ইসলামের ইতিহাস : আব্বাসীয় যুগের প্রথম পর্বে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন- ০১
লিখেছেন লিখেছেন সঠিক ইসলাম ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১২:১৮:৪৮ রাত
আব্বাসী যুগের প্রথম পর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, ইসলামী উম্মাহ তখন বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ও জ্ঞানচর্চার এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছিল, যা ইসলামী উম্মাহর পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি ও সামাজিক পরিবেশেরই স্বাভাবিক ফল ছিল।
বস্তুত বিভিন্ন জাতির জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির গতি ও অগ্রগতি এবং প্রকাশ ও বিকাশ কল্পলোকের কিংবা স্বপ্নজগতের কোন বিষয় নয় যে, প্রকৃতির নিয়মনীতির নিয়ন্ত্রন ভেঙে খেয়ালখুশি মত তা চলতে থাকবে।
বহু গবেষক মানবমস্তিস্ক ও তার স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং বিভিন্ন জাতির চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিবর্তন ও তার বিবিধ কার্যকারণ, অগ্রগতি ও পরিণতির মাঝে এক আশ্চর্য সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তা থেকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশের কতিপয় সাধারণ 'নিয়ম' উদ্ভাবন করেছেন, যদিও এ বিষয়ে ক্ষেত্রবিশেষে এখনো আলোচনা ও পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে।
গবেষকদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির বিভিন্ন পদার্থ যে ধরনের নিয়ম নিয়ন্ত্রিত, বিভিন্ন জাতির চিন্তাধারাও তদ্রুপ নিয়মের নিয়ন্ত্রন আরোপ করা। কেননা বিজ্ঞানীরা একদিকে যেমন মধ্যাকর্ষন ও চৌম্বক সূত্র এবং আলো ও গতির সূত্রসহ বিভিন্ন সূত্র আবিষ্কার করেছেন, তেমনি তারা দেখতে পেয়েছিলেন যে, মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রমও একইভাবে প্রকৃতির নিয়মনিগড়ে আবদ্ধ। উদাহরণ স্বরুপ, চক্ষু আলোর প্রতিফলনসূত্রের এবং কর্ণ ধ্বনিসূত্রের অনুগত, এভাবে অন্যান্য অঙ্গ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠির পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কেও একই কথা, মরুভুমির জীবনে মরুপরিবেশের প্রভাব যেমন সত্য, তেমনি সমতলবাদীদের জীবনযাত্রায় সবুজের প্রভাব অনস্বিকার্য। সমাজ ব্যবস্থার বৈচিত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। প্রত্যেক জাতির শাসনব্যাবস্থা ও সরকার পদ্ধতির বিভিন্নতা তাদের পরিবেশ-পরিমন্ডলের এবং ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। মোটকথা মানবের জীবনসমগ্র যেহেতু প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়মসূত্রে নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু মানবের চিন্তাসমগ্রের বিকাশ ও বিবর্তনকেও প্রকৃতির নিয়মনিগড়ে আবদ্ধ করা সম্ভব। অবশ্য এটা বড় কঠিন ও জটিল প্রয়াস। কেননা এজন্য প্রয়োজন জাতির ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে গভীর ও নির্ভূল জ্ঞান এবং জাতির উত্থান-পতন ও চিন্তা-বৈচিত্রের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ সম্পর্কে সম্যক অবগতি।
সর্বোপরি মানব সত্তায় রয়েছে এমন এক শক্তিশালী কার্যকরণ যা প্রকৃতির অন্য কোন উপাদানে নেই, তা হলো মানবের 'স্বাধীন ইচ্ছা'। এমনকি তার মনে হয় 'ইচ্ছাবলে' প্রকৃতির নিয়মনিয়ন্ত্রনেরও উর্দ্ধে সে। সুতরাং কোন 'কর্ম' সে করতে এবং না করতে পারে এবং সমাজবিজ্ঞানীদের নিয়ম ও সূত্রনির্ভর বিভিন্ন ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণীকেও চ্যালেঞ্জ করে বিপরীত ঘটনা ঘটাতে পারে। সমাজবিঞ্জানীরা অবশ্য 'স্বাধীন ইচ্ছার' ভুমিকা স্বীকার করলেও তাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে নারাজ। তারা বলেন, 'মানব ইচ্ছা' দৃশ্যত স্বাধীন হলেও এমন কিছু নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যা লঙ্ঘন করা সম্ভব নয়। কেননা পরিবেশ ও নাগরিক কার্যকারণ অবয়ব ও বর্ণ তারতম্যের ক্ষেত্রে যেমন ক্রিয়াশীল, ইচ্ছা ও চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও তেমনি ক্রিয়াশীল।
অবশ্য জাতিতে জাতিতে চিন্তায় ও বুদ্ধিবৃত্তিতে কিছু পার্থক্যও দেখা যায় এবং তার বেশ কিছু কার্যকারণও রয়েছে। তন্মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যকারণই প্রধান। যেমন কোন গোষ্ঠির জীবিকা হলো পশু শিকার বা মৎস্য শিকার, কোন গোষ্ঠির জীবিকা কৃষি বা পশুপালন, এই বিভিন্নতায় তাদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিবর্তন ধারায়ও বিভিন্নতা এসে যায়। কিন্তু পার্শ্ব বিভিন্নতা সত্ত্বেও চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ ও বিকাশধারার সাধারণ নিয়মগুলো অভিন্নই থাকে। এটা সত্য যে, বিভিন্ন জাতির বসবাস ও জীবনধারয় প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির পথেও প্রভাব ফেলে। কারো গতি হয় ধীর, কারো গতি হয় দ্রুত বা দ্রুততর। তবে সর্বাবস্থায় সবার গতিপথ হয় অভিন্ন। এই পরিবেশ-ভিন্নতা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে বিশেষ কিছু গৌণ বর্ণবৈচিত্র দান করলেও তার মূল বর্ণরুপ থেকে যায় অভিন্ন।
জাতসিত্তার বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মানবশিশুর ক্রমবিবর্তন, আচার-আচরণে ও স্বভাব চরিত্রে ভিন্নতা যতই থাকুক, প্রতিটি মানব সন্তান জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শেশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের অভিন্ন স্তর ও পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হয়।
কোন কোন আধুনিক গবেষক চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশকে জাতিসত্তার অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিবর্তনের অনুগামী বলে দাবি করেছেন। তাদের মতে কোন জাতির আচার অভ্যাস, রীতিনীতি ও চরিত্র এবং শিল্প, দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আমরা দেখি তা তাদের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। উদাহরণ স্বরুপ পুজিঁবাদী অর্থব্যাবস্থা থেকেই এসেছে নব আবিষ্কারের জোয়ার, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় যার প্রভাব ছিল অপার। এ কারনেই সমাজবিঞ্জানীরা মানবজাতির ফেলে আসা সমগ্র অতীতকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সীমারেখায় বিভক্ত করেছেন এবং সে আলোকে সমকালের বুদ্ধিবৃত্তিক অবয়ব ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। এই মত ও মন্তব্যের বিশদ বিচার পর্যালোচনা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তদ্রুপ একথা প্রমাণ করাও আমাদের লক্ষ্য নয় যে, আর্থসামাজিক অবস্থা সাংস্কৃতিক বিকাশের একটি মাত্র 'কার্যকারণ' সমগ্র কিছু নয়।
যাই হোক আধুনিক গবেষকগণ বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে 'মানব বুদ্ধির' গতি ও অগ্রগতির অভিন্ন প্রাকৃতিক 'নিয়মগুচ্ছ' আহরণের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছেন, কেউ কেউ 'ব্যাক্তিচিন্তার' ক্রমবিকাশের আলোকে 'জাতিচিন্তার' ক্রমবিকাশের বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছেন অর্থাৎ ব্যাক্তি যেমন তার শিশু চিন্তার স্তর থোকে যাত্রা করে বয়স ও পরিপক্বতার সমান্তরালে ক্রমোন্নতির পথে অগ্রসর হয়, একটি জাতির তেমনি তার চিন্তা 'শৈশব' হয়ে পর্যায়ক্রমে বিকাশের পথে অগ্রসর হয়। অবশ্য গতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে জাতিতে জাতিতে তারতম্য থেকে যায়। তাদরে মতে একটি জাতি তার চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির যাত্রাপথে মোট পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে থাকে। যথা-
১. কুসংস্কার ও কল্পকাহিনীর সহজ বিশ্বাসের যুগ।
২. সংশয় ও অনুসন্ধিৎসার যুগ।
৩. বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের যুগ।
৪. বুদ্ধি ও যুক্তি পয়োগের যুগ।
৫. চিন্তাসত্তার জরা ও বার্ধক্যের যুগ।
উল্লেখিত পাচটি স্তর জাতির চিন্তাসত্তাকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করে থাকে এবং গতি ও অগ্রগতির তারতম্যের কারণে বিভিন্ন জাতির অবস্থান বিভিন্ন স্তরে হয়ে থাকে। তবে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্রমবিকাশ ও পর্যায়ন্তরের অর্থ এ নয় যে, জাতির প্রতিটি সদস্যের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি একই পর্যায়ে অবস্থান করবে। বরং বিশ্বপরিসরে জাতিতে জাতিতে যেমন তেমনি জতীয় পরিসরে ব্যক্তিতে ব্যাক্তিতেও চিন্তার বিকাশ ও অগ্রগতিতে তারতম্য থাকে; থাকতে পারে। ঠিক যমন একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের বয়স, চিন্তা ও বুদ্ধিতে তারতম্য থাকে। এ ক্ষেত্রে কোন পরিবারকে 'অগ্রসর' বলতে হলে আমরা পরিবারের সমষ্টিগত অবস্থা এবং তার বিশিষ্ট সদস্যদের চিন্তা-চেতনার স্তর বিচার করে থাকি। জাতিগত ক্ষেত্রেও শিক্ষিত জনগোষ্ঠি ও চিন্তাশীল শ্রেনীর সাধারণ ঝোক ও প্রবণতাই হবে আমাদের বিচার্য।
বিভিন্ন জাতির জীবনে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ও পরিবতর্নের ক্ষেত্রে কতগুলো 'বিবর্তন' ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন দুটি জাতির সামাজিক মিশ্রণ, 'রক্তসংমিশ্রণ' ইত্যাদি।
আধুনিক গবেষকদের প্রবর্তিত এই 'নীতিদর্শন' যদি আমরা 'আরব-চিন্তার' বিকাশ ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে পয়োগ করতে যাই তাহলে কিন্তু আমাদেরকে বেশ জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা পরিবেশ ও ঘটনাপ্রবাহের যে 'পরিবেষ্টন' আরব জাতির ক্ষেত্রে ছিল তা অন্য কোন জাতির বেলায় খুব কমই দেখা যায়।
বস্তুত এ 'নীতিদর্শন' প্রযোগ তখনই অপেক্ষাকৃত সহজ হবে যখন কোন জাতির চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি বাহির থেকে নয়, বরং ভিতর থেকে নিজস্ব স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হতে থাকবে। গ্রীক জাতি যেমন তার নিজস্ব অবয়বে ও স্বকীয় সত্তায় এসব স্তর অতিক্রম করে এসেছে। কিন্তু আরব জাতির বিষয়টি ছিল ভিন্ন। তাদরে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি প্রথম দিকে স্বকীয় ও স্বতন্ত্র ছিল, কিন্তু ইতিহাস তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক যাত্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ক্রম অনুসরণের খুব একটা সুযোগ দেয়নি, কিংবা বলুন, আরবরাই ইতিহাসকে সে সুযোগ দেয়নি। কেননা হঠাৎ করেই আরবরা পারসিক, রোমান, মিসরীয় ও অন্যান্য বহু জাতির উপর সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশপথে যাদের অবস্থান ছিল বিভিন্ন স্তরে। এবং এমন সব স্তর ইতিপূর্বে তারা পার হয়ে এসেছিল, যা জাহেলিয়াতের আরব জাতি পার হতে পারে নি। বিজিত জাতিবর্গের পরস্পর সামাজিক জীবনও ছিল আগাগোড়া ভিন্ন। পারসিক জীবন রোমকজীবন থেকে যেমন পৃথক ছিল তেমনি রোমক-পারসিক জীবন ছিল মিসরীয়দের থেকে পৃথক, অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রেও তাই।
বলাবাহুল্য যে, সামাজিক জীবনের পার্খক্যের অনুবর্তী রুপে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জবিনেও ছিল ব্যাপক তারতম্য। বহু আরব জনগোষ্ঠি তাদের মূল উপদ্বীপ ছেড়ে এসব এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল, কেউ পারস্যে বা মিশরে, কেউ সিরিয়ায় বা ইরাকে। খেলাফতে রাশেদা ও উমাইয়া আমলে আরবদের হাতেই ছিল স্থানীয় শাসন কর্তৃত্ব, আর বিবিন্ন অঞ্চল থেকে আরব উপদ্বীপে আগতদের তুলনায় আরব উপদ্বীপ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে বসতিকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। এবং সমগ্র বিজিত অঞ্চলে আরবরা তাদের ভাষা ও ধর্মের এমন ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিল যে, সমগ্র সংস্কৃতিসত্তায় ছিল আরবীয় ছাপ, এবং আরবী ভাষাই ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির একক ভাষা। সুতরাং জাহেলী যুগকে যদি 'আরব চিন্তার' সূচনাকাল ধরি তাহলে বলতে হয় যে, এসব কারনে এবং অন্যান্য কারনে 'আরব চিন্তা' স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হতে পারেনি, যেমনটি পেরেছে 'মিশ্রণযুক্ত' অন্যান্য জাতি। ভাষায় ও বিষয়ে এবং স্বভাবে ও প্রকৃতিতে জাহেলিয়াতের 'আরবচিন্তা'' ও বুদ্ধিবৃত্তি মৌল অর্থেই আরবীয় ছিল, পক্ষান্তরে ইসলামী যুগের বুদ্ধিবৃত্তিকে নিছক রুপক অর্থে আমরা আরব বুদ্ধিবৃত্তি বলে থাকি। মূলত তা বিভিন্ন জাতির চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির মিশ্রণরুপ, যা আরবী ভাষাকে বাহনরুপে গ্রহণ করেছিল অর্থাৎ আরব, পারসিক, রোমক ও মিসরীয়দের স্ব-স্ব চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি জোরালভাবে সংমিশ্রিত হয়ে একটি অভিন্ন সত্তা লাভ করেছিল। এই নতুন চিন্তাসত্তার বাহন ছিল আরবী ভাষা এবং ভিত্তি ছিল ইসলাম। পারসিক ও রোমান চিন্তাবৃত্তি যেহেতু আগেই কিছু স্তর অতিক্রম করে এসেছিল, যা জাহিলিয়াতের 'আরব চিন্তা' অতিক্রম করতে পারেনি, সেহেতু বিভিন্ন চিন্তাবৃত্তির সংমিশ্রণকালে স্বভাব ও প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মনীতি ও গতিপথ থেকে সরে আসতে স্বীকৃত হয়নি, বরং বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ থেকে সে একটি একক সত্তা তৈরী করে নিয়েছিল, যদিও বা এই একক সত্তা ছিল বিভিন্ন উপাদান ও জটিল সংযোজন বিশিষ্ট। এই সংমিশ্রিত একক চিন্তাসত্তা অতি দ্রুত ঐ সব স্তর অতিক্রম করেছিল যা অতিক্রম করতে কোন 'অমিশ্র জাতির' সুদীর্ঘ সময় লেগে যায়। এ কারনেই এই বিভিন্নমুখি প্রবণতার আলোচনা ও পর্যালোচনা এবং অধ্যযন ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত জটিল ও দু:সাধ্য হয়ে পড়ে, তবু জাতীয় চিন্তাসত্তায় উত্তরণ পক্রিয়াকে আমরা এভাবে বিন্যস্ত করতে পারি। -
১. দৃশ্যত আরব জাহেলিয়াতের অবস্থান ছিল চিন্তাসত্তার বিকাশের প্রথম স্তরে, যার বৈশিষ্ট হলো কুসংস্কার ও কল্পকাহিনীতে সহজ বিশ্বাস, ইসলামপূর্ব কালের ঐ স্তর অতিক্রম করতে আরবদের অবশ্যই বহু শতাব্দি লেগেছে। কিন্তু এ সময়কালের যা কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে তাতে আদি জাহেলিয়াতের অংশ খুবই নগণ্য, অধিকাংশ তথ্যই খুব বেশি হলে নবুওয়্যাতের দুই শতকের, অর্থাৎ আরব জাতি ইতিহাসের পূর্ণ আলোতে যখন আসে, তখন তারা উল্লেখিত স্তরের প্রায় শেষ প্রান্তে ছিল
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, জাহেলী যুগে উপদ্বীপের আরবদের বিশেষত মরুবাসী আরবদের বিবর্তনধারা ছিল অতি ধীর। কেননা চারপাশের জনগোষ্ঠির মাঝে তাদের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ এবং তাদের সবার জীবনধারা ছিল প্রায় অভিন্ন, প্রতিমাপূজা ও পৌত্তলিকতা ছিল তাদের সাধারণ ধর্ম, ঘরে ঘরে ছিল মূর্তির অধিষ্ঠান এবং মূর্তির নামে হতো পশুর বলিদান। মূর্তির কাছেই ছিল তাদের বৃষ্টিকামনা এবং যুদ্ধজয়ের প্রার্থনা। বিবাদকালে মূর্তির সামনে তীর লটারির মাধ্যমে তারা মীমাংসা করতো। দূর যাত্রাকালে তাদের সর্বশেষ কাজ ছিল মূর্তির আর্শিবাদ গ্রহণ, ফিরে এসেও প্রথম কর্তব্য ছিল মূর্তিকে সকৃতজ্ঞ প্রণাম জ্ঞাপন। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে পূর্ণ ছিল তাদের জীবন, অনাবৃষ্টি ও দুর্ভিক্ষে তারা 'সালা ও উশার' বৃক্ষডাল এর আটিঁ গাভীর লেজে বেধেঁ তাতে আগুন ধরিয়ে দিত, ঈশার কোণে বিদ্যুৎ চমকের আশায়। অভিজাত লোকের মৃত্যুতে তারা তার বাহন উটনীকে ঘড়মটকে গর্তে ফেলে দিত, যেন ক্ষুধা-পিপাসায় উটনীও মারা যায়। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, পরকালে এটা তার বাহন হবে। অন্যথায় পায়ে হেটে তাকে পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রেতাত্মায় তাদের এ জাতীয় বিশ্বাস ছিল যে, প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির অশান্ত আত্মা কবরে দাড়িঁয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে 'ইছকুনী' (আমার রক্ত পিপাসা দূর কর) এ ধরনের বহু কুসংস্কার। 'ভবিষ্যত কথন' ও ভাগ্যগণনা ছিল তাদের জীবন-ব্যাবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিপদাপদে ও লড়াই বিবাদে তারা গণকদের সূত্রে গণকরা গায়েবী খবর পেয়ে থাকে, আরব সমাজে বহু গণক প্রকৃত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিল।
এসব এবং অন্যসব কুসংস্কার ছড়িয়ে ছিল আরবের সব গোত্রে এবং এটাই ছিল সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ জীবন ব্যাবস্থা। 'কুলক্ষণ' 'সুলক্ষণ' ই নিয়ন্ত্রণ করতো তাদের জীবনধারা। যা কিছু বলা হতো তাই তারা সহজে বিশ্বাস করতো। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে ঘটনার যে 'কারণ' তারা ব্যাখ্যা করত তা হতো অবস্তব ও দূর্বল। এসব কিছু প্রমাণ করে, জাহেলী যুগে আরবরা আমাদের কথিত চিন্তা বিকাশের প্রথম স্তর অতিক্রম করতে পারেনি।
তবে মনে হয়, ইসলাম সংলগ্নপূর্বে তারা ঐ স্তরের প্রান্ত সীমায় এসে পড়েছিল। কেননা অনেকের তখন 'সংশয়' ও সন্ধান' স্তরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে-স্বগোত্রের ধর্ম-বিশ্বাস, কুসংস্কার ও কল্পকাহিনী সম্পর্কে সংশয় এবং রহস্যের ও সত্যের সন্ধান। এ প্রসঙ্গে যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েল বিন আব্দুল উযযা এর নাম উল্লেখ করা যায়।
তিনি প্রতিমা পূজা ও বলিমাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তার যু্ক্তি ছিল, "আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বষণ করেন, ভূমি থেকে ফসল উৎপন্ন করেন, 'গবাদি' সৃষ্টি করেন যা চারণভূমিতে চরে বেড়ায়, অথচ সেগুলো জবাই হবে গায়রুল্লাহর নামে?"
কথিত আছে যে, তিনি সিরিয়ায় ইহুদী-খৃষ্টানদের এলাকায় 'ধর্মসন্ধানে' গিয়েছিলেন এ আশায় যে, হয়তো তিনি সত্যলাভ করবেন এবং তার হৃদয় শান্ত ও সংশয়মুক্ত হবে।
ওয়ারাকা বিন নওফেলও পৌত্তলিকতা বর্জন করে সত্যের সন্ধানে দুর-দুরান্তে গমন করেছেন এবং আসমানী কিতাব অধ্যায়ন করেছেন।
এভাবে ইতিহাস গ্রন্থে এযুগের বহু লোকের বিবরণ পাওয়া যায়, যারা সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং সত্যের সন্ধান করেছেন। বিভিন্ন সংশয়বাদী কবিতায় প্রতিমার নিন্দা করেছেন এবং যুক্তিহীন আচার-প্রথা প্রত্যাখ্যান করেছেন, ফলে এ সময়টাকে 'সংশয় ও সন্ধান' স্তরের সূচনাকাল অবশ্যই বলা যেতে পারে।
২. সংশয় যুগের পর ঈমান ও বিশ্বাসের যুগ শুরু হলো। ইসলামের আবির্ভাব হলো এবং মানুষকে সে এক 'ইলাহ' এর ইবাদতের আহবান জানালো, যার কোন 'সদৃশ' নেই। মানুষ দলে দলে এ নতুন আহবানে সাড়া দিলো, ফলে জাহেলিয়াতের যা কিছু বিশ্বাস ও কুসংস্কার তা বিলুপ্ত হলো, প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হলো এবং তার অস্তিত্ব ধ্বংস হলো। মক্কা বিজয়ের দিন 'রহমাতুল্লীল আলামীন (স কাবাগৃহে ও কাবা প্রাঙ্গণে মূর্তির 'সমাহার' দেখে ধনুকের মাথায় খুচিয়ে খুচিয়ে সব ভাঙলেন এবং ঘোষনা করলেন- 'জা আল হাক্কু ওয়াজাহাকাল বাতিল, ইন্নাল বাতিলা কানা জাহুকা' - সত্য এসেছে, মিথ্যার বিনাশ হয়েছে, মিথ্যার বিনাশ তো আবশ্যম্ভাবী।
তারপর তার আদেশে সেগুলোকে উপুড় করে ফেলা হলো এবং মসজিদের বাইরে ভস্ম করা হলো। তারপর একই উদ্দেশ্যে খালিদ বিন ওয়ালিদ, তোফায়েল বিন আমর দাওসী ও অন্যান্যকে তিনি বিভিন্নখানে পাঠালেন। গণকদের 'ছন্দ কথা'র নিন্দা করে তাদের মিথ্যাবাদী ঘোষণা করলেন এবং সুলক্ষণ-কুলক্ষণ ও অন্যান্য কুসংস্কার বাতিল করলেন।
মোটকথা, সমগ্র আরব জাহেলিয়াতের বদ্ধমূল কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং তার পরিবর্তে নতুন দীন প্রতিষ্ঠা করলেন ।
আরবগোত্রগুলো সততা ও স্বত:স্ফূর্ততা এবং প্রেরণা ও উদ্দীপনার সাথে ইসলাম গ্রহণ করলো, ফলে তা তাদের সমগ্র সত্তা অধিকার করে নিলো এবং 'সমাজবিষয়ের' সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করলো, আর জ্ঞানচর্চা ছিল তার অন্যতম। এভাবে উমাইয়া আমলের প্রায় শেষ পর্যন্ত দ্বীন ও ধর্মই ছিল জ্ঞানচর্চার যাবতীয় কর্মকান্ডের ভিত্তিমূল। ইতিহাসের মূল উপজীব্য ছিল নবী, সাহাবাগণের জীবনী, মাগাযী এবং জিহাদ ও বিজয়াভিযান। ফিকাহর ভিত্তি ছিল আহকাম বিষয়ক কুরআনের আয়াত ও হাদীস। আলেমদের ওয়াজ ও বয়ান এবং আলোচনা ও অনুসন্ধান সবই ছিল পূর্ণ দ্বীনকেন্দ্রিক, তথা তাফসীর, হাদীস ও ফিকাহভিত্তিক। চিকিৎসা, রসায়ন ও অন্যান্য জাগতিক শাস্ত্রের চর্চা-গবেষণা ছিল খুবই নগণ্য। তদুপরি নিয়োজিত ব্যক্তিদের সিংহভাগই ছিল অমুসলিম। ইসলামের প্রতি আলিমদের ঈমান ও আনুগত্য ছিল পূর্ণ স্বত:স্ফূর্ত এবং 'সংশয় সম্ভাবনা' থেকেও মুক্ত। তাই তাদের ধর্মচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল কুরআন-রহস্যের ব্যাখ্যায়ন, বিক্ষিপ্ত হাদীসের সংকলন, কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আহকাম ও বিধান আহরণ, খন্ড খন্ড ঘটনার সঙ্গে আয়াত ও হাদীসের সাজুয্য সাধন ইত্যাদির মাঝে।
৩. কিন্তু আব্বাসী যুগের আবির্ভাব থেকে আমরা জ্ঞান আমরা জ্ঞান চর্চার ভিন্ন 'অভিপ্রকাশ' দেখতে পেলাম। মুসলিম জাহানের সর্বত্র জাগতিক শাস্ত্র চর্চার অভূতপূর্ব 'জোয়ার' এলো। দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা থেকে শুরু করে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা পর্যন্ত সকল গ্রীক শাস্ত্র এবং ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা আরবীতে অনূদিত হলো। পারসিক, গ্রীক, রোমক ও অন্যান্য জাতির ইতিহাসও অনুবাদের আওতায় চলে এলো। আমরা আরো দেখতে পেলাম, গ্রীক ইশ্বরতত্ব এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম তথা ইহুদী ধর্ম, খৃষ্ট ধর্ম ও অগ্নিপুজার ধর্ম সম্পর্কেও আলোচনা শুরু হয়েছে এবং 'ধর্মনেতাগণ' পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কে অবতীর্ণ হচ্ছেন, যা কখনো ছিল আক্রমণাত্মক কখনোবা রক্ষণাত্মক। এসব কিছু নতুন এক বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থার কার্যকারণ তৈরী করলো। অন্যান্য ধর্মের লোকেরা জ্ঞান ও যুক্তির ভাষায় ধর্ম প্রচারে নামলো এবং তা পরিরোধও করা হলো যুক্তি প্রয়োগের পন্থায়। ফলে স্বভাবতই ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকেও একই পন্থা অনুসরণ করতে হলো, অথচ প্রথম যুগে ইসলামী দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ স্বভাবনির্ভর ও প্রাকৃতিক। যেমন সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করা।
কিন্তু আব্বাসী যুগে অন্যান্য ধর্মের নেতাগণ এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা নির্ভর যু্ক্তি-প্রমাণের অবতারণা করলেন যার কাঠামো ছিল 'শর্তসিদ্ধ' প্রথমসূত্র, দ্বিতীয় সূত্র ও সিদ্ধান্ত- এই তিনের সমন্বয়ে। ফলে ইসলামের দাওয়াতও রুপ নিলো কালাম শাস্ত্রের। এই 'দর্শন-প্রভাব' দ্বারা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন এবং ফিকহী আইন ও বিধান প্রণয়ন সবকিছু দারুনভাবে প্রভাবিত হলো। ফলে আলিমগণ তাদের সামনে উপস্থাপিত সকল ধর্মীয় বিষয় তর্কশাস্ত্রের পরিভাষা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেলেন। এই যদি হয় ধর্মীয় শাস্ত্রের অবস্থা তাহলে জাগতিক শাস্ত্রগুলোর অবস্থা তো আরো পরিষ্কার। চিকিৎসা, গণিত ও জ্যোতিবিদ্যাসহ সকল শাস্ত্রই সম্পূর্ণরুপে নির্ভর করছিল বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তর্কশাস্ত্রীয় তাত্ত্বিক যুক্তি-প্রমাণের উপর। এটা ছিল সাধারণভাবে আব্বাসী আমলের নতুন প্রবণতা, যা সমকালীন সমাজ জীবনের এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতিরই স্বাভাবিক ফল।
অন্যদিকে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসের যারা গবেষক তারা কেউ কেউ মনে করেন যে, প্রথম স্তরে 'জ্ঞান' সুবিন্যাস্ত ও সুশৃঙ্খল থাকে না। বরং বহু বিক্ষিপ্ত বিষয় সেখানে আলোচিত হয় যা কোন 'একক' দ্বারা একীভূত নয় এবং যার কোন সীমা-সংখ্যা নেই। সে ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্ববর্তী চিন্তানায়কদের মতামত ও বর্ণনার উপর নির্ভর করা হয়। 'জ্ঞান-বিষয়' যেমন বিক্ষিপ্ত, জ্ঞানসেবীরাও তেমনি বিক্ষিপ্ত, সমগ্র 'জ্ঞান' সেখানে শাখা-প্রশাখাহীন একটি একক সত্তা, মানুষের বুদ্ধি ও মস্তিস্ক যা কিছু চিন্তা করে সবই 'জ্ঞান', তার ভিন্ন ভিন্ন নাম ও সংজ্ঞা নেই, গ্রীকদের 'দর্শন' যেমন 'মানব চিন্তায়' যা কিছু আসে সবই 'দর্শন' এর আলোচ্য বিষয়।
তারপর জ্ঞানের অগ্রগতি হয়, ফলে জানার পরিধি ক্রমান্বয়ে ব্যাপ্ত এবং অজানার পরিধি সংকুচিত হয়ে আসে। এভাবে যখনই একটি প্রশ্নের সমাধান হয়, তখনই মানুষের 'জ্ঞান-কোষ'-এ তা সংযোজিত হয় এবং তার জানার পরিধি আরো বিস্তৃত হয়।
প্রশ্ন ও সমাধান এর পথ বেয়ে জ্ঞান যতই অগ্রসর হয় পরীক্ষণ ও প্রত্যয়ন প্রবণতাও তত বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ববর্তীদের মতামত ও সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরতা ততই হ্রাস পায়। পরীক্ষা-নীরিক্ষার এই স্তরে একটা দীর্ঘ পথযাত্রার পর জ্ঞানও শাস্ত্র বিণ্যাসের স্তরে উপনীত হয় এবং অভিন্ন বিষয়গুলো একক কাঠামোতে একীভূত হয়ে মোটামুটি স্বতন্ত্র একটি শাখারুপে অস্তিত্ব লাভ করে। জ্ঞানসেবীগণ আরো লক্ষ করেছেন যে, 'মানবচিন্তা' প্রথমত প্রকৃতি ও তার বিভিন্ন অভিপ্রকাশ ক্ষেত্রে নিবদ্ধ হয়েছে, অত:পর তা মনবসত্তা সম্পর্কে অধ্যয়নে নিয়োজিত হয়েছে, এরপরই শুধু জ্ঞান ও শাস্ত্র বিন্যস্ত রুপ ও পৃথক কাঠামো লাভ করেছে।
এ আলোকে আরব বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, জাহেলী যুগে তাদের জানা তথ্যগুলো ছিল বিক্ষিপ্ত। প্রকৃতি সম্পর্কে, কিংবা মাসব সত্তা সম্পর্কে পরস্পর যোগাযোগহীন কিছু চিন্তা ও মতামত, যা পরবর্তীদের অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত রুপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তীরা বর্ণনা করে চলেছে। গতানুগতিক চিকিৎসা, প্রথাগত গণকতা, গ্রহ-তারা সম্পর্কে বংশানুক্রমিক কিছু মতামত ও বিশ্বাস এবং অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণশূণ্য কাব্য বর্ণনা- এগুলো এবং এ জাতীয় কিছু বিষয় সংস্কৃতিবান ব্যাক্তিমাত্রই স্থির সত্যরুপে জেনে আসছিল। এ সকল ক্ষেত্রে তাদের এ জাতীয় আলোচনাই ছিল সব কিছু, কিন্তু নিখুত ও সুবিন্যস্ত কোন রুপ ছিল না। সংলগ্ন পরবর্তী খেলাফতে রাশেদার যুগ থেকে আব্বাসীয়দের অভ্যুদয়ের কিছু পূর্ব পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই যে, ধর্মীয় জ্ঞানই ছিল সমাজের স্বীকৃত সাধারণ জ্ঞান, যেমন আগেও আমরা বলেছি। তবে সব বিষয় অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলোচিত হত, কিন্তু জ্ঞান ও শাস্ত্র তখনো শাখা-প্রশাখায় পৃথক সত্তায় লাভ করেনি। তাফসীর, ফিকাহ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামের কোন শাস্ত্র তখনো ছিল না। আলেমদেরও আলাদা বিষয়গত কোন পরিচয় ছিল না। ইবনে আব্বাস ও অন্যরা একই মজলিসে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা করতেন। তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ এবং অনুষঙ্গরুপে ভাষা ও কাব্যের মিশ্র সত্তাই ছিল তখনকার সংস্কৃতি যা একই 'হালকা' (মজলিস) ও পাঠচক্র থেকে অর্জন করা হতো। মোট কথা, জ্ঞান ও শাস্ত্রের আলাদা নাম ও শাখা-প্রশাখা ছিল না, যারা হাদীস সংকলনে নিয়োজিত ছিল তারা অধ্যয়নে মনোযোগী ছিল না অর্থাৎ একেক বিষয়ের হাদীসকে তারা একেক অধ্যায়ের অন্তর্ভূক্ত করতেন না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। অর্থাৎ সংলগ্ন পরবর্তী যুগের বিন্যস্ত ও রীতিসম্মত 'গ্রন্থনার' সূচনা তখনো হয়ে উঠেনি।
অবশেষে দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরুতে আমরা শাখা-প্রশাখায় জ্ঞানের পৃথকায়ন প্রবণতা দেখতে পেলাম, যা আব্বাসী সালতানাতের প্রথম দিকে পূর্ণতা লাভ করলো। ইমাম যাহাবী বলেন-
১৪৩ হিজরীতে ইসলামী উম্মাহর আলিমগণ হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহর শাস্ত্রীয় সংকলন শুরু করেন। মক্কায় ইবনে জোরায়জ, মদীনায় মালিক (মুয়াত্তা), সিরিয়ায় আওযায়ী, বারোয় ইবনে আবী আরুবা ও হাম্মাদ বিন সালমা প্রমুখ, ইয়ামেনে মামার ও কুফায় সুফিয়ান ছাওরী হাদীসের বিভিন্ন সংকলন তৈরী করলেন। ইবনে ইসহাক আল-মাগাযী নামক সীরাত গ্রন্থ লিখলেন এবং আবু হানিফা ফিকাহ ও কিয়াস-বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করলেন। এর কিছু পরে হোসাইন, লায়ছ, ইবনে লাহী'আ এবং আরো পরে ইবনুল মুবারাক, আবু ইউসুফ ও ইবনু ওয়াহাব প্রমুখ এগিয়ে এলেন। এভাবে জ্ঞান ও শাস্ত্রের সংকলন ও অধ্যয়ন কাজ পুরোদমে চলতে থাকলো। এমনকি আরবী ভাষা, সাহিত্য, সাধারণ ইতিহাস ও যুদ্ধ ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন শুরু হলো, অথচ এর আগে আলিমগণ নিজস্ব স্মৃতি থেকে আলোচনা করতেন কিংবা অবিন্যস্ত (তবে বিশুদ্ধ) খাতা থেকে পড়ে শুনাতেন। (তারীখে খুলাফা, মিশর-সুয়ুতী-১১০ পৃষ্ঠা)।
উপরের উদ্ধৃতি আমাদের পূর্ব বক্তব্যই সমর্থন করে যে, উমাইয়া যুগে জ্ঞান ছিল আলিমদের স্মৃতি কিংবা তাদের সংকলিত অবিন্যস্ত খাতা, যাতে ছিল তাফসির, হাদীস, ফিকাহ, ভাষা, ব্যাকরণ ইত্যাদি সর্ববিষয়ের সমাহার। আলেমদের 'শিক্ষা মজলিসে'ও ছিল একই বৈচিত্র। আতা বলেছেন-
ইবনে আব্বাসের মত এমন মহান মসলিস আমি আর দেখিনি, যেমন জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়, তেমনি আল্লাহভীরুতায়। ফিকাহ চর্চাকরীরা যেমন আছেন তার খিদমতে, তেমনি আছেন কুরআন চর্চাকারীরা, এমনকি কাব্যসেবীরাও, এক বিশাল ভান্ডার থেকে সবা্ইকে তিনি বিতরণ করছেন। (ইসাবাত, খন্ড : তয়, পৃষ্ঠা:৯৩)।
আব্বাসী যুগে এসে জ্ঞান ও শাস্ত্র পৃথক পৃথক সত্তা লাভ করলো এবং প্রতিটি শাস্ত্রের 'বিষয় আলোচনা' স্বতন্ত্রভাবে সংকলিত হলো, এমন কি একই শাস্ত্রের সদৃশ বিষয়গুলো এক অধ্যায়ে উপস্থাপন করা হলো।
উমাইয়া আমলে আরেকটি বিষয় আমরা দেখেছি যে, কুরআন-সুন্নাহই ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এ বিন্দুতেই আবর্তিত হতো জ্ঞানের প্রায় সকল আলোচনা, এ দুই উৎস থেকেই হতো ফিকাহর মাসআলা উদ্ভাবন এবং এ দু'য়ের প্রয়োজনেই হতো ব্যাকরণ চর্চা ও কাব্যালোচনা। মোট কথা, অতি সমান্য ব্যতিক্রম বাদে জ্ঞানচর্চার সমগ্র আলোড়ন ও আন্দোলন ছিল ধর্ম-নির্ভর। পক্ষান্তরে আব্বাসী আমলে বিষয় চর্চার রুপ ভিন্নতা সত্বেও এই ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দুটি বহাল ছিল, তবে তার পাশাপাশি নতুন এক কেন্দ্রবিন্দুতে পূর্ণ উদ্যমে জাগতিক জ্ঞানচর্চার আবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই কেন্দ্রবিন্দুটি হলো চিকিৎসা। নাস্তুরী পন্ডিতগণ ইহুদীদের সহযোগিতায় 'জিন্দা শাপুরে' চিকিৎসা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন, আর আব্বাসী আমলে খলীফাগণ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেন। মূলত এ চিকিৎসা চর্চাকে কেন্দ্র করেই উন্মেষ ঘটেছিল প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, এমন কি যুক্তিবিদ্যা ও ঈশ্বরতত্ত্বের মত শাস্ত্র চর্চার। কেননা 'চিকিৎসা সংস্কৃতির' জন্য জ্ঞানের এসব শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করা অপরিহার্য ছিল, এমনকি আলফারাবী ও ইবনে সীনার মত মুসলিম দার্শনিকদের বেলায়ও আমরা এ ধারা লক্ষ করি। তারা উভয়ে ছিল দার্শনিক চিকিৎসক।
এ কারণেই আলোচ্য যুগে আমরা জ্ঞানচর্চার দুটি পৃথক ধারা প্রবাহমান দেখতে পাই, কুরআন-সুন্নাহ কেন্দ্রিক ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা এবং চিকিৎসাকেন্দ্রিক জাগতিক জ্ঞান চর্চা, আর উভয় ধারার ছিল স্ব-স্ব বৈশিষ্ট এবং নিজস্ব পর্যালোচনা পদ্ধতি। অবশ্য বলাবাহুল্য যে, উভয় ধারায় 'পরস্পর প্রভাব' বিদ্যমান ছিল। ইবনে খালদুন জ্ঞানচর্চার উভয় ধারার নির্ভূল পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন-
'জ্ঞান দু'প্রকার। প্রথমত মানুষের স্বভাবগত জ্ঞান, নিজের চিন্তার সাহায্যে মানুষ যার পরিচয় লাভ করে, দ্বিতীয়ত বাণী-নির্ভর জ্ঞান, যা শুধু 'রাসূল' থেকে গ্রহণ করতে হয়। দর্শনবিষয়ক জ্ঞানসমূহ প্রথম শ্রেণীভূক্ত। নিজের 'স্বভাব-চিন্তা' দ্বারা মানুষ এগুলো জানতে পারে, মানবীয় মেধা দ্বারা এগুলোর বিষয়বস্তু ও আলোচনা আয়ত্ত করতে পারে এবং এগুলোর যুক্তি প্রমাণের বিভিন্ন দিক এবং তা শেখার বিভিন্ন পন্থা বুঝতে পারে। এভাবে একজন চিন্তাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজের চিন্তা-পর্যালোচনা দ্বারা এ বিষয়ে সে ভুল-নিভুল নির্ধারণ করতে পারে।
পক্ষান্তরে 'ওহী-নির্ভর' ও প্রবর্তিত জ্ঞানসমূহ হলো দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। এগুলো শরীয়ত প্রবর্তকের বাণী ও উক্তির উপর নির্ভরশীল। শাখা-বিষয়গুলোকে মূল বিষয়ের সাথে যুক্ত করার ক্ষেত্র ছাড়া সেখানে বুদ্ধি প্রয়োগের অবকাশ নেই" (আল মুকাদ্দামা, পৃষ্ঠা : ৩৬৩)।
আরেকটি সূক্ষ্ণ বিষয়ও তিনি চিহিৃত করেছেন, তা এই যে, স্বভাবগত ও বুদ্ধীয় জ্ঞান হলো সর্বজাতির সম্মিলিত জ্ঞান। কেননা জাতি-বর্ণ নির্বেশেষে মানুষ মাত্রই তার স্বভাবচিন্তার সাহায্যে তা আয়ত্ত করতে পারে। পক্ষান্তরে 'বানীয় জ্ঞান' হলো ইসলামী উম্মাহর নিজস্ব সম্পদ।
যাহাবী বলেছেন, আলোচ্য যুগেই আরবী ভাষায় প্রায় সকল জ্ঞান ও শাস্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়ে গিয়েছিল, এমন ইসলামী শাস্ত্র কমই আছে, পরবর্তীকালে যার উন্মেষ ঘটেছে, অথচ আব্বাসী আমলে তার ভিত্তি রচিত হয়নি। এ যুগেই কোরআন-সুন্নাহ সম্পর্কিত সকল শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল এবং ব্যাকরণ ও অভিধান শাস্ত্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল। ব্যাকরণবিদ 'সীবওয়ায়েহ' তার অমর গ্রন্থ 'আল-কিতাব' এ সময় রচনা করেছেন এবং খলীল বিন আহমদ অভিধানের রুপরেখা তৈরী করেছেন, ছন্দ -শাস্ত্রও তারই উদ্ভাবন। জাহেলিয়াতের কাব্যসংকলনও এ সময়ের কীর্তি। যেমন রাবী হাম্মাদ সংকলিত আল-মুয়াল্লাকাত, মুফাযযাল আদ-দাব্বী সংকলিত আল-মুফাদ্দলিয়্যাত, আসমাঈ সংকলিত আল-ইসমিয়্যাত ও অন্যান্য কাব্য চয়নিকা। জাহিম এ সময় সাধারণ সাহিত্যগ্রন্থ রচনার ভিত্তি তৈরী করেছেন, আর ইবনে কোতায়বা, আল মুবাররাদ প্রমুখ তার অনুগমন করেছেন। একই ক্ষেত্রে ফিকাহ শাস্ত্রেরও তখন প্রবর্তন হয় বিভিন্ন ইমাম ও তাদের ছাত্রদের হাতে, ইতিহাস শাস্ত্রের গোড়াপত্তন হয় ইবনে ইসহাক ও অন্যান্যের হাতে।
এ হলো এক দিকের কথা, অন্যদিকে আলিমগণ দর্শন, গণিত, যুক্তিবিদ্যা, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা ও অন্যান্য শাস্ত্রের গ্রন্থ অনুবাদ ও গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। সুতরাং সে যুগে ছিল না এমন কোন শাস্ত্রের কথা আর বলা যায় ? পরবর্তীতে যা হয়েছে, তা তো শুধু বৃদ্ধি ও পু্ষ্টি এবং শাস্ত্রীর গ্রন্থ রচনার উৎকর্ষ বা অপকর্ষ এবং কল্যাণকর বা ক্ষতিকর ব্যাখ্যা পর্যালোচনার সংযোজন।
এরপর সংগত কারনেই আমরা প্রশ্ন করতে পারি যে, কী কী কার্যকারণ সূত্রে শাস্ত্রসমূহের এই অগ্রগতি এবং বিণ্যাস ও গ্রন্থনা সম্পন্ন হলো ? তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটলো ? এবং জ্ঞান চর্চার ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দুর সমান্তরালে জাগতিক জ্ঞানচর্চার নতুন কেন্দ্রবিন্দু আত্মপ্রকাশ করলো ? ইবনে খালদুনের মতে, নাগরিক প্রাচুর্যই হলো জ্ঞানের সমৃদ্ধি এবং বহুমুখী বিকাশের উৎস। কেননা জ্ঞান মূলত শিল্পধর্মী, বরং তা একটি শিল্প, আর শিল্পের বিকাশ ও সমৃদ্ধি হয় নগরকেন্দ্রিক। সুতরাং নগর জীবনের সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য ও উন্নয়নের যাত্রার উপরই নির্ভর করে শিল্পের উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির যাত্রা। কেননা তা জীবিকার অতিরিক্ত বিষয়। সুতরাং জীবিকার প্রয়োজন থেকে নগরবাসীর সময় যত উদ্বৃত্ত হবে, জীবিকা বহির্ভূত বিষয়, তথা মানব প্রকৃতি গবেষণায় এবং জ্ঞান ও শিল্প সাধনায় তত বেশি আত্মনিয়োগ সম্ভব হবে। এ কারনেই আব্বাসী আমলে ইরাকের সভ্যতা উমাইয়া আমলে দামেস্কের সভ্যতা থেকে সমৃদ্ধতর ছিল। কেননা সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যে ইরাক ছিল অধিকতর অগ্রসর, তাই সেখানে জ্ঞানচর্চা ও শিল্পসাধনা ছিল সহজতর, তবে এসকল কার্যকারণ ছাড়া আরো কিছু বিশেষ কার্যকারণও ছিল। যথা -
১. খেলাফত কেন্দ্রিক পরিবর্তন এবং বাগদাদের গোড়াপত্তন। প্রাচীন কাল থেকেই ইরাক ছিল সমৃদ্ধতর সভ্যতার অধিকারী, এমনকি উমাইয়া আমলেও সিরিয়ার মুকাবিলায় ইরাক তার জ্ঞান সমৃদ্ধির গর্ব করতো।
২. আব্বাসী সালতানাত ছিল পারসিক ও অন্যান্ন জাতির প্রভাবাধীন। উমাইয়া আমলের মত জীবনের সার্বিক নিয়ন্ত্রন সেখানে আরবদের হাতে ছিল না, বরং সালতানাতের সব ক্ষেত্র ছিল আরবদের দখলে। আর জ্ঞানচর্চা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। পারসিক জাতি ইতিপূর্বেই জ্ঞান ও চিন্তায় বিকাশের সব পর্যায় অতিক্রম করে প্রায় পূর্ণতায় পৌছে গিয়েছিল। নাস্থবী ও অন্যান্ন জনগোষ্ঠির অবস্থাও ছিল অভিন্ন। তারা যখন জ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা পেলো তখন তারা নব উদ্যমে অগ্রসর হলো এবং জ্ঞান চর্চার বেগবান আন্দোলনকে সেই ধারায় এগিয়ে নিল, যেমন নিয়েছিল ইসলাম পূর্ব কালে নিজ নিজ জাতিসত্তার আওতায়।
৩. ইসলামের আবির্ভাব ও বিস্তার লাভ এবং আরবদেশ জয় ও রাজ্য শাসন শতাব্দিকাল অতিক্রম করেছিল। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে পারসিক, রোমক ও অন্যান্ন জাতির সমন্বয়ে এমন এক প্রজন্মের উদ্ভব হল যারা ইসলামী দেশে ইসলামী সমাজে প্রতিপালিত হয়েছিল এবং ধর্মসুত্রে অথবা পরিবেশ সুবাদে মুসলিম পরিচয় পেয়েছিল। আরবী ভাষায় আরবদের মতই ছিল তাদের সমান দখল। সেই সাথে পিতৃপুরুষের ভাষা ও সংস্কৃতিও তারা ধরে রেখেছিল। এখন তারা ফার্সী ও গ্রীক ভাষায় পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জ্ঞান ও সংস্কৃতি আরবী ভাষায় উপস্থাপন করতে লাগল এবং অন্যান্ন ভাষায় জ্ঞান ও শাস্ত্রের যে রুপ কাঠামো পগে উঠেছিল, আরবীয় জ্ঞান ও শাস্ত্রকেও তারা সেই রুপ কাঠামোতে গড়ে তুলতে লাগল।
৪. সিরিয়া থেকে ভিন্ন ইরাকের নিজস্ব জীবনে বিশেষ কিছু জ্ঞানের চর্চা অপরিহার্য ছিল। যেমন দজলা-ফোরাত বিধৌত ইরাকে সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল, যা সিরিয়া ও জাযীরাতুল আরবে ছিলনা। ফলে খিরাজ ব্যবস্থারও নব বিন্যাসের অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। নি:সন্দেহে আবু ইউসুফের সুবিখ্যাত কিতাবুল খিরাজ গ্রন্থে তার ছাপ পড়েছিল, তদ্রুপ কুফা ও বসরার ভিন্ন জীবন ধারার পার্থক্যের কারনে উভয় স্থানের ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্য চর্চার বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক মতপার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
৫. কিছু ব্যাক্তিজ কার্যকারণও জান চর্চার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেগুলোর আবির্ভাব না ঘটলে জ্ঞান চর্চার অগ্রযাত্রা কিছু সময়ের জন্য হলেও বিলম্বিত হতো। আবু জাফর আল মামুনের কথাই ধরুন, পাকস্থলীর পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারনেই তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় অধিক মনযোগী হয়েছিলেন। দেশ ও জাতি নির্বিশেষে সমসাময়িক বিশ্বের প্রতিভাধর সকল চিকিৎসককে তিনি জড়ো করেছিলেন এবং চিকিৎসা গবেষণা ও চিকিৎসা বিষয়ক রচনার ক্ষেত্রে তাদেরকে উদারভাবে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন আর এই চিকিৎসা গবেষণাই হয়ে উঠেছিল বুদ্ধিজ জ্ঞানসমূহের চর্চার উৎসবিন্দু। মনসুর জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তার ধারনায় পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। ফলে জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা তার উদার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল। রাশি গননার উপর ভিত্তি করে তিনি বিভিন্ন কাজে হাত দিতেন। যেমন বাগদাদ শহর নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ, বিভিন্ন কাজের শুভক্ষণ নির্ধারণ ইত্যাদি।
৬. আলোচ্য কারণসমূহের মধ্যে এটাই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, ইসলামী উম্মাহ জ্ঞানচর্চার পথে যোগসূত্রশূন্য বিক্ষিপ্ত আলোচনার স্তর অতিক্রম করে এসেছিল। ফলে পরবর্তী স্তর তথা স্বতন্ত্র বিন্যাস ও গ্রন্থনার স্তরে তার উত্তরণ ছিল অনিবার্য। তবে এ ক্ষেত্রে আমদের অবশ্য মনে রাখতে হবে যে, যে সকল জ্ঞান আলোচ্য স্তর অতিক্রম করেছিল সেগুলো হলো বানী ও উক্তিনির্ভর ভাষা-সাহিত্যবিষয়ক জ্ঞান, পক্ষান্তরে বুদ্ধিজজ্ঞান তথা চিকিৎসাশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদির চর্চা ইসলামী উম্মাহর হাতে পৃথক পৃথক সত্তায় বিন্যস্ত অবস্থায় শুরু হয়েছিল। কেননা এ সময় জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর তথা মিশ্রসত্তায় বিক্ষিপ্ত আলোচনার স্তর ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল সেই প্রাচীনকালে। এগুলোর জনক জাতিবর্গ তথা গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিকদের হাতেই। বিন্যাস, গ্রন্থনা এবং পর্যালোচনার স্তরও অতিক্রান্ত হয়েছিল তাদেরই হাতে। সুতরাং আব্বাসীয় আমলে সেগুলো পূর্ণ অবয়ব নিয়েই আরবীতে ভাষান্তর হয়েছিল। ফলে নতুন করে প্রাকৃতিক স্তরসমূহ উত্তরণের পয়োজন সেগুলোর ছিল না। সম্ভবত বানী-নির্ভর জ্ঞানসমূহের রচনাকর্মে নিয়োজিত পন্ডিতরা বুদ্ধিজ জ্ঞানসমূহের বিন্যস্ত রুপ অবলোকন করে নিজেদের চর্চাধীন জ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রেও সেগুলোর নিব্যাসরীতি প্রয়োগ করেছিল।
আলোচনা ও রচনার ক্ষেত্রে বাণীনির্ভর জ্ঞান (ধর্মীয়) ও উক্তিনির্ভর জ্ঞান (জাগতিক), এ দুয়ের রীতি ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাণীনির্ভর জ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে আলোচনা ও রচনার রীতি হলো বর্ণনা ও সনদের বিশুদ্ধতার উপর অখন্ড নির্ভরতা। সে যুগের তাফসীর রচয়িতাগণ কোন আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের বর্ণনাসমূহের উপরই শুধু নির্ভর করতেন। অতিরিক্ত কিছু করার মধ্যে একাধিক উক্তির একটিকে অগ্রাধিকার প্রদান করতেন মাত্র। হাদীসের ক্ষেত্রেও ছিল ঐ একই কথা। যে বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো তা হলো, সংগৃহীত হাদীসের সনদসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতাগত মান নির্ধারণ, অর্থাৎ বিশুদ্ধতার বিচারে হাদীসটি উৎকৃষ্ট, না অনুৎকৃষ্ট তা নির্ধারণ করা। ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ছিল ঐ একই কথা। কেননা ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান দ্বারা এগুলো প্রভাবিত হয়েছিল এবং এগুলোর বর্ণনা পদ্ধতিও ছিল হাদীসেরই বর্ণনা পদ্ধতির অনুরুপ। একজন একজন ভাষাবিদ যেমন আরবদের কাছ থেকে শ্রুত কিংবা আরবদের সাথে কথোপকথনকারী পন্ডিতদের কাছ থেকে শ্রুত বিষয় বর্ণনা করেন, তেমনি একজন সাহিত্যিক বেদুইন আরব কিংবা পন্ডিতদের কাছ থেকে শ্রুত বিষয় বর্ণনা করেন। অনেক ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসদের মত তিনি তার বর্ণনার সনদও উল্লেখ করেন আগানীতে এর নজীর পাওয়া যায়।
মোট কথা উমাইয়া শাসনের শেষ দিক থেকে শুরু করে আব্বাসী সালতানাতের প্রথম দিক পর্যন্ত মোট পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অধিকাংশ জ্ঞান ও শাস্ত্র বিন্যস্ত ও গ্রন্থবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল-হোক তা বাণীনির্ভর জ্ঞান তথা তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, উসূলে ফিকাহ (ফিকাহ মূলনীতি) কিংবা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক জ্ঞান কিংবা বুদ্ধিজজ্ঞান তথা গণিত, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, কালাম ইত্যাদি।
মুসলিম জাতির এ বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা ও কর্মযজ্ঞ অন্যান্য জাতির অবাক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আরবদের দেশ জয়ের উদ্যোগ-উদ্দীপনার সাথেই শুধু এর তুলনা চলে। যুদ্ধক্ষেত্রের সৈন্যবাহিনীর মত আলেম ও পন্ডিতগণ যেন নিজেদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে নিয়ে ছিলেন এবং প্রত্যেকটি দল স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মূর্খতা ও জ্ঞানগত নৈরাজ্য দূর করে সে ক্ষেত্রটিকে তারই নিয়ম-কাঠামোর অনুগত করার সর্বাত্নক চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। ভাষা চর্চায় যেমন ছিল একদল নিবেদিত তেমনি অন্যান্য দল নিবেদিত ছিল হাদীস, ব্যাকরণ, কালাম, গণিত প্রভৃতি শাস্ত্র চর্চায়। জ্ঞান ও শাস্ত্রের বিন্যাস ও গ্রন্থনার এ বিস্ময়কর অভিযানে প্রত্যেক দল ছিল প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে আগুয়ান। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে বেশ এমন বহু স্বনাম খ্যাত ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় ঘটলো, যারা সৃজনশীলতায় একে অপরকে ছারিয়ে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। একদিকে আবু হানীফা ফিকাহ শাস্ত্রের অবকাঠামো তৈরী করে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখলেন, তো অন্যদিকে আবির্ভূত হলেন খলিল বিন আহমদ। আরবী বাক্যে ছন্দ প্রণয়ন ও ভাষা-অভিধানের রুপরেখা প্রণয়ন করে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, মর্দে ময়দান আরো আছে। জ্ঞানের সকল শাখায়ই এ অপূর্ব সৃজন প্রতিযোগিতা তুংগে ছিল। পরবর্তী গোটা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে মুসলিম জাতি আলোচ্য সময়ের রেখে যাওয়া জ্ঞান সম্পদ নাড়াচাড়া করে জীবন ধারণ করেছেন সাধারণভাবে সংকোচন ও সম্প্রসারণ ছাড়া। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোন অবদান ছিল না। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২৫৪৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন