ইসলামিক ক্রয়-বিক্রয় ও আমার দৃষ্টিভঙ্গী – ২
লিখেছেন লিখেছেন বুড়া মিয়া ২৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১১:১৩:৪৩ সকাল
এর আগের পোষ্টে আলোচনা করেছিলাম আমার জানা একটা হাদীসের কিছু অংশের আলোকে খেজুর বেচা-কেনার লাভ সম্বন্ধে, এবার তার চাইতে আরেকটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করবো স্বল্পজ্ঞানেই, দুইটা বাক্য সামনে রেখে, তা হচ্ছে –
‘ব্যবসাতো সুদের মতোই’ এবং ‘ব্যবসা হালাল আর সুদ হারাম’
এবার লাভের ব্যবসা এবং সুদের কারবার, এই দুইটার প্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে এই কারণে যে, কেনো এমন প্রশ্ন উঠতে পারে।
লাভের ব্যবসাঃ
যারা ব্যবসা করে, তারা দিন-রাত ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকে শুধুই লাভের চিন্তায়। এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যে জনসেবায় বা শুধুমাত্র প্রয়োজন পড়লেই বাজারে গিয়ে ক্রয়-বিক্রয় করতে বসে। এখানে এ ধরণের লাভের ব্যবসার মূল উপাদান পণ্য এবং সেবা। নিজের কাছে থাকা অর্থ, পণ্যে বা সেবায় বিনিয়োগ করে লস খাওয়ার এ্যডভার্স-রিস্ক কিংবা লাভ করার অপর্চুনিটি দুই-ই আছে এখানে; এখানে ব্যবসায়ীরা নিজেরা কি সে পণ্য বা সেবা উৎপাদন করার জন্য পরিশ্রম করে?
সোজা উত্তর হচ্ছেঃ না তারা পরিশ্রম করে না পণ্য উৎপাদনে, তারা করে লাভ/লসের উৎপাদন; ব্যবসায়ীরা হয় শ্রমিক নিয়োগ করে, শ্রমিকদের পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বা সেবা বিক্রি করে (প্রোডাকশনে নিয়োজিত কোম্পানী, যেমন গার্মেন্টস-টেক্সটাইল) অথবা, অন্য কারও শ্রমের উৎপাদন অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে কিনে এনে সোজা বিক্রি করে লাভে (শুধুই ট্রেডিং এ নিয়োজিত কোম্পানী, যেমন চাল-ডালের আড়তদার)। এখানেও ট্রেডার এবং প্রোডিউসাদের দুইজনেই স্পষ্ট দালাল, যা এর আগের পোষ্টেই বলেছিলাম!
দুই ধরনের ব্যবসায়ীরাই তাদের টাকা বিনিয়োগ করেছে ম্যানেজমেন্ট-লেবার খাটানোর জন্য এবং পণ্য কিনিয়ে এনেছে তাদের দিয়েই, তাদের মাধ্যমেই প্রোসেস করে অথবা না করেই বেচার জন্য। ব্যাপারটা হলো এমন যে, ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলাম (পণ্য + ম্যানেজমেন্ট + লেবার) আজকে, ১ মাসের মধ্যে প্রোসেস করে ১১৫ টাকায় সেগুলো বিক্রি করার জন্য, ১১৫ টাকায় বিক্রি করা গেলে ১৫% লাভ ১ মাসে; ধরে নিলাম ৩/৪ মাস লস খেয়ে এবং ৯/৮ মাস লাভ করে বছর শেষে তার নেট রিটার্ণ এসেছে ২০%; এই যে ২০% লাভ ব্যবসায়ী করলো যে পণ্য বা সেবা দিয়ে, তার উৎপাদনে অর্থ-বিনিয়োগকারীর কোন পরিশ্রমই লাগে-নি, যা পরিশ্রম করেছে সবই লেবাররা।
