মতিউর রহমান মাদানীর দাবিঃ তাকলীদ শব্দ কুরআনে নেই তাই তাকলীদ আবশ্যক নয়!

লিখেছেন লিখেছেন সঠিক ইসলাম ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১১:৫৫:৩০ রাত

প্রশ্ন

আজকে শায়েখ মতীউর রহমান মাদানীর “দেওবন্দী আকিদাহ” নামে একটি ভিডিও লেকচার শুনলাম। এর এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন যে, দেওবন্দীদের কিতাবে যে কোন এক ইমামের তাকলীদ করাকে ফরজ বলা হয়েছে। যারা চার ইমামের মাঝে যে কোন এক ইমামের তাকলীদ করে না সে গোমরাহ।

তার ভাষায় বলতে গেলে তিনি বলেন- “তাকলীদ যদি ফরজ হয়, তাহলে কুরআনে কারীমের কোথাও না কোথাওতো একবার হলেও তাকলীদ শব্দ আসতো। কিন্তু আপনি যদি পুরো কুরআন পড়ে শেষ করে দেন, তবু তাকলীদের কথা পাবেন না। অথচ রোযা ফরজ, রোযার কথা কুরআনে কতবার এসেছে? অনেক আয়াতে এসেছে তাই না? হজ্ব ফরজ। হজ্বের কথা কুরআনের কত আয়াতে এসেছে তাই না?

যারা এসব কথা বলেন, তাদের বলুন, হুজুররা আপনারা কুরআনের একটি আয়াত দেখান যেখানে তাকলীদ শব্দ আছে। যদি ফরজ হতো তাহলে কুরআনেতো তাকলীদ শব্দ থাকতো। নতুবা হাদীসেতো তাকলীদ শব্দ থাকতো। হাদীসের কোথাও কি তাকলীদ শব্দ আছে?”

শায়েখ মতীউর রহমান মাদানীর উক্ত যুক্তির সঠিক ব্যাখ্যা জানিয়ে কৃতার্থ করার জন্য অনুরোধ করছি।

আহমাদ আলী, ঢাকা বাংলাদেশ।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

এরকম জাহিল আর অজ্ঞদের লেকচার শুনে আপনাদের মূল্যবান সময় কেন নষ্ট করছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। মুর্খতা আর বাগাড়ম্বরতার কি পরাকাষ্ঠা তিনি প্রদর্শন করেছেন তা দেখে আমরা স্তম্ভিত।

তিনি বলছেন যে, রোযা ফরজ। রোযার কথা কুরআনে কারীমে এসেছে। কোথায় রোজা শব্দ এসেছে? কুরআন বা হাদীসের কোন স্থানে রোযা শব্দ আছে? আছেতো সাওম শব্দ। তার মতেতো হুবহু শব্দ থাকা জরুরী কোন কিছু সাব্যস্ত হওয়ার জন্য। তাহলে তিনি নিজেই কোন যুক্তিকে রোযা ফরজ বলে কুরআনের সাওম সম্পর্কিত আয়াত উপস্থাপন করছেন? হুবহু রোযা শব্দ সম্বলিত আয়াত কেন তার লেকচারে উদ্ধৃত করলেন না?

তাকলীদের হুবহু শব্দ যিনি তালাশ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তাকলীদ ফরজ বলে। সেখানে রোযা ফরজ বলে রোযার হুবহু শব্দ কুরআন ও হাদীসে খোঁজার পরামর্শ দেয়ার কথা কেন ভুলে গেলেন? কেন নিজেই রোযার ফরজ প্রমান করতে সাওম ফরজ হওয়ার আয়াত পেশ করলেন?

ফিক্বহ মানেই হল গভীরতম জ্ঞান। যারা ফিক্বহ বিরোধী হবে তাদের থেকে আল্লাহ তাআলা আকল ছিনিয়ে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই এরকম দ্বিমুখী মুর্খতাসূলভ আচরণ প্রকাশ করলেন কথিত শায়েখ মতীউর রহমান মাদানী সাহেব।

“তাকলীদ শব্দ কুরআনে নেই তাই তাকলীদ ফরজ একথা ঠিক নয়” এই অজ্ঞতাসূচক মনোবৃত্তিই যদি তাকলীদ ফরজ না হওয়ার দলীল হয় মতীউর রহমান সাহেবের কাছে। তাহলে আমরাও অজ্ঞতার স্তরে নেমে এসে মতীউর রহমান সাহেবের কাছে প্রশ্ন রাখি-

প্রশ্ন নং-১

তাওহীদ এর উপর ঈমান যদি ফরজ হয়, তাহলে কুরআনের কোথাও তাওহীদ শব্দ নেই কেন?

তাওহীদ শব্দ কুরআনের কোথাও নেই, তাই তাওহীদের উপর ঈমান রাখা ফরজ নয়?

প্রশ্ন নং-২

জানাযার নামায যদি ফরজে কেফায়া হয়, তাহলে কুরআনের কোথাও জানাযা শব্দ নেই কেন?

জানাযা শব্দ কুরআনের কোথাও নেই, তাই জানাযা ফরজে কেফায়া নয়?

এরকম মুর্খতাসূলভ যুক্তি কেবল অজ্ঞ আর বিবেকশূণ্য ব্যক্তিদের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব ফিতনাবাজদের ফিতনা থেকে হিফাযত করুন।

মতীউর রহমান মাদানী সাহেবদের কাছে আমাদের এ প্রশ্নগুলোও পাঠিয়ে দিয়েন।

বিজ্ঞ ব্যক্তির তাকলীদ করে কুরআন ও হাদীস অনুসরণ যদি ফরজ না হয়ে থাকে, শুধুমাত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী আমলই একমাত্র পন্থা হয়ে থাকে, তাহলে নি¤েœর সহীহ হাদীসের উপর কেন তাদের আমল নেই? রাসূল সাঃ এর এসকল সহীহ হাদীসগুলোকে কেন তরক করে দেয়া হয়?



রাসূল সাঃ এর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা বুখারী শরীফের ১ম খন্ডের ৩৬ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ১৩৩ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। {দেখুন-সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২২২,২২৩, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৪৭}

ইংরেজরা যে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে, তাই তারা পাক্কা আহলে হাদীস! কারণ সহীহ হাদীসের উপর আমল করছে? আর আমরা যারা বসে বসে প্রস্রাব করে থাকি, তারা হাদীসের বিরুদ্ধবাদী!



বুখারীর ১ম খন্ডের ৩১ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ১২৩ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল সাঃ অজু করার সময় হাতের তালুতে পানি নিয়ে একই সাথে কুলি ও নাকে পানি দিতেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৮৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৫৭৮}

কুলি ও নাকে পানি দেয়ার জন্য আলাদা আলাদা পানি নেয়ার বর্ণনা না বুখারীতে আছে, না মুসলিমে আছে।

তাহলে এ সহীহ হাদীসটি কেন ছেড়ে দেন পন্ডিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা? সহীহ হাদীস মেনে হাতের তালুতে পানি নিয়ে একইসাথে কুলি ও নাকে পানি দেন না কেন? সহীহ হাদীস নিজেরাই ছেড়ে দিয়ে কোন সাহসে মানুষকে সহীহ হাদীস দেখে দেখে মানার মিথ্যা আহবান করছেন?



বুখারীর ১ম খন্ডের ১২২ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ১২৮ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যদি বেশি কষ্ট না হতো, তাহলে আমি প্রত্যেক নামাযের সাথে মেসওয়াক করার হুকুম দিতাম। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৮৪৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬১২}

ইমাম তিরমিজী রহঃ বলেন যে, এ হাদীস আঠার জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২২} কিন্তু তারপরও অধিকাংশ লোক নামাযের বদলে অজুর সাথে মেসওয়াক করে থাকে। কিন্তু কেউতো তাদের গোনাহগার বলে না। হাদীসে বলেছে নামাযের সাথে মেসওয়াকের কথা, আর করা হয় অজুর সাথে, এ উল্টো আমল কেন করা হয় সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে?



বুখারীর ১ম খন্ডের ৭৪ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ২০৫ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই হাদীস হল- রাসূল সাঃ নামাযের মাঝে স্বীয় নাতি উমামাকে বহন করে নামায পড়তেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৯৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১২৪০}

আর বাচ্চাদের বহন করা ছাড়া নামায পড়ার কোন স্পষ্ট বর্ণনা না বুখারীতে আছে, না মুসলিমে আছে। তাহলে কি যে সকল নামাযীগণ বাচ্চাদের বহন করা ছাড়া নামায পড়ে থাকে, তা মুত্তাফাক আলাই হাদীসের বিপরীত হওয়ার কারণে তাদের নামায বাতিল? আর এ সহীহ হাদীসের উপর ছেড়ে দেয়ার মানে কি?



বুখারী ১ম খন্ডের ৫৬ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ২০৮ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল সাঃ জুতা পরিধান করে নামায পড়তেন। জুতা খুলে নামায পড়ার কোন স্পষ্ট বর্ণনা বুখারী ও মুসলিমের কোথাও নেই। তাহলে কি যেসব খৃষ্টানরা জুতা পরিধান করে নামায পড়ে থাকে, তারা সকলে আপনাদের নিকট পাক্কা আহলে হাদীস? আর যেসব গায়রে মুকাল্লিদরা জুতা খুলে নামায পড়ে থাকে, তারা মুত্তাফাক আলাই হাদীসের উপর আমল না করার কারণে মুনকিরে হাদীস তথা হাদীস অস্বিকারকারী?



বুখারীর ১ম খন্ডের ৫৫ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ১৬৪ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই হাদীসে যে আজানের কথা এসেছে, তাতে তারজী’ নেই। অথচ আপনাদের গায়রে মুকাল্লিদওয়ালা মসজিদের আজানের মাঝে তারজী’ দিয়ে মুত্তাফাক আলাই হাদীসের সাথে বিরোধীতা করা হয় কেন?



বুখারীর ১ম খন্ডের ১০৩ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ২১৯ পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই বর্ণনায় সানার সময় “সুবহানাকাল্লাহুম্মা” এর স্থলে এসেছে “আল্লাহুম্মা বায়িদ বাইনী”। আর বুখারীর ১ম খন্ডের ১০৯ নং পৃষ্ঠা এবং মুসলিমের ১ম খন্ডের ২১৩ নং পৃষ্ঠার মুত্তাফাক আলাই বর্ণনায় রুকু ও সেজদার তাসবীহ “সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম” ও “সুবহানা রাব্বিয়াল আলা” এর বদলে অন্য তাসবীহের কথা এসেছে।

এসব মুত্তাফাক আলাই বর্ণনার উপর আমল না করার কারণে কি পুরো উম্মত গোনাহগার হচ্ছে?



ইমাম বুখারী রহঃ সহীহ বুখারীর ১ম খন্ডের ৪৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত উসমান রাঃ, হযরত আলী রাঃ, হযরত জুবায়ের রাঃ, হযরত তালহা রাঃ, হযরত উবাই বিন কা’ব রাঃ, হযরত আবু আইয়ুব রাঃ, এ ছয়জন সাহাবী থেকে হাদীস এনেছেন যে, যদি কেউ বিবির সাথে সহবাস করে, আর বীর্যপাত হওয়ার আগেই আলাদা হয়ে যায়, তাহলে উক্ত ব্যক্তির উপর গোসল করা ওয়াজিব নয়। এ ছয়জনের বিপরীত এক হযরত আবু হুরায়রা রাঃ এর হাদীস এনেছেন। যাতে এসেছে যে, এরকম অবস্থায় গোসল ওয়াজিব হয়ে যায়।

এখানে ছয়জন সাহাবী থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস ছেড়ে দিয়ে এক সাহাবীর বর্ণনা মেনে নেয়া হচ্ছে কোন নফসের তাকলীদ করে? ছয় সাহাবী থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস ছেড়ে দেয়ার নাম সহীহ হাদীসের উপর আমল?



“ইমাম বুখারী রহঃ বলেছেন যে, হযরত আনাস রাঃ এর হাদীস “আসনাদ” তথা সনদের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী। যে হাদীসে এসেছে যে, “উরু সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়”। এর মানে হল, উরু ঢাকা জরুরী নয়। আর জারহাদ এর হাদীস যাতে এসেছে যে, “উরু ঢাকা জরুরী” সেটি আহওয়াত তথা অধিক সতর্কতমূলক। অর্থাৎ এর উপর আমল করাটা সতর্কতামূলক। এভাবে আমরা উম্মতের মতবিরোধ এড়াতে পারি। {সহীহ বুখারী-১/৫৩, সালাত অধ্যায়, উরু সম্পর্কে বর্ণনার পরিচ্ছেদ}

তাহলে খেলার মাঠে যে সকল ছেলে মেয়েরা উরু বের করে খেলাধুলা করে থাকে, তারা উঁচু পর্যায়ের আহলে হাদীস? কারণ তারা সনদের দিক থেকে অধিক শক্তিশালী হাদীসের উপর আমল করছে! আর আপনারা যারা উরু ঢেকে নামায পড়েন, এখনো উরু ঢেকে আছেন তারাতো কেউ আর আহলে হাদীস বাকি থাকেন না”। কারণ আপনারা সহীহ হাদীস ছেড়ে দিচ্ছেন। কার তাকলীদে এ সহীহ হাদীস ছেড়ে দেয়া হয়?

১০

এমনিভাবে সেজদার সময় রফয়ে ইয়াদাইন করার হাদীস অনেক। সেই সাথে এ হাদীস সর্বসম্মত মতানুসারে সহীহ। এ কারণেই শায়েখ আলবানী লিখেছেনঃ وقد روى هذا الرفع عن عشرة من الصحابة তথা এ রফয়ে ইয়াদাইন দশ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। {সিফাতু সালাতিন নাবী-১৪৬} এমনিভাবে গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফক্বীহ ও উসূলী আবুল মুহাম্মদ আব্দুল হক আলহাশেমী আসসালাফী [মৃত্যু ১৩৯২ হিজরী] সাহেব স্বীয় কিতাব “ফাতহুল ওদূদ ফী তাহক্বীকি রফয়ে ইয়াদাইন ইনদাস সুজূদ” গ্রন্থে হযরত মালিক বিন আনাস রাঃ, হযরত আনাস বিন মালিক আনসারী রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ, হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ, হযরত উমায়ের বিন হাবীব রাঃ, হযরত হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ, হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন খাত্তাব রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাঃ এ নয়জন সাহাবী থেকে সেজদার সময় রফয়ে ইয়াদাইন করার হাদীস একত্র করেছেন।

এমনিভাবে প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ আলেম আবু হাফস বিন উসমান আলউসমানী সাহেব স্বীয় রেসালা “ফজলুল ওদূদ ফী তাহক্বীকে রফয়ে ইয়াদাইন লিস সুজূদ” এ উল্লেখিত নয়জন সাহাবীর হাদীস এনেছেন। আর ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস এর ৪ নং খন্ডের ৩০৬ নং পৃষ্ঠায় লিখা হয়েছে যে, রফয়ে ইয়াদাইন [সেজদার সময়] মানসূখ তথা রহিত হয়নি। বরং রাসূল সাঃ এর শেষ সময়ের আমল এটা ছিল। কেননা, মালিক বিন হুয়াইরিস রাঃ রাসূল সাঃ এর শেষ বয়সে মদীনায় সাক্ষাৎ করে। এরপর এমন কোন স্পষ্ট হাদীস পাওয়া যায় না, যার দ্বারা এটি রহিত হওয়ার কথা বুঝা যায়। {আব্দুল হক্ব ওয়া ফায়যুল কারীম সিন্ধী}

তাহলে অধিক বর্ণনা সমৃদ্ধ এ সহীহ হাদীসকে আপনারা কোন সাহসে আমল করা ছেড়ে দিয়েছেন। এর নাম সহীহ হাদীসের উপর আমলকারী? না নফসপূজারী?

তাকলীদের হাকীকতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

ভূমিকাঃ

এ লেখাটি মূলত জামিয়াতুল আস’আদের জেনারেল শিক্ষিতদের জন্য বিশেষ দাওয়া বিভাগের একটি ক্লাসের জন্য তৈর করা একটি লেকচার কপি। যা গত দু’টি ক্লাসে তাকলীদ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে। আলোচনাটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। তাই লেকচার শিটটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। ইনশাআল্লাহ আগামী ক্লাসগুলোতে আরো নতুন বিষয়ে আলোচনা হবে।

তাকলীদ বিষয়ক ক্লাসে যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তারই সারমর্ম বক্ষ্যমান লেখাটিতে স্থান পেয়েছে। যেহেতু প্রবন্ধ আকারে লেখা হয়নি। শুধু ক্লাসের লেকচারের জন্য তৈরী। তাই কিছুটা অসংলগ্নতা লেখাটিতে থাকতে পারে। তাই বিজ্ঞ পাঠকগণ তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আশা করি পূর্ণ লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে তাকলীদ বিষয়ক অনেক সন্দেহের অবসান ঘটবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল বাতিল ও ভ্রান্ত মতবাদের অপপ্রচার থেকে স্বীয় ঈমান ও আমলকে রক্ষা করে কবরে যাওয়া তৌফিক দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

তাকলীদের হাকীকত

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (2) الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (3) مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (4) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (5) اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (6) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ (7)

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু। যিনি বিচার দিনের মালিক। আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। {সূরা ফাতিহা-১-৭}

তাকলীদের হাকীকত বুঝার সহজ উপায় হল, আমাদের আকাবীরে দেওবন্দের কিতাব ভাল করে মুতালাআ করা। কারণ আমরা যতই কিতাব পড়ি না কেন, আমাদের পড়াশোনার দৌড় আকাবীরদের মুতালাআ পর্যন্ত পৌঁছা খুবই দুস্কর। মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহঃ, হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহঃ, হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ, শাইখুল আরব ওয়াল আজম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ, মুনাজিরে ইসলাম সরফরাজ খান সফদর রহঃ, মুনাজিরে ইসলাম মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ সহ আকাবীরে উলামাগণের লিখিত কিতাব পড়লে তাকলীদ বিষয়ে আমাদের সকল সন্দেহ-সংশয় দুরিভূত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আমাদের সমঝ, আর তাদের সমঝের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। নিজে নিজে শত কিতাব পড়ে যা বুঝে আসে না, তাদের একটি কিতাব পড়ে এরচে’ হাজার গুণ বেশি বুঝে আসে। কুরআন ও হাদীস নিজে নিজে পড়ে অনেকে ভ্রান্ত হয়ে থাকে। তাই বড়দের কিতাব পড়া সবার জন্য জরুরী। আল্লাহ তাআলা আমাদের আকাবীরে দেওবন্দের বাতলানো কুরআন সুন্নাহের পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন।

যদি কোথাও আকাবীরদের কোন ইবারত কুরআন বা হাদীসের বিপরীত মনে হয়, তাহলে এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করে নিলে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবে না।

সংক্ষেপে এখানে তাকলীদের হাকীকত উপস্থাপন করা হচ্ছে।

ইসলামী শরীয়তের বুনিয়াদী বিষয়

ইসলামী শরীয়তে বুনিয়াদী বিষয় হল দু’টি। যথা-১- আকায়েদ। ২- মাসায়েল।

আকায়েদের মাঝে বুনিয়াদী আক্বিদা হল, তাওহীদ। আর মাসায়েলের মাঝে বুনিয়াদী মাসআলা হল তাকলীদ।

যদি ব্যক্তি তাওহীদ না মানে, তাহলে তার রেসালাত মানার কোন ফায়দা নেই। তেমনি যদি কেউ তাওহীদ না মানে, তাহলে আখেরাত মানার কোন ফায়দাই নেই। কারণ আল্লাহর নবী দুনিয়াতে আসার মৌলিক কারণ হল, আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ তথা তাওহীদকে মানুষের কাছে পৌছে দেয়া।

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ [٦١:٩]

তিনি তাঁর রসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্যধর্ম নিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে একে সব ধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। {সূরা সফ-৯}

রাসূল সাঃ নবুওতপ্রাপ্তির পর সর্ব প্রথম যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা তাওহীদ নিয়ে। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছিলেন- يا أيها الناس قولوا لا إله إلا الله تفلحوا

অর্থাৎ হে লোক সকল! বল আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, সফলকাম হয়ে যাবে। {সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১৮৬, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫১৮, সহীহ ইবেন খুজাইমা, হাদীস নং-৮২, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৬০২৩}

নবীর কাজ হল, আল্লাহ তাআলার তাওহীদও শিক্ষা দিবেন। সেই সাথে মাসায়েলও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। নবী আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার মাধ্যম হয়ে থাকেন।

নবীর অনুগত্ব মূলত আল্লাহ তাআলাকে মানার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা নবীকে মানতে বলেছেন তাই নবীকে মানা আবশ্যক। তাই আকায়েদের মাঝে মূল হল তাওহীদ।

মাসায়েলের মাঝে বুনিয়াদী বিষয় হল তাকলীদঃ কেন?

কারণ হল, প্রত্যেক ব্যক্তি কুরআনের সকল আয়াতের অর্থ বুঝা, তার শানে নুজুল বুঝা, হাদীস বুঝা, হাদীসের সনদ মতনের পার্থক্য বুঝা। সনদ সম্পর্কে বক্তব্য বুঝা। জরাহ-তাদীল সম্পর্কে সম্মক অবগতি থাকা এটি সকল মানুষের জন্য অসম্ভব বিষয়। তাই এক্ষেত্রে তাকলীদ ছাড়া কোন গত্যান্তর নেই।

তাকলীদ কী জিনিস বুঝে আসলে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। শরীয়তের উপর আমল করা সহজ হয়ে যাবে যদি তাকলীদ করা হয়। নতুবা আমল করা হয়ে যাবে অসম্ভপর বিষয়।

সূরা ফাতিহা হল পুরো কুরআনের সারাংস। সূরা ফাতিহা প্রথমাংশে তাওহীদ। আর দ্বিতীয়াংশে তাকলীদ বর্ণিত হয়েছে।

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (২) الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (৩) مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (৪) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (৫) পর্যন্ত তাওহীদের কথা আলোচনা হয়েছে। কারণ এ পাচ আয়াতে সব ক’টিতেই আল্লাহ তাআলার সিফাত বর্ণিত। যা তাওহীদ প্রকাশক। আর এর পর বলা হয়েছে “আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ”।

সীরাতে মুস্তাকীম তথা সরল পথ বলতে কাদের পথ? আল্লাহ তাআলাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, যাদের উপর নিয়াম বর্ষিত করা হয়েছে, তাদের পথই হল সরল পথ তথা সীরাতে মুস্তাকীম।

কাদের উপর নিয়ামত বর্ষন করা হয়েছে? আমরা জানি, কুরআনের কতিপয় আয়াত কতিপয় আয়াতের তাফসীর হয়ে থাকে। আমরা দেখতে পাই আল্লাহ তাআলা নিয়ামাতপ্রাপ্ত বান্দা কারা? তাদের তালিকা কুরআনে কারীমে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ وَحَسُنَ أُولَٰئِكَ رَفِيقًا [٤:٦٩]

আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। {সূরা নিসা-৬৯}

তাহলে কী দাঁড়াল?

নবীগন যে পথে চলেন সে পথ মানেই সীরাতে মুস্তাকীম। আর তাদের গন্তব্য হল জান্নাত।

সিদ্দীকীন তথা সাহাবাগণ যে পথে চলেন সে পথ মানেই সীরাতে মুস্তাকীম। আর তাদের গন্তব্য হল জান্নাত।

শহীদগণ যে পথে চলেন সে পথ মানেই সীরাতে মুস্তাকীম। আর তাদের গন্তব্য হল জান্নাত।

সালেহ তথা বুযুর্গগন যে পথে চলেন সে পথ মানেই সীরাতে মুস্তাকীম। তাদের গন্তব্যও জান্নাত।

অর্থাৎ তারা যে পথে চলছেন সে পথে চললে তারা যেখানে গিয়ে পৌঁছবেন, আমরাও সেখানে গিয়ে পৌঁছবো। যেহেতু তাদের পথ সীরাতে মুস্তাকীম। আর তাদের গন্তব্য জান্নাত। তাই আমরা তাদের পথে চললে জান্নাতে পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয়টি আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে।

উদাহরণতঃ

গুলিস্তান থেকে জামিয়াতুল আস’আদে আসা এক ব্যক্তিকে পথের নির্দেশনা আমরা দেই যে, আপনি প্রথমে গুলিস্তান থেকে মেইন রোডে আসুন, তারপর সোজা উত্তর দিকে আসুন, তারপর পশ্চিম দিকে আসুন, তারপর আবার পশ্চিমে আসুন, তারপর আবার উত্তরে আসুন। তারপর পাচ ছয়টি রাস্তা পাড় হয়ে রামপুরা বাজারে আসুন। তারপর সেখান থেকে পূর্বের দিকে আসুন। তারপর বৌ বাজার আসুন। তারপর জামতলা গলিতে ঢুকুন। গলির মাথায় ৭তলা বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় জামিয়াতুল আস’আদ মাদ্রাসা।

এভাবে কাউকে আমরা জামিয়াতুল আস’আদে আসার পথ বলতে পারি। কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তি এ নির্দেশনা ফলো করে গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছা খুবই কঠিন। কিন্তু যদি তাকে বলে দেয়া হয় যে, আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে এক লোক জামিয়াতুল আস’আদ ভাল করে চিনে। আপনি তার পিছনে পিছনে চলে আসুন। ব্যস। কত সহজ জামিয়াতুল আস’আদে আসা তাই নয়কি?

ঠিক তেমনি কুরআন হাদীস মন্থন করে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর চলা খুবই কঠিন। তাই আল্লাহ তাআলা তাকলীদের সহজ পথ বাতলে দিয়েছেন। চার তবক্বার যে কোন একজনের তাকলীদ করলেই গন্তব্য জান্নাতে পৌছে যাওয়া যাবে।

আয়াতে কারীমায় চার তবক্বার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম তবক্বা হল, নবীগণ। এ তবক্বা দ্বারা কাদিয়ানীরা বেরিয়ে গেছে। কারণ তারা এমন ব্যক্তিকে নবী মানে যে ব্যক্তি নয়।

আর সিদ্দীক বলে শিয়া রাফেজীরা বেরিয়ে গেছে। কারণ শিয়ারা সাহাবাগণকে মানে না।

আর শুহাদা বলার দ্বারা আহলে বিদআত বেরিয়ে গেছে। কারণ তাদের কাছে কেউ শহীদ নয়।

আর যখন সালেহীন বলা হয়েছে, তখন মামাতী তথা যারা রাসূল সাঃ কে কবরে মৃত বিশ্বাস করে তারা এবং গায়রে মুকাল্লিদরা বেরিয়ে গেছে। কারণ তারা আউলিয়াদের মানে না।

শুধুমাত্র দেওবন্দীগণই চার তবক্বাকেই মেনে থাকে। নবীগণকেও মানেন। সাহাবাগণকেও মানেন। শহীদকেও মানেন। আউলিয়াদেরও মানেন। তাই হাকীকী সীরাতে মুস্তাকীমে আছেন উলামায়ে দেওবন্দ আলহামদুলিল্লাহ।

কুরআনে কারীমের ১১৪ সূরার মাঝে সূরা ফাতিহা হল সারাংস। আর বাকি ১১৩ সূরা হল বিস্তারিত। আর সুরা ফাতিহার মাঝে মৌলিকভাবে দুটি বুনিয়াদী বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। অর্ধেকের মাঝে তাওহীদ। আর বাকি অর্ধেকে তাকলীদ।

ফাতিহা নিয়ে ঝগড়াকারী দুই ভ্রান্ত দল

রঈসুল মুনাজিরীন মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ বলেনঃ সূরা ফাতিহা নিয়ে ঝগড়াকারী দুই দল তৈরী হয়েছে। যথা-১- ফাতিহা খালফাল ইমাম। ২- ফাতিহা আলাত তাআম।

একদল আছে, আপনি নামায শেষ করলে জিজ্ঞাসা করবে যে, আপনি ইমামের পিছনে নামায পড়েছেন?

-হ্যাঁ পড়েছি।

- ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়েছেন?

- না পড়িনি।

- তাহলে আপনার নামায হয়নি।

- ইমামের অনুসরণ তথা তাকলীদ করার দ্বারাতো আমার ফাতিহাও হয়ে গেছে।

- না হয়নি।

এই হল এক তবক্বা। যারা সূরা ফাতিহা নিয়ে ঝগড়া করে থাকে। এরা তাওহীদকে মানে আর তাকলীদ নিয়ে ঝগড়া করে থাকে।

আরেক দলের কাজ হল। আপনার কোন আত্মীয় মারা গেলে যদি আপনি গরীব দুঃখিকে খানা পাকিয়ে খাওয়ান। তাহলে এসে বলবে- আপনার মৃত আত্মীয়র জন্য ঈসালে সওয়াব করেন?

-হ্যাঁ, অবশ্যই করে থাকি।

- কিভাবে?

- আমি গরীবদের মাঝে খানা পাকিয়ে খাইয়েছি।

- খানা খাওয়ানোর সময় সূরা ফাতিহা পড়েছেন?

- না পড়িনি।

- তাহলে আপনার ঈসালে সওয়াব হয়নি।

এই হল আরেক তবক্বা। এরা তাকলীদ মেনে তাওহীদ অস্বিকার করে ঝগড়া করে থাকে। এ দুই দল হল ফাতিহা নিয়ে ঝগড়া করে থাকে। আর আমরা দেওবন্দীরা ফাতিহা নিয়ে ঝগড়া করি না। আমরা তাওহীদও মানি, সেই সাথে তাকলীদও মানি। ঝগড়াকারী হল, ফাতিহা খালফাল ইমামওয়ালা আর ফাতিহা আলাত তাআমওয়ালারা।

মান্যকারীরা ঝগড়াটে হয়? না অস্বিকারকারী ঝগড়াটে হয়? আলহামদুলিল্লাহ আমরা মান্যকারী। অস্বিকারকারী ঝগড়াটে নয়।

আলোচনা চলছিল ইসলামী শরীয়তে বুনিয়াদী বিষয় দু’টি। আকায়েদ ও মাসায়েল। আকায়েদের মাঝে বুনিয়াদী আক্বিদা তাওহীদ। আর মাসায়েলের বুনিয়াদী মাসআলা তাকলীদ। তাওহীদ ছাড়া আকায়েদের কোন ধর্তব্যতা নেই। আর তাকলীদ ছাড়া মাসআলার উপর আমল করা অসম্ভব।

তাকলীদ বুঝতে হলে মৌলিকভাবে চারটি বিষয় জানতে হবে। যথা-১- তাকলীদের সংজ্ঞা কি? ২- তাকলীদের দলীল কি? ৩- তাকলীদের উপর উত্থাপিত অভিযোগের জবাব। ৪-তরকে তাকলীদের ক্ষতি কি?

তাকলীদের আভিধানিক অর্থ-

আভিধানিক বলা হয়, যা অভিধানবীদগণ নির্ধারণ করে থাকেন। আর পারিভাষিক অর্থ বলা হয়, যা কোন কোন জাতি বা এলাকা বা বিশেষজ্ঞগণ নির্ধারণ করে থাকেন।

কখনো এমন হতে পারে যে, অভিধানবিদগণ এক অর্থে নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কউমের কাছে এর অর্থ ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনিভাবে বিষয় পরিবর্তন হওয়ার দ্বারাও অর্থ পাল্টে যায়। যেমন সালাত অর্থ নিতম্ব হেলানো। পরিভাষায় বলা হয়, বিশেষ আরকান আদায় করা। আজান অর্থ ঘোষণা করা, পরিভাষায় বিশেষ শব্দ বলা, রোযার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর পরিভাষায় খানা-পিনা ও সহবাস থেকে বিরত থাকা সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত নিয়তের সাথে। হজ্বের আভিধানিক অর্থ ইচেছ করা। আর পারিভাষিক অর্থ বিশেষ দিনে বিশেষ কাজ সম্পন্ন করা। জিহাদের আভিধানিক অর্থ চেষ্টা করা মেহনত করা। পরিভাষায় বলা হয়, আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করা।

বিষয় ভিন্ন হয়ে গেলে অর্থ পাল্টে যাচ্ছে, যেমন কালিমা শব্দ। নাহুবীদদের কাছে এক অর্থ। আক্বিদা বিশেষজ্ঞদের কাছে আরেক অর্থ।

গায়রে মুকাল্লিদরা যত স্থানেই আমাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে, সকল ক্ষেত্রে এ সকল পরিভাষার পার্থক্য না বুঝার কারণে। এটি বুঝলে আমাদের আকাবীরদের উপর যত অভিযোগ আছে সব ক’টির জবাব দেয়া সহজ হয়ে যাবে।

যেমন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহঃ তার এক কিতাবে দুআ হিসেবে লিখেছেন যে, “আলী মশকিল কুশা কি ওয়াস্তে তথা বিপদ থেকে উদ্ধারকারী আলীর উসীলায়”।

ব্যাস, গায়রে মুকাল্লিদরা এর পিছনে লেগে গেছে। হযরত আলীকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী বলাতো শিরক। কিন্তু ওরা ফন বুঝতে পারেনি। আক্বিদার ফনে মশকিলকুশার এক অর্থ আর তাসাউফ শাস্ত্রে মাশকিল কুশার ভিন্ন অর্থ। আকাইদ ফনে মশকিল কুশা অর্থ হল বিপদ থেকে উদ্ধার করা। আর তাসাউফ ফনে মাশকিল কুশা অর্থ হল, যিনি গোমরাহী থেকে হেদায়েদের পথে পথ প্রদর্শন করে থাকে। আর তাকে নাপাক পথ থেকে পাক পথে নিয়ে আসে, এবং মনের অবস্থাকে পরিস্কার করে দেয়, তাকে বলা হয় মশকিল কুশা। এটি অনেক মশকিল কাজ। কিন্তু শায়েখ যেহেতু এ কাজ করে দিয়েছেন। তাই শায়েখকে মশকিল কুশা বলা হয়ে থাকে। যেমন আমরা বলে থাকি যে, উস্তাদ আমি ফেঁসে গিয়েছিলাম। তারপর আপনার বুঝানোর কারণে আমি উদ্ধার পেলাম। এখানেও তাই হয়েছে। এ হিসেবে শিরক হল কিভাবে?

তাকলীদের আভিধানিক অর্থ হল, جعل القلادة فى العنق তথা গর্দানে কালাদা পরিধান করার নাম তাকলীদ। কালাদা অর্থ দু’টি। যথা-১- রশি। ২- হাড়।

উভয় অর্থ হাদীসে বিদ্যমান।

রশি অর্থ নিলে তা বিদ্যমান বুখারীর ১ম খন্ডের ২৩০ নং পৃষ্ঠায় এসেছে যে,

باب من قلد القلائد بيده এ অধ্যায়ে হাদীস এসেছে যে, فقالت عائشة رضي الله عنها ليس كما قال ابن عباس أنا فتلت قلائد هدي رسول الله صلى الله عليه و سلم بيدي ثم قلدها رسول الله صلى الله عليه و سلم بيديه তখন হযরত আয়শা রাঃ বললেনঃ ইবনে আব্বাস যেমন বলেছেন বিষয়টি তেমন নয়, আমি রাসূল সাঃ এর হাদীর রশি আমার নিজ হাতে পাকিয়ে দিতাম। তারপর তা রাসূল সাঃ নিজ হাতে তা পরিয়ে দিতেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৬১৩}

তাহলে এখানে তাকলীদ অর্থ আসল, রশি।

অপরদিকে বুখারীর ২ খন্ডের ৮৭৪ নং পৃষ্ঠায় এসেছে যে, হযরত আয়শা রাঃ এর বোন আসমা রাঃ থেকে হাড় ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন রাসূল সাঃ এর সাথে বনীল মুস্তালিকের যুদ্ধে। ফিরার পথে হাড়টি হারিয়ে যায়। এ ব্যাপারে হযরত আয়শা রাঃ বলেন- هَلَكَتْ قِلَادَةٌ لِأَسْمَاءَ তথা আসমার [কালাদাটি] হাড়টি হারিয়ে গেছে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৮২, ৪৩০৭}

এখানে হাড়কে কালাদা বলা হয়েছে।

গায়রে মুকাল্লিদরা বলে থাকে যে, আমরা কি পশু নাকি যে, আমরা গলায় রশি দিব কেন?

আসলে তারা কালাদার দুই অর্থ বিষয়ে অজ্ঞ। দুই অর্থ জানলে এমন বোকামীসূলভ মন্তব্য করতো না। যেমন মওত। রাসূল সাঃ মওতকে কবজ বলেছেন।

إِنَّ اللَّهَ قَبَضَ أَرْوَاحَكُمْ حِينَ شَاءَ ، وَرَدَّهَا إِلَيْكُمْ حِينَ شَاءَ

আর কবজের অর্থ দুটি। যথা খুরুজ তথা বেরিয়ে যাওয়া। আরেক অর্থ হল কাবজ তথা আবদ্ধ করা। কাবজ আসে বাসতুন তথা বিস্তৃতির বিপরীতে। হাত ছড়িয়ে দেয়া বাসতুন। আর মুঠ করে ফেলা কাবজুন। কবজুন এর আরেক অর্থ খুরুজ। যেমন এক হাত থেকে বেরিয়ে অন্য হাতে কোন কিছু চলে যাওয়া। কাসেম নানুতবী রহঃ উভয় অর্থ জানতেন। তাই তিনি বলেছেন যে, সাধারণ মুসলমানদের আত্মা খুরুজ হযে যায়, আর নবীদের আত্মা হাবস তথা আবদ্ধ হয়। আর মামাতীরা জানে একটি অর্থ। তাই তারা একটি অর্থই বলে থাকে।

গায়রে মুকাল্লিদ যত বক্তৃতা আপনারা তাকলীদের ব্যাপারে শুনে থাকবেন, ওরা কখনোই তাকলীদের দুই অর্থ বলবে না। কখনোই বলবে না যে, তাকলীদের অর্থ হাড়ও। সর্বদা বলবে একটি তথা রশি। যেমন মামাতীরা মওতের অর্থ কখনোই দুটি করবে না। সব সময় বলবে খুরুজ। কখনোই কবজের আরেক অর্থ হাবস বলবে না।

রঈসুল মুনাজিরীন মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ বলেন। ইনসানওয়ালা অর্থ নেয়। আর জানোয়ার জানোয়ারওয়ালা অর্থ নেয়।

মুতাকাল্লিমে ইসলাম মাওলানা ইলিয়াস ঘুম্মান বলেন- তাকলীদ মুতাআদ্দির সিগা। যার অর্থ হল, কালাদা পড়ানেওয়ালা। কালাদা পরিধানকারী নয়। তাই তাকলীদের অর্থ রশি হলেও সমস্যা নেই। আমরা কালাদা পড়াই। ওরা পড়ে। তাই সমস্যা ওদের আমাদের টেনশনের কিছু নেই।

রফয়ে ইয়াদাইন করা মানেই হল খুশুহীন নামায

আমরা বাংলাভাষাভাষীরা অনেক সময় মানুষের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন পশুর উপমা দিয়ে থাকি। যেমন-

শক্তিশালী-সিংহ।

চালাক-বানর।

বুদ্ধিমান-শিয়াল।

তেজী-খরগোস।

অলস-গন্ডার।

বোকা-গাধা।

গায়রে মুকাল্লিদদের সিফাত হল বোকার মত। যার পশুর উপমা হল গাধা। কিভাবে? দেখুন কুরআন ও তাফসীরের দৃষ্টিতে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন সূরা মুমিনূনে قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ (১) الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ (২)

তথা – নিশ্চয় ঐ সকল মুমিনগণ সফলকাম। যারা তাদের নামায খুশুর সাথে আদায় করে। {সূরা মুমিনূন-১-২}

হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ নামাযের খুশুর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন- الذين هُمْ فِي صَلاَتِهِمْ خَاشِعُونَ } مخبتون متواضعون لا يلتفتون يميناً ولا شمالاً ولا يرفعون أيديهم في الصلاة তথা যারা খুব বিনয়ী হয়, ডান বাম দিকে তাকায় না। আর নামাযের মাঝে রফউল ইয়াদাইন করে না তথা হাত উঠায় না। {তানয়ীরুল মিকআস মিন তাফসীরে ইবনে আব্বাস}

আরেক আয়াতে এসেছে যে,

وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ [٢:٤٥]

ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত খুশুওয়ালা তথা বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। {সূরা বাকারা-৪৬}

এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, যারা খুশুর সাথে রয়েছে তাদের কাছে নামায হালকা। আর যারা খুশুহীন তাদের কাছে নামায ভারি। আর ইবনে আব্বাস রাঃ এর মতে রফউল ইয়াদাইনকারীরা খুশুহীন। সেই হিসেবে রফউল ইয়াদাইনকারীদের নামায ভারি। তরকে রফউল ইয়াদাইনকারীদের নামায হালকা।

এবার আমাদের দেখার বিষয় হল, কোন প্রাণীর কাঁধে বোঝা রাখলে পা ছড়িয়ে দাঁড়ায়। আর বোঝা না দিলে পা সোজা রাখে?

গাধা। গাধা এমনিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কাঁধে বোঝা চাপলেই পা ছড়িয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তেমনি গায়রে মুকাল্লিদ তথা নামধারী আহলে হাদীসরা এমনিতে পা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু যখনই রফউল ইয়াদাইনযুক্ত খুশুহীন বোঝাওয়ালা নামায শুরু করে তখন তাদের পা ছড়ে যায়। দুই পা’কে দুই দিকে ছড়িয়ে দেয়।

গাধার আরেকটি সিফাত হল, গাধার কোমরে টনের পর টন বোঝা বহন করে। কিন্তু মাথায় যদি পাতলা একটি কাপড়ও রাখা হয়, তা ফেলে দিবে। ঠিক তেমনি গায়রে মুকাল্লিদরা, স্যুট, কোট, শীতের বোঝাওয়ালী কাপড় পড়তে রাজি। মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য জিহাদের নামে কালাশিনকোভও কোমরে নিয়ে নেয়। কিন্তু পাতলা একটি টুপি মাথায় দিলে তা ফেলে দিবে।

তাকলীদের পারিভাষিক অর্থ

জামেউল উলুম ফি ইসতিলাহাতিল ফুনুনে বিদ্যমান তাকলীদের পারিভাষিক অর্থ হল,

التقليد : إتباع الإنسان غيره فيما يقول بقول أو بفعل معتقدا للحقيقة فيه من غير نظر وتأمل في الدليل كان هذا المتتبع جعل قول الغير أو فعله قلادة في عنقه

তথা তাকলীদ বলা হয়, কোন মানুষ আরেকজনের কথা বা কর্মের ইত্তিবা করা এ বিষয়ে লোকটি সঠিক বিশ্বাস করে, দলীলের দিকে দৃষ্টি ও চিন্তা না করেই। যেন এ ইত্তিবাকারী অন্যের কথা বা কাজটিকে নিজের কাঁধে হাড় হিসেবে পরিধান করে নিয়ে নিয়েছে।

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ তাকলীদের সংজ্ঞা করেছেনঃ কারো কথা এ হিসেবে মেনে নেয়া যে, লোকটি দলীলের ভিত্তিতে বলে দিবে। কিন্তু তার থেকে দলীলের বিষয়ে কোন তাহকীক করা হয় না।

তাহলে উক্ত দুই সংজ্ঞা দ্বারা আমরা বুঝতে পারছি যে, কারো অনুসরণ করা তার কাছে দলীল চাওয়া ছাড়া। যদিও তার কাছে দলীল বিদ্যমান আছে। এক হল দলীল নেই। আরেক হল দলীল না চাওয়া। তাকলীদ হল, দলীল আছে, কিন্তু মুকাল্লিদ সেই দলীল জানতে চায় না।

তাকলীদের একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা

তাকলীদ হল, মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাতে, গায়রে মুজতাহিদ ব্যক্তির এমন মুজতাহিদের মুফতাবিহা মাসায়েলকে দলীল চাওয়া ছাড়া মেনে নেয়া, যে ব্যক্তির মুজতাহিদ হওয়া শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমানিত, এবং তার মাযহাব উসুলান ও ফুরূআন সংকলিত হয়ে মুকাল্লিদের কাছে আমল হিসেবে মুতাওয়াতির সূত্রে পৌঁছেছে।

মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাহ

মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাহ বলে তাকলীদের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাসায়েল দুই প্রকার হয়ে থাকে। যথা-১- মাসায়েলে ওয়াজেহা তথা সুষ্পষ্ট মাসায়েল। ২- মাসায়েলে গায়রে ওয়াজেহা তথা অস্পষ্ট মাসায়েল।

ওয়াজেহ মাসায়েলের মাঝে তাকলীদ হয় না। চাই তা কুরআনে বর্ণিত হোক। বা হাদীসের মাঝে হোক।

মাসায়েলে গায়রে ওয়াজেহা পাচ প্রকার। যথা-

১-মাসায়েলে গায়রে মানসূসাহ।

তথা মাসআলা বিদ্যমান কিন্তু এর উপর কুরআনের আয়াত বা হাদীস নেই। এর মূলনীতি কুরআনে বা হাদীসে বিদ্যমান। কিন্তু মাসআলাটি কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান নেই।

কুরআন থেকে উদাহরণ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ [٥:٩٠]

হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। {সূরা মায়িদা-৯০}

এ আয়াতে মদকে অপবিত্র হওয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তাই অটোমেটিক তা হারাম হওয়া এমনিতেই বুঝে এসে গেছে। কারণ, কোন বস্তু নাপাক হলে, তা হারাম হয়ে থাকে, কিন্তু হারাম হলেই উক্ত বস্তু নাপাক হওয়া শর্ত নয়। হারাম ও নাপাকের মাঝে আম খাস মুতলাকের নিসবত। যেমন সুদের টাকা হারাম। কিন্তু হারাম টাকা নাপাক নয়। চুরি কলম হারাম। কিন্তু কলম নাপাক নয়।

হারাম তিন কারণে হতে পারে। যথা-১- নাপাক হওয়ার কারণে। যেমন প্র¯্রাব-পায়খানা, গোবর-মদ ইত্যাদি। ২- ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য। যেমন বিষ। ৩- সম্মানার্থে। যেমন- মানুষ।

সুতরাং আমভাবে হারাম হলেই তাকে নাপাক হওয়ার হুকুমে নেয়া যাবে না। কিন্তু যে বস্তু নাপাক হয়, তা অবশ্যই হারাম হবে।

এ আয়াতের মাঝে মদকে নাপাক বলা হয়েছে। এর দ্বারা মদ হারাম একথা বুঝা গেল। কিন্তু ভাং বা গাঁজার কি হুকুম? এ কথার উল্লেখ আয়াতের মাঝে নেই। কিন্তু উসুল রয়েছে। আয়াতে খমর শব্দ বলা হয়েছে। খমর অর্থ হল মুখামারাতুল আকল তথা যা আকলকে ঢেকে দেয়। সুতরাং প্রত্যেক ঐ বস্তু যা আকলকে ঢেকে দেয়, তাই হারাম হবে।

মুজতাহিদ ইল্লত বের করেছেন আয়াত থেকে। তারপর ভাং জাতীয় বস্তুর হুকুম বলে দিয়েছেন, যা সরাসরি কুরআনে বর্ণিত নয়।

হাদীসের উদাহরণ

أَبَا هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَقُولُ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِي شَرَابِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ ثُمَّ لِيَنْزِعْهُ فَإِنَّ فِي إِحْدَى جَنَاحَيْهِ دَاءً وَالْأُخْرَى شِفَاءً

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যখন কারো পান পাত্রে মাছি পড়ে যায়, সে যেন তাকে আরেক বার ডুবিয়ে নেয়, তারপর তাকে ফেলে দেয়। কেননা, তার এক ডানায় থাকে রোগ আর আরেক ডানায় থাকে অষুধ। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৩২০}

এখানে লক্ষ্যণীয় দুটি বিষয়। এক হল মাছি পড়লে তাকে ডুবিয়ে নিবে। আর উক্ত খানা খেতে কোন সমস্যা নেই। জায়েজ আছে খাওয়া।

এখন প্রশ্ন হল, মাছি ফেলে দিয়ে খানা খাওয়া জায়েজ কেন? এর কারণ ইমাম আবু হানীফা রহঃ বের করেছেন যে, মাছি এমন প্রাণী যার রগের মাঝে প্রবাহমান রক্ত নেই। তাই এটি পাত্রে পড়লে পাত্রের খাবার নাপাক করে না। তাই প্রত্যেক ঐ বস্তু যার মাঝে প্রবাহমান রক্ত নেই তার হুকুমও মাছির মতই হবে। অর্থাৎ এরকম প্রাণী খাবারে পরে গেলে তা ফেলে দিয়ে উক্ত খানা খাওয়া জায়েজ হবে। যেমন, পিপড়া, মাছ ইত্যাদি।

পার্থক্য হল মাছির কথা হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আর মাছ ও পিপড়ার কথা স্পষ্ট নেই। যা মুজতাহিদ ইজতাহিদ করে বের করেছেন।

২- মাসায়েলে মানসূসায়ে মুতাআরিজা

তথা মাসআলা কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান। কিন্তু পরস্পর বিরোধী বর্ণনা নসের মাঝে রয়েছে।

কুরআন থেকে উদাহরণ

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا ۖ فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ [٢:٢٣٤]

আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতি সঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোন পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে। {সূরা বাকারা-২৩৪}

এ আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, মহিলার স্বামী মারা গেলে সে ইদ্দত পালন করবে চার মাস দশ দিন।

অথচ অন্য আয়াতে এসেছে

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِّأَزْوَاجِهِم مَّتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ ۚ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعْرُوفٍ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ [٢:٢٤٠]

আর যখন তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে তখন স্ত্রীদের ঘর থেকে বের না করে এক বছর পর্যন্ত তাদের খরচের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যাবে। অতঃপর যদি সে স্ত্রীরা নিজে থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সে নারী যদি নিজের ব্যাপারে কোন উত্তম ব্যবস্থা করে, তবে তাতে তোমাদের উপর কোন পাপ নেই। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী বিজ্ঞতা সম্পন্ন। {সূরা বাকারা-২৪০}

এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্ত্রীর ইদ্দত হল এক বছর।

এখন যদি কেউ হাদীস রেখে শুধু কুরআন দেখে, তাহলে সে বলে বসবে যে, কুরআনের মাঝে বৈপরীত্ব আছে। তাই কুরআন গ্রহণীয় নয় [নাউজুবিল্লাহ]।

এ বিষয়ে মুজতাহিদগণ এসে বলে দিয়েছেন যে, স্বামী মৃত্যুবরণকৃত মহিলার ইদ্দত সম্পর্কিত বাকারা ২৪০ নং আয়াত মানসুখ তথা রহিত। কেননা, তা আগে নাজিল হয়েছিল। আর ২৩৪ নং আয়াত নাসেখ কেননা, তা পরবর্তীতে নাজিল হয়েছে। সুতরাং আর কোন বৈপরীত্ব বাকি নেই। এ বৈপরীত্ব দূর করেছেন মুজতাহিদ।

হাদীস থেকে দলীল

তিরমিজীর সৌন্দর্য হল, উভয় প্রকারের হাদীস তিনি এনেছেন। তারপর একটিকে তারজীহ দিয়েছেন। আর ইমাম বুখারী রহঃ শুধু এক পক্ষের দলীল এনেছেন। তাই বুখারীর তুলনায় তিরমিজী গবেষণার জন্য অধিক উপকারী। আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী রহঃ এর মতে ইমাম বুখারী রহঃ শাফেয়ী। আর ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ এর মতে তিনি হাম্বলী ছিলেন।

তাহাবী শরীফ ও খুব চমৎকার কিতাব। এতে উভয় প্রকারের দলীল এনে আকলী ও নকলী দলীলের ভিত্তিতে একটি প্রাধান্য দিয়েছেন। এ কিতাব ভাল করে পড়ানো উচিত।

তিরমিজীতে এক হাদীসে এসেছে

عن وائل بن حجر قال سمعت النبي صلى الله عليه و سلم قرأ ( غير المغضوب عليهم ولا الضالين ) فقال آمين ومد بها صوته

হযরত ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি পড়েছেন গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দুয়াল্লীন, তারপর বললেন আমীন। তিনি তা মাদ্দের সাথে পড়লেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪৮}

মাদ্দা বিহা সাওতাহু এর অর্থ দুটি। একটি অর্থ হল- জাহারা, তথা জোরে বলা।

এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল সাঃ আমীন জোরে বলেছেন। ওয়ায়েল বিন হুজুর থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে যে,

عن علقمة بن وائل عن أبيه أن النبي صلى الله عليه و سلم قرأ ( غير المغضوب عليهم ولا الضالين ) فقال آمين وخفض بها صوته

হযরত ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি পড়েছেন গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দুয়াল্লীন, তারপর বললেন আমীন। তিনি তা আস্তে সাথে পড়লেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪৮}

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল সাঃ আমীন আস্তে বলেছেন। তাহলে এক বর্ণনায় এসেছে, আমীন জোরে বলার কথা। আরেক বর্ণনায় এসেছে আস্তে বলার কথা। আর উক্ত হাদীস দু’টিতে কোনটি আগের আমল আর কোনটি পরের আমল তার কোনই উল্লেখ নেই। তাই এখন আমরা কী করবো?

এর সমাধান মুজতাহিদ ছাড়া কেউ করতে পারবে না।

৩- মাসায়েলে মানসূসাহ মুজমালা

মাসআলা কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান আছে। কিন্তু বিস্তারিত নয় সংক্ষিপ্ত হওয়া।

কুরআনের উদাহরণ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ ۚ وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا ۚ وَإِن كُنتُم مَّرْضَىٰ أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُم مِّنْهُ ۚ مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ [٥:٦]

হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর। {সূরা মায়িদা-৬}

এ আয়াতে অজহুন তথা চেহারা ধৌত করার নির্দেষ এসেছে। কিন্তু অজহুন কাকে বলে? এটি কুরআনে বর্ণিত নয়। কতটুকুকে অজহুন বলে? কুরআন এ বিষয়ে নিশ্চুপ।

এর সমাধান দিয়েছেন মুজতাহিদগণ। মাথার চুল উঠার স্থান থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত, আর এক কান থেকে থেকে আরেক কান পর্যন্তের অংশের নাম চেহারা বলা হয়। কিন্তু একথা কুরআনে নেই। যা বলে দিয়েছেন মুজতাহিদগণ।

হাদীস থেকে প্রমাণ

عن ابنِ مسعودٍ أن النبيّ صلى الله عليه وسلم قال: “إذا رَكعَ أحدُكُم فقَالَ في ركوعِه: سبحانَ رَبّيَ العظيم ثلاث مراتٍ فقد تمّ ركُوعُهُ، وذلك أدناهُ. وإذا سجدَ فقالَ في سجودهِ: سبحانَ رَبّيَ الأعْلَى ثلاثَ مرّاتٍ، فقد تمّ سجودُهُ، وذلك أدناه”

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৬০}

এ হাদীসে রুকু সেজদায় সর্বনি¤œ তিনবার তাসবীহ পড়ার কথা বলা হয়েছে। আর এটাকে বলা হয়েছে সর্বনি¤œ। অথচ তাসবীহ একবার পড়লেও নামায হয়ে যায়, এমন কি তাসবীহ না পড়লেও নামায হয়, এ বিষয়ে হাদীস নিশ্চুপ। এর সমাধান কে দিবে? মুজতাহিদ।

৪- মাসায়েলে মানসূসাহ মুহতামিলাতুল মায়ানী

তথা মাসআলা কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান। কিন্তু উক্ত নসে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। মুজতাহিদ তা নির্ধারণ না করলে তা বুঝা দুস্কর হয়ে যায়।

কুরআন থেকে উপমা

সূরা বাকারা ২২৮ নং আয়াত وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ এ আয়াতে কুরু অর্থ স্পষ্ট নয়। কুরু অর্থ হায়েজ ও হয়। আর আবার কুরু মানে তুহুরও হয়।

কোন অর্থ এখানে কাম্য, তা নির্ধারণ করে দেন মুজতাহিদ।

হাদীস থেকে উপমা

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ الطَّلاَقُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَأَبِى بَكْرٍ وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ طَلاَقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ إِنَّ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوا فِى أَمْرٍ قَدْ كَانَتْ لَهُمْ فِيهِ أَنَاةٌ فَلَوْ أَمْضَيْنَاهُ عَلَيْهِمْ. فَأَمْضَاهُ عَلَيْهِمْ.

{সহীহ মুসলিম। হাদীস নং-৩৭৪৬}

আরবীতে দু’টি শব্দ আছে। এক হল, তাকীদ। আরেক হল ইস্তিনাফ। ইস্তিনাফ হল যেমন এক ছাত্র এলে বললাম, টুপি নিয়ে আস। আমার কথা শুনে টুপি নিয়ে আসল। তারপর আরেক ছাত্রকে বললাম, টুপি নিয়ে আস। তখন সে আরেক টুপি নিয়ে আসল। এভাবে প্রত্যেকবার টুপি চাওয়ার দ্বারা নতুন টুপি উদ্দেশ্য হওয়ার নাম ইস্তিনাফ।

আর তাকীদ হল, একাধিকবার বলার দ্বারা একই অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া। যেমন মেহমান এলে আমরা খুশি হয়ে বলে থাকি যে, মেহমান এসেছে, মেহমান এসেছে, মেহমান এসেছে। এখানে তিনবার বলা হলেও মেহমান তিনবার আসেনি। এসেছে একবারই। বাকি দুইবার তাকীদান বলা হয়েছে।

কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীকে বলে যে, انت طالق، انت طالق، انت طالق তথা তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক। তাহলে এখানে দুই অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। তাকীদ হিসেবে একটি। আর ইস্তিনাফ হলে তিনটি। এখানে কোনটি উদ্দেশ্য হবে?

ইমাম নববী রহঃ রাসূল সাঃ, হযরত আবু বকর রাঃ এবং হযরত উমর রাঃ এর শুরুর জমানায় মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, তাকীদ। কিন্তু পরবর্তীতে দ্বীনদারী কমতে থাকায় ইস্তিনাফ। তাই হযরত উমর রাঃ দুই অর্থের মাঝে একটি অর্থকে নির্দিষ্ট করে দিলেন। নতুন কিছু করেন নি। দুই অর্থের মাঝে একটিকে নির্দিষ্ট করেছেন।

أنه كان في أول الأمر إذا قال لها أنت طالق أنت طالق أنت طالق ولم ينو تأكيدا ولا استئنافا يحكم بوقوع طلقة لقلة ارادتهم الاستئناف بذلك فحمل على الغالب الذي هو ارادة التأكيد فلما كان في زمن عمر رضي الله عنه وكثر استعمال الناس بهذه الصيغة وغلب منهم ارادة الاستئناف بها حملت عند الاطلاق على الثلاث عملا بالغالب السابق الى الفهم منها في ذلك العصر

৫- মাসায়েলে মানসূসাহ গায়রা মুতাআইয়্যিনাতিল আহকাম

তথা মাসআলা নসে রয়েছে। কিন্তু মাসআলার হুকুম নসে বিদ্যমান নেই। সূরা মায়িদার দুই নং আয়াত وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوا

এখানে হজ্ব থেকে ফারিগ হওয়ার পর শিকার করার আদেশ এসেছে। ঠিক তেমনি আদেশ সূচক শব্দ এসেছে সূরা মায়িদার ছয় নং আয়াতে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا

এ সকল স্থানের চেহারা ধুয়ার হুকুম কি? শিকার করার আদেশ হলেও এর হুকুম কি? জাওয়াজ। তো মাসআলা নসে বিদ্যমান। কিন্তু হুকুম নসে নেই। হুকুম বলে দিবে কে? মুজতাহিদ।

গায়রে মুজতাহিদ

তাকলীদ করবে গায়রে মুজতাহিদ। আর মুজতাহিদ করবে ইজতিহাদ। এ কারণে গায়রে মুকাল্লিদদের অভিযোগ যে, আমাদের ইমাম গায়রে মুকাল্লিদ। আমরা বলি যে, ইমাম গায়রে মুকাল্লিদ মানে হল, তিনি মুজতাহিদ। তাই তার মুকাল্লিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর তোমরা গায়রে মুকাল্লিদ মানে হল, তোমরা মুজতাহিদও নয়, আবার তাকলীদও করো না, এর নাম গায়রে মুকাল্লিদ।

এক ব্যক্তি হয়তো ইমাম হবে, নতুবা মুক্তাদী। একজন এমন যে ইমাম ও নয়, মুক্তাদী নয়। ফাসাদকারী। হয়তো ব্যক্তি রাজা হবে, নয়তো প্রজা। উভয়ের কোনটি না হলে হয় বিদ্রোহী। তেমনি গায়রে মুকাল্লিদ। আর ইমাম আবু হানীফা রহঃ হলেন রাজাওয়ালা, আর ইমামওয়ালা। গায়রে মুকাল্লিদরা হল, ফাসাদকারী আর বিদ্রোহী।

মুসলমান হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নবীর কালিমা পড়া জরুরী। নবীজী সাঃ নিজেও মুসলমান। কিন্তু তিনি কার কালিমা পড়েছেন? কারো নয়। তারপরও তিনি সাচ্চা মুসলমান। কারণ তিনি নিজেই নবী। তার জন্য কারো কালিমা পড়ার প্রয়োজনই নেই।

তেমনি ইমাম আবু হানীফা রহঃ মুজতাহিদ। তাই তার কারো তাকলীদ করার প্রয়োজনই নেই।

যেমন মুক্তাদী ইমামে ইত্তেবা করে বা জামাআত নামায পড়ে। আর ইমামও বা জামাআত নামায পড়ছে যদিও তিনি কারো ইত্তেবা করছে না। কেননা, তিনি নিজেই ইমাম। এমনিভাবে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর অনুসারীরা তার তাকলীদ করে থাকে, কিন্তু তিনি কারো তাকলীদ করেন না। কারণ তিনি নিজেই ইমাম।

বিষয়: বিবিধ

৫১৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File