অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা – ১১

লিখেছেন লিখেছেন বুড়া মিয়া ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:২৫:২৮ রাত

ব্যাংকিং-ব্যবস্থা সমাজে যে অবিচার করে, সেটা আসলে টিকিয়ে রেখেছে এই সমাজেরই অনেক মানুষ, যাদের সামর্থ্য ছিলো এ ব্যবস্থাপনাকে বদলে দেয়ার, কিন্তু তাদের বাজে ইচ্ছা বা লোভই মূলত এ ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রেখেছে, আর এর কুফল বাধ্য হয়ে অনেকেরই ভোগ করতে হচ্ছে; তবে আমি যেটা মনে করিঃ এটা পূর্ব-নির্ধারিত একটা বিষয়ই ছিলো যে ব্যাপারে আমরা ভবিষ্যদ্বানী জেনে এসেছিলাম এমন যে – প্রত্যেক মানুষকেই কোন না কোনভাবে সুদ স্পর্শ করে ফেলবে।

পূর্বযুগের সুদ ব্যবস্থাপনার ব্যাপার ছিলো একরকম আর বর্তমানের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার সুদ তার চাইতেও ভয়াবহ রকম। আগের যুগের সুদ ছিলো স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রায় প্রদেয়, এখন সেটা কাগুজে মুদ্রায়; আগের যুগের স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রায় সুদ নিলে বা দিলেও সেটা ছিলো মূল্যবান জিনিস, সীমিত আকারে, একটা নির্দিষ্ট লিমিট পর্যন্ত (যা গোল্ড-সিলভারের উৎপাদন দ্বারা সীমিত) এবং স্বভাবিক পণ্য-সেবা দিয়ে উপার্জন করা যেতো, আর এখনকার কাগুজে সুদ আনলিমিটেড এবং ক্রিমিনাল না হলে অসম্ভব এটা প্রদান করা। বর্তমান প্রচলিত সুদ ব্যবস্থাপনা যতোটা না লাভ অর্জনের জন্য, তার চাইতে বেশী ব্যবহার করা হয় এটা মানুষকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখার জন্য, এটা এমনই এক শৃংখল যেটা থেকে গাণিতিকভাবে কখোনই কারও পক্ষে বেরিয়ে আসা সম্ভব না, পুরোনো এ ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে নতুন করে না সাজালে।

এ ব্যবস্থাপনা সারা বিশ্বেই একই রকমঃ একটা নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট আর কি! একেকটা দেশে সেন্ট্রালী কন্ট্রোল করে সে দেশের সরকারঃ ট্রেজারী-ডিপার্টমেন্ট এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকের মাধ্যমে, আর সেন্ট্রাল ব্যাংক রিপোর্ট করে আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থার কাছে, যাতে করে বৈশ্বিক সরকার এগুলোর হিসেব করে, তাদের মন মতো ব্যবহার করতে পারে একেকটা দেশ ও জাতিকে। ব্যাংকিং সিষ্টেম কিভাবে এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে, তা বলার আগে জানবো মানুষের কোন চরিত্র এ ব্যবস্থাপনা চলতে সাহায্য করছে।

এ ব্যবস্থাপনা চলার পেছনে মূলত মানুষের লোভ এবং ভোগের মাত্রাতিরিক্ত ইচ্ছাই দায়ী। সাধারণ একজন মানুষ উন্নতি বলতে অর্থনৈতিক লাভকেই বুঝে আর এ অজানা ও অলীক উন্নতির আশায় অকাতরে বিলিয়ে দেয় তার মেধা ও শ্রম মূল্যহীন মুদ্রার পেছনে সামান্য ভোগের আশায়, আর এর জন্য নিযুক্ত করে আরও হাজারো মানুষের মেধা ও শ্রম; যা সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করলে হয়তো বা অর্থনৈতিক মুদ্রা ছাড়াই তাদের সবাই-ই তা ভোগ করতে পারতো অনায়াসে শ্রম না দিয়েই (একবার আবিস্কার করলে পুনরায় এতো শ্রম আর লাগে না)। এর আগের একটা পোষ্টে বলেছিলাম – প্রত্যেক লাভেরই সমান ক্ষতি রয়েছে, মানে একজন মানুষের লাভের ইচ্ছা পূরণ আরেকজন মানুষের ক্ষতি বা ত্যাগ ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।

সারা বিশ্বে যদি মুদ্রার পরিমান স্থির করে রাখা হয় এবং এখানে যদি কিছু মানুষ প্রত্যেক বছর ২০% করে লাভ করে, তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্বের সমস্ত মুদ্রা ঐ কিছু মানুষের কাছেই পুরোপুরি চলে যাবে এবং বাকী মানুষদের হাতে কিছুই থাকবে না, লাভের ইচ্ছা এভাবেই অন্যান্য সাধারণদের ক্ষতি করে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়। আর এ লাভের প্রতিযোগিতা মানুষের মধ্যে নিয়ে আসে অসৎ চরিত্র, কে কিভাবে কতো তাড়াতাড়ি মুদ্রা জমিয়ে ধনবান হবে তার জন্য হীন কোন কাজ তারা করতে কুন্ঠাবোধ করে না। এবার এই লাভ থেকে যদি সদকা করা হয়ঃ যারা লাভ করলো ২০% তারা সদকা করবে ১০%, তবে কি হবে? এরকম স্থির মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় পূর্বের চাইতে দ্বিগুন সময়ে সমস্ত মুদ্রা ওই লাভ অর্জনকারী ও দানকারীদের হাতে চলে যাবে, নেট এ্যাকুমুলেশন-রেইট হবে ২০% এর জায়গায় ১০%। এ থেকে মুক্তির জন্য উপায় একটাই – যা ইনকাম করবে তার পুরোটাই ব্যবহার করতে হবে, যেখানে যেভাবে লাগে! যতোক্ষণ না করবে যতোই হাউকাউ করুক কোন লাভ নাই, সব একদিকে কেন্দ্রীভূত হবেই হবে।

এই যে লাভের ইচ্ছা, একেই বলে পূজিবাদী মানসিকতা; আর এরকম সব কিছুতেই লাভ-ক্ষতির হিসাব যারা করে, তাদেরকে বলে পূজিবাদী। এই পূজিবাদী ব্যবস্থা কি নির্মূল সম্ভব? মনে হয় সম্ভব না, কেননা সেখানেও ভবিষ্যদ্বাণী জেনেছি এমন যে – সব মানুষ যদি একমূখী হয়ে না যাওয়ার আশঙ্কা থাকতো, তবে কাফেরদেরকে দেয়া হতো স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত অনেক কিছু! এই যে কাফের বলা হলো তাদের, কেনো? আমার মনে হয় এই জন্য যে, তাদের পূর্ণ ঈমান মুদ্রা বা স্বর্ণ-রৌপ্য এর প্রতি বা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে টাকার প্রতি, তাদের অনেকেরই প্রচলিত প্রবাদ – ‘টাকা থাকলে সব সম্ভব’ (এটা তাদের ঈমান বা বিশ্বাসের গভীরতা, সর্বোচ্চ ঈমান তাদের টাকার উপর), তাই মনে হয় এমন বলা হয়েছে।

এছাড়াও, যে সময়ের ভবিষ্যদ্বানী এটা, তখন স্বর্ণ-রৌপ্যই বর্তমানের কাগুজে মুদ্রার স্থানে ছিলো, তার মানে বোঝা যাচ্ছে এখানে আমাদের কিছু করার নেই! পূজিবাদীদেরকে দেয়া হবেই (যে কোন ব্যবস্থাপনায়ই হোক না কেন) এবং আরও বেশিই দেয়া হতো যদি বাদ বাকী সবার কাফের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকতো! এছাড়াও এরকম পূজিবাদীদের আরেকটা চরিত্রেরও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে অনেকটা এমন – তারা গণনা করতেই থাকে, যদিও তারা কবরে পৌছে যায়! তাহলে কি এরকম পরিবেশে জন্ম নেয়া সবাই-ই কাফের? নাহ, তাও হতে পারে না, সেখানেও ভাল মানুষ থাকার কথাঃ সুলায়মান (আঃ) ছিলেন এমন পরিবেশে।

এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ইসলামে পূজিবাদীদের ব্যাপারে বলা হলো, তাহলে ইসলাম পূজিবাদীদের থেকে কিভাবে আলাদা? যেহেতু ইসলাম পূজিবাদীদের চরম কটাক্ষ করেছে – তার মানে অবশ্যই এখানে পূজিবাদের স্থান নেই, কি আছে এতে তবে? সূরা বালাদ এর ১০-১৭ নম্বর আয়াতে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে এর একসাথে সংক্ষিপ্তাকারে – দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হতে বলা হয়েছে সেখানে, অনেকটা এভাবেঃ

এবং আমি কি তাকে দু'টি পথই দেখাইনি? কিন্তু সে দুর্গম গিরি পথে প্রবেশ করলো না। তুমি কি জান যে, দুর্গম গিরি পথটি কি? এটা হচ্ছেঃ কোন দাসকে মুক্ত করা; অথবা, দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য দান; কোন ইয়াতীম, আত্মীয়কে, অথবা ধুলায় লুন্ঠিত দরিদ্রকে, তারপর তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের ও দয়া করুণার।


তার মানে দুর্গম গিরিপথ পূজিবাদ থেকে অবশ্যই আলাদা কিছু এবং এটা সমাজবাদের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায় (তবে এক শ্রেণীর লুটপাটের যে সমাজবাদ, সেটা না), ইসলামি এ সমাজব্যবস্থা হবেঃ হয় সামগ্রিক (রাষ্ট্রীয়) অথবা ব্যক্তিগতভাবে! যাকাত দিয়ে এগুলো দূর করা গেলে সেটা দিয়ে অথবা তা দিয়ে যদি না হয় তবে দান করেই, খালি যাকাত দিয়ে যতো খুশী ততো, যেমনে খুশী তেমনে লাভ করলে হবে? কখনোই না, তা উপরে ২০% লাভ অর্জনকারীদের ১০% বন্টনে ভালোভাবেই বোঝা গেছে, আর সেখানে যাকাত-তো মাত্র ২.৫%। উপরে সূরা বালাদের দুইটা শব্দ বেশ জুতসই প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ব্যাখ্যায় তা হচ্ছে দাসত্ব এবং দারিদ্র!

প্রচলিত ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং যতোদিন চলবে মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করাতো সম্ভব না-ই, আরও বেশি কিভাবে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করা যায় – তার একটা পদ্ধতি এটা এবং এটা শুধু এক শ্রেণিকেই মুদ্রায়-ধনী করে অন্যদেরকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রেখে! ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং এর রুট বোঝার জন্য ঠাকুর-মার ঝুলিতে গোল্ডস্মীথ টেইল রয়েছে, ইউটিউবেও আছে বেশ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। এটাকে ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ বলে এ জন্য যে, এখানে টোটাল রিজার্ভ যা থাকার কথা তার একটা ফ্র্যাকশনাল বা সামান্য পরিমাণ বাদ দিয়ে আর সব রিজার্ভ থেকে ধাক্কিয়ে বের করে দেয়া হয় বাজারে! এটা করে একটা টুল দিয়ে সেটাকে বলে রিজার্ভ রেশিও, এটাই অনেকের মতে মানি-সাপ্লাই ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ!

বিশ্বের সব দেশেরই মানিটারী ম্যানেজমেন্ট একই, অল্প কিছু টুল দিয়ে টোটাল এ সিষ্টেম চালানো হয়। সব দেশেই মানি সাপ্লাই এর সোল-অথরিটি ট্রেজারী এবং সেন্ট্রাল-ব্যাংক; এটা সম্বন্ধে আমার জানা মতে বাখ্যা করবো, আমার জানামতে মানিটারী রেগুলেশনের টুলগুলো হচ্ছেঃ

১/ ব্যাংক-রেইট/ডিসকাউন্ট রেইট

২/ ওপেন মার্কেট অপারেশন

৩/ রিপো, রিভার্স রিপো

৪/ রিজার্ভ রেশিও

৫/ ইন্টারভেনশন

এগুলো বিশ্বের সব দেশেই একই, ইন্টারভেনশন সাধারণত ফরেইন-এক্সচেইঞ্জের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় বিধায় এটা আলোচনার বাইরে আপাতত; ব্যাংক-রেইট, ডিসকাউন্ট-রেইট অনেকে একই অর্থে ব্যবহার করে আবার কেউ কেউ আলাদা করে, তবে আলাদাই যুক্তিসঙ্গত; ব্যাংক-রেইট বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে চলে কিন্তু উদ্দেশ্য একই।

এখানে সেন্ট্রাল ব্যাংক ইন্টারেষ্ট মার্কেটকে একটা দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপারেশন চালায় যেটা ওপেন-মার্কেট অপারেশন নামে পরিচিত, এর জন্য তারা ব্যবহার করে বন্ড, বিল। এরা এগুলো কিনে এবং বেচে।

সাধারণত বন্ড-বিলের সাপ্লাই দেয় সরকার কোথাও কোথাও সেন্ট্রাল ব্যাংকও দেয়, আমাদের দেশে মনে হয় সেন্ট্রাল ব্যাংক এরও বিল রয়েছে, এছাড়াও এক্সচেইঞ্জ বিলও এর অন্তর্ভুক্ত; এ গুলো আসলে একটা কাগজে সিগনেচার দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে আমি তোমাকে এতো পার্সেন্ট ইন্টারেষ্ট দিয়ে এতোদিন পরে টাকা পরিশোধ করবো, আমাকে এখন টাকা দাও। এই টাকা দিতে বলে সরকার, কমার্শিয়াল বা সেন্ট্রাল-ব্যাংক-কে, কমার্শিয়াল ব্যাংকের কাছে টাকা থাকলে সেই কাগজ ওরা কিনে নেয় সরকার থেকে টাকা দিয়ে, সরকার সেই টাকা খরচ করে, আর না হলে সেন্ট্রাল-ব্যাংক-কে ধরিয়ে দিয়ে প্রিন্ট করে টাকা নিয়ে এসে খরচ করে।

এরকম বন্ড-বিল বিভিন্ন মেয়াদের রয়েছে, আমাদের এখানে সর্বোচ্চ মনে হয় ২৫ বছরের। এখানে সরকার যদি সেন্ট্রাল-ব্যাংক-কে ধরিয়ে দেয় তবে ফিজিক্যাল-কারেন্সী সরাসরি বেড়ে যায়, আর যদি কমার্শিয়ালদের ধরিয়ে দেয় তবে ওদের টাকা ট্রান্সফার হয়ে আসে সরকারের কাছে আর সরকার থেকে মানুষের কাছে, কমার্শিয়ালরা আবার এই কাগজ নিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে যাবে আর সেন্ট্রাল ব্যাংক চালাবে অপারেশন, সেন্ট্রাল ব্যাংক কমার্শিয়ালদের কাছ থেকে সেগুলো কিনে (ওপেন-মার্কেট পারচেজ) প্রিন্ট করে টাকা ধরিয়ে দিবে অথবা ইলেক্ট্রনিক্যালী একাউন্টে পোষ্টিং দিয়ে রাখবে দরকার পড়লে দিবে। আবার যদি মনে করে সেন্ট্রাল ব্যাংক যে, কমার্শিয়ালদের কাছ থেকে টাকা এনে ভরে রাখবে তাহলে অপারেশন চালিয়ে (ওপেন মার্কেট সেল) ওদেরকে বন্ড-বিল ধরিয়ে দিয়ে ওদের কাছে থাকা টাকা নিয়ে আসবে। সরকার, ইন্টারেষ্ট মার্কেট বা অন্য অনেক কিছু মনে করে এটা তারা করে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য।

রিপো (Repurchase agreement [Repo]) বা রিভার্স রিপোও একইভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটা ইন্টারেষ্ট-রেইট টার্গেট করে না; কোন ইনষ্টিটিউশনের ইমার্জেন্সী টাকা দরকার পড়লে সে সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে যাবে, বলবে আমাকে টাকা দাও, সেন্ট্রাল ব্যাংক বলবে এমনে এমনে দেবো না, তোমার কি আছে দাও আমার কাছে বন্ধক। তারা তাদের বন্ড, বিল, ইত্যাদী বন্ধক দিবে সেন্ট্রাল-ব্যাংকের কাছে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে পুনরায় কিনে আনার ওয়াদা করে, এই যে পুনরায় কিনে আনার ওয়াদা এটা রিপারচেজ-এ্যাগ্রিমেন্ট, এখানে যে রেইট ব্যবহার করা হয় লাভ/ক্ষতির হিসেব করার জন্য, এই রেইটকে অনেকে ডিসকাউন্ট রেইট বলে; একইভাবে সেন্ট্রাল ব্যাংক এর যদি টাকার দরকার হয় সরকারকে দেয়ার জন্য বা অন্য কোন কারণে, তাহলে সেন্ট্রাল ব্যাংকও এরকম বন্ধকী দিতে পারে কমার্শিয়ালদের কাছে সরাসরি প্রিন্ট না করে, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো হয় বিধায় সেখানে এর নাম হয় রিভার্স-রিপো।

মানি-সাপ্লাইয়ে সবচাইতে বেশি অবদান রাখা রিজার্ভ রেশিও, আমাদের দেশে এস.এল.আর/সি.আর.আর নামে পরিচিত। এই সেট করা রেইট বা পার্সেন্টে যে এ্যামাউন্ট হিসেব করলে আসে সেটা রিজার্ভে রেখে বাকী সব টাকা উজার করে দিলেও ব্যাংক এর জন্য দায়বদ্ধ না দেউলিয়া হয়ে গেলেও! এই রিজার্ভ-রেশিওর কারণেই দেউলিয়া অর্থব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয় এবং প্রযোজনা করে সরকার বা রাজনীতিবিদরা, যেহেতু এটা কমার্শিয়াল/ন্যাশনালাইজড/স্পেশালাইজড ব্যাংক দিয়ে করতে হয়, তাই দেখা যায় কমার্শিয়াল সবগুলোর মালিকানা ঐ শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের কাছেই, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোলামদের মালিকের তকমা দিয়ে বসিয়েও রাখা হয়।

দেউলিয়া অর্থব্যবস্থাপনা এটা এজন্যই যে, এর মাধ্যমে কোনদিনও কারও দেনা শোধ হবে তো না-ই, দেনা আরও না বাড়ালে আগের দেনা শোধই করা যায় না! দেনা বাড়ে সরকারের এবং পাবলিকের, এ ব্যবস্থাপনা চলে এ জন্যই যে এতে করে লোভী মানুষদের বদৌলতে অন্যান্য অনেককেই ইচ্ছামতো দাসত্বে নিযুক্ত রেখে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, এ কাগজের প্রতি ঈমান আনার কারণে ওর পিছনেই ছুটবে সবাই, তাই ঝুকিমুক্ত ব্যবস্থাপনা চালাতে কোন অসুবিধা হয় না!

এই রিজার্ভ রেশিওর কারণে দেনা কি পর্যন্ত বাড়তে পারে, তার সর্বোচ্চ লিমিট বের করা যায় গাণিতকভাবে যা মানি-মাল্টিপ্লাইয়ার নামে পরিচিত; মানে রিজার্ভ রেশিও যদি ১০% হয়, তবে সেন্ট্রাল ব্যাংক ১০০ টাকা প্রিন্ট করে ধরিয়ে দিলে সর্বোচ্চ লোন দেয়া যায় ১০০/.১০=১,০০০ টাকা। এটা আবার পূর্বের প্রিন্ট করা পাবলিকের হাতে থাকা টাকা কমার্শিয়ালদের কাছে আসলে এ্যাডজাষ্টেড মাল্টিপ্লাইয়ার বের করা হয় প্রিন্সিপাল এ্যামাউন্ট বিয়োগ করে। তবে কোন দেশেই এটা ম্যাক্সিমাম লিমিট স্পর্শ করে না বিভিন্ন কারণে, তাই সেটার জন্য মাল্টি-ভ্যারিয়েবল ফাংশনাল এ্যানালাইসিস করা হয় কারেন্সী-ডিপোজিট রেশিও, এক্সেস রিজার্ভ-রেশিও ইত্যাদী কনসিডার করে। এটা কেনো দেউলিয়াত্বের মূল তা অনেকে হিসেব করে বের করেছে এভাবেঃ

শুরুতে ধরে নিতে হবে বিশ্বে কোন টাকা ছিলো না, সেন্ট্রাল ব্যাংক প্রিন্ট করেছে ১১১.১১ টাকা, সারা বিশ্বে একটাই ব্যাংক এবং সমস্ত জনগণ ব্যাংকিং এর আওতায়, মানে ব্যাংক ছাড়া কোন ট্র্যানজেকশন হয় না! আর ব্যবসার জন্য লোন নিতে সবাই উদগ্রীব! তো রিজার্ভ রেশিও ১০% হলে সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে জমা থাকবে রিজার্ভে ১১.১১ টাকা আর বাকী ১০০ টাকা ব্যাংকের ক্যাশ ব্যালেন্স হিসেবে থাকবে; এটা যে কাউকে লোন হিসেবে দিয়ে দেয়া হবে, সেক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে লোন সম্পদ হিসেবে ১০০ টাকা দেখা যাবে, আর সবাই যেহেতু ব্যাংকিং এর আওতায় তাই সে ১০০ টাকা সে ব্যাংকেই ডিপোজিট করবে যা ব্যাংকের লায়াবিলিটি হিসেবে থাকবে। যেহেতু এই লোনই আবার ডিপোজিট হিসেবে ব্যাংকের কাছে থেকে গেলো, তাই আবার সে ১০% রিজার্ভ রেখে ৯০ টাকা লোন স্যাংশন করবে, এভাবে করতে করতে এটা সর্বোচ্চ হবে ১,০০০ টাকা মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্টের কারণে। এখানে ১০০ টাকাকে বলা হবে মানিটারী-বেইজ এবং ১,০০০ টাকা টোটাল মানি সাপ্লাই। এগুলো আরও ক্লাসিফিকেশনের জন্য M1, M2, M3, এগ্রিগেট মানিটারী এ্যাসেট হিসেবে ভাগ করা হয়। আমাদের দেশে ট্রেজারী মনে হয় চাইরানা, আটানা থেকে দুই টাকা পর্যন্ত বাজারে ছাড়ে আর ৫ টাকা থেকে শুরু করে উপরের সব ব্যাংক নোট সেন্ট্রাল ব্যাংকের দায়িত্বে।

এই যে ১০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা লোন ব্যাংকেই ডিপোজিট করার কারণে ডিমান্ড-ডিপোজিট (কারেন্ট-এ্যাকাউন্ট) হয়ে গেলো, এটা সবাই উত্তোলন করতে চাইলে ১,০০০ টাকার ফিজিক্যাশ ক্যাশ প্রিন্ট করে দিতে হবে এবং দেয়া হয় আইনগতভাবেই; প্রিন্টেড এই ১,০০০ টাকা নিয়ে ঋনগ্রহীতারা বাইরে গেলো ধরে নিলাম, এবং তাদের লোন দেয়ার সময়েই বলা হয়েছে তোমরা ব্যাংকে ১০% ইন্টারেষ্ট সহ ১ বছরের মধ্যে ১,১০০ টাকা ফেরত দিবে, আর না দিতে পারলে বন্ধক দাও তোমাদের জমি-সম্পত্তি, তারাও বন্ধক দিয়ে ১,০০০ টাকা নিয়েছে। এখন টাকা প্রিন্টের সোল অথরিটি যে, সে-তো প্রিন্ট করলো ১,০০০ টাকা, বিশ্বে তো আর কোন টাকা নাই, ১,১০০ টাকা কিভাবে দিবে ঋনগ্রহীতারা? ইন্টারেষ্টের ১০০ টাকা ঋনগ্রহীতারা প্রিন্ট করে দিতে গেলে জাল টাকা বানানোর অপরাধে তাদেরকে মারা হবে তো, কিন্তু দিতেও তো পারবে না!

এই মুহুর্তে লোন স্যাংশন এবং টাকা প্রিন্ট বন্ধ করে সবাইকে ফেরত দিতে বললে, কখনোই সম্ভব না বিধায় – এ ব্যবস্থাপনাকে বলে দেউলিয়া-অর্থব্যবস্থাপনা। এই লোন নিয়ে এর পর যা শুরু হয়, তা আন্তঃপ্রতিযোগিতা! কে কাকে মেরে কার পকেট থেকে বের করে এনে ব্যাংকে দিয়ে খেলাপী হওয়া থেকে বাচবে তার প্রতিযোগিতা, মানে কে কতো লাভ করতে পারে ক্রিমিনালী করে! কেউ কেউ প্রতিযোগিতায় জিতে স্বার্থক হয়ে ট্রিপল-এ রেটেড ঋনগ্রহীতা হয়, কেউ কেউ খেলাপী! এখানে মানুষ এমন প্রতিযোগিতায় নিযুক্ত হলো যাতে কেউ না কেউ মার খাবেই, খেতেই হবে!

এই প্রসেসটাই কনষ্ট্যান্টলী চলছে সারা বিশ্বে, আর এখন ফিজিক্যাল মানির সাথে আরও যোগ হয়েছে ইলেকট্রনিক মানি, তবে সবই কন্ট্রোলড রিজার্ভ রেশিও দিয়ে। কখনো কখনো সরকার টাকা এনে খরচ করে বিভিন্ন শ্রেণিকে ধরিয়ে দেয় বিভিন্নভাবে যাতে তাদের সবাই খেলাপী না হয় – এতে করে ক্রমাগত সরকারের দেনা বা পাবলিক-ডেট বাড়তেই থাকে, ব্যাংক কখনো বিভিন্ন ক্লাসকে বেতন দিয়ে দেয়, অন্যান্যরা নিজেরা নিজেরা লাভের জন্য মারামারি করে, বাকীরা গোলামী করে কোনরকমে দিনাতিপাত করে, ইত্যাদী নিয়ে এক প্রসেসে ব্যাপারটা এভাবেই চলছে সারা বিশ্বে – এ দেউলিয়া ব্যবস্থাপনার বয়স খুব বেশি হয় নি এখনও, বাচ্চা লেভেলে দৌড়াদৌড়ি করছে! এবং এ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা বাচ্চারা এসব তথ্যের অনেক কিছুই লুকিয়ে লুকিয়ে করছে বাচ্চাদের-স্বভাবসুলভ কারণেই! আর বড়রা তাদের সাবধান করছে গুরুজনদের হাতে মাইর খেয়ে চামড়া-হারা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে, দেখা যাক কি হয় শেষ-মেষ!

এই লোন যারা নিচ্ছে, তারা বন্ধক দিচ্ছে তাদের সব সম্পদ ও সময় ঐ এক শ্রেণীর মানুষের প্রিন্ট করা কাগজের জন্য, এবং পুরো জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে তাদেরই প্রিন্ট করা কাগজ অর্জনের জন্য, নিযুক্ত করছে নিজেদের সাথে বাদ-বাকী মানুষদেরও ব্যবসার নামে পরের গোলামীতে। এখানে রাজা-বাদশা আপাতত ব্যাংক এবং সেসবের মালিক রাজনীতিবিদ। এরা এই কাগজ কোন পরিশ্রম না করে অংক করে কামাই করছে – ইচ্ছা করলে প্রিন্ট করেও করতে পারতো, সেটা দিয়েই আবার সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে পণ্য-সেবা-সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে; সাধারণকে দৌড়ের উপরে রাখছে লোন ধরিয়ে দিয়ে, আর সাধারণরা দৌড়াচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতির মোহে! এভাবে অত্যাধিক প্রিন্ট এবং এ্যালোকেশনের কারণে টাকার পারচেজ পাওয়ার কমছে দিনকে দিন এবং সাধারণরা অনেক টাকা জমিয়েও আশানুরুপ রিয়েল-উন্নতি করতে পারছে না! হাতে গোনা খুব সামান্য কিছু অত্যাধিক চাতুরতাপূর্ণ ক্রিমিনালীর কারণে কিছু কিছু লাভও অর্জন করছে!

আমাদের সবাই এতে নিযুক্ত হয়ে গেছি এমনভাবেই যে, কোন মেয়ে বিয়ে বসবে না টাকা ছাড়া, কোন সন্তান বাপের কাছে থাকবে না টাকা ছাড়া, মা-বাবা সন্তানকে বকাঝকা করে টাকা ছাড়া, ইত্যাদী।

বিষয়: বিবিধ

১৫৭০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

274091
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:১১
আবদুল্লাহ বাংলাদেশী লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ, ভাই আপনাকে একটা ইমেইল করেছি।
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৪:২১
218046
বুড়া মিয়া লিখেছেন : মাঝে কয়েকদিন চেক করা হয় নি মেইল, রিপ্লাই দিয়েছি; ধন্যবাদ আপনাকে ...
274110
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:৫৪
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো।
১৪ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৪:২১
218047
বুড়া মিয়া লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File