বিক্ষিপ্ত ঘটনা, বিচ্ছিন্ন চিন্তা
লিখেছেন লিখেছেন গেঁও বাংলাদেশী ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:২৯:০৮ সকাল
-আলমগীর মহিউদ্দিন
পর্দার অন্তরালবর্তিনীকে উদ্দেশ করে ডাকাতদলের সর্দার বলল, ‘মা, আমরা ডাকাতি করি ঠিকই, তবে নেমকহারাম নই। আপনার নিমক আমরা খাইছি, তাই ডাকাতি করলাম না। একটা লোহার মই পুঁতে গেলাম। যত দিন এটা পোঁতা থাকবে, এ বাড়িতে ডাকাতি হবে না।’ ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় এক শ’ বছর আগে নাটোরের সাঁতইল বিলের ধারের এক গ্রামের বাড়িতে। এক দুপুরে বাড়ির ঘাটে একটা নৌকা ভিড়ল। তখন সব পুরুষ বাইরে। শঙ্কিত গৃহিণী কাজের লোকটিকে পাঠালেন জানতে। পরে নৌকার লোকদের বলা হলো, পুরুষেরা সবাই বাইরে, তবে জরুরি কাজ থাকলে অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে তারা রাজি থাকলে ডাল-ভাত খেতে পারেন। গৃহের সবাই খুশি হবে। নৌকার মানুষেরা ুধার্ত ছিল। তারা খেতে রাজি হলো। তবে জানাল, ‘তরকারিতে তারা লবণ খায় না।’ তাদের জানানো হলো, রান্না হয়ে গেছে। এখন এটা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই ুধার্ত মানুষগুলো খেল। খাবারের পরে তারা কথাগুলো বলে নৌকা নিয়ে চলে গেল।
এ ঘটনার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে এক প্রচণ্ড বর্ষণের পরে বাড়ির পূর্বপাশের একাংশ ক্ষয়ে গেলে মইটা বের হয়ে পড়ে। তখন সবাই দাদীর কাছে ছুটল এর কোনো ঘটনা আছে কি না জানতে। দাদী গ্রামেরও সবচেয়ে পুরনো মানুষ। দাদী তার শাশুড়ির কাছে মইয়ের ঘটনাটা শুনেছিলেন। তবে জানতেন না এর সঠিক স্থানটি। তিনি বললেন, তার শাশুড়ির সাহসিকতার কথা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নৌকার আরোহীরা ডাকাত। কারণ সে সময় বর্ষাকালে দুপুরেই এমন ঘটনা ঘটত। তবে কথা প্রচলিত ছিল যে, ডাকাতেরা নেমকহারামি করে না। তাই চালাকি করে তাদের লবণ দেয়া তরকারি খাওয়ানো হয়।
সবাই অবাক হয়ে শুনল, সেকালের ডাকাতদেরও একটা নীতি ছিল, যা আজকের দিনের ‘অসাধারণ’ মানুষদেরও লজ্জা দেয়। অবশ্য নেমকহারাম শব্দটির অর্থ-ব্যঞ্জনা বহু। তবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নেমকহারামদের ঘৃণা করা হয়। এমনকি সেকালের ডাকাতেরাও নেমকহারামদের ঘৃণা করত। সংস্কৃতিটা এখনো চালু, তবে কর্মটি নয়। বরং কর্মটি এখন নতুন অর্থ ও ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে। অনেক অর্থের মধ্যে নেমকহারামের একটি অর্থ প্রতারক ও মিথ্যাবাদী। আর এটাকে ‘পলিটিকস’ বলে প্রায়ই প্রকাশ করা হয়। যেমন কাউকে নিন্দা-তিরস্কার করতে চাইলে প্রায় বলা হয় ‘আমার সাথে পলিটিক্স হচ্ছে।’ অর্থাৎ এই বক্তব্য দিয়ে বোঝানোরও চেষ্টা হচ্ছে যে, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অনাচার করা হচ্ছে। অবশ্য বিজ্ঞজনেরা এখন রাজনীতি ও প্রতারণার মধ্যে প্রচুর যোগসূত্র খুঁজে পান। এর অন্যতম কারণ হতে পারে এখন ‘নেমকহারামির’ সব কর্মকাণ্ড ব্যবহার করে ‘ফায়দা লুটা’কে অনেক ক্ষেত্রে কৃতিত্বের বিষয় বলে মনে করা হয়।
এখন সমাজে অনেক বহুল লালিত নিয়ম-কৃষ্টি হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। সেখানে স্থান করে নিচ্ছে এক শঙ্কর সংস্কৃতি। এর অধিকাংশের জন্ম তথাকথিত আধুনিকায়তনের আবর্তে। এ শঙ্কর সংস্কৃতিকে কেউ কেউ প্রগতিবাদ বলছে। আবার এটা পশ্চাদপদতাকে অপসরণের প্রাচীর বলছে। যাই বলা হোক, সামাজিক এই কিছু পুরনো সংস্কৃতি শুধু সামাজিক বন্ধনগুলোকে অনন্য করেনি, তার সাথে সুস্থ-সুন্দর-আস্থাবান-নিরাপদ পারিবারিক জীবনও নিশ্চিত করেছিল। যেমন বৃদ্ধ পিতা-মাতা-ভাইবোনসহ বৃহৎ পরিবার যেন একটি পরিবার। পশ্চিমা ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার প্রভাবে এ ব্যবস্থা হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন বৃদ্ধ পিতা-মাতা অবহেলিত হচ্ছে তেমনি ুদ্র স্বার্থ ভাইবোনদের মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করছে। এখানে তিন দশকের আগের এক ঘটনা বর্ণনা করা যায়। প্যারিসের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরব। সেন্টারের সেক্রেটারি বিদায়ী ডিনার দিলেন। একপর্যায়ে বললেন, তার ‘ভালো লাগছে। দুপুরে পাপাকে গেট ওয়েল কার্ড পাঠাতে পেরেছেন বলে।’ পশ্চিমা জগতে অসুস্থজনকে ‘গেট ওয়েল’ কার্ড পাঠানো একটা রেওয়াজ। আমার অবাক দৃষ্টি লক্ষ করে সেক্রেটারি (মহিলা) বললেন, ‘তুমি অবাক হচ্ছো।’ স্বীকার করে বললাম, ‘তোমার বাবা হাসপাতালে আর তুমি কার্ড পাঠিয়ে আমার সাথে ডিনার করছ তাই।’ আমরা কী করি জানতে চাইল। বললাম, ‘আমরা গরিব। ওষুধের পয়সাও জোটাতে পারি না। তবে পিতা-মাতা অসুস্থ হলে সব কাজ ফেলে তাদের কাছে থাকতে চেষ্টা করি। তত দিন কাজকর্ম নিয়ে চিন্তা করি না।’ সেক্রেটারি এক স্মরণীয় মন্তব্য করলেন। ‘তোমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের সম্পদ (ওয়েলথ) যদি এক হতো, সম্ভবত এ বিশ্বটাই স্বর্গ হতো।’ অবশ্য তার মন্তব্য এসেছিল, আমরা গরিবত্বকে কেমন করে ঠেকাই। আমাদের বৃহৎ পরিবার সুখে-দুঃখে একে অন্যের জন্য বেদনা-সমস্যা ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করি। প্রায়ই দেখি তথাকথিত প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেন মমত্ববোধটুকু হারিয়ে যাচ্ছে। কেবলই নিজেদের নিয়েই মগ্ন।
খবরের কাগজ আর পড়তে ইচ্ছে করে না। একবার আমার এক আত্মীয় বলছেনÑ কেবল হত্যা-গুম-অনাচারে ভর্তি। অনাচারকারীরাই দেশটি দখল করে আছে।
সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ-হত্যাকাণ্ড সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে। অতীতে এ অপরাধ সংঘটিত হলে সমাজে বিশেষ সাড়া পড়ে যেত। এখন সম্ভবত চোখের পাতাটিও কুঞ্চিত হয় না। শুধু তা-ই নয় এর বিস্তৃতি ঘটছে দ্রুত। ফলে সামাজিক অশান্তি যেমন ক্রমান্বয়ে স্থায়িত্ব বজায় রাখছে, তেমনি ক্ষমতালিপ্সু শ্রেণী তাদের অনৈতিকতাকেই জীবনযাপনের মাপকাঠি হিসেবে নির্ধারণ করছে। দু’টি উদাহরণই যথেষ্ট হবে। এক ঘটনায় মহিলা কনস্টেবলের পদপ্রার্থীকে প্রচুর অর্থ দিতে হয়েছিল চাকরিটি পেতে। তার অর্ধশিক্ষিত কয়েক ভাই মিলে এ অর্থের জোগান দেয়। হিসাব করে দেখা যায় মহিলাকে তার সাড়ে ছয় বছরের বেতন দিতে হয়েছে। মহিলাটি নাকি ধার্মিক। এখন সে কী করবে। তার এক সহকর্মী বলল, বড় সাহেবরা বলেছেন চিন্তার কারণ নেই। তোমরা যা উপরি পাবে তা থেকে সহজেই এ টাকা পেয়ে যাবে। এখন সে মহিলা কনস্টেবল সারা দিন তওবা করে এবং বসের হুকুম অনুসারে উপরির চেষ্টায় থাকে। অর্থাৎ যারা ন্যায়নীতি-আইন রক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা, তাদের ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে অন্যায়-অনাচারের লালনে।
ঠিক একই ঘটনা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরি প্রাপ্তির ব্যাপারে। সে অর্থ ব্যয় করে চাকরি পেয়েছে। আর ধার করা অর্থ শোধ করার জন্য তাকে কর্তৃপক্ষের সব ধান্ধাবাজির দোসর হতে হচ্ছে। এমনকি তার ছাত্রছাত্রীদের ফেল-পাস নিয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ব্লাকমেইলও করতে হচ্ছে। অথচ এ পেশা মানুষ গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকার কথা। অথচ এ শিক্ষক তার পেশাই শুরু করল দুর্নীতির মধ্যে। যিনি এ ঘটনাটি বলেছিলেন তিনি আর একটি ভয়ঙ্কর তথ্য দিলেন। এ শিক্ষকের স্কুলে নাকি কয়েকজন সৎ-শিক্ষানুরাগী শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় চাকরি হারায়।
এখন এটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের সর্বোচ্চপীঠ প্রাচ্যের অক্সর্ফোডের দাবিদার শিক্ষক পেটানো, অনাচারের কাহিনী প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ এই চার যুগ আগেও এটা ছিল অভাবনীয় ব্যাপার। এর অনেক কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ এখন বিদ্যাপীঠে নৈতিকতার সত্যের চর্চা নিষিদ্ধ। ফলে এ দেশের গর্ব করা সংস্কার হারিয়ে গেছে। স্কুলে এখন সে কবিতা পড়ানো নিষিদ্ধ। যে কবিতায় বাদশা আলমগীরকে শিক্ষকের পা ধুইয়ে দেয়ার কাহিনী আছে। সামান্য অনুসন্ধানেই ধরা পড়ে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে নৈতকতা সত্যবাদীতাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে।
এখন আর কোনো লুকোচুরি নয়। এ দেশের জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে বিশেষ আগ্রহী। কিছু সংবাদপত্র এ নিয়ে আলোচনা করলে তাদের এসব জনপ্রতিনিধির রোষানলে পড়তে হয়। আবার এরা সরকারেরও বিশেষ প্রিয় পাত্র। ফলে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে জাতির বিবেক বলে পরিচিত সংবাদ মাধ্যমও বিশেষ সতর্কভাবে এসব অনাচার নিয়ে আলোচনা করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান-ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ বা তাদের দলছুটদের নিয়েই তাই তাদের লেখালেখি। ফলে অনাচার-অবিচার-শোষণ-শাসনের প্রকৃত উৎস এবং চিত্র আড়ালেই থেকে যায়।
ঘটনাগুলোর সাথে সত্য ও ন্যায়ের বিরামহীন পরাজয়ে সাধারণ মানুষের হাল ছেড়ে দেয়ারই কথা। কিন্তু প্রতিবাদীদের প্রকৃতি বা বিশ্বাসীদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেই এই অন্যায়ের স্রোতে সবার অজান্তে বাধার সৃষ্টি হতে থাকে। একপর্যায়ে অন্যায় পরাজিত হয়। তবে অনেক মূল্যের পরে। এভাবেই জীবন চলছে।
হয়তো বা সে জন্যই ‘কেন এমন হয়’Ñআর কেন সাহায্য আসছে না বলে আর্তনাদ চলতেই থাকে।
কখনো কখনো মনে হয় বিশ্বে কি এমন পরিবর্তন হয়েছে? যে জন্য প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ও অতিআধুনিক বলে এত আলোচনা, সাধারণ ভাষায় তড়পানি। প্রাচীন যুগেও ক্ষমতাবানেরা ছিনতাই, দখল, হত্যা, লুণ্ঠন করে সহজেই পার পেত। এখনো ক্ষমতাবানেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে অতীতে যারা শুদ্ধ জীবনযাপন করত, তারা বহু বছর বাঁচত। এমনকি সাধারণ মানুষও বাঁচত। যখনই জীবন কলুষতায় আবৃত হতে থাকল, আয়ুর দৈর্ঘ্য কমতে থাকল। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি দিয়ে এই কলুষতাকে দূর করে দীর্ঘ জীবনের চেষ্টায় শুধুই যন্ত্রণা, আনন্দ নেই। তাহলে কী পরিবর্তন হলো? মানুষ এক স্থান থেকে আর এক স্থানে দ্রুত যেতে পারছে। তাতেই নির্ভেজাল আনন্দের নিশ্চিত হচ্ছে? এই যে বিমানটা কয়েক শ’ মানুষ নিয়ে হারিয়ে গেল? এত উন্নতির পরেও, মানুষ একইভাবে হাসে, আনন্দ পায়, কথা বলে। যেহেতু জীবন প্রবহমান তাই এই চলাটাই জীবন। তাকে শুধু নানা রঙে বর্ণনা করা হয়।
বিষয়: বিবিধ
১০৬৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার বিবেক জাগ্রত করা পোষ্টের জন্য জাজাকাল্লাহু খায়রান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন