মাযহাব কি এবং কেন

লিখেছেন লিখেছেন সঠিক ইসলাম ১০ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:৩৫:৫৪ বিকাল

মাযহাব কি রাসূল,সাহাবী এবং তাবেঈ কারো মানার দলীল আছে?

কুরআন ও হাদীস দেখে আমল করলে অসুবিধা কোথায়?

মুহাদ্দিসগন কি মাযহাব মেনেছেন?

আমরা কেন চারটি মাযহাব থেকে বেছে বেছে মাসআলা আমল করতে পারব না?

কেন একটি মাযহাবই মানতে হবে?

জবাব:

بسم الله الرحمن الرحيم

মাযহাব কি

মুজতাহিদ হল কুরআন সুন্নাহ, সাহাবাদের ফাতওয়া, কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ঐক্যমত্বে এবং যুক্তির নিরিখে কুরআন সুন্নাহ থেকে মাসআলা বেরকারী গবেষক দলের নাম। যারা নিষ্ঠার সাথে বিভিন্ন মূলনীতি নির্ধারণ করে কুরআন সুন্নাহর বাহ্যিক বিপরীতমুখী মাসআলার মাঝে সামাঞ্জস্যতা এনেছেন। কুরআন সুন্নাহর একাধিক অর্থবোধক শব্দের নির্ধারিত পালনীয় অর্থকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। নতুন উদ্ভূত মাসআলার শরয়ী মূলনীতির আলোকে সমাধান বরে করেছেন। সেই সাথে নতুন নতুন মাসআলার কোন মূলনীতির আলোকে হুকুম আরোপিত হবে যার বিধান সরাসরি কুরআন সুন্নাহে বর্ণিত নেই, সেই মূলনীতিও নির্ধারিত করেছেন। মূলত সেই গবেষক দলের নাম হল মুজতাহিদ। আর তাদের উদ্ভাবিত মূলনীতির আলোকে বের হওয়া মাসআলার নাম মাযহাব।

এবং কেন?

মাযহাব পালনের কথা এই জন্য বলা হয় যে, যেহেতু কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে আলেম খুবই নগণ্য। যারাও আছে তারা কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে। কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কি? আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে এই বাক্যটি? এই আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে? ইত্যাদী সম্পর্কে বিজ্ঞ হন না। সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদীস কোনটি দুর্বল হাদীস? কোন হাদীস কি কারণে দুর্বল? কোন হাদীস কী কারণে শক্তিশালী? হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম এখন নাই। অথচ হাদীসের বর্ণনাকারী শক্তিশালী না হলে তার দ্বারা শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয়না।

এই সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পাওয়া যাওয়া দুস্কর। একেতু অধিকাংশ মানুষই আলেম না। আর মুষ্টিমেয় যারা আলেম তারাও উল্লেখিত সকল বিষয় সম্পর্কে প্রাজ্ঞ নয়। তাই আমাদের পক্ষে কুরআন সুন্নাহ থেকে সঠিক মাসআলা বের করা অসম্ভব

এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-اقيموا الصلاة তথা সালাত কায়েম কর। আরেক আয়াতে বলেছেন-إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ তথা নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেস্তারা নবীজীর উপর সালাত পড়ে। এই আয়াতের শেষাংশে এসেছে-يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا তথা হে মুমিনরা তোমরাও তাঁর উপর সালাত পড় এবং তাঁকে সালাম জানাও। {সূরা আহযাব-৫৬}

এই সকল স্থানে লক্ষ্য করুন-“সালাত” শব্দটির দিকে। তিনটি স্থানে সালাত এসেছে। এই তিন স্থানের সালাত শব্দের ৪টি অর্থ। প্রথম অংশে সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল “নামায” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা নামায কায়েম কর। {সূরা বাকারা-৪৩}

আর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও তার ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর উপর সালাত পড়েন মানে হল-আল্লাহ তায়ালা নবীজী সাঃ এর উপর রহমত পাঠান, আর ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর উপর সালাত পড়েন, মানে হল নবীজী সাঃ এর জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।

আর তৃতীয় আয়াতাংশে “সালাত” দ্বারা উদ্দেশ্য হল উম্মতরা যেন নবীজী সাঃ এর উপর দরূদ পাঠ করেন। (كتاب الكليات ـ لأبى البقاء الكفومى)

একজন সাধারণ পাঠক বা সাধারণ আলেম এই পার্থক্যের কথা কিভাবে জানবে? সেতো নামাযের স্থানে বলবে রহমাতের কথা, রহমতের স্থানে বলবে দরূদের কথা, দরূদের স্থানে বলবে নামাযের কথা। এরকম করলে দ্বীন আর দ্বীন থাকবে না, হবে জগাখিচুরী।

এরকম অসংখ্য স্থান আছে, যার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। তাই একজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তির শরাপন্ন হয়ে তার গবেষনা অনুযায়ী উক্ত বিষয়ের সমাধান নেয়াটাই হল যৌক্তিক। এই নির্দেশনাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন- {فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ} [النحل:43]তথা তোমরা না জানলে বিজ্ঞদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাও। {সূরা নাহল-৪৩}

বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কিরাম কুরআন সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মাত, এবং যুক্তির নিরিখে সকল সমস্যার সমাধান বের করেছেন। সেই সকল বিজ্ঞদের অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব অনুসরণ। যেই অনুসরণের নির্দেশ সরাসরি আল্লাহ তায়ালা দিলেন পবিত্র কুরআনে।

মাযহাব কি এটা নিশ্চয় আগের বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে। সেই হিসেবে রাসূল সাঃ এর দুনিয়াতে কারো মাযহাব অনুসরণের দরকার নাই। কারণ তিনি নিজেইতো শরীয়ত প্রণেতাদের একজন। তিনি কার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অনুসরণ করবেন? তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার থেকেই সমাধান জেনে আমল করেছেন, এবং আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সাহাবীদের মাযহাব কি?

সাহাবায়ে কিরাম যারা সরাসরি রাসূল সাঃ এর কাছে ছিলেন তাদের জন্য রাসূল সাঃ এর ব্যাখ্যা অনুসরণ করা ছিল আবশ্যক। এছাড়া কারো ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু যেই সকল সাহাবারা ছিলেন নবীজী সাঃ থেকে দূরে তারা সেই স্থানের বিজ্ঞ সাহাবীর মাযহাব তথা মত অনুসরণ করতেন। যেমন ইয়ামেনে হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ এর মত তথা মাযহাবের অনুসরণ হত। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ কে অনুসরণ করতেন ইরাকের মানুষ।

রাসূল সাঃ যখন মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ কে ইয়ামানে পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন মুয়াজ রাঃ কে জিজ্ঞেস করলেন-“যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হবে তখন তুমি কিভাবে ফায়সাল করবে?” তখন তিনি বললেন-“আমি ফায়সালা করব কিতাবুল্লাহ দ্বারা”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি কিতাবুল্লাহ এ না পাও?” তিনি বললেন-“তাহলে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাত দ্বারা ফায়সালা করব”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাতে না পাও?” তখন তিনি বললেন-“তাহলে আমি ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করব”। তখন রাসূল সাঃ তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন-“যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট”। {সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৯৪, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৩২৭, সুনানে দারেমী, হাদিস নং-১৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৬১}

এই হাদীসে লক্ষ্য করুন-রাসূল সাঃ এর জীবদ্দশায় হযরত মুয়াজ রাঃ বলছেন যে, আমি কুরআন সুন্নাহ এ না পেলে নিজ থেকে ইজতিহাদ

মুহাদ্দিসগন কি মাযহাব মেনেছেন?

এই কথাটি বুঝার আগে একটি কথা আগে বুঝে নিন। সেটা হল-রাসূল সাঃ এর যুগ থেকেই দু’টি দল চলে আসছে, একটি দল হল যারা ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। তারা ইজতিহাদ করতেন তথা মত দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে। আর একদল ছিলেন যাদের এই ক্ষমতা ছিলনা, তারা সেই মুজতাহিদদের মতের তথা মাযহাবের অনুসরণ করতেন।

ঠিক একই অবস্থা ছিল সাহাবাদের যুগে। একদল ছিল মুজতাহিদ, যাদের একটি তালিকা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। আর বিশাল এক জামাত ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন না। তারা সেই সকল মুজতাহিদদের মাযহাব তথা মতের অনুসরণ করতেন। তেমনি তাবেয়ীদের একই অবস্থা ছিল, একদল মুজতাহিদ, আরেকদল মুকাল্লিদ তথা অনুসারী। এমনি মুহাদ্দিসীনদের মাঝেও দুই দল ছিল, একদল ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন, আরেকদল ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন না। তাই তাদের মাঝে কারো কারো মাযহাব রয়েছে কারো কারো নেই। কেউ কেউ নিজেই মাসআলা বের করেছেন, কেউ কেউ অন্য কোন ইমামের অনুসরণ করেছেন।

যেমন ইমাম বুখারী মুজতাহিদ ছিলেন, তাই তার কারো অনুসরণের দরকার নাই। তবে কেউ কেই তাকে শাফেয়ী মাযহাবী বলে মত ব্যক্ত করেছেন। {আল ইনসাফ=৬৭, তাবাকাতুশ শাফেয়িয়্যাহ-২/২, আবজাদুল উলুম—৮১০}

এমনিভাবে ইমাম মুসলিম রহঃ ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। {আল হিত্তাহ-১৮৬}

নাসায়ী শরীফের সংকলক ইমাম নাসায়ী রহঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ এর মাযাহাবের অনুসারী ছিলেন।, ইমাম আবু দাউদ রহঃ, ও ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। {ফয়জুল বারী-১/৫৮, আবজাদুল উলুম-৮১০, ইলাউল মুয়াক্কিয়ীন-১/২৩৬}

ইমাম তাহাবী রহঃ ছিলেন হানাফী মাযহাবের অনুসারী। যা তার সংকলিত তাহাবী শরীফ পড়লেই যে কেউ বুঝতে পারবে। এছাড়াও বাকি সকল মুহাদ্দিস হয়ত মুজতাহিদ ছিলেন, নতুবা ছিলেন মুকাল্লিদ কোননা কোন ইমামের।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব আছে।

(১) হানাফী মাযহাব,

(২) মালেকী মাযহাব

(৩) শাফেয়ী মাযহাব,

(৪) হাম্বলী মাযহাব। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ হানাফী মাযহাব অনুসরন করে। ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) দ্বীনের কিভাবে সঠিক পথে চলার যায় তার জন্য আমাদেরকে নিখুঁতভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি একজন yuhuতাবেয়ী ছিলেন। স্বচক্ষে সাহাবাদেরকে দেখেছেন। এই বৈশিষ্ট্য অন্য কোন ইমামের মধ্যে নেই। দ্বিতীয় ইমাম হলেন, ইমাম মালেক (রহ.)। তিনি ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) এর ছাত্রতুল্য। তৃতীয় ইমাম হলেন,ইমাম শাফেয়ী (রহ.)। তিনি ইমাম আবূ হানিফা (রহ.)-এর প্রথম স্তরের শীর্ষস্থানীয় ছাত্রদ্বয়ের তথা ইমাম আবূ ইউসূফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান শায়বানী (রহ.) এর ছাত্র, অর্থাৎ ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) এর নাতি ছাত্র। চতুর্থ ইমাম হলেন, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.)। তিনিও ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) এর নাতি ছাত্র।

আজকাল অনেক ভাইকে দেখা যায় মাযহাব শব্দটি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগে থাকেন।

আবার অনেকে এই শব্দটির সঠিক অর্থ জানা সত্ত্বেও এই শব্দটি নিয়ে সাধারন মুসলমানদের ভিতরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন।

যারা জেনে শুনে মাঝহাব নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন তাদের জন্য এই পোষ্ট নয়।

কারন ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো আমার সম্ভব কিন্তু জাগ্রত ব্যক্তিকে সম্ভব নয়।

যারা সত্যিকার অর্থেই মাযহাব নিয়ে জানতে চান তাদের জন্য আমার এই পোষ্ট।

............................................................................................................

মাজহাব মানে মতামত, বিশ্বাস, ধর্ম, আদর্শ, পন্থা, মতবাদ, উৎস।

মিসবাহুল লুগাত (থানবী লাইব্রেরী-২৬২ পৃষ্ঠা)

মাজহাব শব্দের অনেক অর্থ আছে। তার ভিতরে একটি হল মতামত।

আসুন এবার মাজহাব শব্দের উৎস কোথায় দেখি.....

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা রা. হুজুরের হাদীস বর্ণনা করেছেন, যখন কোন হাকীম (বিচারক ও মুফতী) কোন বিষয়ে ইজতিহাদ করে এবং তা সঠিক হয়, তবে সে দ্বিগুন সওয়াব পাবে। আর ইজতিহাদে যদি ভুল করে, তবুও সে একগুন সওয়াব পাবে। -বুখারী 2/109, মুসলিম 2/72, তিরমিজী 193

ইজতিহাদের শাব্দিক অর্থ, উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করা। ইসলামী ফেকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায় ইজতিহাদ অর্থ,কোরআন ও সুন্নায় যে সকল আহকাম ও বিধান প্রচ্ছন্ন রয়েছে সেগুলো চিন্তা-গবেষণার মাধ্যেমে আহরণ করা। যিনি এটা করেন তিনি হলেন মুজতাহিদ। মুজতাহিদ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে সকল আহকাম ও বিধান আহরণ করেন সেগুলোই হলো মাযহাব। অথাৎ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে সকল আহকাম ও বিধান আহরণ করে মুজতাহিদগণ যে সকল মতামত পেশ করেছেন তাকে মাযহাব বলে।যাদের কোরআন ও সুন্নাহ থেকে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে আহকাম ও বিধান আহরণের যোগ্যতা নেই তাদের কাজ হল মুজতাহিদদের আহরিত আহকাম অনুসরনের মাধ্যমে শরীয়তের উপর আমল করা।

কুরআন ও সুন্নাহ থেকে যে সকল আহকাম ও বিধান আহরণ করার জন্য কি কি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে ?

১. কোরআনের কোন আয়াত কখন নাজিল হয়, কোন আয়াত নাছেখ (রহিতকারী), কোন আয়াত মানছুখ (রহিত), কোন আয়াত মুজমাল (সংক্ষিপ্ত), কোন আয়াত মুতাশাবেহ ইত্যাদি বিষয়গুলো সবিস্তারে জানার সাথে সাথে কোরআনের নিগুঢ় তথ্যগুলোর সঠিক মর্মগুলি বুঝার পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে।

২. হুজুর স. কর্তৃক ত্রিশ পারা কোরআনের ব্যাখ্যায় রেখে যাওয়া দশ লক্ষ হাদীস সনদের ভিন্নতাসহ জানা আবশ্যক। আর হাদীসের এ বিশাল ভান্ডার থেকে কমপক্ষে যেসব হাদীস দ্বারা শরীয়তের বিধি-বিধান সাব্যস্ত হয়, সেসব হাদীস সনদ (বর্ণনাকরী), মতন (মূল বিষয়) এবং উক্ত হাদীস সমূহের বর্ণনাকারীদের জীবন ইতিহাস (সাহাবা ও তাবেয়ীনদের জীবনাচার)সহ কন্ঠস্থ থাকতে হবে। তারই সাথে হাদীসের নিগুড় তথ্যগুলি, সঠিক মর্মগুলি বুঝার পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। যাতে করে মতবিরোধ বিশিষ্ট মাসআলাসমূহে কোরআন, হাদীস,সাহাবা ও তাবেয়ীনদের নির্দেশিত সীমা অতিক্রম না করা হয়।

৩. মুজতাহিদ আরবী ভাষা সম্পর্কে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হবে। কেননা কোরআন ও হাদীস উভয়টি আরবী। তাই আরবী ভাষা সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা ছাড়া ইজতিহাদ তো দূরের কথা শুধু কোরআন-হাদীসের অর্থ বুঝাও সম্ভবপর নয়। আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য আরবী আভিধানিক অর্থ ও পারিভাষিক অর্থ, নাহু-ছরফ, উসূল, আলাগাতের পূর্ণ দক্ষতা অপরিহার্য।

৪. মুজতাহিদ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বুদ্ধিমত্তা ও অন্তদৃর্ষ্টি দ্বারা বিশেষভাবে ভূষিত হয়ে অত্যাধিক স্মরণশক্তি ও জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। মুজতাহিদের জন্য কেবল সাধারণ বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ট নয়। সাধারণ বুদ্ধিমত্তাতো সকল আলেমেরই থাকে। এতে মুজতাদিরে বিশেষ গুরুত্ব আর রইল কোথায়? মুজতাদি তাক্ব ওয়া ও খোদাভীতি সম্পন্ন হতে হবে। তাকে কখনও মনপূজারী হওয়া চলবে না।

৫. ইজতিহাদ ও মাসআলা চয়নের প্রক্রিয়া সমূহের উপর পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতে হবে।

সূত্র :- তাফসীরে আহমদী, পৃষ্ঠা- ১০১

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. ইমাম বাগাবী রহ. সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইজতিহাদের জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে। যার মধ্যে এ পাঁচটি হতে একটিও কম পাওয়া যাবে, তার জন্য তাক্বলীদ ছাড়া কোন পথ নেই।

- কাঞ্জুল উসূল ইলা মা’রিফাতিল উসূল- ২৭০, উসূলে ফিক্বাহ লি আবি হুরায়রা- ২৩৬, আল মালাল ওয়ান নাহাল- ১/২০০ মিশরী ছাপা।

হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. কে জিজ্ঞাসা করা হল, যার এক লক্ষ হাদীস স্মরণ থাকে, সে কি ফক্বীহ বা মুজতাহিদ হতে পারেবে, তদুত্তরে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বললেন, না। পুনারায় জিজ্ঞাসা করা হলো, যদি পাঁচ লক্ষ হাদীস স্মরণ থাকে, তদুত্তরে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বললেন, সে সময় তাকে ফক্বীহ হবে আশা করা যেতে পারে।

- এমদাদুল ফতোয়া ৪/৮৭

হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর পর শুধুমাত্র হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী উক্ত চার মাযহাবেই (কুরআন ও হাদীসের বিশ্লেষন) তাক্বলীদ (অনুসরন) সীমাবদ্ধ হয়েছে। কেননা, চার মাযহাব ছাড়া অন্যান্য মুজতাহিদদের মাযহাব তেমন সংরক্ষিত হয়নি। ফলে আস্তে আস্তে সেসব মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে পড়ে।

- আহসানুল ফতোয়া ১/৪৪১, তাফসীরে আহমদী- ২৯৭, আল ইনসাফ- ৫২।

কুরআন-সুন্নাহ থাকতে আবার আমরা মাযহাব কেন?

আজ এই মুহূর্তে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন কিংবা আপনি জন্মগতভাবেই মুসলিম, এ মুহূর্তে আপনি ইসলামের কোনো বিধান পালন করতে চান, তো আপনাকে আলেম-উলামা বা ইসলাম সম্পর্কে জানেন-এমন ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের এই ভূখন্ডে প্রথম দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা ঈমান শিখেছিলেন ইসলাম-প্রচারকদের কাছে। এরপর তাদের কাছেই নামায আদায় করতে শিখেছিলেন। আজ এবং অনাগত দিনেও পৃথিবীব্যাপী প্রতিটি নওমুসলিমই ঈমান, অযু-গোসল, হালাল-হারাম, সালাত-যাকাত, সিয়াম-হজ্ব ইত্যাদির প্রথম ধারণা লাভ করবেন তার ইসলাম গ্রহণের প্রথম মাধ্যম ব্যক্তিটির কাছ থেকে এবং বহু কিছু তিনি শিখে নিবেন মুসলিমসমাজের ধর্মীয় কার্যক্রম ও কালচার থেকে। এ বিষয়টি আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব যদি কল্পনা করি সে সময়টির কথা, যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত উন্নত হয়নি। শিক্ষা-দীক্ষার হার ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যম বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ছিল না এত বই-পুস্তক, পত্রিকা ও প্রকাশনা। তখন ভাবের আদান-প্রদান ও যোগাযোগের একটিই উপায় ছিল। তা হল মৌখিক জ্ঞান বিনিময়ের পাশাপাশি বাস্তব অনুশীলন। অর্থাৎ হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া।

আজকের এই সময়টা নিয়েই ভাবুন। দেখবেন, বাংলাদেশের মুসলমানরা ইসলামী বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ইবাদত-বন্দেগী, সুন্নত-বিদআত, জায়েয-নাজায়েয, হালাল-হারাম প্রভৃতি যা কিছুই জানেন এর সিংহভাগই সমাজ, পরিবেশ, গৃহশিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ওয়ায়েজ, মক্তবের উস্তাদ, মা-বাবা, দাদা-দাদী ইত্যাদি মানুষ থেকে শেখা। কেবল নিজের পড়াশোনা, প্রচারমাধ্যম বা অন্যান্য ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে এখনও অনেক কম।

আমাদের সমাজের প্রকট বাস্তবতার আলোকেই বাঙ্গালী মুসলমানের প্রথম ইসলামী জ্ঞান অর্জনের এ ব্যবস্থাকে অবলম্বন করেই প্রবচন চালু হয়েছে-‘শুইন্যা মুসলমান।’ অর্থাৎ মূল উৎস ঘেঁটে, দেখে বা পড়ে নয়, শুনে শুনে যারা একটি বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এ প্রবচনটি প্রয়োগ করে থাকেন গ্রাম-বাংলার মানুষ।

কেবল বই-পুস্তক পড়ে একটা কাজ শেখা আর একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হাতে-কলমে শিক্ষালাভ করার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। কোনো খেলা, ব্যায়াম, সাইকেল বা গাড়ি চালনা কোনোটাই শুধু বই-পুস্তক পড়ে, মিডিয়ায় ছবি দেখে পূর্ণরূপে শিখে নেওয়া সহজ নয়। একজন উস্তাদের সাথে থেকে তার ইনস্ট্রাকশন মেনে বিষয়টি শিখলে এবং হাতে-কলমে অনুশীলন করলে পুঁথিগত জ্ঞান বা তাত্ত্বিক ব্যাকরণ ততটা না জানলেও কাঙ্খিত কার্যক্রমটুকু শিখে নেওয়া সম্ভব। পড়াশোনার বিষয়টি ব্যবহারিক পর্যায়ে থাকলেও কাজ বাধাগ্রস্ত হবে না। গভীর তত্ত্ব আলোচনা ও সামগ্রিক জ্ঞান অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের জন্য জরুরি হলেও বিশ্বাস, দর্শন ও জীবনব্যবস্থার সাধারণ অনুসারীর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ওই প্রশিক্ষক, গুরু, পীর, উস্তাদ, মুর্শিদ, আলেম, ইমাম বা প্রচারকের সান্নিধ্যই যথেষ্ট।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ও আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামের প্রচার তত্ত্বের চেয়ে ব্যবহারিক পর্যায়েই বেশি অগ্রসর হয়েছে। কেননা, পৃথিবীর সকল অঞ্চলের সকল যোগ্যতার মানুষকে তাওহীদ, রিসালত ও আখেরাতের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দিতে চাইলে কোনো কঠিন ও জটিল পন্থা অবলম্বন করা চলবে না। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর সরল ও সনাতন পন্থায়ই তা করতে হবে।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জীবনের প্রতিটি বিষয় হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো বই-পুস্তক ধরিয়ে দিয়ে গবেষণা করে বুঝে নিতে বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। পৃথিবীর অপরাপর এলাকায় বসবাসরত সমকালীন মানুষ এবং পরবর্তী সকল যুগের অনাগত বিশ্বমানবমন্ডলীর কাছে নিজের দাওয়াত পৌঁছে দিতেও হযরত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, পান্ডুলিপি ইত্যাদির আশ্রয় নেননি। তিনি তাঁর সাহাবীগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড় এবং আমার আদর্শের একটি বাণী হলেও পূর্ব-পশ্চিমে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলতেন, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়, সাহাবীরা যেমন নতুন কোনো মানুষকে অযু শেখানোর সময় তাদের সামনে বসে অযু করতেন এবং বলতেন, এই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অযু। ইসলামের প্রতিটি বিধানই প্রাথমিকভাবে এর ধারক-বাহকদের মাধ্যমে ব্যবহারিক তথা প্রায়োগিকভাবেই বিস্তৃত ও প্রচলিত হয়েছে। আর ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বা এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এখানেই যে, এটি ধারণ বা পালন না করে বহন করা যায় না। আর একে ভালো না বেসে ধারণও করা যায় না। যারা একে ভালবাসেন ও নিজেরা ধারণ করেন, তারাই কেবল একে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এর আনুষ্ঠানিক প্রচারের তুলনায় এর ধারক ও সেবকদের আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমেই ইসলাম অধিক, ব্যাপক, গভীর আর টেকসই পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসই এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জীবনের প্রতিটি বিষয় হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়েছেন, কোনো বই-পুস্তক ধরিয়ে দিয়ে গবেষণা করে বুঝে নিতে বলেই দায়িত্ব শেষ করেননি। পৃথিবীর অপরাপর এলাকায় বসবাসরত সমকালীন মানুষ এবং পরবর্তী সকল যুগের অনাগত বিশ্বমানবমন্ডলীর কাছে নিজের দাওয়াত পৌঁছে দিতেও হযরত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, পান্ডুলিপি ইত্যাদির আশ্রয় নেননি। তিনি তাঁর সাহাবীগণকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড় এবং আমার আদর্শের একটি বাণী হলেও পূর্ব-পশ্চিমে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।

হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলতেন, তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়, সাহাবীরা যেমন নতুন কোনো মানুষকে অযু শেখানোর সময় তাদের সামনে বসে অযু করতেন এবং বলতেন, এই ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অযু। ইসলামের প্রতিটি বিধানই প্রাথমিকভাবে এর ধারক-বাহকদের মাধ্যমে ব্যবহারিক তথা প্রায়োগিকভাবেই বিস্তৃত ও প্রচলিত হয়েছে। আর ইসলামের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বা এর অন্তর্নিহিত শক্তিও এখানেই যে, এটি ধারণ বা পালন না করে বহন করা যায় না। আর একে ভালো না বেসে ধারণও করা যায় না। যারা একে ভালবাসেন ও নিজেরা ধারণ করেন, তারাই কেবল একে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। এর আনুষ্ঠানিক প্রচারের তুলনায় এর ধারক ও সেবকদের আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার মাধ্যমেই ইসলাম অধিক, ব্যাপক, গভীর আর টেকসই পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। দেড় হাজার বছরের ইতিহাসই এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

এখন ইসলামের একজন অনুসারী হিসেবে আমি নিজেকে নিয়েই চিন্তা করি। ইসলামের একজন প্রচারক যখন আমার কাছে ইসলামের আদর্শ তুলে ধরবেন, সে সময়টা যদি হয় আরও ২, ৪, ৫, ৭ শ বছর আগের, তখন কি তার পক্ষে সম্ভব আমার হাতে এক কপি কুরআন বা সহীহ হাদীসের একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলন তুলে দেওয়া? বাংলাভাষী হওয়ায় আমার পক্ষে কী আরবী ভাষায় তা পাঠ করাও সম্ভব? শুধু আরবী ভাষা বলেই কথা নয়, আমার পক্ষে কি তাত্ত্বিক এ দুটো উৎস-বিদ্যার বিষয়গত ভাব উদ্ধার করাও সম্ভব? এখানে আমার জ্ঞান-গরিমার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বোধ-বিবেকের পরিমাণও একটি প্রশ্ন। এরপর বহু সাধনা করে কুরআন-সুন্নাহর ভান্ডার হাতে পেয়ে গবেষণা করে এর সারনির্যাস হাসিল করে নিজে ঈমান, আমল ও আখলাক চর্চা শুরু করতে আমার কত মাস, বছর বা যুগ লাগবে সেটাও কি কম বড় প্রশ্ন ? এতটা পরিশ্রম করে যদি ইসলাম পালন আমি শুরু করি, তাহলেও তো ভালো। কিন্তু এ কাজটুকু ক’জন মানুষের পক্ষে সহজ বা সম্ভব? তদুপরি প্রশ্ন দেখা দেবে যে, কুরআন-সুন্নাহ গবেষণা করে ঈমান-আমল, নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত, বিয়ে-শাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণ-উৎপাদন, দান-খয়রাত, জীবন-মৃত্যু, জানাযা-উত্তরাধিকার ইত্যাদি শুরু করার আগ পর্যন্ত আমার মুসলমানিত্বের এ দীর্ঘ সময়ের নামায-বন্দেগী ও কাজকর্মের কী হবে?

আমার তো মনে হয়, কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর ঈমান ও আমলের জন্য, ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য প্রথম দিনই কুরআন ও সুন্নাহ গবেষণা শুরু করার পদ্বতি ইসলামের স্বাভাবিক রীতি নয়। যদি এই না হবে তাহলে আমার সন্তানকে আমি ঈমান শেখাব কী করে? তাকে নামায, যিকর, সবর, শোকর, তাওয়াক্কুল ও আদব-আখলাক আমি কোন অধিকারে শিক্ষা দেব? যদি সে প্রশ্ন তোলে, আববু! তুমি আমাকে কুরআন ও সুন্নাহ শেখাও কেন? কুরআন-সুন্নাহ থেকে আমিই আমার জীবনবিধান খুঁজে নেব। তুমি এর মধ্যে এসো না। তুমি তোমার প্রায়োগিক আচরণ ও পর্যবেক্ষণ আমার ওপর চাপাতে চেষ্টা করো না। আমি তোমার বা তোমাদের মাযহাব মানি না। আমার দায়িত্ব তো কুরআন-সুন্নাহর ওপর আমল করা। অতএব কুরআন-সুন্নাহর ওপর দখল স্থাপন করার সময় আমাকে দাও। এরপরই আমি শরীয়তের ওপর আমল শুরু করব। পুত্রের এসব যুক্তির পর আমার বলার কি কিছু থাকবে?

পুত্রের এ বক্তব্য যে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সে ভিত্তিই আমাকে কথা বলার সুযোগ দেবে। কারণ মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনের প্রচার ও শিক্ষাকে যে সনাতন ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে প্রচলিত ও বিস্তৃত করেছেন, এর সম্পূর্ণ অনুরূপ হচ্ছে আমার এ উদ্যোগ

আমার পুত্রকে ইসলামী জীবন-বিধান শিক্ষা দেওয়া আমার ওপর শরীয়তের নির্দেশ। আমি তাকে আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর শক্তি, প্রীতি, ভীতি ও ভালবাসা শেখাব। তাকে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহত্ত্ব, অবস্থান ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে ধারণা দেব। তাকে নামায শেখাব। খাওয়া-পরা, ঘুম-বিশ্রাম, প্রস্রাব-পায়খানা, প্রবেশ-প্রস্থান, মসজিদে যাতায়াত, আযানের জবাব, হাঁটা-চলা, সালাম, মোসাফাহা ইত্যাদির ইসলামী নিয়ম শিক্ষা দেব। আমি নিজেও অযু-গোসল, রোযা-নামায, দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, হজ্ব-কুরবানী প্রভৃতি যথাযথ নিয়মে পালন করব। অথচ আমি কুরআন বা হাদীস পড়ার বা বুঝার মতো যোগ্যতা রাখি না। জ্ঞানের এ দুই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান হস্তগত করে আমল করার মতো শিক্ষা, মেধা, মানসিক যোগ্যতা বা সামগ্রিক অবস্থা আমার নেই, এমতাবস্থায় আমার কী করণীয়?

আমার তো মনে হয়, এখানে আমার ও আমার পুত্রের একই ধরনের করণীয়, যা ইসলামের ১৫০ কোটি সমসাময়িক অনুসারীর প্রত্যেকেরই করণীয়। আর তা হল, কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস থেকে গৃহীত ইসলামী বিধিবিধানের প্রায়োগিক রূপ ফিকহের অনুসরণ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলেছেন, একজন ফকীহ শয়তানের মোকাবেলায় এক হাজার আবেদেরও চেয়েও শক্তিশালী। এর কারণ সম্ভবত এটিও যে, এক হাজার সাধারণ মুসলিমকে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে সংশয় উদ্বেগ ও বিভ্রান্তিতে ফেলে দেওয়া শয়তানের জন্য যত না কঠিন একজনমাত্র শরীয়ত-বিশেষজ্ঞ ফকীহ আলেমকে বিভ্রান্ত করা এরচেয়ে বেশি কঠিন। কেননা, এই ব্যক্তির কাছে কুরআন ও সুন্নাহর শক্তিশালী সম্পদ রয়েছে। রয়েছে ইলমে দ্বীনের আরও বিস্তারিত ভান্ডার।

কুরআন মজীদেও আল্লাহ তাআলা এ মর্মে বলেছেন, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে একদল মানুষ যেন দ্বীনী ইলমের উপর ব্যুৎপত্তি অর্জন করে কারণ জনগোষ্ঠীর বাকি অংশটিকে তাদের শরীয়তের উপর পরিচালনা করতে হবে। এখানেও আমরা ফকীহ বা শরীয়তের আলেমের বিধিগত অস্তিত্ব এবং তাঁর কুরআনী দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মহামান্য সাহাবীগণের পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ইসলাম যখন আরব-উপদ্বীপ ছেড়ে একদিকে সাহারা গোবি ছুঁয়ে দূর অতলান্তিক স্পর্শ করছিল, অপরদিকে আসমুদ্র সাইবেরিয়া আর মহাচীনের প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল তখনও কিন্তু পবিত্র কুরআন ব্যাপকভাবে হস্তলিখিত হয়ে এত বিপুল পরিমাণ অনুলিপি তৈরি হয়নি, যা প্রতিটি শিক্ষিত নও-মুসলিমের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর হাদীস শরীফ তো তখনও যাচাই বাছাইয়ের পর সংকলিত ও গ্রন্থবদ্ধ হয়েও শেষ হয়নি। তো ইসলামের এ অগ্রযাত্রা, ইসলামী শরীয়তের আলোয় প্লাবিত এ নতুন পৃথিবীর বুকে কাদের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহর আলো প্রতিবিম্বিত হয়েছিল? এর ছোট এক টুকরো জবাবই ইসলামের ইতিহাসে সুরক্ষিত আছে, যা আমি এ লেখার শুরুতে নিবেদন করেছি। হাদীস শরীফে তো বলা হয়েছে, তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় আমি রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা এ দুটো আঁকড়ে রাখবে ততদিন পথচ্যুত হবে না। এক আল্লাহর কিতাব। দুই. আমার আদর্শ। এ মহা দিকনির্দেশনার আরও সুসংহত রূপ হচ্ছে হযরতের অপর বাণী, যেখানে মুসলিম জাতিকে সত্যপথের দিশা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে আদর্শের উপর আমি রয়েছি আর আমার সাহাবীগণ রয়েছেন।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য অবধারিত করছি আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসরণ।’

এখানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামী অগ্রযাত্রা ও ইসলামী জীবনসাধনার সঠিক দিকনির্দেশের জন্য কুরআন ও সুন্নাহকে মূল উৎস সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামী জীবনব্যবস্থার আদর্শ ও মাপকাঠিরূপে অভিহিত করা হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরবৃন্দের অনুসৃত পথ, যা প্রধানতই ব্যবহারিক ও সান্নিধ্যগত আদর্শ। বই-পুস্তক ও তত্ত্ব প্রধান নয়। যে জন্য সাহাবায়ে কেরামের মূল সময়কালের শেষ পর্যায়ে আমরা পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় হযরত মালেক ইবনে আনাসকে রাহ. দেখতে পাই গোটা মুসলিমসমাজের লোকশিক্ষক ও দিকনির্দেশক হিসেবে। ইসলামের উপর আমল করার জন্য মদীনাবাসী তখন থেকেই কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা বা অনুসন্ধান শুরু না করে ফকীহ ও আলেম ইমাম মালেকের ফিকাহ বা মাযহাবের উপর, তার নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করেছেন। এরও বহু আগে থেকে মক্কাবাসীরা নির্ভর করেছেন হযরত ইবনে আববাস রা.-এর উপর। এর কিছুদিন পর থেকে বৃহত্তর ইরাকবাসী ইমামে আজমের ফিকহের উপর। আর এটিই কুরআন ও সুন্নাহর বিধান। আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন, তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের। আর অনুসরণ কর তোমাদের উলুল আমর বা শরীয়তী অথরিটির। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, পিতার সন্তুষ্টিতেই রয়েছে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তো আমার পুত্রকে দৈনন্দিন জীবনের যে শরীয়ত সম্পর্কিত শিক্ষা-দীক্ষা আমি দেব তা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করা ও তার উপর আমল করাও পুত্রের উপর শরীয়তেরই নির্দেশ। এখানে আমাদের মধ্যকার এ আদান-প্রদান কিছুতেই কুরআন-সুন্নাহ বিবর্জিত বা বিরোধী নয়।

মুসলিমজাতির হাতে তাদের শরীয়তের ব্যবহারিক রূপরেখা সমন্বিত ও সংকলিত আকারে তুলে দেওয়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে যেসব সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের ফকীহগণ কঠোর জ্ঞান-গবেষণা ও সাধনা করেছেন তাদের মর্যাদা বা গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, একখানা উদ্ধৃতি উল্লেখ করাই বিষয়টির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট মনে হয়। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, রাতের কিছু সময় ইলম চর্চা করা রাতভর নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম।

কুরআন-সুন্নাহর ভেতর মানবজীবনের উদ্ভূত যে কোনো সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলে এ থেকেই আমাদের তা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সমাধানে পৌঁছার জন্য নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনার আশ্রয় নিতে হবে। এটি হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই আদর্শ। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় তার মুখ থেকে এ কথা শুনতে পেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে আল্লাহর শোকর গোযারি করেছিলেন।

ইসলাম পৃথিবীর সর্বকালের সকল মানুষের জন্য চিরস্থায়ী জীবনব্যবস্থারূপে কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস প্রভৃতির মূলনীতির ভিত্তিতে ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাধ্যমে ব্যবহারিক বিধানরূপে, সমস্যার সমাধানরূপে, বিচারালয়ে ফয়সালারূপে জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে অতুলনীয় ব্যবস্থারূপে তার ব্যাপক আকার পরিগ্রহ করতে থাকে। ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের নানা বিধানে কিছু বৈচিত্র ইসলামের বিশালত্ব ব্যাপ্তি ও কালজয়ী গুণেরই বহিঃপ্রকাশ। অসংখ্য বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের পর্যবেক্ষণে ছিল অনেক মতবৈচিত্র! এ ইসলামের এক স্বীকৃত রীতি। প্রায়োগিক বিধানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তথা বিস্তারিত ফিকহ রচনার সময়ও মুজতাহিদ আলেমগণের পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও নির্বাচনে এ ধরনের বৈচিত্র ফুটে ওঠে। শরীয়তে চিন্তার এ বৈচিত্রকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে কুরআন মজীদ, সুন্নাহ, প্রথম যুগের প্রচলন, সাহাবীদের ঐকমত্য আর পূর্ববর্তী নজির অনুসরণ। এসব মূলনীতি বিশ্লেষণ করেই আপেক্ষিক বিষয়ের মধ্যে একটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর এ ইজতিহাদী তত্ত্ ভিত্তিতেই গড়ে ওঠেছে ইসলামের বহুমাযহাব সম্বলিত ব্যবহারিক ফিকহ।

কুরআন-সুন্নাহ ও এর প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় যে সুযোগ্য ব্যক্তির নখদর্পণে, মুসলিম জাতির প্রয়োজনে তিনিই পারেন ইজতিহাদ করতে। কেননা, সাহাবায়ে কেরামের মতবৈচিত্রপূর্ণ কোনো বিষয় কিংবা সাহাবীদের যুগের পরবর্তী কোনো নতুন সমস্যার সমাধান নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। ফলে অসংখ্য মত ও মাযহাবের বৈচিত্র ছিল খুবই স্বাভাবিক, যার মধ্যে অপেক্ষাকৃত প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাবের সাথে মুসলিম জনসাধারণ সমধিক পরিচিত। এসব মাযহাবের কোনোটিই কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত নয় এবং কোনোটিই এমন নয়, যার অনুসরণ করলে আমরা কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী বলে গণ্য হব না। এমনকি একটি মাযহাবের ইমাম অপর মাযহাবের ইমামের এলাকায় বেড়াতে গিয়ে তার ফিকহ অনুসারেই আমল করেছেন এমন উদাহরণও ইমামদের জীবনে দেখা যায়। যেন আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে, মাযহাব কেবলই নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়।

কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের সমন্বয়ে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তের বহুমাত্রিকতা থেকে একটি অবস্থাকে প্রাধান্য দেওয়ার নাম তারজীহ। আর এ প্রাধান্যপ্রাপ্ত সমাধানগুলোই হচ্ছে মাযহাবের বৈচিত্রপূর্ণ অংশ। অতএব মাযহাব মানা আর কুরআন-সুন্নাহ মানার মধ্যে কোনোই ফারাক থাকার কথা নয়। তাছাড়া সাধারণ মুসলমানের পক্ষে কোনো আংশিক বা সামগ্রিক, প্রসিদ্ধ কিংবা অখ্যাত মাযহাব অনুসরণ ছাড়া শরীয়তের উপর আমল করাও প্রায় অসম্ভব।

কেননা, ইসলামের বিশালত্ব, চিরস্থায়িত্ব ও সর্বকালের সকল অঞ্চলের মানুষের উপযোগী ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে এর ভেতরকার সবকিছুই পরম উদার ও বৈজ্ঞানিক। এতে অনেক সুযোগ, উদারতা ও বিস্তৃতি রয়েছে। জীবন ও জগতকে গতিশীল উপায়ে এগিয়ে নেওয়া ইসলামের প্রেরণা। সুতরাং এখানে প্রায় সব বিষয়েই অনেক এখতিয়ার, অনেক সহজতা। ইসলামের মূল ইবাদত নামাযের ভেতর যত বৈচিত্র ও সহজতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন থেকে হাদীসের মারফত আমরা পাই, এর সবগুলোর উপরই আমাদের আমল করার বৈধতা ও যুক্তি রয়েছে। এতে একজন বিজ্ঞ মুজতাহিদ যখন একটি নামায পদ্ধতি আমাদের জন্য কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস-এর আলোকে নির্বাচন করবেন, তখন সেটাই এক এলাকার, এক সংস্কৃতির মানুষকে ধারণ করতে হবে। এ পদ্ধতির চর্চাই পরস্পরগতভাবে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকবে। শুধু নামায নয়, যাকাত, হজ্ব, কুরবানী, পাক-নাপাক, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েযের প্রতি ক্ষেত্রেই এভাবে মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা মুসলিমজাতি উপলব্ধি করবে। সর্বোপরি সকল মাযহাবের ইমামদের অভিন্ন একটি কৈফিয়ত ইসলামে রয়েছে যে, আমার নির্বাচিত মাসআলার বিপরীতে যদি আরও শক্তিশালী প্রমাণ খুঁজে পাও তাহলে আমার মাসআলা ত্যাগ কর। বিশুদ্ধ হাদীস যদি আমার সিলেকশনকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। এখানে অবশ্য একজন মুজতাহিদের নির্বাচনকে যাচাই করার জন্যও ন্যূনতম কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন। সাধারণ একজন দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের পক্ষে এক্ষেত্রে নাক গলানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অসঙ্গত।

যদি কোনো ব্যক্তি নিজেই শরীয়তের সকল শর্ত পূরণ করা একজন মুজতাহিদ হন তাহলে তিনি কোনো ইমামের মাযহাব অনুসরণ না করে নিজেই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবনযাপন করতে পারেন। তবে কুরআন-হাদীসের অনেক শাস্ত্রবিদ মনীষীও এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চাননি। কেননা, বিষয়টি শরীয়তের এক বা দুই শাস্ত্রের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, কুরআন ও হাদীস সংক্রান্ত সকল মৌলিক শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তির অধিকারী হয়ে নিজেকে নতুন পথের পন্থী দাবি করা চাট্টিখানি কথা নয়।

অতএব নির্দ্ধিধায় আমরা স্বীকৃত মাযহাবগুলোর উপর আমল করতে পারি। কর্মসূচিগত ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য যেকোনো একটি মাযহাবকে বেছে নেওয়া জরুরি। যেমন, একটি বহুতল ভবনে ওঠার জন্য যদি সিঁড়ি, এসকেলেটর, লিফট, ক্রেন, রশি প্রভৃতি উপায় থাকে তাহলে একই সঙ্গে একাধিক উপায় অবলম্বন করা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ বলে বিবেচিত। একটি পন্থাই বেছে নিতে হবে আমাকে। তাছাড়া ধর্মীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি পন্থা অনুসারে আমল করা এজন্যও কর্তব্য যে, ইবাদত বা আচরণে অস্থিরতা এর আবেদনকে বহুলাংশে ক্ষুণ্ণ করে থাকে।

অতএব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মাযহাব অনুসরণ করলে প্রকৃতপক্ষে আমি কুরআন-সুন্নাহই অনুসরণ করলাম। আমি তখন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। আমি তখন আহলে কুরআন, আহলে হাদীস। আমিই তখন সালাফী বা পূর্ববর্তী মুরববীদের অনুসারী। কেননা, এসব পথের মূল প্রেরণা আর মাযহাব সংকলনের প্রেরণায় কোনোই বিরোধ নেই।

>তাক্বলীদপন্থীদে র দলীল ও তার জবাব :

প্রথম দলীল : তাক্বলীদপন্থীদে র নিকট তাক্বলীদ জায়েয হওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল হ’ল আল্লাহ তা‘আলার বাণী- فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- ‘আর জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জেনে থাক’ (নাহল ৪৩) । আর আমরা অজ্ঞ ব্যক্তি। অতএব আমাদের উপর ওয়াজিব হ’ল আলেমদের নিকট জিজ্ঞেস করা ও তাদের দেওয়া ফৎওয়ার তাক্বলীদ করা।

জবাব : আয়াতে বর্ণিত أَهْلُ الذِّكْرِ কারা? তারাও যদিঅন্য কারো মুক্বাল্লিদ হয়, তাহ’লে তারা অন্যদেরকেও ভুলের মধ্যে পতিত করবে। আর যদি তারাই প্রকৃত أَهْلُ الذِّكْرِ না হয়, তাহ’লে এতে কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হবে।

আয়াতে বর্ণিত أَهْلُ الذِّكْرِ -এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনীষীগণ বিভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হ’ল।-

ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, তারা হ’লেন أهل السنن তথা সুন্নাতের অনুসারীগণ অথবা أهل الوحي অর্থাৎ অহী-র বিধানের অনুসারী। [1]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, أهل القرآن والحديث অর্থাৎ কুরআন ও হাদীছের অনুসারীগণ

সত্যিকার আহ্‌লে হাদীস কে?

১।

যুগযুগ ধরে হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিক্বাহ, উসূলে ফিক্বাহ এবং হাদীসের ব্যাখ্যা ও হাদীসের বর্ণনাকারীদের ইতিহাসের কিতাব সমূহের ভাষ্য মতে, যারা হাদীসের সনদ ও মতন (বর্ণনাকারী ও মূল বিষয়) নিয়ে নিবেদিত এবং হাদীস শরীফের সংরক্ষণ, হিফাযত, সঠিক বুঝ এর অনুসরণ-অনুকরণে নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকেই আহ্‌লে হাদীস বা আছহাবুল হাদীস বলা হয়। চাই সে হানাফী হোক বা শাফেয়ী, মালেকী অথবা হাম্বলী।

২।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা যাকে গাইরে মুক্বাল্লিদরাও অনুসরণ করে থাকে, তিনি বলেনঃ

“ কেবল মাত্র হাদীস শ্রবণ, লিখন অথবা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ব্যক্তিদেরকেই “ আহলে হাদীস ” বলা হয় না বরং আমাদের নিকট “ আহলে হাদীস ” বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বুঝায় যারা হাদীস সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থের অনুসারী হবে। ”

( নাক্বদুল মানতিকঃ পৃ – ১৮; কায়রো থেকে প্রকাশ ১৯৫১ ইং )

৩।

আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে ইব্রাহীম আল-অজীর (মৃঃ ৮৪০ হিজরী ) লিখেনঃ

“ একটি জ্ঞাত কথা হল “ আহলে হাদীস ” বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝায় যিনি এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে খেদমত করেছেন এবং এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ”

উভয়ের বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই পরিষ্ফুটিত হয় যে, আহ্‌লে হাদীস হতে হলে হাদীস সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে নিবেদিত প্রাণ হতে হবে। ফিক্বহে হাদীস তথা হাদীসের মর্মকথা অনুধাবন করতে হবে আর আমল করতে হবে সে অনুযায়ী। চাই সে যে মায্‌হাবেরই হোক না কেন।

৪।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও আশ্চর্যের সাথে ব্যক্ত করতে হচ্ছে যে, গাইরে মুক্বাল্লিদরা “ আহলে হাদীস ” বলতে তাক্বলীদ অমান্যকারী একটি দল ও একটি নির্দিষ্ট মতবাদ বুঝায়। অনুরূপভাবে যেথায়ই আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস শব্দ দেখতে পাওয়া যায় এর দ্বারা তারা নিজেদেরকেই মনে করে, চাই সে জাহেল বা মূর্খ হোক, নামাযী হোক বা বেনামাযী হোক... হাদীস সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞান থাক বা না থাক, কেবল আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই আহলে হাদীস উপাধী পেয়ে যাবে।

( আখবারুল ইত্তেছালঃ পৃ – ৫, কলাম – ১, সংখ্যা – ২, ফেঃ ১৯৬২ আহলে হাদীসের তদানিন্তন জেনারেল সেক্রেটারী মাওলানা ইসমাইল কর্তৃক প্রকাশিত )

৫।

তাই এ দলের সবার উপাধি “ আহলে হাদীস ” যদিও তাদের অনেকেরই পেটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেও একটি হাদীস নির্গত হবে না। উপরন্তু তাদের নামধারী আলেমদের অনেকেই ফিক্বহে হাদীস সম্বন্ধে কিঞ্চিত জ্ঞানও রাখে না, বুঝার চেষ্টাও করে না।

এর প্রমাণ হিসেবে তাদেরই নেতা নবাব ছিদ্দিক হাসান খানের উক্তি পেশ করছিঃ

“ আপনি তাদেরকে কেবল হাদীসের শব্দ নকল করতে দেখবেন, হাদীস বুঝার প্রতি তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করে না, এতটুকু তারা নিজেদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে অথচ এ ভ্রান্ত ধারণা মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে, কেননা হাদীসের কেবল শব্দের গন্ডীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হাদীস বুঝা, এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে গবেষণা করাই হল মূল উদ্দেশ্য। ”

( আল-হিত্তাহ ফী যিক্‌রিচ্ছিহাহ্‌ ছিত্তাহ্‌: পৃ – ৫৩ )

৭।

তিনি আরও লিখেনঃ

“ আহ্‌লে হাদীস নামধারীরা লেনদেন বিষয়ক হাদীসের ফেক্বাহ তথা এর গূঢ়তত্ত্বে সামান্যতম জ্ঞান রাখে না। হাদীস ও আহ্‌লে সুন্নাতের নীতিমালা অনুসারে হাদীস থেকে একটি মাসায়ালা বা একটি শরয়ী বিধান নির্গত করতে তারা সক্ষম নয়। তাদের মৌখিক দাবি অনুযায়ী আমল ও সুন্নতের অনুসরণের পরিবর্তে কেবল শয়তানী চক্রের অনুকরণই যথেষ্ট মনে করে। ”

( আল-হিত্তাহঃ পৃ – ৫১ )

তিনি আরও লিখেনঃ

“ তাদের মধ্যে যদি নিষ্ঠা থাকত তাহলে কেবল প্রথাগত আহলে হাদীস আর নামে মাত্র কুরআন-কিতাবের অনুসারী হওয়াই যথেষ্ট মনে করতো না। ”

( আল-হিত্তাহঃ পৃ – ১৫৬ )

৯।

উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই বা এ মতবাদ গ্রহণ করলেই অথবা আহ্‌লে হাদীস নামকরণেই প্রকৃত অর্থে “ আহলে হাদীস ” হওয়া যায় না। বরং এর জন্য চাই অসীম ত্যাগ ও পরিপূর্ণ যোগ্যতা। আরও বুঝা গেল যে, বর্তমানে যাদের নাম “ আহলে হাদীস ” তারা কাজে ও বাস্তবে আহলে হাদীস নয়, তাদের নামে আর কাজে কোন মিল নেই। কেবল সরলমনা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ হিসেবে এ নামটি গ্রহণ করেছে। যেমন-জামের ন্যায় কালো মানুষের নামও অনেক সময় লাল মিয়া বা সুন্দর আলী রেখে থাকে।

সত্যিকারার্থে “ আহলে হাদীস ” নামটি তারা তৎকালীন বৃটিশ সরকারের মাধ্যমে এর প্রকৃত অর্থ থেকে আত্নসাৎ করে নিয়েছে নিজেদের জন্য, যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদেরকে পূর্বের যুগের প্রকৃত “ আহলে হাদীস ” মনে করে প্রতারিত হয়।

কিছু কথাঃ

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যারা আহলে হাদীস নামধারী তারা অনেকেই তাদের নিজেদের প্রকৃত ইতিহাস জানে না। আমার এই পোস্টের মাধ্যমে যদি অন্তত একজন মানুষও যদি সত্য ইতিহাস জানতে পারে ও বুঝতে পারে, তাতে আমি এই পোস্টটিকে স্বার্থক মনে করব। এখানে আহলে হাদীসদের নিজেদের আলেমদেরও বিভিন্ন মতামত ও দলীল উল্লেখ করা হয়েছে, যা দ্বারা স্পষ্ট যে আহলে হাদীস নামটি ইংরেজদের দ্বারাই সৃষ্ট এবং ইতিহাস বলে তারা ইংরেজদের দালালী করে এসেছে, ইংরেজদের অধীনে মুসলমানদের থাকাকে যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে থাকার চেয়েও উত্তম মনে করে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদ রোধ করার জন্য গ্রন্থ রচনা করে সেখানে জিহাদ মানছুখ বা রহিত প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।

এই যাদের ইতিহাস তারা কিভাবে কোরআন ও সুন্নাহর সঠিক অনুসরণের দাবী করে, তা আমার কেন অনেক সত্যানুরাগী মুসলমানদেরই বুঝে আসে না ‍‍!!

Imran Khan @azad :

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদ, হাদীসের জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজন স্বীকৃত ইমাম বিশেষত হাদীস যাচাই-বাছাই বা ইল্মুল্ জারহ্ অ-তা’দীলের অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্যাসাগর ইয়াহ্ইয়া ইবনে মঈন (রহঃ)।

কিন্তু অসীম জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বল্গাহীন পথ পরিহার করে ইমাম আবু হানীফার তাক্বলীদ করে চলতেন।

এ সম্পর্কে তাঁর নিজের মত দেখুনঃ

“ আমার নিকট গ্রহণযোগ্য ক্বিরাআত হামযার ক্বিরাআত এবং গ্রহণযোগ্য ফিক্বহ ইমাম আবু হানিফার ফিক্বহ। সকল মানুষকেও আমি এর উপর ঐক্যবদ্ধ পেয়েছি। ”

( তারিখে বাগদাদঃ পৃ – ১৩/৩৪৭ )

ইমাম ইবনে মঈন (রহঃ) এর মায্হাব সম্পর্কে ইমাম যাহাবী বর্ণনা করেনঃ

“ ইয়াহইয়া ইবনে মঈন জারহ অ-তা’দীলের ইমাম এবং শীর্ষস্থানীয় হানাফীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ”

-মা’রিফাতুল্ মুতাকাল্লাম ফীহিম…যাহাবীঃ পৃ – ৭, ছাপা, মিশর ১৩২৪ হিঃ

ইবনে মঈনের প্রশংসা করতে গিয়ে ইমাম আহ্মাদ (রহঃ) বলেনঃ

“ ইমাম ইবনে মঈন যে হাদীস সম্পর্কে জানেন না সেটি হাদীস নয়। ”

বস্তুত ইমাম ইবনে মঈন হাদীসের বর্ণনাকারীর সত্যায়ন ও হাদীসের যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সত্যিই অতুলনীয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, অবশ্যই যাচাই-বাছাই করতঃ হাদীসের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ও বিশুদ্ধ মায্হাব হিসেবেই তিনি হানাফী মায্হাবকে মনোনীত করেছেন। অতএব, যারা বলে, হানাফী মায্হাব বিশুদ্ধ হাদীস পরিপন্থী, তাদেরকে ন্যায়পরায়ণতা ও আল্লাহর ভয় নিয়ে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রশ্নঃ

যদি মাযহাব মানা শিরক হয়ে থাকে, তাহলে ইমাম ইবনে মঈন শিরক করেছেন, ফলে তিনি কাফির হয়ে গিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)। এখন, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম তাদের হাদীসগ্রন্থে তাদের এই উস্তাদ থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। প্রশ্ন হল,

১। একজন কাফের (!!) থেকে হাদীস নেওয়া জায়েয কি না ?? জায়েয হলে, কোরআনের কোন আয়াত বা কোন হাদীস দ্বারা তা জায়েয, প্রমাণ করুন।

২। আর যদি জায়েয না হয়, তাহলে তো এই উস্তাদ থেকে বর্ণিত বুখারী মুসলিমের অনেক হাদীসই সহীহ থেকে সরে এসে দুর্বল এমনকি জালই হয়ে যাবে !! তাহলে ঐসব ব্যক্তিগণ যারা মাযহাব মানাকে শিরক বলেন, তারা কি কখনো বুখারী মুসলিমের হাদীসকে জাল বলেছেন বা মানেন কি না যে বুখারী মুসলিমের সব হাদীস সহীহ না ??

৩। তাহলে বুখারী মুসলিম সিহাহ সিত্তার প্রধান ২টি কিতাব হল কি করে ??

৪। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম একজন কাফেরের (!!) কাছ থেকে হাদীস শিখেছেন। এরকম ব্যক্তির সংকলিত হাদীসগ্রন্থ মানা যাবে কি না ?? মানা গেলে, তা কেন মানা যাবে ??

আহলে হাদীস নাম ইংরেজের বরাদ্দকৃতঃ

১।

বর্তমানে অবশ্য গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্‌হাবী বা সালাফী নামে আত্নপ্রকাশ করে সউদী রিয়াল, দিনার, দিরহাম উপার্জনের মোহে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু ১২৪৬ হিজরীতে, তাদের উদ্ভবের সূচনালগ্নে যখন তেল পেট্রোলের পয়সার জমজমাট ছিল না, ওহ্‌হাবীদেরই যখন দুর্দিন দুর্ভিক্ষ চলছিল, বিশেষ করে ভারতবর্ষে ইংরেজ-বিরোধী ও ইংরেজ বিতাড়নের জিহাদে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে ইংরেজ সরকার ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করেছিল, তখন গাইরে মুক্বাল্লিদরা ওহ্হাবী নামের আখ্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাই তারা তখন নিজেদের জন্য “ মুহাম্মদী ” এবং পরবর্তীতে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করার সম্ভাব্য সকল অপতৎপরতা চালিয়ে গিয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের তৎকালীন অন্যতম মুখমাত্র মৌলভী মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভী লাহোরী বৃটিশ সরকারের প্রধান কার্যালয় এবং পাঞ্জাব, সি-পি, ইউ-পি, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাঙ্গালসহ বিভিন্ন শাখা অফিসে ইংরেজ প্রশাসনের আনুগত্যতা ও বশ্যতা স্বীকার করত: তাদের জন্য “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ দেয়ার দরখাস্ত পেশ করেন । এ দরখাস্তগুলোর প্রতি উত্তর সহ তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত তৎকালীন “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হয় যা পরে সাময়ীক নিবন্ধ আকারেও বাজারজাত করা হয়।

( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

২।

তাদের মানসিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিছুটা আঁচ করার জন্য পাঠক সমীপে তন্মধ্য হতে একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে পেশ করছিঃ

“বখেদমতে জনাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী,

আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও পার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “ এশায়াতুস সুন্নাহ ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহ্হাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে “ আহলে হাদীস ” বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।

অতএব, এ দলের প্রতি ওহ্হাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভার্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহ্হাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “ আহলে হাদীস ” সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন

সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ

দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্যে “ ওহ্হাবী ” শব্দের পরিবর্তে “ আহলে হাদীস ” নাম বরাদ্দ করেছে। এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “ আহলে হাদীস ” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়।

৩।

ক) সর্বপ্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডাব্লিউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন।

খ) অতপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ইং সি,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে

গ) এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ ইং ইউ,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে

ঘ) এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে

ঙ) এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮ মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং-১২৭ এর মাধ্যমে

চ) এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভীকে অবহিত করা হয়।

( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ৩২-৩৯, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

৪।

কোন মুসলিম জামাতের নাম অমুসলিম, মুসলামানদের চিরশত্রু খৃষ্টান নাছারাদের মাধ্যমে বরাদ্দ করার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিরল। যা কেবল হিন্দুস্তানী গাইরে মুক্বাল্লিদদেরই গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয় (!) তাই তারা এ ইতিহাসটা অত্যন্ত গৌরবের সহিত নিজেরদের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে তৃপ্তি লাভ করেছেন।

আহলে হাদিস গুরুপের উৎপত্তির ছহীহ ইতিহাস

ইংরেজদের ষড়যন্ত্রঃ ইতিহাস সাক্ষ্য ইংরেজরা আসার আগে এই উপমহাদেশে মাযহাবের বিরোধিতা ছিলনা। ধর্মীয় কোন্দল ছিলনা। টিপু সুলতান, মোঘল সম্রাজ্যের সকল মোঘল বাদশা, শাহজাহান, ঘুরি, জাহাঙ্গীর, বাদশা যফরসহ সকলেই হানাফী মাযহাবী ছিলেন। এ উপমহাদেশে যত মুসলিম হাকিম বংশীয়, যত গোলাম বংশীয় আর যত ঘুরি বংশীয়, আর যত খিলজী বংশীয়, সাদাত বংশীয়, তুঘলোক বংশীয়, আর সুরী অথবা মোগল বংশীয় বাদশা ছিল, সবাই ছিলেন সুন্নী হানাফী। ..... (তরজুমানে ওহাবিয়া-২৫)

যখন ইংরেজরা আসল। ওরা দেখল এদেশের মুসলমানরা তাদের ধর্মের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ। তাদের মাঝে কোন অভ্যান্তরীণ বিভেদ নাই। একতার এক স্বর্গীয় বাঁধনে তারা জড়িয়ে আছে। তাই ইংরেজরা তাদের বহুল প্রচলিত “ডিভাইট এন্ড রোলস” তথা “পরস্পরে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের উপর শাসন করা হবে” এই নীতি বাস্তবায়িত করতে উঠেপরে লেগে গেল। মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় বিভেদ-কোন্দল সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল। টাকা দিয়ে, অর্থ সম্পদ দিয়ে, বিত্ত-বৈভব দিয়ে কিছু দুনিয়ালোভি আলেমদের নির্বাচিত করে।

একদিকে হুসাইন আহমাদ মাদানী ছাহেবের ফাতওয়া যে, “ইংরেজদের দলে ঢুকা হারাম”। আর আশরাফ আলী থানবী ছাহেবের ফাতওয়া, “ইংরেজদের পণ্য ব্যবহার হারাম”। অপরদিকে ইংরেজরা একদল ঈমান বিক্রেতাদের ক্রয় করে নিল। ইংরেজদের পক্ষে একজন কিতাব লিখল- “আল ইকতিসাদ ফি মাসায়িলিল জিহাদ”। যাতে সে লিখে যে, ইংরেজদের শাসন ইসলামী রাষ্ট্র। আর ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম। এই বই লিখার পর তাকে ‘শামসুল উলামা উপাধী’ দেয়া হয়, তাকে মেডেল দেয়া হয়। অনেক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

ওহাবী সম্বোধনঃ যখন এদেশের মানুষ দেখল যে, ওরা ইংরেজদের দালালী করেছে। তখন তাদেরকে “ওহাবী” বলে গালি দেয়া শুরু হয়। ওহাবী সেই যুগে তাদের বলা হত- যারা দেশের গাদ্দার। দেশদ্রোহী। ওরা যেখানেই যেত সাধারণ মানুষ তাদের দেখে বলত- এইতো ওহাবী চলে এসেছে।

আহলে হাদীছ নামকরণঃ এভাবে যখন তাদেরকে সবাই ঘৃণার চোখে দেখতে লাগল, তখন নিজেদের সম্মানিত করার জন্য ওরা রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে গিয়ে আবেদন করল যে, আমরাতো আপনাদের কথা অনুযায়ী কিতাব লিখে আপনাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হারাম বলেছি, এখন আমাদের সবাই ধিক্কার দিচ্ছে। গালি দিচ্ছে “ওহাবী” বলে। আমাদের জন্য সম্মানজক কোন পদবীর ব্যবস্থা করুন। তখন তাদের নাম দেয় রাণী ভিক্টোরিয়া “মুহাম্মদী” এবং পরবর্তীতে “আহলে হাদীস”। (এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ২৪-২৬, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

পাঠকের সুবিধার্থে ওহাবী থেকে আহলে হাদীছ পদবী পাওয়ার একটি দরখাস্তের অনুবাদ নিম্নে তুলে ধরা হলঃ

“বখেদমতে জনাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী,

আমি আপনার খেদমতে লাইন কয়েক লেখার অনুমতি এবং এর জন্য ক্ষমাও পার্থনা করছি। আমার সম্পাদিত মাসিক “ এশায়াতুস সুন্নাহ” পত্রিকায় ১৮৮৬ ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওহ্হাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমক হারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার সমীচিন হবে না, যাদেরকে “আহলে হাদীস” বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমক হালালী, আনুগত্যতা ও কল্যাণই প্রত্যাশা করে, যা বার বার প্রমাণও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি প্রত্রে এর স্বীকৃতিও রয়েছে।

অতএব, এ দলের প্রতি ওহ্হাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং সাথে সাথে গভার্মেন্টের বরাবর অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এ ওহ্হাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর এর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক এবং এ শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” সম্বোধন করা হোক।

আপনার একান্ত অনুগত খাদেম

আবু সাঈদ মুহাম্মদ হুসাইন

সম্পাদক, এশায়াতুস সুন্নাহ

দরখাস্ত মুতাবেক ইংরেজ সরকার তাদের জন্যে “ ওহ্হাবী ” শব্দের পরিবর্তে “আহলে হাদীস” নাম বরাদ্দ করেছে। এবং সরকারী কাগজ-চিঠিপত্র ও সকল পর্যায়ে তদের “আহলে হাদীস” সম্বোধনের নোটিশ জারি করে নিয়মতান্তিকভাবে দরখাস্তকারীকেও লিখিতভাবে মঞ্জুরী নোটিশে অবহিত করা হয়- ক) সবর্প্রথম পাঞ্জাব গভার্মেন্ট সেক্রেটারী মি: ডাব্লিউ, এম, এন (W.M.N) বাহাদুর চিঠি নং-১৭৫৮ এর মাধ্যমে ৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৬ ইংরেজিতে অনুমোদনপত্র প্রেরণ করেন। খ) অতপর ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ইং সি,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৪০৭ এর মাধ্যমে গ) এবং ২০শে জুলাই ১৮৮৮ ইং ইউ,পি গভার্মেন্ট চিঠি নং-৩৮৬ এর মাধমে ঘ) এবং ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ ইং বোম্বাই গভার্মেন্ট চিঠি নং-৭৩২ এর মাধ্যমে ঙ) এবং ১৫ই আগষ্ট ১৮৮৮ মাদ্রাজ গভার্মেন্ট চিঠি নং-১২৭ এর মাধ্যমে চ) এবং ৪ঠা মার্চ ১৮৯০ ইং বাঙ্গাল গভার্মেন্ট চিঠি নং-১৫৫ এর মাধ্যমে দরখাস্তকারী মৌলভী আবু সাইদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালভীকে অবহিত করা হয়। ( এশায়াতুস সুন্নাহঃ পৃ: ৩২-৩৯, সংখ্যা: ২, খ: ১১)

এদের ভন্ডামী ও গোড়ামীর একাংশঃ

• এরা যা আমল করে সেগুলো সহীহ হাদীছ। যা করে না তা বেদয়াতী, কুফরী, শিরকী আমল। অথচ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই।

• যে সমস্ত হাদীছ তাদের দলের/মতের পক্ষে সেগুলোকে বলে ছহীহ হাদীছ। আর যে হাদীছগুলো তাদের মতের বিরুদ্ধে যায় সেগুলো ছহীহ হলেও তারা বলে এটা জাল হাদিস। (নাউযুবিল্লাহ)

• বুখারী শরীফ খুলে যা বুঝবে তাই আমল করবে। কাউকে অনুসরণ করবে না বা কোন বিশেষজ্ঞদের নিকট জ্ঞান অন্বেষণ করবেনা। অথচ তারা তাদের নেতা জঙ্গি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী, একাধীন মামলায় জর্জরীত ড. গালিব ওরফে গালিযসহ অন্যান্য নেতাদের পুজা/অনুসরণ ঠিই করে।

• মাযহাব মানা বেদয়াত ও নাজায়েয। অথচ মাযহাব অনুসরণ করেছিলেন বুখারী, মুসলিম, তিরিমীযী, আবু দাউদ, নাসাঈ সহ সমস্ত হাদীছ শরীফ এর লিখকগণ এবং হক্কানী রব্বানী আলিম ওলামাগণ সকলেই। এমনকি মদীনা শরীফে মালেকী মাযহাব এবং মক্কা শরীফে হাম্বলী মাযহাবের প্রচলন রয়েছে।

• বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, রমযান এলে বেনামাযী নামাযী হয়ে যায়। ফরজ যারা পড়তেন তারা নফল পড়া শুরু করেন। সকল আমলকে বাড়িয়ে দেন। যে কুরআন পড়েনা, সেও কুরআন পড়তে শুরু করে। যে নফল দুই রাকাত পড়ত সেও ৪ রাকাত বা বেশি পড়তে থাকে। কিন্তু এই নাফরমান, ওহাবী, গায়রে মুকাল্লিদ, আহলে হাদীছ গ্রুপ ২০ রাকাত তারাবীহকে কমিয়ে ৮ রাকাত পড়ে। তারা যে বুখারী শরীফের দলীল যে তাতে তারাবীর নামাযের কথা নেই। মক্কা-মদীনা শরীফেও ২০ রাকাত তারাবীহ পড়া হয়। মুলতঃ তারাবীর নামায বিশ রাকায়াত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম-এর যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। (মুসান্নেফ ইবনে আবী শায়বা ২/২৮৬, আবু দাউদ ১/২০২, বাইহাকী ২/৯৬)

ফেতনাবাদ এই দলের অযৌক্তিক প্রশ্ন “তোমরা মুহাম্মদী না হানাফী”?

ওদের এই প্রশ্নটিই একটা ধোঁকাবাজি ও ফেতনার শামিল। এরকম প্রশ্ন মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়, আজ শনিবার নাকি ৫ তারিখ? আজ নভেম্বর নাকি রবিবার? প্রশ্ন হবে সামঞ্জস্যতামূলক আজ শনিবার নাকি রবিবার? আজ নভেম্বর নাকি ডিসেম্বর? সুতরাং এক্ষেত্রেও প্রশ্ন হবে-“তুমি মুহাম্মদী না ঈসায়ী? তুমি হানাফী না শাফেয়ী?” কিন্তু একথা বলা ভুল- আজ নভেম্বর না শনিবার? তুমি হানাফী না মুহাম্মদী?”

আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। এরা মুহাম্মদি পরিচয় দিতে চায় কিন্তু আমরা উপরে ইতিহাস পড়েছি যে, এরা কথিত আহলে হাদীছ যারা ছিল ইংরেজদের দালাল তথা ওহাবী ।

এরা সন্দেহ সৃষ্টির এক ভয়ানক দল:

আহলে হাদীস গ্রুপ ইংরেজদের হওয়ার কারণে, নবীজির শান মুবারকে মানহানি ও সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সমালোচনায়, এবং জঙ্গিপনায়, দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত। এসবের দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং যেই লোকগুলো নামায পড়ছে তাদের মনে ওয়াসওয়াসা তথা সন্দেহ সৃষ্টি করে দিয়ে বলছে যে, তোমাদের নামায হয়না। তোমাদের নামায মুহাম্মদী নামায নয় হানাফী নামায। এদের ওয়াসওয়া থেকে আশ্রয়ের জন্য আল্লাহ তায়ালা শিক্ষা দিয়েছেন যে, যারা মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা তথা সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় মানুষ ও জিন জাতির মধ্য থেকে তাদের থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। {সূরা নাস-৫-৬}

তথাকথিত আহলে হাদীছ নেতাদের সম্পর্কে জাতীয় পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তার একাংশ:

সোনালী ব্যাংকের আরো ঋণ জালিয়াতির তথ্য ফাঁস

ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (বাসস) : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক অর্থ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তকালে আরো কিছু কোম্পানীর বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। .....

অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, সম্পদের বিষয়ে তথ্য গোপন, অর্থ পাচার ও প্রতারণার অভিযোগে দুদক গত এক মাসে জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ মোট ৫৮ জনের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- এনজিও’র মাধ্যমে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে তার অপব্যবহার করার অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপসারিত শিক্ষক ড. আসাদুল্লাহ গালিবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের। (বাসস সংবাদ সংস্থা)

আহলে হাদীস আন্দোলন নেতা গালিবের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ আহলে হাদীস আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় থেকে বেআইনীভাবে ব্যবসায় জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। .... মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কুয়েতের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও সমাজ কল্যাণের স্বার্থে ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১৭ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকার পে-অর্ডার দেন। ওই পে-অর্ডার ড. গালিব নিজের নামে খোলা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড রাজশাহী শাখায় (হিসাব নম্বর-১৭৪৮) জমা করে পরবর্তীতে ব্যাংক হতে অর্থ তুলে বিভিন্ন খাতে খরচ করেন।

সরকারী বেতনে নিয়োজিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং দ-বিধির ২১ ধারা অনুযায়ী পাবলিক সারভেন্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তাওহীদ ট্রাস্ট গঠন করে চেয়ারম্যান/আমির পদে নিয়োজিত থেকে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ টাকার নির্মাণ কাজের চুক্তি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারী কর্মচারী হয়ে বেআইনী ব্যবস্থায় জড়িত হয়েছেন, যা দ-বিধির ১৬৮ ধারার অপরাধ বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সরকারী কর্মচারী হিসেবে বহাল থেকে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে লাভজনক বেসরকারী এনজিওর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ ২ নম্বর আইনের ৫ (১) (ডি) বর্ণনামতে ওই আইনের ৫ (২) ধারার অপরাধ করেছেন বলেও এজাহারে বলা হয়।

(২৪-০৮-২০১২, দৈনিক জনকণ্ঠ, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো সহ সকল জাতীয় পত্রিকা)

দুর্নীতি মামলায় জামিন পাননি ড. গালিব

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর, ২৯ আগস্ট, ২০১২, ঢাকা: আহলে হাদিস আন্দোলনের আমির ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিবের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলায় জামিন আবেদন উপস্থাপিত হননি মর্মে খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ...

প্রসঙ্গত, জঙ্গি মদদদানের অভিযোগে ২০০৫ সালে ড. গালিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একাধিক মামলা। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তবে ২০০৮ সালে তিনি জামিনে ছাড়া পান। ...

বিষয়: বিবিধ

১১৩৪৯ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

161085
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১৬
বুড়া মিয়া লিখেছেন :
বিশাল আকারের লেখা! তবে খারাপ হয় নাই, যুক্তিগুলোও সুন্দর-ই হয়েছে।

এখন যে যোগাযোগ মাধ্যম, হাদীস-কুর’আন এর শব্দ-অর্থ-ক্ষেত্র-প্রয়োগ ইত্যাদী বিচার-বিশ্লেষনের যে আধুনিক উপায় তাতে করে গবেষনার জন্য এখন সময়ও অনেক কম লাগে এবং কষ্টও পোহাতে হয় অনেক কম। এক এস.কিউ.এল দিয়াই এই সব তামা-তামা কইরা ফেলা যায় ধুপ-ধাপ। সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুবই সহজ – ইচ্ছাটাই এখন মূখ্য।

কবে যে ইচ্ছা করবে সবাই সেটাই দেখার বিষয়।
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২২
115441
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : এখন ওলামায় দেওবন্দ আর জামাতে ইসলামের ঐক্য করা ফরজে আইন। ফেতনাবাজ, বেদাতী, জে.এম.বি বোমাবাজ আহলে হদস তাদের মুনাফেকী খাসলত ত্যাগ করতে না পারলে মুসলিম উম্মাহর কোনই দরকার নেই তাদের মত ভুইফোর সংগঠন কে।
161090
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২২
লাঠীপেটা লিখেছেন : আচ্ছা ইমাম গনেরা কোন মাজাদের অনুসারী ছিলেন?
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৭
115443
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : পোষ্ট ভাল করে পড়লেই জবাব পেয়ে যাবেন।
161095
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩২
লাঠীপেটা লিখেছেন : ডঃ গালিবের লগে মাজাবের সম্পর্ক কি?
ডঃ জাকির নাইকের সমালোচনা করে নাস্তিকেরা নাস্তিকতার জন্য কিন্তু আপনারা কেনো সমালোচনা করেন?
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৬
115445
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : ড.জাকির নায়েক নি:সন্দেহে এ যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ দায়ী ইলাল্লাহ বাট আলেম নয়। ইসলামের প্রতি তার দাওয়াতী কার্যক্রম নি:সন্দেহে কবুল যোগ্য কিন্তু তার মাযহাবের বিরোধীতা করা নিরেট মূর্খতা। ওলামায় দেওবন্দ তার মাযহাব বিরোধীতা করা ছাড়া বাকী সকল কাজের পূর্ণ সমর্থক এবং দোয়া দাতা।
161099
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৮
লাঠীপেটা লিখেছেন : পবিত্র কোরইন ও সহিহ হাদিসের আলোকে চলবো তার জন্য যদি ওহাবী সালাফী লামাজাবি হতে হয় হবো কিন্তু আমি একজন মুলসিম সেটা আমার বড় পরিচয়.
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪০
115446
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : তাতে যে আপনি মুসলিম থাকতেই পারবেন না, সেটা আমার সকল পোষ্ট পড়লেই জানতে পারবেন।
161100
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৯
ইশরাত জাহান রুবাইয়া লিখেছেন : লেখাগুলো পর্ব আকারে দিলে ভালো হয়।
এতে পাঠকদের পড়তে সুবিধা হয়। Happy
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৪
115448
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : ধন্যবাদ আপু। আরো কয়েকটি পর্ব দিয়ে একটি একটি সিরিয়াল সাজিয়ে উপসংহার টানবো কিছু দিন পর।
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫০
115452
ইশরাত জাহান রুবাইয়া লিখেছেন : আমি বলতে চাইছিলাম, এ্ই লেখাটাও অনেক বড় হয়ে গেছে। এই লেখাটাই প্রায় ৩ পর্বের সমান বড়। আপনার সব লেখাগুলিই এত বড় হয়ে যাওয়ার কারণে শুরুতেই হয়তো কোন কোন পাঠক মনোযোগ দিয়ে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। Worried

মুফতী ত্বাকী উসমানী সাহেবের "মাযহাব কি এবং কেন" বইটির পিডিএফ লিংক থাকলে শেয়ার করবেন। Happy
১০ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০৮:৩৬
115497
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : ওহ ! সত্যানসন্ধানী হলে তো একটু কষ্ট করতে হবেই ! পিডিএফ পেলামনা আপু, তবে ডাউনলোড লিঙ্ক আছে-

মাওলানা তাকী উসমানীর ও মাওলানা সাঈদ আল-মিসবাহ মাযহাব বিষয়ক দুটি চমৎকার বই-এর ডাউনলোড লিঙ্কঃ
১. http://www.banglakitab.com/BanglaBooks/SchoolOfThoughts-WhatAndWhy-Part1.pdf
২. http://www.banglakitab.com/BanglaBooks/SchoolOfThoughts-WhatAndWhy-Part2.pdf

*মাযহাব বিষয়ে ইংরেজীতে লিখা দুটি চমৎকার আর্টিক্যাল
১. https://sites.google.com/site/allahiseloi/the-four-madhabs-the-schools-of-thoughts
২. http://thinkhanbali.wordpress.com/2010/08/16/following-a-madh-hab/
161103
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪১
লাঠীপেটা লিখেছেন : যদি সহিহ হাদিস পাওয়ার পর ও মাযাব মানি তা হলে জেলের পায়ের গোড়ালী খেতে হবে সেটা বিবেকবান মুসলিম কখনো করবেনা
১০ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৮
115451
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : এ জন্যই আপনাকে বলেছি এই পোষ্ট এবং আমার পূর্ববর্তী সকল পোষ্ট ভাল করে পড়ুন। কারন আপনি মাযহাব ই বুঝেন নি। মাজহাব সহীহ হাদীস এর বিরোধী কোন মত নয়, বরং একাধিক বিপরীত মুখি সহিহ হাদীসের সমন্নয় সাধন। যাকে ফলো না করলে আপনি একটি সহিহ হাদীসের উপর আমল করতে গিয়ে আরেক সহিহ হাদীসকেই বয়কট করে ফেলবেন। তখন সোয়াবের পরিবর্তে আপনার অজান্তেই গুনাহগার হয়ে যাবেন !
293721
১২ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:২০
আঃ হাকিম চাকলাদার লিখেছেন : মাজহাব মানা ফরজ নয়, এখানে দেখুন।
http://www.youtube.com/watch?v=K50ldRZLeNw
১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:১৭
237448
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : পোষ্ট না পড়েই মন্তব্য করেন কেন ? মাজহাব মানা ওয়াজিব। আমার সকল পোষ্ট পড়ুন তাইলেই জানতে পারবেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File