যেই যমীনের খাজনা দেয়া হয়, তাতে উৎপন্ন ফসলের উশর (যাকাত) দিতে হবে কি?

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহশাহেদ ২২ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:৪১:৫৬ রাত

যে সমস্ত সম্পদের যাকাত দিতে হয়, তার মধ্যে যমীন থেকে উৎপন্ন ফসল অন্যতম। তবে যমীন থেকে উৎপন্ন ফলমূল ও শাক-শব্জিতে কোন যাকাত নেই। শুধু দানা জাতিয় বস্তু যেমন ধান, গম, ভূট্রা ইত্যাদি এবং যা গুদামজাত করা সম্ভব কেবল তাতেই যাকাত ওয়াজিব। এখন প্রশ্ন হল, আমাদের যে সকল ভূমির খাজনা (টেক্স) প্রদান করি, তা থেকে উৎপন্ন ফসলের যাকাত দিতে হবে কি না?

এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে দুই ধরণের কথা পাওয়া যায়। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং তার অনুসারীদের মতে যে সমস্ত ভূমির খাজনা দেয়া হয় তাতে উশর বা যাকাত নেই। হেদায়া গ্রন্থকার বলেনঃ ولا عشر في الخارج من أرض الخراج অর্থাৎ খিরাজী ভূমিতে উৎপন্ন ফসলের উশর নেই।

ইমাম আবু হানীফার পক্ষে নিম্ন বর্ণিত হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

لا يجتمع عشر وخراج في أرض مسلم

কোন মুসলিমের যমীনে উশর ও খিরাজ (খাজনা) একসাথে একত্রিত হতে পারে না। (ইবনে আদী স্বীয় কিতাব কামিলে এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তারা আরও বলেন মুসলিমদের ন্যায়পরায়ন কিংবা জালেম কোন শাসকই একই ভূমিতে এক সাথে খিরাজ ও উশর নির্ধারণ করেন নি। সুতরাং বিষয়টি ইজমার মতই হয়ে গেছে।

অপর পক্ষে ইমাম শাফেঈসহ অধিকাংশ ফিকাহবিদদের মতে একই ভূমিতে খিরাজ ও উশর আবশ্যক। উভয়টি আবশ্যক হওয়ার কারণ বিভন্ন। অর্থাৎ খিরাজ আবশ্যক হয় শাসকের (সরকারের) হুকুম (আইন) অনুযায়ী। আর উশর আবশ্যক হওয়ার বিষয়টির সম্পর্ক হচ্ছে যমীনে ফসল উৎপন্ন হওয়া না হওয়ার সাথে। নিসাব পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে তা থেকে যাকাত দিতে হবে। আর ফসল উৎপন্ন না হলে কিংবা নিসাব পরিমাণ না হলে তাতে উশর নেই।

তাদের দলীল হচ্ছে, ইমাম যহরী (রঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যুগ থেকে মুসলিমগণ যমীন থেকে উৎপাদিত ফসলের যাকাত দিয়ে আসছে। ইবন উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

فِيمَا سَقَتْ السَّمَاءُ الْعُشْر

আকাশের (বৃষ্টির) পানিতে উৎপন্ন ফসলের দশভাগের একভাগ (যাকাত) দিতে হবে। (বুখারী ও মুসলিম) এই হাদীছটি আম বা ব্যাপকার্থবোধক। এখানে ভূমিকে খিরাজী ও উশরী এভাবে ভাগ করা হয়নি। অর্থাৎ এ কথা বলা হয়নি, যে ভূমির খাজনা দিতে হয়না তাতে যাকত আছে আর যে ভূমির খাজনা দিতে হয়না তাতে উৎপন্ন ফসলের যাকাত দিতে হবে।

মোট কথা কোন মুসলিমের যমীনে খিরাজ ও উশর এক সাথে একত্রিত হবেনা, এই মর্মে কোন দলীল নেই। উপরে বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ এবং এই অর্থে বর্ণিত অন্যান্য হাদীছ প্রমাণ করে যে, একই ভূমি হতে একই সাথে উশর ও খিরাজ নেওয়া যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরবর্তী যুগে এর উপরই আমল ছিল। (দেখুনঃ তুহফাতুল আহওয়াযী, (২/১৭৫)

হানাফীদের দলীলের জবাবঃ

لا يجتمع عشر وخراج في أرض مسلم

কোন মুসলিমের যমীনে উশর ও খিরাজ (খাজনা) একসাথে একত্রিত হতে পারে না। এই হাদীছটি বাতিল। এর কোন ভিত্তি নেই। ইমাম যায়লায়ী হেদায়ার তাখরীজ গ্রন্থ নাসবুর রায়াতে বলেনঃ হাদীছটি ইমাম ইবনে আদী কামিলে ইয়াহইয়া বিন আনবাসা থেকে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর ইমাম ইবনে আদী (রঃ) বলেনঃ ইয়াহইয়া ইবনে আনবাসা মুনকারুল হাদীছ। অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদীছ মুনকার। তিনি ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) রাবীর নাম দিয়ে বানোয়াট হাদীছ বর্ণনা করায় প্রসিদ্ধ ছিলেন।

ইমাম ইবনে হিব্বান (রঃ) বলেনঃ এটি অর্থাৎ খিরাজী ভূমিতে উৎপন্ন ফসলের উশর নেই। এটি একটি বাতিল হাদীছ। এর কোন ভিত্তি নেই- এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী নয়। ইয়াহইয়া ইবনে আনবাসা একজন দাজ্জাল (মিথ্যুক)। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মিথ্যা হাদীছ রচনা করত। সুতরাং তার থেকে হাদীছ বর্ণনা করা হালাল নয়।

ইমাম দার কতুনী (রঃ) বলেনঃ এই ইয়াহইয়া হচ্ছে দাজ্জাল। সে ইমাম আবু হানীফা এবং তার পরে অন্যান্য ইমামদের নাম দিয়ে মিথ্যা হাদীছ রচনা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দিকে নিসবত করত।

ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেনঃ উপরোক্ত হাদীছটি বাতিল। ইয়াহইয়া মিথ্যা হাদীছ রচনার অভিযোগে অভিযুক্ত। সুতরাং এই হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যাবেনা।

আর খিরাজী ভূমিতে উশর ওয়াজিব না হওয়ার উপর হেদায়া গ্রন্থকার যেই ইজমার দাবী করেছেন, তাও বাতিল। কেননা দেরায়া গ্রন্থকার হাফেয ইমাম যাইলায়ী সাহেবে হেদায়ার জবাবে বলেনঃ এ বিষয়ে কোন ইজমা সংঘটিত হয়নি। কেননা উমার ইবনে আব্দুল আযীয এবং ইমাম যুহরী থেকে ইজমার খেলাফ পাওয়া যাচ্ছে। (দেখুন, তুহফাতুল আহওয়াযী, (২/১৭৫)

প্রাধান্যমত মতঃ

একাধিক সহীহ হাদীছ প্রমাণ করে যে, একই ভূমিতে খিরাজ ও উশর ইভয়ই আবশ্যক হবে। সুতরাং এটিই প্রাধান্য প্রাপ্ত মত। ইমাম যাইলায়ী (রঃ) নাসবুস্ রায়াতে বলেনঃ একই ভূমিতে উশর ও খিরাজ ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে ইমাম ইবনুল জাওযী ইমাম শাফেয়ীর মতের পক্ষে ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন। হাদীছটি হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

أَنَّهُ سُنَّ فِي مَا سَقَتْ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشُرُ وَفِيمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْر

যেই যমীনে আকাশের (বৃষ্টির) ও ঝর্ণার পানিতে ফসল উৎপন্ন হয় অথবা যা পানি ছাড়াই উৎপন্ন হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে দশভাগের এক ভাগ যাকাত নির্ধারণ করেছেন। আর যাতে সেচ দিয়ে ফসল উৎপন্ন করতে হয়, তাতে বিশভাগের একভাগ যাকাত দিতে হবে। (বুখারী) এখানে খিরাজী ভূমি ও অন্যান্য ভূমির মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য করা হয়নি।

আমর বিন মায়মুন বিন মিহরান (রঃ) বলেনঃ আমি উমার বিন আব্দুল আযীয (রঃ)কে বললামঃ যেই মুসলিমের হাতে খিরাজী ভূমি রয়েছে, তার সেই ভূমিতে উৎপন্ন ফসলের যাকাত চাওয়া হলে সে বলেঃ আমি তো ভূমির খিরাজ (খাজনা) দেই। এতে উমার ইবনে আব্দুল আযীয (রঃ) বলেনঃ খিরাজ হচ্ছে ভূমির উপর আর উশর হচ্ছে ফসলের উপর।

হাফেয ইমাম যাইলায়ী দেরায়তে বলেনঃ উমার ইবনে আব্দুল আযীয (রঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বলেছিল আমি তো যমীনের খিরাজ প্রদান করি, তার জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ খিরাজ হচ্ছে ভূমির উপর আর উশর হচ্ছে ফসলের উপর। ইমাম বায়হাকী কিতাবুল খিরাজে ইয়াহইয়া বিন আদম থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। (দেখুনঃ তুহফাতুল আহওয়াযী, (২/১৭৫)

বিষয়: বিবিধ

১৫০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File