=ZPKUr56rXzs
2. ৪ হাজার ২শ ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত: ‘মুহাম্মদ’ – ইরানের বিখ্যাত চলচিত্রকার মাজিদ মাজিদী পরিচালিত। ডলার হিসেবে সেটি প্রায় ৫৫ কোটি ডলার। আগামী ২৬শে আগস্ট নবীবংশের অষ্টম পুরুষ ইমাম রেজা (আ.)’এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইরানে এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবে। ১৭১ মিনিটের এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণে ৫ বছর সময় লেগেছে। আর এ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে থাকছেন ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান।
Trailer: https://www.youtube.com/watch?v=2B98FBP6Vck
https://www.youtube.com/watch?v=BOVBCjZZkEo
রাসূল ﷺ এর উপর কয়েকটা ওয়েবসাইট
http://lifeofprophet.com/
http://seerah.hpage.ms/
http://www.lastprophet.info/
http://www.muhammad.net/
http://seerah.net/
http://www.prophetofislam.com/
http://salaf-us-saalih.com/muhammad/
http://www.prophetmuhammad.name/
http://www.muhammadfactcheck.org/
http://www.prophetmuhammadforall.org/webfiles/index_1.php
আমরা মুসলিমরা আজকে প্রচন্ড সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই সময়ে সিরাহ অধ্যয়নের জন্য আমাদের বিশেষ আগ্রহ থাকা দরকার। মুসলিমরা আজকে সমস্যার সমাধানের পথে ফেরার উপলব্ধিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে যখন তাদের চোখের সম্মুখে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ট জেনারেশনের আদর্শ নমুনা রয়েছে, উসওয়াতুন হাসানাহ।
শেষ করবো একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। নুমান আলী খান এটি বর্ণনা করেছিলেন।
একজন মুসলিম ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যায়লয়ে যাওয়ার পর ইসলামের প্র্যাক্টিস হারিয়ে ফেলে। ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়।
তিনি একজন খৃষ্টান মেয়েকে বিয়ে করেন। যেহেতু মুসলিম ছেলেটি তখনও ধর্ম পালন করতো না, ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল, সেজন্য ভিন্নধর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিয়ে এবং জীবন-যাপনে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। হঠাৎ করে কোনো এক ঘটনার কারণে ছেলেটি আবার ধর্মের দিকে আকর্ষণবোধ করতে থাকে, তিনি আবার ইসলাম পালন করতে শুরু করেন। যেহেতু ছেলে-মেয়ে দুজনই দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো এবং বিয়ে করার সময় মুসলিম ছেলেটি ইসলামও ঠিকমত পালন করতো না, সেজন্য দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যাও হয়নি তখন।
তিনি যখন থেকে ইসলাম পালন করা শুরু করেন, তখন তার স্ত্রী ছেলেটির মাঝে ধীরে ধীর পরিবর্তন দেখতে পান। তাদের মাঝে কথাও হয় এ পরিবর্তনের রেশ ধরে। দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কেউ চাচ্ছিল না সংসার ভেংগে যাক, কিন্তু ছেলেটি দেখলো মতপার্থক্য বা ডিবেট করলে সংসার টিকবে না, মেয়েটিও থাকতে চাইবে না।
ছেলেটি একজন ভালো স্কলারের কাছে গেলো। তাঁর কাছে সব খুলে বলল, পরামর্শ চাইলো। স্কলারটি অনেক দূরদর্শী ছিলেন। তিনি সেই মুসলিম ছেলেটিকে কিছু উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে ইসলাম নিয়ে কোনো কথা বলবেন না, ঝগড়া বা কোনো ডিবেট করবেন না, তিনি করতে চাইলেও আপনি করবেন না, সে টপিকে কথা বাড়াবেন না। আপনি আপনার স্ত্রীর প্রতি কেবল একটি কাজ করবেন…রাসূল ﷺ কেমন স্বামী ছিলেন, সেগুলোই আপনার স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা, আনন্দ ইত্যাদি করবেন। অর্থাৎ স্বামী হিসেবে আপনার স্ত্রীর প্রতি ঠিক সেরুপ-ই করার চেষ্টা করবেন যেরুপ রাসূল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের প্রতি করতেন।
রাসূল ﷺ কেমন স্বামী ছিলেন তার ওপর একটি বই কিনলেন, পড়লেন, সেগুলো তার স্ত্রীর জন্য করতে থাকলেন। এক বছর গেলো, দুই বছর গেলো, তিন বছর গেলো। এর মাঝে মুসলিম ছেলেটি কেবল একটি কাজ-ই করেছে, সেটা হলো রাসূল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের প্রতি যেরুপ ছিল, ঠিক সেরুপ করার ক্রমাগত করতে চেষ্টা করেছে। এর মাঝে ছেলেটি কিন্তু বাড়িতেও ইসলাম পালন করা শুরু করেছে।
তিন বছর পর, ছেলেটি একদিন সালাত আদায় করতেছিল বাড়িতে। হঠাৎ করে তিনি দেখতে পেলেন তার স্ত্রী ধীরে ধীরে তার ডানপাশে এসে সালাতে দাঁড়িয়ে গেছে!! তিনি সালাতের ভেতরেই অবাক!! অথচ এক সময় তার স্ত্রী-ই তাঁর ইসলাম পালনে বিরোধিতা করতো।
সালাত শেষ, তিনি তাঁর স্ত্রীকে কাছে বিষয়টি জানতে চাইলেন। তার স্ত্রী বললেনঃ
একজন ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর জন্য এত ভালোবাসা দিতে পারে, স্ত্রীর প্রতি এতো দায়িত্বশীল হতে পারে, স্ত্রীর জন্য এতো উদার মনে অধিকারী হতে পারে, স্ত্রীর জন্য এতো আনন্দের খোরাক হতে পারে, স্ত্রীর সকল সমস্যার প্রতি এতো গভীর দৃষ্টি রাখতে পারে, স্ত্রীকে এতো গভীরভাবে নিজের ভালোবাসার মাঝে আগলে রাখতে পারে – এতোটা ভালো মানুষ কোনো ভুল ধর্মের লোক হতে পারে না – This religion can’t be without truth. তাই আমি আজ থেকে এই সত্য ধর্মের অনুসারী হয়ে গেলাম।
কেন আমি এই ঘটনাটা বর্ণনা করলাম? কারণ একটি—রাসূলের জীবনী থেকে যেকেউ যেই অংশ-ই গভীরভাবে জেনে প্রয়োগ করবেন, সে সেখানে সফলতা দেখতে পাবেন।
রাসূলের চাইতে একজন শ্রেষ্ট দাঈ এই পৃথিবীতে আর কেউ আসেনি, আসবেও না। রাসূলের চাইতে শ্রেষ্ট সমাজ সংস্কারক কেউ আসেনি, আর আসবেও না। রাসূলের চাইতে শ্রেষ্ট স্বামী কেউ হয়নি, কেউ হবেও না। রাসূলের চাইতে শ্রেষ্ট সাংগঠনিক কেউ আসেনি, কেউ আসবেও না। রাসূলের মত মুজাহিদ কেউ আসেই নি, কেউ আসবেও না। রাসূলের মত রাষ্ট্রনায়ক কেউ আসেনি, কেউ আসবেও না। রাসূলের মত প্রিয় পাত্র কেউ আসেনি, কেউ আসবেও না। রাসূলের মত রাহমাতের অধিকারী কেউ আসেনি, কেউ আসবেও না।
এভাবে পৃথিবীর যে কেউ সকল ভালো গুণের সর্বোচ্চ আদর্শের বাস্তবিক নমুনা রাসূল থেকে তার জীবনের জন্য সর্বোচ্চ আদর্শ নিতে পারে, সেই আদর্শে সর্বোচ্চ সফল হতে পারে। এর শর্ত রাসূলের জীবনী গভীরভাবে অধ্যয়ন করা, যাকে আল্লাহ বাধ্যতামূলক জানা ও অনুসরণ করা ফরজ করে দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সবার জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বলে।
তোমাদের জন্য অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ – যারা কামনা করে আল্লাহ (এর সাক্ষাৎ) ও আখিরাতকে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে (কুরআন ৩৩:২১
বিষয়: বিবিধ
৪১৬৩ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর একটি পোস্ট
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকুমুল্লাহ
তবে কয়েক পর্বে হলে ভাল হতো।
আলহামদুল্লিলাহ।আমি আমার বাবা মার কাছ হতে এ জিনিসটাই বেশি পেয়েছি।
অতিরিক্ত লম্বা হওয়াতে পাঠকের কনসেন্ট্রেশান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কষ্ট করে কয়েকটি পার্ট করে দিলে খুবই ভাল হত।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন