অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা - ২

লিখেছেন লিখেছেন বুড়া মিয়া ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:৩৬:১৪ রাত

প্রতিযোগীতায় নামলে আসলে সব দিক থেকেই প্রতিযোগীতা করা উচিৎ, আর এ প্রতিযোগীতা দু’রকমের মোটামুটি সব দেশেই; এক – দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা, দুই – বহিঃবিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগীতা। আভ্যন্তরীনভাবে দেশের মানুষ একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতায় অবতীর্ণ হলেও, বহিঃবিশ্বের তুলনায় দেশেকে পিছিয়ে ফেলাটা কোন দেশেরই সাধারণ মানুষের এবং প্রতিযোগীদেরও কাম্য নয়। দেশকে অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে বা পিছিয়ে নেয়ার দোষ, দেশের মানুষের এবং সরকার – দুইয়ের উপরেই বর্তায়, সে আলোচনায় আপাতত যাবো না। অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতার মূল অস্ত্র প্রধানত দুইটি – ১) শক্তি খাটিয়ে (যুদ্ধ লাগিয়ে) লাভ করা এবং ২) ব্যবসা করে লাভ করা।

ব্যবসা করে লাভ করতে গেলে চলে আসে উৎপাদনশীলতা এবং কি উৎপাদন করছি, সেসব ব্যাপার। প্রত্যেকটা দেশের একটা নির্দিষ্ট সময়ের উৎপাদনকে মোট দেশীয় উৎপাদন বা GDP বলে; এটাকে বর্তমান বাজার মূল্যে (at Current price) এবং একটা নির্দিষ্ট বছরের বাজার মূল্যে (at Constant price) প্রদর্শন করার রেওয়াজ সবারই রয়েছে। এ GDP এর মধ্যে Indirect tax এবং Govt. Subsidy এর ব্যাপার সমন্বয় করে আরেক রকমের GDP বের করা হয়, যাকে GDP at factor cost বা Total value added বলা হয়। আর এসব GDP এর উপর একটা দেশের Price-level অনেক বড় ভূমিকা রাখে, যেমন বাংলাদেশের একজন ইকোনোমিষ্ট আমাদের দেশে কাজ করলে টোটাল ভ্যালু এ্যাড করে বছরে ১৫,০০০ – ২০,০০০ ইউ.এস. ডলার; কোন প্রকার স্পেশালাইজেশন ছাড়া এই একই ইকোনোমিষ্ট ইউ.এস.এ তে গিয়ে কাজ করলে সে ইউ.এস.এ-তে টোটাল ভ্যালু এ্যাড করে বছরে ৫০,০০০ – ১২০,০০০ ইউ.এস. ডলার। এরকম সার্ভিসের মতো একইভাবে প্রোডাক্টের প্রাইস-লেভেলও কাজ করে। একটা দেশের আভ্যন্তরীন বাজারে নিয়ন্ত্রণ এবং ফিস্ক্যাল ও মানিটারী পলিসি টাইট থাকলে এসব দিকে আসলে পিছিয়ে পড়তে হয় না খুব একটা; তবে আমরা অনেক পিছিয়ে।

আমাদের দেশের সাথে মালয়েশিয়ার টোটাল-ভ্যালু-এ্যাডেড তুলনা করলে যেটা হয়, তা নীচের চিত্রে দেখা যায় –



এখানে দেখা যায় শুরুর দিকে মালয়েশিয়া ভাল্যু-এ্যাডিশন এর ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে পিছিয়ে ছিলো এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে তো চলছেই। নীচের চিত্রে দুই দেশের এক্সপোর্ট এবং ইম্পোর্ট তুলনা করলে এমন হয় –



এখানে শুরু থেকেই মালয়েশিয়া আমাদের থেকে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টে এগিয়ে ছিলো, এবং শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে – মালয়েশিয়া ইম্পোর্টের চাইতে এক্সপোর্ট বেশী করছে, আর আমরা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইম্পোর্ট বেশী করি এবং এ পার্থক্য ক্রমবর্ধমান।

উপরের চিত্রগুলো United Nations Statistics Division এর ডাটা থেকে করা হয়েছে এবং এসব ডাটা সবার জন্যই উন্মুক্ত। মালয়েশিয়া কোন দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেখার জন্য এ সংস্থার Total value added এর ছয়টা বড় খাতকে নীচে সাতটা ভাগে ভাগ করা হলোঃ



৭ টা খাতের নীচে ইম্পোর্ট-এক্সপোর্টের দিকে লক্ষ্য করেলে দেখা যায়, মালয়েশিয়া বহিঃবিশ্বের সাথে প্রচুর ট্রেড করে। একইভাবে বাংলাদেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়ঃ



বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে, তবে গতি একটু কম। দুই দেশের লোকাল কারেন্সীর সাথে ইউ.এস.ডলারের রেইটও লক্ষ্যনীয়। ১৯৭২ এ যেখানে বাংলাদেশে ৭ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যেতো, ২০১২ তে সেখানে ১ ডলার পেতে প্রায় ৮২ টাকা লাগতো আর ওইদিকে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে তা হয়েছে পৌনে ৩ রিংগিত থেকে সোয়া ৩ রিংগিত এর চাইতেও কম, যদিও মনে হয় বাংলাদেশের সাথে ইউ.এস.এ এর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশের এক্সপোর্টের প্রায় পুরোটাই Textile-Clothing খাত থেকে আসে, তাই এখন World Trade Organization এর ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে ২০১২ সালের ডাটাবেইজ থেকে দেখবো টোটাল এক্সপোর্ট মার্কেটে এ খাতের কি অবস্থা এবং এ খাতে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার কি অবস্থান। World Trade Organization মোটামুটি ১৬০-৭০ টা দেশের ইনফরমেশন মনে হয় দিয়ে থাকে, যেগুলো বাদ পড়ে সেগুলো খুব একটা আহামরি কিছু না, তাই ওগুলোর মোটফলকেই টোটাল এক্সপোর্ট ধরবো। এছাড়াও এদের ডাটাবেইজে দেখা যায় প্রত্যেক বছরের টোটাল এক্সপোর্ট সমান সমান টোটাল ইম্পোর্ট হয় না – যদিও টেকনিক্যালী তা সমান হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে একেক দেশ একেক সময়ে রিপোর্ট করার কারণে এবং কিছু ডাটা এষ্টিমেটেড থাকার কারণে হয়তো এরকম সমস্যা হয়ে থাকে; তাই যে বছরগুলোর উপাত্ত নেয়া হয়েছে, সেগুলো এক্সপোর্ট এবং ইম্পোর্টের মধ্যে যেটা বড় সেটা নিয়ে করা হয়েছে।



প্রথম ব্লকে তাদের মার্চেন্ডাইজ এবং সার্ভিস ট্রেডের ডাটা এবং তার মোট ফল দেয়া হয়েছে, এটাকে আমরা ধরে নেবো ওয়ার্ল্ড এর মোট এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট মার্কেট। দ্বিতীয় ব্লকে Manufacturing খাত থেকে Textile and Clothing তুলে ধরা হয়েছে; এতে করে দেখা যাচ্ছে অংকে সংখ্যাটা বেড়ে গেলেও টোটাল মার্কেট শেয়ার ধীরে ধীরে কমছে এ দুই খাতের শেয়ার – ১৯৮০ সালে মোট এক্সপোর্টের ৩.৪৯% ছিলো এবং সেটা ২০১২ সালে এসে হয়েছে ২.৭৫%। শেষ ব্লকে এই দুই খাতে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ কে কতো এক্সপোর্ট করে ওয়ার্ল্ড মার্কেটে তা দেখানো হয়েছে, এখানে দেখা যাচ্ছে এ মার্কেটে আরও বেশী শেয়ার নেয়ার জন্য আমাদের গতি অত্যন্ত ক্ষিপ্র এবং মালয়েশিয়ার ধীর। এবারে বাংলাদেশ ছাড়া মালয়েশিয়ার সাথে অন্যান্য উন্নত এবং একই দিকে ধাবিত কিছু দেশগুলোর অবস্থা দেখবো। এখানে প্রত্যেকটা দেশের মোট মার্চেন্ডাইজ-এক্সপোর্টের মধ্যে লাইন-আইটেম গুলোর কতোটুকু অবদান তা শতকরা হারে প্রদান করা হয়েছেঃ



এখানে সোনা-রূপা-মুক্তা বেচা কেনায় দেখার মতো পজিশনে রয়েছে ইউ.কে এবং ইন্ডিয়া; পরিশ্রম কম কিন্তু লাভ বেশি। আবার রাশিয়াও লক্ষ্যনীয় – মাইনিং ছাড়া ওর আর তেমন কিছু নাই – তারপরেও ওর অবস্থান কিন্তু বিশ্বে অন্যরকম, কারণ আসল জায়গায়, মানে মারামারি-তে খুব ভালোভাবেই সক্ষম; খুব খারাপ অবস্থায় গেলে প্রয়োজনে সাধারণ ব্যবসা পুরোপুরি গুটিয়ে অধিক ঝুকিপূর্ণ ব্যবসা বা যুদ্ধে মনোনিবেশ করা তার জন্য ব্যাপার না!

যাহোক যুদ্ধে ইনভেষ্ট নিয়ে সময় পেলে এবং ভালো লাগলে পরে আলোচনা করবো, এখন আবার দেশের দিকে মনোযোগ দিইঃ আমরা এমন এক সেক্টরে, মানে Textile and Clothing এ চরমভাবে এগিয়ে যাওয়া মনে হয় ঠিক হবে না, একদিকে এটার মার্কেট শেয়ার কমছে আর দ্বিতীয়ত এটায় প্রচুর রিসোর্স (ল্যান্ড, লেবার, পাওয়ার) খাটিয়ে খুব সামান্যই লাভ করা যায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে, এছাড়াও এটার প্রাইস কম হওয়ায় এটা GDP তেও অন্যান্য প্রোফিটেবল সেক্টরের চাইতে কম অবদান রাখে। আমার মনে হয় – এ সেক্টরকে এখন এ অবস্থায় রেখে অন্য অপর্চুনিটি দেখা উচিৎ আমাদের, তবে তার জন্য অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। গার্মেন্টস-টেক্সটাইল খাতে সাবসিডি দিয়ে খুব একটা লাভ আমাদের হবে না, তা মোটামুটি উপরের আলোচনা, চিত্র এবং বৈশ্বিক বাজার দেখে নিশ্চিত। তাই কম রিসোর্স খাটিয়ে বেশী আয়ের পথে হাটাই উত্তম বলে মনে হয় ....

বিষয়: বিবিধ

১১৬৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

265976
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:২৮
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৪৮
209805
বুড়া মিয়া লিখেছেন : আপনাকে ধন্যবাদ
266374
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৯
সাদাচোখে লিখেছেন : আপনার এ লিখায় 'দেশ', 'জিডিপি'র নামে পন্য ও সেবার উৎপাদনশীলতা, 'সম্পদ আহরন' ও 'সম্পদের সমৃদ্ধি' ইত্যাদি কনসেপ্ট সমূহ মূলতঃ নিয়ন্ত্রণকারী রূপী আবির্ভূত ভেজাল 'রবদের' কিংবা অলিখিত 'দেবতাদের' (ইউ এন, ডব্লিউটিও, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই এম এফ ইত্যাদি ও তাদের পেছনের প্রভুদের) আর্টিফিশিয়াল বা মেকি ভাবে সৃষ্টি করা প্রকৃতি বিরুদ্ধ নতুন ধ্যান ধারনা, বা ইক্যুয়েশান - যার সবগুলোরই কন্ট্রোলিং চাবি, তন্ত্র মন্ত্র ও পাসওয়ার্ড এবং সে সাথে কারিগর তাদের কাছে - ঐ সব তন্ত্রমন্ত্র কিংবা কন্ট্রোলিং কোন ডিভাইস ই বাংলাদেশের কাছে নেই। স্বভাবতঃই বলা যায় নিয়ন্ত্রণহীন কোন দেশ কিংবা এনটিটি তার দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে অপারগ ই হবে যদি নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে দেশ চালায় তাদের ই গাড়ী বা সূত্র বা মন্ত্র ধারন করে।

বিকল্প না খুজেঁ - আপনি আমি যদি সেই তত্ত্বে আলোচনা করি, উপায় খুজি, এবং সমাধান পেয়ে তা বাস্তবায়ন করতে যায় - রেজাল্ট হবে আপনি আমি আমরা আরো বেশী 'দাস' এ পরিনত হব, আরো বেশী পূজা করতে বাধ্য হব তাদের।

বরং আমরা যদি পুরো থিংকিং প্রসেস টা উল্টো করে দেই, এবং নতুন ধ্যান ধারনার অনুপ্রবেশ করাই - তাহলে তুলনামূলক বেটার রেজাল্ট পাব বলে আমার কাছে মনে হয়।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৪৮
210113
বুড়া মিয়া লিখেছেন : এটায় আমিও আপনার সাথে পুরোপুরি একমত, ভিন্ন-রকম প্রাইসিং নিয়ে একটা প্যারামিটারে প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে আমরা দাসের মতো খেটে যাচ্ছি, কিন্তু মূল বিষয় যে অন্যরকম সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা নেই। এ বিষয়ে একটা কম্পেয়ারেবল পজিশন নিয়ে জিডিপি নিয়ে আমি আমার একটা মত তুলে ধরেছিলাম এই-লেখায়

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File