সুদের কারবারঃ
এখানেও ১০০ টাকা সুদের কারবারী বিনিয়োগ করে যার প্রয়োজন আছে তার কাছে, বিনিময়ে আশা করে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রিটার্ণ, ধরলাম ২০%। এই সুদের কারবারীরও লস খাওয়ার চান্স আছে এবং এই চান্স ব্যবসায়ীর চাইতে বেশী! ব্যবসায়ী টাকা বিনিয়োগ করে পণ্য নিয়ে এসে প্রোসেস বা ট্রেড করে, তাই তার রিজার্ভে পণ্য থেকে যায় বেচার আগ পর্যন্ত, সামান্য কিছু লস দিয়ে হলেও রিকভার করতে পারে যেকোন সময় অথবা নিজে ব্যবহার করে নিতে পারে; কিন্তু সুদের কারবারী টাকার বিনিময়ে বন্ধকী কিছু না নিলে, পুরাই মাইর খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এখানেও সুদের কারবারী বড় রকমের কারবারী হলে ব্যবসায়ীদের মতোই ম্যানেজমেন্ট চালায় ব্যবসায়ীর মতোই অর্থ বিনিয়োগ করে এবং বছর শেষে একটা পরিমাণ নেট-সুদ অর্জন করে।
এখানে লাভের ব্যবসায়ী এবং সুদের কারবারী উভয়েই কি বিনা পরিশ্রমে লাভ করতেছে না ম্যানেজমেন্ট বসিয়ে? এবং হিসাব করলে অবশ্যই দেখা যাবে – এই দুই দলের মধ্যে লাভের ব্যবসায়ীর লাভ বেশীঃ যে জন্য তাত্ত্বিকভাবেও বলা হয় কষ্ট অফ ইক্যুইটি সবসময় কষ্ট অফ ডেট থেকে বেশী হয়, অন্যভাবে কষ্ট অফ ইক্যুইটি বা লাভের ব্যবসায়ীর লাভ সবসময় কষ্ট অফ ডেট বা সুদের বিনিময়ে ঋনের কারবারীর অর্জন থেকে বেশী হয়।
তবে আমাদের দেশের শেয়ারবাজারের শেয়ারহোল্ডারদের দিকে খেয়াল করলে তাত্ত্বিক এ বিষয়ের কোন প্রমাণ মেলে না, এদেরকে প্রায়ই কোন ক্যাশ ডিভিডেন্ড (কষ্ট অফ ইক্যুইটি) দেয়া হয় না, হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাগজ বা বোনাস বা স্ক্রিপ ডিভিডেন্ড ধরিয়ে দিয়ে ওদের মধ্যেই বেচা-কেনার মারামারি লাগিয়ে দিয়ে লাভের ব্যবসায়ীরা আরও লাভ করে সেখান থেকে!
অবস্থা যদি এরকম হয়, তবে কেনো বলা হবে না যে, ‘ব্যবসাতো সুদের মতোই’; সব ন্যাচার-তো একই দুই দলের, উপরন্তু লাভের ব্যবসায়ী বিনাশ্রমে সুদের কারবারীর চাইতেও বেশি অর্জন করে যাচ্ছে! এটা কি সুদের চাইতেও ভয়াবহ হচ্ছে না?
এক্ষেত্রে যদি পার্থক্য করতে হয়, তবে আগের পোষ্টে যে খেজুর ক্রয়-বিক্রয়ের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, ঐরকমভাবেই লাভ ছাড়া নিজের পরিশ্রম করে ট্রেড করতে হবে না? সুদের কারবারীর কাছে ঋনগ্রহীতা পরিশ্রম করে উপার্জনের অংশ দিয়েছে সুদ হিসেবে, একইভাবে লেবারের উপার্জনের অংশ লাভের নামে ব্যবসায়ী মেরে খেয়েছে; দুই ক্ষেত্রেই দুইজনই অন্যের পরিশ্রমের ফল বিনাশ্রমে দেখাশুনার নামে আনন্দে ঘুরে ফিরেই খেয়ে ফেললো! এই ধরনের ব্যবসা কি হালাল?
ইমরান নযর হোসাইন এর একটা বই পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম, সূরা নজম এর ৩৯ নং আয়াত এর উল্লেখঃ
‘মানুষ যার জন্য পরিশ্রম করেছে সেটা ছাড়া অন্য কিছুরই উপর তার অধিকার নেই’
ধরলাম গার্মেন্টস-টেক্সটাইল-ওয়ালা, সে-তো কাপড়ে এক ফোটা পরিশ্রম করে না, কাপড়ে লেগে থাকা ১০০% পরিশ্রম শুধুই লেবারের, এখানে সেই কাপড় বেচার লাভে গার্মেন্টস-টেক্সটাইল-ওয়ালার কোন অধিকার আছে? অধিকার যদি নিতে হয়, গার্মেন্টস-টেক্সটাইল-ওয়ালাকে আগে হিসাব করতে হবে এভাবে যে, আমি আমার সমস্ত টাকা বিনিয়োগ করে আমার নিজের দুই হাত এবং দুই পা লাগিয়ে কতোটুকু কাপড় একলা বানিয়ে বেচে লাভ করতে পারি, অতোটুকুই আমার প্রাপ্য, এর বাইরে কি তার পরিশ্রমের সুযোগ আছে টাকা থাকলেও, মানে ৫০০ মেশিন কিনে নিজের দুই হাত বা পা দিয়ে চালানোর চান্স আছে তার?
তার তো উচিৎ ছিলো লেবারদের কর্জ দিয়ে দেয়া, এবং লেবারদের সৎ পথ প্রদর্শন বা পরিশ্রম করে পারিশ্রমিক অর্জনের জন্য বলা অথবা, লকারে টাকা ফেলে রেখে হলেও লেবারদের উপর অবিচার না করা এবং সময়মতো যাকাত দিয়ে দেয়া। কর্জ দিলে যা হতো তা হচ্ছেঃ লেবাররা একেকজন মেশিন কিনে বসতো এবং তা দিয়ে কাপড় বানিয়ে বেচে লাভ করে করে কর্জ পরিশোধ করতো সুদ ছাড়া এবং মেশিনের মালিকানা থাকতো লেবারদের, প্রয়োজনে লেবাররা মেশিন বেচে একবারে পরিশোধ করে দিতেও পারতো।
আর ঐদিকে কর্জ যে দিতো, সেও নিজে শুধুমাত্র তার পরিশ্রমের বিনিময়ের অর্জন খেতো। এক্ষেত্রে টাকার মালিক এবং কর্জ নেয়া দুইজনের পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য উপার্জনের পরিমাণও প্রায় সমানই হতো, তাই না? তাহলে কর্জ না দিয়ে তারা লেবারদের বাধ্য করাচ্ছে কেনো তার কাছে কাজ করতে? উত্তর একটাইঃ নিজের একলা পরিশ্রমে যা লাভ করা যায়, এই রকম সিষ্টেমে তার চাইতে বেশী কামাই করা যায়! এই কারণেই অনেকে বলতে চায়, ব্যবসা সুদের মতোই অর্থাৎ, বিনাশ্রমে অন্যের শ্রমের ফল মেরে খাওয়া! আমার যুক্তি বা বোঝায় কি ভুল হয়েছে?
এই জন্য আমার বুঝ মতো আগের আরেক পোষ্টে বলেছিলাম, যেখানেই সম্মিলিত পরিশ্রম এর ফল আসবে, সেখানে গণিমত ষ্টাইলে বন্টন হবে, কেননা পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করতে গেলে, ব্যক্তিবিশেষ এর অবদান সামান্য এদিক সেদিক হওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই! এছাড়াও আরও মনে হয়েছে ইসলাম এভাবে সবাইকেই পরিশ্রম করতে বলে, যাতে করে প্রয়োজন না পড়লে কারোই ফাও লাভের আশায় ট্রেড এর জন্য নিকৃষ্টতম স্থান বাজারে যাওয়ার দরকার না পড়ে, আর একান্তই দরকার পড়লে ট্রেড হবে আগের পোষ্টের খেজুর-ষ্টাইলে বাজারে অথবা আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে, যাতে করে স্পষ্টভাবে ক্রয়-বিক্রয় আলাদা হয় বিনাশ্রম লাভের বা সুদের ব্যাপার থেকে।
বিষয়: বিবিধ
১৮৩৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখাটি খুব ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন