ওরা আহলে হাদীস না আহলে তাকলীদ?!

লিখেছেন লিখেছেন সঠিক ইসলাম ১১ জানুয়ারি, ২০১৪, ১০:৩৮:১৭ রাত

গায়রে মুকাল্লিদ হয়ে তাকলীদ কেন?

গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীস ভাইদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উপর সবচে’ বেশি অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে তাকলীদ নিয়ে। তাদের ভাষ্যমতে কুরআন হাদীসের ইবারত ছাড়া কোন ব্যক্তির তাকলীদ করা জায়েজ নয়। বরং এটি শিরক।

প্রফেসর আব্দুল্লাহ বাঘলপুরী গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেছেনঃ

প্রতিটি মুশরিক প্রথমে মুকাল্লিদ হয়্ তারপর মুশরিক হয়। যদি তাকলীদ না থাকতো তাহলে শিরক সৃষ্টি হতো না। শিরকের সৃষ্টিই হয় তাকলীদ থেকে।

মাওলানা সানাউল্লাহ উমারতাসরী গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেছেনঃ

“আহলে হাদীসদের কিতাব, রিসালা ও ফাতাওয়া দেখুন, যাতে তাকলীদকে শুধু বিদআত বলা হয়নি, বরং কুফরী সাব্যস্ত করা হয়েছে। {আহলে হাদীস}

গায়রে মুকাল্লিদ মাসউদ সাহেবের লেখা বইয়ের কামাল আহমাদের অনূদিত সালাফী পাবলিকেশন্স ঢাকা থেকে মুদ্রিত “মাযহাব ও তাকলীদ” নামক বইয়ে তাকলীদকে একাধিক স্থানে শিরক এবং মুকাল্লিদকে মুশরিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামক এক গায়রে মুকাল্লিদের লেখা মাযহাবীদের গুপ্তধন নামক বইয়েও একই বক্তব্য স্থান পেয়েছে যে, তাকলীদ করা শিরক। আর মুকাল্লিদরা মুশরিক।

আর গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের সংজ্ঞা অনুপাতে তাকলীদ হল, কুরআন হাদীসের দলীল ছাড়া কারো অন্ধ অনুসরণ করার নাম তাকলীদ।

কিন্তু পরিতাপের সেই সাথে মজার ব্যাপার হল, আমাদের গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা এ শিরকী কর্মটি করেছেন খুবই নিষ্ঠার সাথে। কুরআন হাদীসের দলীল ছাড়া অসংখ্য মাসআলায় ব্যক্তির তাকলীদের নজির উপস্থাপন করে নিজেদের পরিভাষা ও ফাতাওয়া অনুযায়ী মুশরিকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা যে শুধু মুসলমান ব্যক্তির অনুসরণ করেছেন, তাই নয়, বরং কাফেরের তাকলীদ করাকেও আপন করে নিয়েছেন।

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা আব্দুল হক গজনবী সাহেব আহলে হাদীসদের সর্দার মাওলানা সানাউল্লাহ উমরতাসরী সাহেব সম্পর্কে লিখেনঃ তিনি ফালসাফা, নিচরীউ এবং মুতাজিলাদের মুকাল্লিদ ছিলেন। {আলআরবাঈনা-৫, রাসায়েলে আহলে হাদীস, প্রথম খন্ড}

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা আব্দুল আহাস সাহেব মাওলানা উমরতাসরী সম্পর্কে লিখেনঃ “তিনি সাহাবাদের জামাআত এবং তাদের ইজমাকে বাতিল করে দিয়ে কাফের এবং মুশরিকদের তাকলীদ করতেন। {আলফায়সালাতুল হিযাজিয়্যাহ-৩৩, রাসায়েলে আহলে হাদীস, ১ম খন্ড}

যদিও গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের দাবি হল, তারা কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাসআলাই কেবল মেনে থাকেন হুবহু। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, তারা কুরআন ও সহীহ হাদীস রেখে নিজের মনগড়া মতের তাকলীদ করে থাকেন। স্মর্তব্য যে, তাকলীদ মানে গায়রে মুকাল্লিদের পরিভাষায় কুরআন হাদীসের দলীল ছাড়া কোন কিছু নেয়া। সুতরাং যদি কোথায় কুরআন ও হাদীসের ইবারত থাকে, তারপরও তারা অন্য মত পোষণ করে থাকেন কারো কথা মেনে কিংবা নিজের মনগড়া তাহলেও তারা তাকলীদ করে থাকেন।

আসুন আমরা গায়রে মুকাল্লিদ আলেমদের মনগড়া তাকলীদের কিছু নমুনা দেখিঃ

গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের কাছে বড় আল্লামা ওহীদুজ্জামান সাহেব। যিনি তাদের প্রসিদ্ধ কিতাব নুজুলুল আবরার এবং হাদিয়াতুল মাহদী ও তাইসীরুল বারী ইত্যাদি কিতাব রচনা করেছেন। গায়রে মুকাল্লিদ আবু ইয়াহইয়া ইমাম খান নৌশহরী ওহীদুজ্জামান সাহেবের নুজুলুল আবরার ও হাদিয়াতুল মাহদী কিতাবের ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেনঃ এ দুটি কিতাব আহলে হাদীস ফিক্বহের বিষয়ের উপর লেখা। আর সাধারণ মানুষের মাঝে খুবই গ্রহণযোগ্য। {আহলে হাদীস কি তাসনীফী-৬২}

কুরবানী ওয়াজিব না সুন্নত?

ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব বুখারীর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুখারী ১ম খন্ডের ১৩৪ পৃষ্ঠার হাদীসের ব্যাপারে লিখেন যে, এ হাদীস দ্বারা কুরবানী ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। হানাফীদের মত এটাই। {তাইসীরুল বারী-২/৭০}

এখানে তিনি স্বীকার করলেন যে, বুখারীর হাদীস হিসেবে কুরবানী করা ওয়াজিব। কিন্তু তার আরেক কিতাবে লিখেছেনঃ “কুরবানী করা সুন্নত”। {কানযুল হাকায়েক-১৯৩}

বুখারীর সহীহ হাদীস রেখে কার তাকলীদে এ মত পোষণ করে কথিত আহলে হাদীসরা?

মহিলাদের স্পর্শ করার দ্বারা অজু ভাঙ্গে কি?

ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব বুখারীর ১ম খন্ডের ৭৪ নং পৃষ্ঠার হাদীসের ব্যাপারে মন্তব্য করে লিখেন যে, এ হাদীস দ্বারা শাফেয়ীদের মতকে বাতিল করে দেয়। কারণ তাদের নিকট মহিলাকে স্পর্শ করা অজু ভঙ্গের কারণ। {তাইসীরুল হাদী-২/২১০}

আল্লামা সাহেব একথা স্বীকার করলেন যে, যারা মহিলাদের স্পর্শের দ্বারা অজু ভেঙ্গে যাওয়ার কথা বলেন, তাদের মতটি বুখারীর উক্ত হাদীস দ্বারা রদ হয়ে যায়। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, তার মাসলাক হল, মহিলাদের স্পর্শ করার দ্বারা অজু ভেঙ্গে যায়। {তাইসীরুল বারী-১/১৪২}

ইমাম বসে নামায পড়ালে মুক্তাদীও কি বসে নামায পড়বে?

বুখারীর ১ম খন্ডের ৯৬ পৃষ্ঠার হাদীসে এসেছে যে, রাসূল সাঃ মৃত্যুর আগে অসুস্থ্য থাকার সময় বসে বসে নামায পড়িয়েছেন। কিন্তু সাহাবাগণকে বসার হুকুম দেন নি। ওয়াহিদুজ্জামান সাহেবও লিখেছেন যে, “রাসূল সাঃ বসে বসে নামায পড়ান। আর সাহাবাগণ রাসূল সাঃ এর পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। {রফউল আজাজাহ আন সুনানি ইবনে মাজাহ-১/৪৩০}

কিন্তু এ স্বীকারোক্তির পরও তিনি তার আরেক গ্রন্থে লিখেন যে, “আহলে হাদীসদের মাযহাব এটাই যে, যখন ইমাম বসে নামায পড়বে, তখন মুক্তাদীরা বসে বসে নামায পড়বে। {তাইসীরুল বারী-১/৪৩৯}

হায়েজ অবস্থায় তালাক দিলে পতিত হয় কি?

মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ৪৭৬ নং পৃষ্ঠায় এসেছে যে, হযরত ইবনে ওমর রাঃ হায়েজ অবস্থায় স্বীয় স্ত্রীকে তালাক দিলেন। তখন রাসূল সাঃ তাকে স্ত্রীকে রাজআত করার আদেশ দিলেন।

গায়রে মুকাল্লিদ ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব এ হাদীসের অধীনে লিখেন যে, রাসূল সাঃ যেহেতু রাজআত করার হুকুম দিয়েছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, হায়েজ অবস্থায় তালাক দেয়ায় তালাক পতিত হয়েছিল। {শরহে মুসলিম-৪/৮৯}

কিন্তু এ সহীহ হাদীস ছেড়ে দিয়ে তিনি ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর অন্ধ তাকলীদ করে লিখেছেনঃ হায়েজ অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না। {তাইসীরুল বারী-৭/১৬৪, ২৩৫}

কুকুর ও তার ঝুটা পাক না নাপাক?

মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ১৩৭ পৃষ্ঠার হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, কুকুর নাপাক এবং তার উচ্ছিষ্ট নাপাক।

গায়রে মুকাল্লিদ ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব এসব হাদীসের অধীনে লিখেনঃ “এসব হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, কুকুর নাপাক, এবং তার লালা ও ঘাম নাপাকা। {শরহে মুসলিম-১/৪০৬}

কিন্তু এসব হাদীসের উল্টো নিজের আরেক কিতাবে পূর্বসূরীদের তাকলীদ করে লিখে দিলেনঃ “অধিক সহীহ কথা এটাই যে, কুকুর ও শুকরের উচ্ছিষ্ট পাক। {নুজুলুল আবরার-১/৩১}

ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব নিজেই হাদীসের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ করতে গিয়ে হাদীসের একটি অর্থ করলেন। তারপর হাদীসের সে অর্থ রেখে নিজের আহলে হাদীস ইমামদের তাকলীদ করে হাদীসের উল্টো আরেক মত পোষন করেছেন। তাহলে হাদীসের বিরোধীতা করে কি তারা আহলে হাদীস থাকে? যারা সারা দিন তাকলীদকে শিরক শিরক বলে চিল্লায় তাদের এ তাকলীদের হুকুম কি হবে?

ইবনে হাজমের তাকলীদ

মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেবরা শুধু কুরআন ও হাদীস মানার দাওয়াত দিয়ে তাকলীদকে হারাম ও শিরক বললেও নির্লজ্জবাবে কুরআন হাদীসের বিপরীত ইবনে হাজম রহঃ এর তাকলীদ করেছেন।

কুরআনে কারীমে স্পষ্টভাষায় لَهْوَ الْحَدِيثِ তথা অবান্তর বিষয়কে হারাম সাব্যস্ত করেছে। {সূরা লুকমান-৬} আর এটা সুনিশ্চিত যে, গান-বাজনা অযথা বিষয়ের মাঝে শামিল। সেই সাথে বুখারীর ২য় খন্ডের ৮৩৭ পৃষ্ঠায় এসেছে যে, রাসূল সাঃ বলেছেনঃ আমার উম্মতের মাঝে কিছু লোক এমন হবে, যারা গান-বাদ্যকে হালাল মনে করবে।

কুরআন ও হাদীসের এসব বর্ণনা সত্বেও গায়রে মুকাল্লিদ ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব ইবনে হাজম রহঃ এর তাকলীদ করে ঘোষণা দিলেন যে, গান-বাজনা জায়েজ হওয়ার মতটিই অধিক যুক্তিযুক্ত। {তাইসীরুল বারী-২/৫০, আসরারুল লুগাত-৮৬ আসারে খায়রের উদ্ধৃতিতে-৩৭৭, হাদিয়াতুল মাহদী-১১৮}

অন্ধ তাকলীদ মাযহাবীরা? না নামধারী আহলে হাদীসরা?

হাফেজ মুহাম্মদ সাহেবের তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদদের কাছে বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন যিনি “তারীখে আহলে হাদীস” তাফসীরে ওয়াজেহুল কুরআন” ইত্যাদি কিতাব রচনা করেছেন। তার নাম হল মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইবরাহীম শিয়ালকুটি। তিনি তাফসীরে সূরা কাহাফের ৬ নং পৃষ্ঠায় আসহাবে কাহাফের নামে ওসীলা সম্পর্কে কতিপয় আমলের উল্লেখ করেছেন।

এ বক্তব্যের উপর পর্যালোচনা করে গায়রে মুকাল্লিদ আরেকজন আলেম মাওলানা আব্দুল কাদের হাসারয়ী সাহেব লিখেছেনঃ “মাওলানা [শিয়াকুটি] এসব নাম নিয়ে ওসীলা গ্রহণের যে আমলের কথা বলেছেন, যাতে এসব নামে উপকার অর্জন আর বিপদ দূরিকরণের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ÑÑÑÑÑ এ সম্পর্কে তিনি শরীয়তের কোন দলীল পেশ করেন নি। বরং তিনি অন্য একজন আলেমের উপর তাকলীদ করে তা বলে দিয়েছেন। {ফাতাওয়া সেতারিয়া-৩/১৪১}

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখও করে দিয়েছেন যে, কার তাকলীদে শিয়াকুটি সাহেব এ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি লেখেনঃ “মাওলানা [শিয়ালকুটি] হাফেজ মুহাম্মদ সাহেব এর বক্তব্যের দ্বারা দলীল দিয়েছেন যে, এ আমল শরীয়তের অনুকুল। অথচ তার কাছে এটি শরীয়ত সম্মত হওয়ার কোন দলীল নেই। {ফাতাওয়া সেতারিয়া-৩/১৪২}

দলীল না দেখে শুধু কথা মানার নামই হল তাকলীদ। তাহলে গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদার শিয়াকুটি সাহেব তাকলীদকে অস্বিকার করে নিজে কেন করলেন তাকলীদ?

মুতলাক তাকলীদ গায়রে মুকাল্লিদদের কাছেও ওয়াজিব?

মাওলানা শিয়ালকুটি গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব তার শায়েখ মিয়া নজীর হুসাইন দেহলবী সাহেবের কিতাব “মিয়ারে হক” এর রেফারেন্সে লিখেন যে, মুতলাক তাকলীদ ওয়াজিব। দেখুন তার ভাষ্যঃ

“অবশিষ্ট রইল না জানা ব্যক্তিদের তাকলীদ। এটি চার প্রকার। প্রথম প্রকার হল ওয়াজিব। এটি হল মুতলাক তাকলীদ। মুজতাহিদ আহলে সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে। সুনির্দিষ্ট কাউকে নয়, যার উল্লেখ মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ “ইকদুল জীদ” গ্রন্থে লিখেছেন যে, “এ তাকলীদ ওয়াজিব এবং সহীহ পুরো উম্মতের ঐক্যমত্বে। আর দ্বিতীয় প্রকার হল সুনির্দিষ্ট মাযহাবের তাকলীদ করা এটি জায়েজ”। {তারীখে আহলে হাদীস-১৪৭}

একদিকে প্রচার করছে তাকলীদ শিরক আর কুফর। অপরদিক দিয়ে এটাকে ওয়াজিব বলে বেড়াচ্ছে! সেই সাথে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ এর উদ্ধৃতিতে এর উপর সমস্ত উম্মতের ঐক্যমত্বের কথাও বলছে। হায়রে গায়রে মুকাল্লিদ!

শুধু কি তাই? গায়রে মুকাল্লিদ অন্যান্য আলেমদের মন্তব্য শুনুন!

# নওয়াব সিদ্দিক হাসান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেনঃ “সাধারণ মানুষের উপর মুজতাহিদের তাকলীদ করা এবং তার ফাতওয়ার উপর চলা ওয়াজিব।” {লুক্বতাতুল উজলান-১৩৭}

# মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেনঃ “সাধারণ লোকদের জন্য উলামাদের তাকলীদ করা আবশ্যক। {হাদইয়াতুল মাহদী-১১০}

# মাওলানা সানাউল্লাহ উমরতাসরী গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেনঃ “এটাতো স্বীকৃত কথা যে, ইলমহীনের উপর আলেমের তাকলীদ করা জরুরী। {তাকলীদে সখসী-২০}

তাকলীদকে ওয়াজিব বলছেন। অপর দিকে তাকলীদকারীদের মুশরিকও বলে বেড়াচ্ছেন। এ কেমন বিচার?

আল্লামা শাওকানীর তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদদের কাছে বড় আলেম আল্লামা শাওকানী নামে প্রসিদ্ধ মুহাম্মদ বিন আলী রহঃ ও তাকলীদ করতেন। গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব এ বাস্তবতা স্বীকার করে বলেনঃ “বর্তমান জমানার এক জামাত যারা নিজেদের আহলে হাদীস পরিচয় দেয়, তারা সুন্নতের অনুসারী দাবি করার পরও নিজেদের আলেম যেমন ইবনে তাইমিয়া, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, শাওকানী এবং মাওলানা ইসমাঈল শহীদ প্রমূখদের এমন মুকাল্লিদ হয়ে যায় যে, তাদের রায়ের বিপরীত দলীল বর্ণনাকারীদের দলীল পর্যন্ত শুনে না। {তাইসীরুল বারী-৬/৪৯৯, নুমানী কুতুবখানা}

শাওকানী প্রমুখদের এমন কট্টর তাকলীদ করার দরূন বিপরীত মতাবলম্বীদের দলীল পর্যন্ত শুনে না এ কথিত আহলে হাদীসরা। এমনকি তাদের ইমামদের তাকলীদ করে পূর্ববর্তী সম্মানী মুজতাহিদদেরও সমালোচনা করতে মুখ কাঁপে না।

ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব এ বক্তব্যের পরপরই লিখেনঃ “পূর্ববর্তী আইয়িম্মায়ে দ্বীন যেমন ইমাম আবু হানীফা রহঃ, ইমাম শাফেয়ী রহঃ প্রমূখ ও অন্যান্য ওলীআল্লাহ বা সুফিয়ানে কেরাম ছিলেন, তাদের সমালোচনা পর্যন্ত করে বেড়ায়।” {তাইসীরুল বারী-৬/৪৯৯}

এর চেয়ে কট্টর তাকলীদ কাকে বলে?

নাপাক কাপড়ে নামায হয়?

মুসলমানদের শিশু বাচ্চারাও জানে যে, নাপাক কাপড়ে নামায হয় না। কিন্তু এর উল্টো আল্লামা শাওকানী রহঃ এর রায় হল, নাপাক কাপড়ে নামায পড়লে নামায হয়ে যাবে। গায়রে মুকাল্লিদ দলের মুজাদ্দিদ নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব আল্লামা শাওকানী রহঃ এর কট্টর তাকলীদ করে বলে দিলেনঃ “নাপাক কাপড়ে নামায পড়লে নামায হয়ে যায়। {নুজুলুল আবরার-১/৬৪}

কাপড় থাকা অবস্থায় উলঙ্গ হয়ে নামায পড়া জায়েজ?

কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা দ্বারা একথা সবাই জানেন যে, কাপড় থাকা অবস্থায় খালি শরীরে নামায পড়া জায়েজ নয়। কিন্তু এর বিপরীত আল্লামা শাওকানী রহঃ এর সিদ্ধান্ত হল, উলঙ্গ হয়ে নামায পড়া জায়েজ আছে।

নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব এ মাসআলাও আল্লামা শাওকানী রহঃ এর অন্ধ তাকলীদ করে বলে দিলেন যে, “উলঙ্গ হয়ে নামায পড়লে তা সহীহ হয়ে যাবে”। {নুজুলুল আবরার-১/১১১}

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীস জামাতের নামকরা আলেম মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আসরী সাহেব লিখেনঃ “গযনবী বুযুর্গরা বিশেষ করে এবং অন্যান্য আহলে হাদীসরা আমভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর আমালান তাকলীদ করে থাকে। {আলইতরুল বালীগ-১৫৯, রাসায়েলে আহলে হাদীস, ২য় খন্ড}

গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদারদের তাকলীদ নিয়ে ওহীদুজ্জামান সাহেবের ধমকি

মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেছেনঃ “আমাদের আহলে হাদীস ভাইয়েরা ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়্যুম, শাওকানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ এবং মাওলানা ইসামাঈল শহীদ রহঃ দের দ্বীনের ঠিকাদার বানিয়ে রেখেছে। যেখানেই এসব বুযুর্গদের বিপরীত মত কেউ গ্রহণ করেছে, সেখানেই তাদের পিছনে লেগে গেছে। ভাল-মন্দ বলতে শুরু করে দেয়। ভাইয়েরা! একটু ইনসাফতো করেন। সেই সাথে একটু ভেবে দেখুন! যখন তোমারা আবু হানীফা এবং ইমাম শাফেয়ী রহঃ দের তাকলীদ ছেড়ে দিয়েছো, সেখানে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়্যুম এবং শাওকানী রহঃ দের মত পরবর্তীদের তাকলীদের কী প্রয়োজন? {ওহীদুল লুগাত, মাদ্দা সার, হায়াতে ওহীদুজ্জামানের উদ্ধৃতিতে-১০২}

বাইতুল্লাহ-মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা ছাড়া কোন কিছুর জন্য সফর বৈধ নয়?

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেছেনঃ বাইতুল্লাহ, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা ছাড়া অন্য কিছুর জন্য সফর বৈধ নয়। এমন কি রাসূল সাঃ এর রওজা যিয়ারতের জন্যও সফর করা জায়েজ নয়। [নুজুলুল আবরার-১/১৭৯}

কিন্তু সহীহ কথা হল, রাসূল সাঃ এর রওজা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েজ এবং সওয়াবের কারণ। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর এ মাসআলায় ভুল করেছেন।

এ কারণেই আল্লামা ওহীদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেনঃ “এ বাবের সর্বশেষ কথা হল, এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ থেকে ভুল হয়েছে। তবুও তিনি একটি সওয়াব পাবেন। একটি মাসআলার ভুলের কারণে তার মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে? কখনোই নয়। {তাইসীরুল বারী-২/১৯৭}

এখানে ওহীদুজ্জামান সাহেব স্পষ্টভাবে স্বীকার করলেন যে, এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ ভুলের মাঝে রয়েছেন। তারপরও তার অন্ধ তাকলীদ করে তিনি তার আরেক গ্রন্থে লিখেনঃ “যখন আল্লাহর কোন ঘরের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ নয় এ তিনটি ঘর ছাড়া। সেখানে শুধু যিয়ারতের জন্য সফর করা কি করে বৈধ হতে পারে? {শরহে মুসলিম-৩/৪০৫}

তিন তালাকে এক তালাক?

এক মজলিসে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে এ মতটি আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ। গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীসদের মাঝে কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া সকলেই ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ করে এ মত পোষণ করেন যে, তিন তালাক দিলে এক তালাকই পতিত হবে।

মাওলানা শরফুদ্দীন দেহলবী আহলে হাদীস লিখেনঃ “আসল কথা হল, মুজীব সাহেব যে লিখেছেন যে, মুহাদ্দিসীনদের নিকট এক মজলিসের তিন তালাকে এক তালাকের হুকুমে হবে, এ মতবাদ সাহাবা রাঃ, তাবেয়ী, তাবেয়ীগণ, আইয়িম্মায়ে মুহাদ্দিসীন এবং মুতাকাদ্দিমীন আলেমদের নয়, বরং এ মতবাদ সাত শত বছর পরের মুহাদ্দিসীনদের। যারা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ফাতওয়ার পাবন্দ এবং অনুসারী। [ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২১৯}

এ ইবারত দ্বারা বুঝা গেল যে, এক মজলিসে তিন তালাক দিলে এক তালাক হবে মতটি সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়ী তাবেয়ীগণের নয়, বরং এটি শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর মত। অথচ ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর অন্ধ তাকলীদ করে বর্তমানের সকল আহলে হাদীস নামধারীরা তিন তালাকে এক তালাকের ফাতওয়া প্রদান করে থাকে।

এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদের কথা অস্বিকার করে কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা বলতে পারেন যে, আরে! আমরাতো এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ করে একথা বলি না। আমরা এটা বলি মুসিলম শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা। যেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল সাঃ, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ, এবং হযরত ওমর রাঃ এর শাসনামলের প্রথম ভাগে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো।

এ হাদীসের ভিত্তিতে আমরা তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করি। ইবনে তাইমিয়ার তাকলীদ করে নয়।

এ কথার জবাব হল, আল্লামা ইবনে হাজম [যাকে আহলে হাদীস নামধারীরা নিজেদের একজন বলে গণ্য করে] রহঃ লিখেছেনঃ মুসলিমের এ বর্ণনাটি রাসূল সাঃ এর হাদীস নয়। কেননা, এ বক্তব্যটি না রাসূল সাঃ এর বাণী, না তার কোন আমল, না রাসূল সাঃ থেকে এ ব্যাপারে তাকরীর রয়েছে। এটি হাদীসের তিন প্রকারের কোন প্রকারের মাঝেই শামিল নয়। {মুহাল্লা লিইবনে হাজম-১০/১০৬, নুজুলুল আবরার-২/৬৪}

আহলে হাদীসদের আলেম মাওলানা শরফুদ্দীন সাহেব দেহলবীও বলেনঃ এ হাদীস মারফু নয়। অর্থাৎ এটি রাসূল সাঃ এর হাদীস নয়। তাই তিনি লিখেনঃ “হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর মুসলিমের এ হাদীসটি মারফু নয়। এটি কতিপয় সাহাবীর আমল। যাদের রহিত হওয়ার কোন ইলম ছিল না। {ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২১৯}

সুতরাং একথা বলা যে, তিন তালাকে এক তালাক গণ্য করার বিষয়টি হাদীস থেকে গৃহিত তা সম্পূর্ণই মিথ্যাচার। বরং এটি পুরোটাই ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর অন্ধ তাকলীদের ফল

মুহাদ্দিসীনদের তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদদের প্রথম সারির আলেম মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব লিখেছেনঃ

“গায়রে মুজতাহিদীন মুতালাকের জন্য মুজতাহিদীনদের তাকলীদ থেকে বের হয়ে আসা এবং তাদের অস্বিকার করার কোন জো নেই। তাদের কোথাও না কোথাও মুজতাহিদীন এবং মুহাদ্দিসীনদের আবশ্যকীয়ভাবে তাকলীদ করতে হয়। কিছু শাখাগত মাসআলার বিষয়ে হোক বা উসূল বা কায়দা-কানুনের ক্ষেত্রে হোক। চাই তা হাদীসের সহীহ বা জঈফ বলার ক্ষেত্রে হোক। {ইশাআতুস সুন্নাহ-১১/৩১২}

বাটালাবী সাহেবের বক্তব্য একথা সুষ্পষ্ট প্রমানিত করছে যে, যে ব্যক্তি মুজতাহিদে মুতলাক নয়, তার কোন না কোন স্থানে তাকলীদ করতেই হয়। চাই তা মাসআলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে হোক, বা হাদীস সহীহ-জঈফ বলার ক্ষেত্রেই হোক না কেন।

সুতরাং গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীসরা যে হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলছেন এটাতো মুহাদ্দিসীনদের মতের উপর তাকলীদ করেই।

হ্যাঁ, যেহেতু তাদের কাছে তাকলীদ শব্দের মাঝে চুলকানি রয়েছে, তাই তারা তাকলীদ শব্দ ব্যবহার না করে, এখানে তারা ইত্তেবাহ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কাজ কিন্তু একই। তাকলীদের মাঝে যেমন একজন সাধারণ মুকাল্লিদ সাধারণত দলীল জিজ্ঞেস করে না। তেমনি মুহাদ্দিসীনগণের মন্তব্য মানার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময় দলীল জানা যায় না। তাই মুহাদ্দিসীনদের কথা মেনে হাদীসকে সহীহ-জঈফ বলাওতো তাকলীদ।

নাসীরুদ্দীন আলবানীর স্বীকারোক্তি



গায়রে মুকাল্লিদদের বড় ইমাম শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেব এক হাদীসের সনদের ব্যাপারে জনৈক মুহাদ্দিস মন্তব্য করেন- رجاله رجال الصحيح তথা এর রাবীগণ সহীহ রাবী। এ কথাটি আল্লামা সুয়ুতী রহঃ নকল করে বলেছেন যে, হাদীসটি সহীহ।

এ বক্তব্যের উপর নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ এ ব্যাপারে সুয়ুতী তার তাকলীদ করেছেন। {সিলসিলাতুজ জঈফাহ-২/৩৪০}



হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ এক হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ رجاله ثقات তথা এর রাবীগণ সিক্কা তথা তাদের উপর নির্ভর করা যায়।

এ বক্তব্যটিই আল্লামা ছানআনী রহঃ নকল করেছেন। এ ব্যাপারে আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ “সানআনী তাকলীদ করেছেন”। {সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩৬২}



আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ একটি হাদীসকে সহীহ বলেছেন। এ ব্যাপারে শায়েখ আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ “শাওকানী, সিদ্দিক হাসান এবং আলুসী রহঃ এ ব্যাপারে তার তাকলীদ করেছেন। {সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩৮৭}

সারা দুনিয়া জানে যে, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান এবং আল্লামা শাওকানী রহঃ আপনাদের ঘরাণার লোক তথা গায়রে মুকাল্লিদ। অথচ আল্লামা আলবানী সাহেবের তাহকীক অনুযায়ী তারা হাদীসের সহীহ-জঈফের ক্ষেত্রে হাফেজ ইবনে কাসীর শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ করেছেন।



আলবানী সাহেব নিজের ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেনঃ

قلدت فى ذلك كله للجنة القائمة على تحقيقه তথা আমি এসব ব্যাপারে এ মজলিসের তাকলীদ করেছি, যা তাহকীকের জন্য কায়েম করা হয়েছে। {{সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩১৬}

শায়েখ আলবানী সাহেবের বক্তব্য একথা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় প্রমাণ করছে যে, পরবর্তী ব্যক্তিগণ পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্যের আলোকে হাদীসকে সহীহ-জঈফ বলাটা তাদেরই তাকলীদ করা। এ হিসেবে নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান এবং শাওকানী এবং আলবানী সাহেব নিজেকেও মুকাল্লিদ বলেছেন। অথচ এ তিনজনই গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদার।

আহলে হাদীসদের কাছে নাসীরুদ্দীন আলবানীর মর্যাদা

ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস” কিতাবে শায়েখ আলবানীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয় যে,

“শায়েখ আলবানী জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা ইউনিভার্ষিটির প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বংশের দিক থেকে তিনি ইংরেজ ছিলেন। তার খান্দানের লোকেরা যখন মুসলমান হন, তখন তারা হানাফী মাযহাব গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাকে ইলম ও ফজলের পূর্ণতা দান করেন। তিনি স্বীয় তাহকীকে আহলে হাদীস বনে যান। সিরিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার ইলমে হাদীসে বিশেষ করে আসমাউর রিজালের ক্ষেত্রে বিশেষ পান্ডিত্ব ছিল। আরব রাষ্ট্রসমূহে তার ইলমী গ্রহণযোগ্যতার প্রসিদ্ধি এমন ছিল যে, তার মত তাহকীক আর কারো ছিল না। {ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস-৩/১৭৬}

এই হল, আহলে হাদীসদের নিকট শায়েখ আলবানীর অবস্থান। সেই আলবানী সাহেব বলছেন যে, তিনি পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসীনদের মুকাল্লিদ ছিলেন। তাহলে নিজেরা তাকলীদ করে নফসে তাকলীদের উপর এমন খরগ হস্ত কেন?

তাকলীদ কী? তাকলীদ গায়রে মুকাল্লিদরাও করে কি?

তাকলীদের সংজ্ঞা গায়রে মুকাল্লিদদের কিতাব ফাতাওয়া নাজীরিয়্যাহ এর ১ম খন্ডের ১৮৪ নং পৃষ্ঠায় এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে- “এমন ব্যক্তির কথা মানা, যার কথা শরয়ী দলীল এর নামই হল তাকলীদ”।

কথিত আহলে হাদীস দলের বড় আলেম জুবায়ের আলী জুয়ীর বক্তব্য হল- “হাদীসের সহীহ-জঈফ বলার বিষয়টি মুহাদ্দিসীনদের ইলহামের উপর নির্ভরশীল। {মুহাসসালাহ নূরুল আইনাইন-৮৫}

তাহলে কী দাঁড়াল? শুধু কুরআন ও হাদীসের দাবিদারদের জন্য আবশ্যক হয়, যখনি কোন হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলে মন্তব্য করবে, সাথে সাথে উক্ত হাদীসটিকে আল্লাহ বা রাসূল সাঃ এর বক্তব্যের আলোকে সহীহ বা জঈফ বলবে। কিন্তু তারা একাজটি করে না, বা কিয়ামত পর্যন্ত করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তার কী করে থাকে? মুহাদ্দিসীনদের কথাকে দলীলহীনভাবে মেনে নেয়। [স্মর্তব্য যে, তাদের মতে দলীল কেবল কুরআন ও হাদীস, ইজমা বা কিয়াস কোন দলীল নয়]

আর জুবায়ে আলী জুয়ী সাহেব স্পষ্টই স্বীকার করেছেন যে, হাদীস সহীহ-জঈফ বলাটা মুহাদ্দিসীনদের ইলহামী সিদ্ধান্ত। আর ইলহাম কোন শরয়ী দলীল নয়। তাহলে শরয়ী দলীল ছাড়া কারো কথা মানার নামইতো তাকলীদ। এ তাকলীদ আপনারা সর্বদা করার পরও তাকলীদকে শিরক বলার আগে নিজেদের কী হুকুম কি হচ্ছে তা একবার ভেবে দেখেন কি?

ইমাম বুখারীর তাকলীদ



ইমাম বুখারীর মত হল, সেজদায়ে তেলাওয়াত অজু ছাড়া করা জায়েজ। {আউনুল বারী-২/৫৫৪}

এ বক্তব্যকে দুর্বল আখ্যায়িত করে গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা হাফেজ আব্দুস সাত্তার সাহেব লিখেছেনঃ “ইমাম বুখারীর এমতটি দুর্বলতাহীন নয়। {মুখতাসার সহীহ বুখারী-১/৩৭১}

মাওলানা সাহেব ইমাম বুখারী রহঃ এর মতকে দুর্বলতাহীন নয় মন্তব্য করে উক্ত মতকে দুর্বল বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি এবং তার সম-মতবাদের গায়রে মুকাল্লিদ মাযহাব যেহেতু ইমাম বুখারীর মুকাল্লিদ, তাই তাকলীদের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বলে দিলেন যে, “অজু ছাড়া সেজদায়ে তেলাওয়াত দেয়া জায়েজ”। {ফাতাওয়া নজীরিয়া-১/৫৭১}



নাসায়ীর ১ম খন্ডের ১০৭ নং পৃষ্ঠায় হাদীস এসেছে যে, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, “যখন কিরাত পাঠ করা হয়, তখন তোমরা চুপ থাক”।

এ হাদীস দ্বারা প্রমানিত হয় যে, ইমামের উপর আবশ্যক হল, কিরাত পড়া, আর মুক্তাদীর উপর আবশ্যক হল চুপ থেকে ইমামের কেরাত শ্রবণ করা।

ইমাম বুখারী রহঃ এ হাদীসের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন যে, উক্ত হাদীসটির বর্ণনাকারী আবু খালেদ আলআহমার মুফরাদ তথা একা। {জুযউল কেরাত-৫৬}

অর্থাৎ আবু খালেদ আহমার এ হাদীস এককী বর্ণনা কারার কারণে উক্ত হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়।

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী সাহেব তাহকীক করা ছাড়াই ইমাম বুখারী রহঃ এর বক্তব্যের উপর তাকলীদ করে লিখে দিলেন যে, এ হাদীস বর্ণনাকারী আবু খালিদ মুতাফাররিদ এবং একা। {আবকারুস সুনান-১৫২, আহসানুল কালাম-১/১৬৯}

মুবারকপুরী সাহেব ইমাম বুখারী রহঃ যে বক্তব্যের উপর তাকলীদ করেছেন। উক্ত বক্তব্যটি শুধু দুর্বলই নয়, বরং এটি দলীলহীন একটি মত। এ হাদীসের বর্ণনাকারী আবু খালেদ একা নয়, বরং এ হাদীস আরো বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ বিন সাদ আলআনসারী। {দলীলুত তালেব-২৯৪}

আব্দুর রহমান মুবারকপুরী সাহেব যদি ইমাম বুখারীর অন্ধ তাকলীদ না করে তাহকীক করতেন, তাহলে আবু খালেদের হাদীস দেখার পর পরই নাসায়ীতেই বর্ণিত মুহাম্মদ বিন সাদ আনসারীর হাদীসও তার নজরে আসতো। আর তিনি এটাকে মুতাফাররিদ মন্তব্য করতে পারতেন না। সুতরাং বুঝা গেল যে, দলীলের ভিত্তিতে তিনি এ কাজটি করেন নি। বরং ইমাম বুখারীর তাকলীদ করেছেন।

হয়তো ইমাম বুখারী রহঃ এর কাছে মুহাম্মদ বিন সাদের হাদীসটি পৌঁছেনি। বা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তিনি বলে দিয়েছেন আবু খালেদ উক্ত হাদীসে মুতাফাররিদ। কিন্তু বর্তমানে সিহাহ সিত্তার কিতাব যখন সর্বত্র পাওয়া যায়, তারপরও একথা বলা যে, আবু খালিদ উক্ত হাদীসের ক্ষেত্রে মুতাফাররিদ। এটি তাহকীক না করে তাকলীদ নয়তো কি?

মুফাসসিরীনদের তাকলীদ

মুফাসসিরীনগণ তাফসীরের ক্ষেত্রে মূলনীতি নির্ধারন করেছেন। একটি মূলনীতির ক্ষেত্রে তারা বলেন যে, কুরআনের শব্দ শুধু তার খাস বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এর হুকুমটি আমভাবে সকলের উপর প্রযোজ্য হবে। যেমন সূরা বাকারা ২০৪ নং আয়াতে কাফের আখনাস বিন শুরাইকের বিষয়ে আয়াতটি নাজিল হয়েছে। কিন্তু উক্ত আয়াতের শব্দ আম হওয়ার কারণে সেটি আমভাবে ঐ সকল মানুষকে শামিল করবে, যারা আখনাসের মত আচরণ করবে।

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা সালাহউদ্দীন ইউসুফ লিখেছেনঃ “শব্দের উমুম তথা ব্যাপকাতা গ্রহণ করা হবে। শানে নুজুলের খুসুসের উপর নির্ভর করা হবে না। সুতরাং আখনাস বিন শুরাইক [যার উল্লেক ইতোপূর্বে হয়েছে] মন্দ কাজের একটি নমুনা মাত্র। যে ব্যক্তিই এমন কাজ করবে, তার ক্ষেত্রেও একই হুকুম আরোপিত হবে। {তাফসীরী হাওয়াশী-৮৩}

এ মূলনীতিটি গায়রে মুকাল্লিদদের সকলের কাছেই গ্রহণীয়। এ মূলনীতিটির অবস্থা কি? গায়রে মুকাল্লিদদদের আলেম মাওলানা আবু সাঈদ শরফুদ্দীন দেহলবী সাহেবের ভাষায় দেখুনঃ

খাস শব্দকে আম হিসেবে মেনে নেয়াও কিয়াস। {ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/৩৩৮}

তাহলে গায়রে মুকাল্লিদরা যখনি এ উসুলকে মেনে নিবে, তখনি মুফাসসিরীনদের কিয়াসকে মানছে। আর কিয়াসী মাসআলা মানা মানেইতো তাকলীদকে মানা। অথচ এ গায়রে মুকাল্লিদরাই প্রচার করে থাকে যে, কিয়াস হল ইবলিসের কর্মকান্ড। আর এ কথিত ইবলিসী কর্মকান্ডকেই মানছে তারা দ্বিধাহীন চিত্তে।

কিয়াসী মাসআলায় উলামায়ে কেরামের তাকলীদ

আহলে হাদীস নামধারী ভাইয়েরা যদিও সারাদিন প্রচার করে বেড়ায় যে, তারা শুধু কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বিধানকেই মানেন। কিয়াসের অনুসরণ করেন না। কিন্তু সত্য কথা হল, কার্যত তারা অনেক মাসআলায় তারা কেবল কিয়াসের উপর ভিত্তি করে আমল করে থাকেন। এছাড়া কোন গতি নেই।

এ বিষয়ের বিশাল সমুদ্রতুল্য মাসআলা ভান্ডারের মাঝে কয়েকটি মাসআলা নিচে উদ্ধৃত হল-



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা মুবাশশির রাব্বানী সাহেব লিখেছেনঃ

বিতিরের কুনুতের সময় হাত উঠানো রাসূল সাঃ এর কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। যেসব আহলে হাদীসরা হাত উঠিয়ে দুআ করে থাকেন, এর উপর কিয়াস করে তারা এটাকে কুনুতে নাজেলা এর উপর কিয়াস করে এমনটি বলে থাকেন। {আহকাম ওয়া মাসায়েল-২৫৯}



গায়রে মুকাল্লিদ ডক্তর শফীকুর রহমান সাহেব লিখেছেনঃ “আগের কাতার থেকে পিছনের কাতারে কোন মুসল্লিকে টেনে নিয়ে আসা কোন সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত নয়। তবে এক ইমাম ও এক মুক্তাদীর মাসআলার উপর কিয়াস করে এটা জায়েজ বলে প্রতিপন্ন হয়। {নামাযে নববী-১৩০}



গায়রে মুকাল্লিদ হাফেজ নাঈমুল হক মুলতানী সাহেব লিখেছেনঃ

“কিয়াসে শরয়ী যতক্ষণ পর্যন্ত কোন শরয়ী ইবারতের বিপরীত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা শরয়ী দলীল হিসেবে গৃহিত হবে। {ভয়েস কি কুরবানী কা তাহকীকী জায়েজাহ-৯১}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব লিখেছেনঃ

“আহলে হাদীসরা শুকর ও কুকুরকেও মৃতের উপর কিয়াস করেছেন। এবং বলেছেন যে, হাদীসটি আম। তাই শুকর ও কুকুরের চামড়া দাবাগত করালে তা পাক হয়ে যাবে। {তাইসীরুল বারী-৭/৩৭৭}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা সানাউল্লাহ উমরতাসরী সাহেব লিখেছেনঃ

“এসব হাদীসের উপর কিয়াস করে যদি কেউ মৃতের পক্ষ থেকে কাযা নামায আদায় করে, তাহলে সওয়াব পৌঁছার আশা করা যায়। {হাশিয়ায়ে ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/৩৮}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা শরফুদ্দীন দেহলবী সাহেব লিখেছেনঃ

“যে পশুর গোস্ত খাওয়া যায়, তার হাড্ডির ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। আর যেসব পশুর গোস্ত খাওয়া জায়েজ নয়, সেসব ব্যবহার করা এবং বিক্রির বিষয়টি হাতির দাঁতের উপর কিয়াস করে জায়েজ হওয়া দলীল সমৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।”



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা হাফেজ আব্দুস সাত্তার হাম্মাদ সাহেব লিখেছেনঃ

“সফরের সময় ‘আলবিদা’ বলা সুন্নত। চাই মুসাফির মুকীমকে বলুক, বা মুকীম মুসাফিরকে বলুক। হাদীসের মাঝে প্রথম সুরতের কথা বর্ণিত। দ্বিতীয় সুরতটিকে এর উপর কিয়াস করা যেতে পারে। {মুখতাসার সহীহ বুখারী-২/৭৩}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইবরাহীম শিয়ালকুটি সাহেব লিখেছেনঃ

“সন্ধানহীন ব্যক্তির স্ত্রীকে অক্ষম ব্যক্তির স্ত্রীর উপর কিয়াস করা সহীহ বরং উত্তম। {ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২৬৬}



আল্লামা শাওকানী রহঃ লিখেছেনঃ

“সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, আম বিষয়কে কিয়াস দ্বারা খাস করা যায়। {নাইলুল আওতার-৪/৮}

এই হল আহলে হাদীস দাবিদারতের কিয়াসের একটি ঝলক মাত্র।

কিয়াসী মাসআলায় উলামায়ে কেরামের তাকলীদ

আহলে হাদীস নামধারী ভাইয়েরা যদিও সারাদিন প্রচার করে বেড়ায় যে, তারা শুধু কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট বিধানকেই মানেন। কিয়াসের অনুসরণ করেন না। কিন্তু সত্য কথা হল, কার্যত তারা অনেক মাসআলায় তারা কেবল কিয়াসের উপর ভিত্তি করে আমল করে থাকেন। এছাড়া কোন গতি নেই।

এ বিষয়ের বিশাল সমুদ্রতুল্য মাসআলা ভান্ডারের মাঝে কয়েকটি মাসআলা নিচে উদ্ধৃত হল-



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা মুবাশশির রাব্বানী সাহেব লিখেছেনঃ

বিতিরের কুনুতের সময় হাত উঠানো রাসূল সাঃ এর কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। যেসব আহলে হাদীসরা হাত উঠিয়ে দুআ করে থাকেন, এর উপর কিয়াস করে তারা এটাকে কুনুতে নাজেলা এর উপর কিয়াস করে এমনটি বলে থাকেন। {আহকাম ওয়া মাসায়েল-২৫৯}



গায়রে মুকাল্লিদ ডক্তর শফীকুর রহমান সাহেব লিখেছেনঃ “আগের কাতার থেকে পিছনের কাতারে কোন মুসল্লিকে টেনে নিয়ে আসা কোন সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত নয়। তবে এক ইমাম ও এক মুক্তাদীর মাসআলার উপর কিয়াস করে এটা জায়েজ বলে প্রতিপন্ন হয়। {নামাযে নববী-১৩০}



গায়রে মুকাল্লিদ হাফেজ নাঈমুল হক মুলতানী সাহেব লিখেছেনঃ

“কিয়াসে শরয়ী যতক্ষণ পর্যন্ত কোন শরয়ী ইবারতের বিপরীত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা শরয়ী দলীল হিসেবে গৃহিত হবে। {ভয়েস কি কুরবানী কা তাহকীকী জায়েজাহ-৯১}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব লিখেছেনঃ

“আহলে হাদীসরা শুকর ও কুকুরকেও মৃতের উপর কিয়াস করেছেন। এবং বলেছেন যে, হাদীসটি আম। তাই শুকর ও কুকুরের চামড়া দাবাগত করালে তা পাক হয়ে যাবে। {তাইসীরুল বারী-৭/৩৭৭}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা সানাউল্লাহ উমরতাসরী সাহেব লিখেছেনঃ

“এসব হাদীসের উপর কিয়াস করে যদি কেউ মৃতের পক্ষ থেকে কাযা নামায আদায় করে, তাহলে সওয়াব পৌঁছার আশা করা যায়। {হাশিয়ায়ে ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/৩৮}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা শরফুদ্দীন দেহলবী সাহেব লিখেছেনঃ

“যে পশুর গোস্ত খাওয়া যায়, তার হাড্ডির ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। আর যেসব পশুর গোস্ত খাওয়া জায়েজ নয়, সেসব ব্যবহার করা এবং বিক্রির বিষয়টি হাতির দাঁতের উপর কিয়াস করে জায়েজ হওয়া দলীল সমৃদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।”



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা হাফেজ আব্দুস সাত্তার হাম্মাদ সাহেব লিখেছেনঃ

“সফরের সময় ‘আলবিদা’ বলা সুন্নত। চাই মুসাফির মুকীমকে বলুক, বা মুকীম মুসাফিরকে বলুক। হাদীসের মাঝে প্রথম সুরতের কথা বর্ণিত। দ্বিতীয় সুরতটিকে এর উপর কিয়াস করা যেতে পারে। {মুখতাসার সহীহ বুখারী-২/৭৩}



গায়রে মুকাল্লিদ মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইবরাহীম শিয়ালকুটি সাহেব লিখেছেনঃ

“সন্ধানহীন ব্যক্তির স্ত্রীকে অক্ষম ব্যক্তির স্ত্রীর উপর কিয়াস করা সহীহ বরং উত্তম। {ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২৬৬}



আল্লামা শাওকানী রহঃ লিখেছেনঃ

“সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, আম বিষয়কে কিয়াস দ্বারা খাস করা যায়। {নাইলুল আওতার-৪/৮}

এই হল গায়রে মুকাল্লিদ আলেমদের কিয়াসী মাসআলার সামান্য ঝলকমাত্র।

এবার লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, তাদের এসব কিয়াসী মাসআলার অবস্থান কি?

জামাআতুল মুসলিমীনের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মাসউদ সাহেব বলেন, “কোন ব্যক্তির ইজতিহাদ এবং কিয়াস না আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত না এসব আসল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত”। {জামাআতুল মুসলিমীন আওর আহলে হাদীস-৪}

আমাদের জানা মতে আহলে হাদীস ফিতনা থেকে প্রসব হওয়া দল জামাআতুল মুসলিমীন প্রতিষ্ঠাতার মত গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরাও কিয়াস ও ইজতিহাদকে মুনাজ্জাল মিনাল্লাহ তথা কুরআন ও হাদীস সাব্যস্ত করে না।

যখন অবস্থা হল তাই, তাহলে গায়রে মুকাল্লিদদের আলেমদের কিয়াসী মাসআলা সাধারণ গায়রে মুকাল্লিদরা মানা কি তাকলীদ নয়? গায়রে মুকাল্লিদ তথা নামধারী আহলে হাদীসরা তাদের কিতাবে এসব কিয়াসী মাসআলা লিখে পরোক্ষভাবে তাদের তাকলীদ করার দাওয়াত কি দিচ্ছে না? আর এসব মাসআলা দলীল ছাড়া সাধারণ আহলে হাদীস দাবিদাররা মানার মাধ্যমে সুষ্পষ্টভাবে মুকাল্লিদে পরিণত হচ্ছে। তবে মুজতাহিদের মুকাল্লিদ তারা হচ্ছেন না বরং গায়রে মুজতাহিদ অজ্ঞ ব্যক্তির মুকাল্লিদ হচ্ছেন। এই হল চার ইমাম মুজতাহিদের তাকলীদ আর গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীসদের তাকলীদের মাঝে পার্থক্য। চার ইমামর মুকাল্লিদরা মুজতাহিদের তাকলীদ করছেন। আর কথিত আহলে হাদীসরা গায়রে মুজতাহিদ তথা সাধারণ ব্যক্তির তাকলীদ করছেন।

কথিত আহলে হাদীস মাযহাব জিন্দাবাদ?!

সারা দিন যারা তাকলীদকে শিরক বিদআত বলে বেড়ায় তাদের তাকলীদের হাল হল এই। অনেকের হয়তো ধারণা হতে পারে যে, গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদাররা শুধু মাসায়েলের ক্ষেত্রেই কেবল তাকলীদ করে থাকেন, আক্বিদার ক্ষেত্রে তারা কারো তাকলীদ করেন না। এ ভুল ধারণাও আপনাদের থাকবে না ইনশাআল্লাহ। লক্ষ্য করুন-

আশায়েরা ও মাতুরিদীয়্যার তাকলীদ

প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা আব্দুল জলীল সামাওয়ারদী সাহেব লিখেছেনঃ “আহলে হাদীসদের মাঝে আহলে হাদীস আক্বিদা নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। শুনে আশ্চর্য লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা জানার পর এটি আর আশ্চর্য বিষয় থাকবে না”। {ফাতাওয়া সেতারিয়া-৩/২৩]

গায়রে মুকাল্লিদদের কাছেতো এটা আশ্চর্যজনক মনে হবেই। কারণ যেখানে শাখাগত মাসায়েলে চার ইমামের মাঝে মতভেদ হওয়াকে তারা ফিরক্বাবাজী, দ্বীনকে বিভক্ত করা বলে মন্তব্য করে থাকে। সেখানে আক্বিদার মত মৌলিক বিষয়ে তাদের আলেমদের মাঝের মতভেদ কেন ফিরক্বাবাজী আর ফিতনা বলে সাব্যস্ত হবে না?

যাইহোক। মাওলানা সামাওয়ারদী সাহেব এ বিষয়কে আরো স্পষ্ট করে বলেনঃ

“আহলে হাদীস ও দুই প্রকার। একদল হল খালিস আহলে হাদীস। যারা উসূল ও ফুরু তথা মৌলিক ও শাখাগত সকল বিষয়ে আহলে হাদীস। আরেক দল হল উসুলের দিক থেকে গায়রে আহলে হাদীস মাতুরিদী এবং আশআরী। {ফাতাওয়া সেতারিয়া-৩/২৪}

উল্লেখিত বক্তব্য দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আহলে হাদীসরা আক্বিদার দিক থেকে দুই প্রকার। এক প্রকার হল, যারা তাদের উলামায়ে আহলে হাদীসের পাবন্দ। আর আরেক দল মাতুরিদী আর আশআরী রহঃ এর মুকাল্লিদ।

মাওলানা সামাওয়ারদী সাহেব কয়েক লাইন পর লিখেনঃ

“আহলে হাদীসদের মাদরাসায় খালিস আহলে হাদীস আক্বিদার কোন ছোট বা বড় কিতাব দরসে না ছিল কখনো। না বর্তমানে আছে। সেই দরসে নেজামী আর আকায়েদে নাসাফী ইত্যাদিই আছে। একথা সর্বজন বিদিত যে, যে বৃক্ষ্য রূপন করা হবে, ফল তেমনি হবে। কাঁকড় গাছ লাগিয়ে আম ফল কিভাবে আশা করা যায়? মোদ্দাকথা, বড় উলামাগণই আসল আহলে হাদীস আক্বিদা থেকে অনবহিত। খারাপ মনে করবেন না, সেখানে সাধারণ মানুষ সহীহ আক্বিদা কোত্থেকে শিখবে? আর বড় আলেমদেরই বা দোষ দিয়ে লাভ কি? তাদের তালীমতো এর থেকেই শিখেছে। তারা তাদের তালীমের পাবন্দ হয়ে থাকে। জন্মসূত্রেতো মুসলমান সবাই হয়। কিন্তু পিতা-মাতা ইহুদী-নাসারা, পৌত্তলিক ইত্যাদি বানিয়ে দেয়। এটি তাদের রূহানী পিতা-মাতার দোষ। বড় আহলে হাদীসরা না এটি অনুভব করেছেন, না উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন”। {ফাতাওয়া সিতারিয়া-৩/২৪}

গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা সামাওয়ারদী সাহেবের বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝা যাচ্ছে। যথা-



কথিত আহলে হাদীসদের মাদরাসায় আহলে হাদীস আক্বিদার কোন কিতাব নিসাবে শামিল নেই। বড় কিতাবতো দূরে থাক, ছোট কিতাবই পড়ানো হয়নি। বরং ঐ ব্যক্তিদের কিতাবই পড়ানো হয়েছে, যাদের আক্বিদাকে আহলে হাদীস ভাইয়েরা কুরআন ও হাদীসের বিপরীত বলে বেড়ান। কিন্তু আহলে হাদীস মাদরাসাগুলোতে তাদের আক্বিদাকেই গ্রহণ করে তাদেরই মুকাল্লিদ হয়ে রইল।



মাতুরিদী আর আশায়েরার আক্বিদাকে কাঁকড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ অবাক কান্ড হল, তারা মুখে দিয়ে চাবায় কাঁকড় ফল, কিন্তু মুখ দিয়ে বলে যে, তারা আম খাচ্ছে।

অন্য শব্দে বললে বলতে হয়, আহলে হাদীস মাদরাসায় আহলে হাদীসী আক্বিদা রেখে আশায়েরা এবং মাতুরিদী আক্বিদা পড়ানো হচ্ছে, যা তাদের ভাষায় কুরআন ও হাদীস বহির্ভূত আক্বিদা। অথচ মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়ায় যে, “গায়রে মুকাল্লিদরা স্বীয় আমল এবং আক্বিদায় কিতাবুল্লাহ এবং হাদীসে নববীর উপর আমল করে”। {তরীকে মুহাম্মদী-১১৮, উদ্ধৃতি-মাসায়েলে গায়রে মুকাল্লিদীন-৩৪৫}



উলামায়ে আহলে হাদীসরা আশায়েরা এবং মাতুরিদীর মুকাল্লিদ এ কারণে হয়েছে, যেহেতু তাদের মাদরাসায় শুধ্ ুএরই তালীম দেয়া হয়ে থাকে। আর তাদের রূহানী পৈত্রিকসূত্রে তাদের কাছে এটিই এসেছে। আফসোস তাদের জন্য, তারা কুরআনের আয়াত “মা ওয়াজাদনা আবাআনা” এর দিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। অথচ এটিকে তারা তাকলীদের বিপক্ষে উপস্থাপন করে থাকে। অথচ নিজেরাই বাপ-দাদার পদ্ধতির তাকলীদ করাকে তাহকীকের উপর প্রাধান্য দিয়ে বসে আছে।



যেখানে আহলে হাদীস আলেমদের আক্বিদাই সহীহ নেই। সেখানে সাধারণ আহলে হাদীসদের আক্বিদা কি করে সহীহ হবে?

একথা দ্বারা এটিই প্রতিয়মান হয় যে, সাধারণ আহলে হাদীসরা উলামায়ে আহলে হাদীসের মুকাল্লিদ।

মাওলানা সামাওয়ারদী সাহেব স্বীয় বক্তব্যকে শক্তভাবে চ্যালেঞ্জের সাথে বলে ঘোষাণা দেন-

“আমি আমার সময়কার সকল উলামায়ে কেরামকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি যে, তারা আমার কথাকে ভুল প্রমাণিত করে সত্য প্রকাশিত করে দিন। আপনারা কি আশআরী কাদীম এবং মাতুরিদীর আক্বিদার পাবন্দ নন? তারপরও নিজেদের খাঁটি আহলে হাদীস বলতে লজ্জা করে না? সূর্যের মাঝে মাটি ঢালতে চাও, আর চাঁদকে ঢাল দিয়ে আলোহীন করতে চাও?”। [ফাতাওয়া সেতারিয়া-৩/২৬}

শুধু কি তাই? গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন-

ايمان المقلد صحيح ولا يتكلف العامى بمعرفة الدلائل

মুকাল্লিদের ঈমান সহীহ। আর সাধারণ লোকদের দলীল জানাকে আবশ্যক করা যাবে না। {হাদিয়াতুল মাহদী-১১৩}

গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীস আল্লামা ওহীদুজ্জামান সাহেবের বক্তব্য অনুপাতে ব্যক্তি দলীল চাওয়া ছাড়া শুধু তাকলীদ করে মুমিন হয়ে যেতে পারে। তার জন্য দলীল চাওয়ার কোন দরকার নেই।

কিন্তু আফসোস, মুর্খ-জাহিলদের জন্যও মাসআলা মানতে বিজ্ঞ আলেমের তাকলীদ করা তাদের মতে জায়েজ নয়। কিন্তু মুমিন হওয়ার জন্যও তাদের কাছে আক্বিদার দলীল জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। একেই বলে, অন্যের বেলা ধর্ম যায়, আর নিজের বেলা সবই রয়।

গায়রে মুকাল্লিদদের তাকলীদের আরো কিছু নমুনা

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এর তাকলীদ

মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব লিখেছেনঃ

“ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রঃ এর বক্তব্য হল, জুমআর নামাযের সময় সূর্য মধ্যাকাশ থেকে হেলে পড়ার আগেও জায়েজ আছে।” {তাইসীরুল বারী-২/১৬}

আহলে হাদীস ভাইয়েরা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এর তাকলীদ করে নিজেদের মাযহাব এটাকেই বানিয়ে নিয়েছে। তাদের মতেও জুমআর নামায সূর্য ঢলে যাওয়ার আগেই জায়েজ আছে। {ফাতাওয়া আহলে হাদীস-২/২২, আননাহজুল মাকবূল-২৮, আররাওজাতুন নাদিয়্যাহ-১/১৩৭, নুজুলুল আবরার-১/১৫২}

অথচ কোন সহীহ হাদীসে সূর্য হেলে পড়ার আগে জুমআর নামায শুদ্ধ হওয়ার কোন দলীল নেই। বরং এর বিপরীত সহীহ বুখারীর কিতাবুল জুমআতে এসেছে

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: ্রأَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي الجُمُعَةَ حِينَ تَمِيلُ الشَّمْسُগ্ধ

হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাঃ জুমআর নামায পড়তেন সূর্য যখন সূর্য ঢলে পড়ে। {সহীহ বুখারী, -১/৩০৭, হাদীস নং-৯০৪}

সরাসরি সহীহ হাদীসের বিপরীত হওয়ার পরও কথিত আহলে হাদীসরা যারা ইংরেজদের রাজত্বকে আল্লাহর রহমত মনে করে [আলহায়াত বাদাল মামাত-১৬২] তারা শুধুমাত্র হানাফীদের বিরোধিতা করে এ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করতে চায়। আর ইংরেজদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চায়। এছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য এতে বাহ্যিকভাবে নেই।

ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ

শহীদের জানাযার নামায পড়া একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা একথা স্বীকার করে বলেন-

“আসল কথা হল, শহীদদের জানাযার নামায পড়া সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।” {আহকাম ও মাসায়েল-৩৮০}

কিন্তু কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা শুধুমাত্র হানাফীদের বিরোধীতা করার জন্য ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ করে লিখে দিয়েছে যে, শহীদের জানাযার নামায পড়া উচিত নয়। {দস্তুরুল মুত্তাকী-১৭৮, কানযুল হাকায়েক-৪৩, সালাতুর রাসূল-৪৪১, তাইসীরুল বারী-২/৩০০}

ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদদের ইমামদের একজন মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব লিখেছেনঃ আর যেখানে আমরা কুরআন ও হাদীসের কোন ইবারত পাই না, সেখানে সাহাবায়ে কেরাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ করি। বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের ইমামদের। যাদের উসূল এবং ফুরূয়ের কিতাব আমাদের পড়াশোনায় বিদ্যমান থাকে। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২৩/২৯০}

বাটালবী সাহেব আরো স্পষ্ট ভাষায় অনুসারীদের নসিহত করে লিখেছেনঃ

“অধমের ২০ নং খন্ডের ছয় নং রিসালার ১২০ তম পৃষ্ঠায় আমার কিছু ভাই এবং আহলে হাদীস বন্ধুদের পরামর্শ দিয়েছি যে, যদি তাদের ইজতিহাদে মুতলাকের দাবি না থাকে, তাহলে যেখানে কুরআন এবং হাদীসের স্পষ্ট ইবারত না পাওয়া যায়, তাহলে সেখানে মুজতাহিদীনদের তাকলীদ করাতো কোন সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব বা শাফেয়ী মাযহাবের দিকে নিজেদের সম্পর্কিত করবে। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২৩/২৯১}

অবাক কান্ড। গায়রে মানসূস মাসআলা তথা কুরআন ও হাদীসে নেই, এমন মাসআলা এবং কুরআন ও হাদীসে বিপরীতমুখী বর্ণনা এমন মাসআলায় আমরা মুজতাহিদের তাকলীদ করলে হাদীস বিরোধী, আর নামধারী আহলে হাদীসরা করলে হাদীসের নামের বরকতে তারা থেকে জান আহলে হাদীস রূপেই।

আরো মজার ঘটনা দেখুন-

মাওলানা বাটালবী সাহেব আরো এক কদম বেড়ে লিখেনঃ

“যে মাসআলায় আমি কোন সহীহ হাদীস না পাই, সে মাসআলায় মাযহাবের ইমামদের বক্তব্যের মধ্য থেকে কোন একটি বক্তব্যকে এ ভাল ধারণা করে নেই যে, এ মাসআলায় ইমামের কাছে এ ব্যাপারে দলীল আছে তাই তার তাকলীদ করি। এমনই আমাদের শাইখুল কুল [মিয়া নজীর আহমদ সাহেব] সারা জীবনের আমল ছিল। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২২/৩১০}

এ ইবারতের পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিটি তারীখে খতমে নবুয়াহ গ্রন্থের ৪৩৮ নং পৃষ্ঠায় দেখা যেতে পারে।

এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, গায়রে মুকাল্লিদ প্রচারকদের প্রধানদের একজন মিয়া নজীর আহমাদ এবং মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব যে মাসআলায় কুরআন ও হাদীসে দলীল না পান, সেক্ষেত্রে তারা তাকলীদের রশি গলা পরিধান করে নিতেন।

তাকলীদের প্রতি বাটালবী সাহেবের আগ্রহের কারণ কি?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যিনি তাকলীদের বিরুদ্ধে সবচে’ বেশি শোরগোল করেছেন তার ইশাআতুস সুন্নাহ পত্রিকা দিয়ে। গায়রে মুকাল্লিদ মাযহাবকে ছড়িয়েছে পুরো উপমহাদেশে। সেই লোক তাকলীদের এত পক্ষে মানুষ হল কিভাবে? এর কারণ কি?

আসল কারণটি হল, আহলে হাদীসদের বড় বড় আলেম, বিতার্কিক, লেখক, প্রচারক, বক্তা, অনুসারী এরকম বিভিন্ন প্রকারের লোক গায়রে মুকাল্লিদিয়্যত প্রচার করতে করতে এক সময় সকল মতকেই গুডবাই বলে কাদিয়ানী হয়ে গেছে। কাদিয়ানী হওয়া এসব ব্যক্তিদের অধিকাংশ ছিল বাটালবী সাহেবের সরাসরি ছাত্র।

একথার স্বীকারোক্তি খোদ বাটালবী সাহেব তার সম্পাদিত পত্রিকা ইশাআতুস সুন্নাহ এর ১৫ নাম্বার খন্ডের ১৪৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট ভাষায় করেছেন। যার ছাপা কপির ছবি তারীখে খতমে নবুয়াহ এর ২৬৬ নং পৃষ্ঠায় বিদ্যমান।

খাস আহলে হাদীস ব্যক্তিদের ছাড়া সাধারণ আহলে হাদীসদের মাঝে যারা কাদিয়ানী হয়ে গেছে তাদের সংখ্যাতো বলা কঠিন। তবে সংক্ষিপ্তভাবে মাওলানা বাটালবী সাহেব এই লিখেছেনঃ

“মির্যা কাদিয়ানীকে অনুসরণের মুসিবত অধিক হারে ছড়িয়েছে ঐ ফিরক্বার মাঝে, যারা সাধারণ ও মুর্খ হয়েও মুতলাকান তাকলীদকে ছেড়ে দিয়ে গায়রে মুকাল্লিদ হয়ে গেছে। অথবা ঐ সকল লোক যাদের নীচরী বলা হয়, যারা মূলত গায়রে মুকাল্লিদদেরই একটি শাখা”। [ইশাআতুস সুন্নাহ-১৫/২৭১}

এ ইবারতের প্রকাশিত ছবিটি তারীখে খতমে নবুয়াহ গ্রন্থের ৩৮১ নং পৃষ্ঠায় দেখতে পারেন।

মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব যখন নিজেদের আহলে হাদীসদের চোখের সামনে দলে দলে কাদিয়ানী, খৃষ্টান আর মুরতাদ হতে দেখলেন। তখন তার পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা নি¤েœর শব্দে উল্লেখ করেনঃ

“পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা দ্বারা আমার একথা বুঝে এসেছে যে, যে ব্যক্তি ইলম না থাকা সত্বেও মুজতাহিদে মুতলাকের দাবি করে, আর মুতলাক তাকলীদকে ছেড়ে দেয়, উক্ত ব্যক্তি অবশেষে ইসলাম ধর্মকেই গুডবাই জানিয়ে বসে। কুফরী, ইরতিদাদ এবং ফাসেকীর আরো অনেক কারণ দুনিয়াতে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু দ্বীনদারদের বেদ্বীন হয়ে যাওয়ার সবচে’ বড় মারাত্মক কারণ হল ইলমহীন হওয়া সত্বেও তাকলীদ ছেড়ে দেয়া। আহলে হাদীস দলের মাঝে যারা বে-ইলম বা কম ইলমের অধিকারী হয়েও তাকলীদ ছেড়ে দেয়ার দাবি করে, তাদের পরিণাম এমনি হয়। এ দলের সাধারণ লোকেরা স্বাধীনচেতা আর স্বীয় মত পূজারী হয়ে যায়”। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২/১১, প্রকাশ সাল-১৮৮৮ ঈসাব্দ}

তাকলীদ ছেড়ে দেয়া ইলমহীন আহলে হাদীসদের এ ভয়ংকরভাবে মুরতাদ হওয়ার প্রবণতা দেখে বাটালবী সাহেব তাকলীদ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। তখন তিনি লক্ষ্য করেন যে, তাকলীদের মাঝেই ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই তিনি তাকলীদের সহযোগী হয়ে যান। সেই সাথে তিনি নিজেও হানাফী ফক্বীহদের তাকলীদ করতে শুরু করে দেন।

এ কারণেই আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলি যে, মুসলমান নাস্তিক হওয়া, মুরতাদ হওয়া, বিধর্মী হওয়ার প্রধান কারণের মাঝে একটি হল গায়রে মুকাল্লিদ হওয়া। গায়রে মুকাল্লিদ না হয়ে কেউ সহজে নাস্তিক হতে পারে না। ইলম না থাকা সত্বেও যখন নিজেকে মুজতাহিদ মনে করতে থাকে, আর কুরআন ও হাদীসের সকল মর্মার্থ বুঝে গেছে মনে করে, তখনি সে নাস্তিকতা, খৃষ্টান হওয়া আর কাদিয়ানী হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। কারণ নিজের সমঝ ও বুঝকে কারো সমঝের সাথে যখন মিলানোর বা মান্য করার মানসিকতা যখন মনে না থাকে, তখন মন যেদিকে টানে সেদিকেই ধাবিত হয়ে পড়ে। নাস্তিকতার দিকে ধাবিত হলে নাস্তিক হয়ে যায়। খৃষ্টান হওয়ার দিকে ধাবিত হলে খৃষ্টান হওয়ার দিকে ধাবিত হলে খৃষ্টান হয়ে যায়। আর কাদিয়ানীর দিকে ধাবিত হলে কাদিয়ানী হয়ে যায়।

কিন্তু একজন মুকাল্লিদ তা সহজে পারবে না। কারণ সে তার নিজের বুঝকে পূর্ণাঙ্গ কখনোই মনে করে না। বরং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যাকে নিজের ব্যাখ্যার উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই কুরআন হাদীস পড়ে তার মনে খটকা লাগলে তা মুজতাহিদ বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির বক্তব্যের আলোকে মিলিয়ে দেখে। সেই সাথে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যার তাকলীদ করে কুরআনের সেই অর্থই বুঝে নেয়, যা মুজতাহিদ বুঝে ছিলেন। কিন্তু গায়রে মুকাল্লিদ ব্যক্তি এ নেয়ামত থেকে হয় বঞ্চিত।

আর সবচে’ ভয়ংকর দিক হল, খৃষ্টানরা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তাদের ধর্মমত প্রচার করে কুরআনের আয়াতের দলীলের ভিত্তিতে। হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে। ঠিক তেমনি কাদিয়ানী তাদের ধর্মমত প্রচার করে কুরআন ও হাদীস দিয়েই। তাই গায়রে মুকাল্লিদরা স্বীয় মনের পূজা করে সহজেই খৃষ্টান বা কাদিয়ানীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়। যা মুকাল্লিদের পক্ষে সহজ নয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাত ফিতনা থেকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

বিষয়: বিবিধ

২৪৬৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

161622
১২ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:১৩
বুড়া মিয়া লিখেছেন : মুকাল্লিদতো সবাই-ই; স্বীকার করলেও না করলেও; শুধুই যদি হাদীস-কুর’আন এর কথাও ধরা যায়; তবে কারও অনুবাদ বা কারও ব্যাখ্যা তো মেনেই নেয়া হচ্ছে এবং রাবীদের কথাতো বিশ্বাস করা হচ্ছেই এবং তার কথা মেনেই তো আমল করা হচ্ছে।
161632
১২ জানুয়ারি ২০১৪ সকাল ১১:৫৪
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : জ্বি, এই সিম্পল ব্যাপারটাই ওদের ঘিলুতে ঢুকেনা, তারপরও তারস্বরে চিল্লাতেই থাকবে যে, কারো তাকলীদ করা যাবেনা, তাকলীদ করা শির্ক !

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File