নবী ও রাসূলদের মানহাজ (কর্ম পদ্ধতি) ছিল সর্বপ্রথম তাওহীদের প্রতি আহবান করাঃ
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহশাহেদ ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:৫২:৩১ দুপুর
কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানকালের অনেক মুসলিম জন সমাজের অবস্থা জাহেলী যুগের মুশরিক আরবদের অবস্থার মতই। বর্তমানে মুসলমানদের বিরাট এক অংশের মাঝে বিভিন্ন প্রকার শির্কের ছড়াছড়ি। কবর পূজা, মাজার পূজা, কবরে সেজদা করা, অলী-আওলীয়াদের উসীলা দেয়া, গাইরুল্লাহর কাছে দু’আ করা, পীর-ফকীরের নামে পশু কুরবানী করা, মানত করা ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে মক্কার মুশরেকদের চেয়ে বর্তমানকালের মুসলমানদের শির্ক অধিক ভয়াবহ। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সন্তান চাওয়া, সাহায্য চাওয়া, বিপদে-আপদে গাইরুল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা ইত্যাদি।
এর উপর ভিত্তি করে আমি বলবো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, সেভাবেই শুরু করতে হবে। যেহেতু উভয় সমাজের অবস্থা একই, তাই চিকিৎসা একই হবে। যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহেলী সমাজকে দাওয়াতের মাধ্যমে শির্কের কদর্যতা থেকে মুক্ত করেছিলেন, আজকের সকল আলেম ও দাঈদের কর্তব্য হল তারা (لاإله إلا الله) এর সঠিক অর্থ অনুধাবন করে তা মানুষকে বুঝাতে সচেষ্ট হবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পদ্ধতিতে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তারাও তাই করবে। আমার এই কথার অর্থ খুবই সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِىْ رَسُوْلَ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيْراً
“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনীতে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহজাবঃ ২১)
আমাদের বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের এবং সকল যুগের মুসলমানদের সকল সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। একথার অর্থ এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার মাধ্যমে দাওয়াত শুরু করেছেন, আমরাও তা দিয়ে আরম্ভ করবো। তা এই যে আমরা প্রথমে মুসলমানদের ভ্রান্ত আকীদাহ সংশোধনের কাজে আতœনিয়োগ করবো। অতঃপর আমল সংশোধন। তারপর তাদের চরিত্র গঠনের চেষ্টা। আমি এই ধারাবাহিকতার মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়গুলোর একটি হতে অন্যটিকে পৃথক করতে চাইনি। আমার কথার অর্থ হল আকীদা সংশোধনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করবে। মুসলমানদের আকীদাহ সংশোধনের ক্ষেত্রে দাঈ ও আলেমদের কথা আসবে সবার পূর্বে। কারণ আলেমদের ভিতরে কুরআন-সুন্নার সঠিক জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তা সত্বেও তারা ইসলামের প্রচারক ও খাদেম হিসাবে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। আলেমদের ইলম শুণ্য অবস্থার ক্ষেত্রে জ্ঞানীদের সুপ্রসিদ্ধ আরবী প্রবাদ বাক্যটি প্রজোয্য। فاقد الشئ لا يعطيه অর্থাৎ যার কাছে যে জিনিষ নেই সে তা অপরকে দিবে কিভাবে? আমরা জানি, মুসলিম উম্মার মাঝে লক্ষ লক্ষ ইসলাম প্রচারক রয়েছেন। মানুষের কাছে তারা তাবলীগ জামাতের মুরব্বী বা আলেম হিসাবে পরিচিত। তাদের অধিকাংশই দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَلَكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسَ لاَ يَعْلَمُوْنَ
“কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ”। তাবলীগীদের দাওয়াতের তরীকা হল, তারা প্রথম মূলনীতির (আকীদাহ) প্রতি গুরুত্ব দেয়া থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ। অথচ তার মাধ্যমেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সংশোধনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। শুধু আমাদের নবী নন; সমস্ত নবী-রাসূলগণই তাওহীদের মাধ্যমে তাদের দাওয়াতী মিশন আরম্ভ করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِى كُلِّ اُمَّةٍ رَسُوْلاً اَنِ اعْبُدُوْا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوْتَ
“আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্যে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। (সূরা নাহলঃ ৩৬) তাবলীগীরা ইসলামের এই প্রথম রুকন ও মূলনীতির উপর মোটেই গুরুত্ব প্রদান করেনা। এই মূলনীতির দিকে পৃথিবীবাসীর নিকট প্রেরিত প্রথম রাসূল নূহ (আঃ) প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। আর একথা সকলের জানা যে, আমাদের দ্বীনের ন্যায় পূর্ববর্তী শরীয়ত সমূহের মধ্যে ইবাদত ও বৈষয়িক জীবনের আহকামগুলোর বিস্তারিত বিবরণ ছিলনা। কেননা আমাদের দ্বীন সর্বশেষ দ্বীন। এ দ্বীন পূর্বের সকল দ্বীনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছে। অথচ নূহ (আঃ) তাঁর জাতির মাঝে নয় শত পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত অবস্থান করে বেশীরভাগ সময় জাতির লোকদেরকে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে অতিবাহিত করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর জাতির লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবূল করে নাই। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
وَ قَالُوْا لاَ تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَ لاَ تَذَرُنَّ وَدًّا وَ لاَ سُوَاعًا وَ لاَ يَغُوْثًا وَيَعُوْقًا وَ نَسْرًا
“এবং তারা বলেছিল, তোমরা কখনও পরিত্যাগ করোনা তোমাদের দেবদেবী, পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সু’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকে”। (সূরা নূহঃ ২৩) এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম যে, সঠিক ইসলামের প্রচারকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল সদাসর্বদা তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া। আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ
فَاعْلَمْ اَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ
“আপনি জেনে নিন যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবূদ নেই”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর তরীকা এটাই ছিল যে প্রথমে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া। এ কথাটি বেশী বুঝিয়ে বলার দরকার নাই। মক্কী জীবনে রাসূল (সাঃ) সমস্ত কাজ-কর্ম অধিকাংশ সময়ই তাঁর গোত্রের লোকদেরকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তিনি কাউকে শিক্ষা দেয়ার সময়ও তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়ার শিক্ষা দিতেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুয়ায (রাঃ)কে ইয়ামানের গভর্ণর ও শাসক নির্বাচন করে পাঠালেন তখন তাকে বলে দিলেন যে,
فَادْعُهُمْ إِلَى أَنْ يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوا لَكَ بِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ
“তুমি তাদেরকে সর্বপ্রথম এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার প্রতি আহবান জানাবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবূদ নেই। তারা যদি তোমার এ কথা মেনে নেয় তবে তুমি তাদেরকে বল যে, আল্লাহ তা’আলা দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেছেন। যদি তারা এটিও মেনে নেয়, তখন তুমি তাদেরকে বল যে, আল্লাহ তোমাদের সম্পদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন। ধনীদের নিকট থেকে তা আদায় করা হবে এবং দরীদ্রদের মাঝে তা বিতরণ করা হবে। একথা যখন তারা মেনে নিবে তখন যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে বেছে বেছে ভাল সম্পদগুলো গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। আর বিশেষ করে অত্যাচারিত ব্যক্তির বদ দু’আ থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ অত্যাচারিতের বদ দু’আ এবং আল্লাহর মাঝে কোন আবরণ নেই। হাদীছটি সকলের কাছে পরিচিত।
সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা দিয়ে আরম্ভ করেছেন, তাঁর সাহাবীদেরকেও তা দিয়ে আরম্ভ করার আদেশ দিয়েছেন। আর তা হল তাওহীদের মাধ্যমে শুরু করা। কোন সন্দেহ নেই যে, জাহেলী যুগের মুশরিক আরব ও বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুসলমানদের মধ্যে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ বুঝার ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আরবের মুশরেকরা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ বুঝত। কিন্তু মুখে তা উচ্চারণ করতো না। এই জন্যই তাদেরকে মুখে এই বাক্যটি উচ্চারণ করার দাওয়াত দিয়েছেন। বর্তমান কালের সকল মাযহাবের ও ফির্কার অনেক মুসলমানই মুখে কালেমাটি উচ্চারণ করে কিন্তু এর অর্থ বুঝেনা। তাই তাদেরকে তা মুখে উচ্চারণের দাওয়াত দেয়ার প্রয়োজন নেই। তারা এই পবিত্র বাক্যটির অর্থ বুঝার প্রতি খুবই মুখাপেক্ষী। প্রথম যুগের আরবগণ এই পার্থক্যটি ভাল করেই বুঝতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখণ তাদেরকে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলার দিকে আহবান জানাতো, তখন তারা অহংকার করত। কুরআনে তাদের এই অহংকারের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা কেন অহংকার করতো? কারণ তারা এই বাক্যটির গভীর মর্মকথা অনুধাবন করেছিল। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এই কথা উচ্চারণ করলে আল্লাহর সাথে অন্য কোন অংশীদার নির্ধারণ করা চলবেনা, চলবেনা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত। অথচ তারা দীর্ঘদিন থেকে আল্লাহর ইবাদতের সাথে শরীক করে আসছে, গাইরুল্লাহকে আহবান করে আসছে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে আসছে। একই সাথে তারা গাইরুল্লাহর জন্য মানতি পেশ, গাইরুল্লাহর উসীলা দেয়া, গাইরুল্লাহর জন্য পশু যবাই করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে বিচার ফয়সালা নিয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন প্রকার শির্কে লিপ্ত ছিল।
এই সমস্ত বহুল প্রচলিত শির্কে লিপ্ত থাকার সাথে সাথে তারা এটাও জানত যে, এই পবিত্র বাক্য “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর দাবী হলো তাদের সমস্ত শির্কী উসীলা ও দেব-দেবীর সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন ঘোষণা করা। কারণ এই সমস্ত বাতিল মাবূদদের সাথে সম্পর্ক রাখা “লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ” এর অর্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন