গেয়ো-চাষার মতো কিছু মানহানীকর অভিজ্ঞতা!
লিখেছেন লিখেছেন বুড়া মিয়া ২৫ আগস্ট, ২০১৪, ১২:২২:৫১ রাত
আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদনে আমরা অনেক পিছিয়ে উন্নত এবং আশা পাশের দেশের তুলনায়ও, এবং এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে ব্যাপক-মাত্রার উৎপাদনে কেউ ইচ্ছা করে এগিয়ে যায় না, যে কয়জন করে, তা যেন বাধ্য হয়েই! এ বিষয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা এবং দর্শন শেয়ার করছি।
ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জেলাশহরে থাকতে হতো আমাকে এবং সেখানে প্রায় সবসময়-ই বেশ বড় বাসায় থাকতাম এবং লোকবলও থাকতো। প্রথম যখন সেসব বাসায় যেতাম - দেখতাম বাসাগুলো ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো অথবা জঙ্গলে ভরা। আমার বাবা-মা প্রথমেই সেখানে গিয়ে বাসার সামনের কিছু ফুলের বাগান ছাড়া বাকী সব ফুল-বাগান ও জঙ্গল লোকবল নিয়ে পরিস্কার করে ফেলতেন, সেখানে তারা লোকজন দিয়ে চাষাবাদ করতেন বিভিন্ন সময়ের তরি-তরকারী। প্রয়োজনীয় যত্ন নেয়ায় সেগুলো প্রচুর পরিমানে ফলতো, যাতে করে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনের পর উদ্বৃত্তগুলো এলাকার পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসে মনে-মনে কিনে নিয়ে যেতো এবং অনেক আশে-পাশের লোকজনকে ফ্রী-তে বিলানোও হতো।
এছাড়াও এগুলোর পাশাপাশি থাকতো মুরগীর খামার, অল্প কিছু দেশি মুরগী থাকতো যেগুলো কাজে লাগানো হতো বাচ্চা ফুটানোয়, প্রতি ২১/২২ দিনে একেকটা দেশী মুরগী ১২/১৫ টা বাচ্চা ফুটাতো, মাসে এভাবে ১০০-২০০ মোরগ-মুরগী জন্ম নিতো, এগুলোও বড় হতো এবং বিক্রি করা হতো আর এর সাথে থাকতো অন্যান্য লেয়ার ও ব্রয়লারঃ সেখান থেকেও বেশ ডিম-মুরগী বিক্রি হতো, নিজেরাও খাওয়া হতো।
গরুর খামারে থাকতো ১৫/২০ টা গরু, সেগুলোর প্রায় সবই হরিয়ানা, সিন্ধি-শাহীওয়াল, অষ্ট্রেলীয়ান জাতের হওয়ায় প্রচুর দুধ হতো, নিজেরা খাওয়ার পর এবং আশে পাশে সমস্ত মানুষ আমাদের থেকে কিনে নেয়ার পরও এলাকার মিষ্টির দোকানদাররা প্রতিদিন ৩০/৪০ লিটার দুধ কিনে নিয়ে যেতো আমাদের থেকে। এ ছাড়াও প্রতি বছর ৩/৪ টা ষাড় বাছুর জন্ম নিতো – সেগুলোও বড় হলে বিক্রি করা হতো।
এতে করে দেখেছি অতটুকু জায়গায় কিভাবে বেশ ভালো আয়ের সংস্থান করা যায় এবং ফ্রেশ ফরমালিনমুক্ত খাবার পাওয়া যায়!
এখন অবশ্য ঐরকম বড় বাড়ি এবং লোকবল না থাকার কারণে, স্বল্প পরিসরে বাসার ছাদে আমার বাবা তরকারীর বাগান করে এবং প্রায় ১০০ এর মতো কবুতর রয়েছে; বিভিন্ন সময়ের তরকারী আমাদের প্রায় কিনতে হয় না বললেই চলে এবং প্রত্যেক মাসে ৫/১০ টা কবুতর খাওয়া হয়ে থাকে!
কিছুদিন আগে কোন এক পত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম, খুব সম্ভবত ইউ.এস.এ তে চাকরীর বাজারে মন্দা যাওয়ায় অনেক ছেলে-মেয়ে জমি লীজ নিয়ে এসবে মনোযোগ দিয়েছে এবং তারা নাকি বেশ ভালো আয় করে চলছে এতে। আমাদের দেশেও চাকরীর বাজারে বেশ মন্দা চলছে, এবং এখানে প্রচুর ছেলে-মেয়ের সরবরাহ থাকায় নিজেদের যোগ্যতার বিনিময়ে খুব সামান্যই মূল্য পাচ্ছে চাকরীর ক্ষেত্রে এবং যাও চাকরী পাচ্ছে – সে বেতন দিয়ে কোনমতে টিকে থাকছে, কোন সঞ্চয় নাই তাদের; দেশও যে তাদের শ্রম-ফলে স্বয়ংসম্পন্ন হচ্ছে তা-ও না! অল্প কিছু ব্যবসায়ী তাদেরকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অল্প-মূল্যে হীন-গোলামীতে নিযুক্ত করছে!
টি.ভি-তে আগে শাইখ সিরাজের একটা অনুষ্ঠান দেখতাম মা, মাটি ও মানুষ; বেশ ভালো উদ্যোগ ছিলো তার এবং এতে করে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আমি দেখেছি অনেককে অনুপ্রাণিত হয়ে সাবলম্বী হতে! ইদানীং টি.ভি দেখা হয়না বলে জানি না উনি এখনও এটা করেন কি না।
এছাড়াও জহিরুল ইসলাম এর বেশ কিছু এ ধরনের প্রজেক্ট এবং মেজর রঞ্জনের গচিহাটা ফার্মও দেখেছি ঘুরে ঘুরে, সেখানে তাদের অনেক বড় জায়গা, কিন্তু তারপরেও প্ল্যান করে এমনভাবে সাজিয়েছে যে অব্যবহৃত কোন জায়গা পড়ে রয় নি, ম্যাক্সিমাম বেনিফিট বের করে আনছে তারা সেখান থেকে।
জেলা শহর এবং গ্রামে গতানুগতিক চাষাবাদের কারণে লোকজন তেমন লাগে না, তাই তাদের অনেকেই এখন শহর এবং প্রবাসমূখী হওয়ায়, গ্রাম এলাকার জমিগুলো সর্বোচ্চ-মাত্রায় চাষাবাদ করা হচ্ছে না এবং এ ধরনের ডেইরী-পোল্ট্রী-এক্যুয়া ফার্ম গড়ে উঠছে না, যাও কিছু দেখি সবাই প্রচুর দামে ব্রয়লারের বাচ্চা কিনে, পালন করে, সামান্য লাভে বিক্রি করে! আর যে জমি মানুষ বর্গা দিয়ে প্রবাসে অথবা শহরে চলে যাচ্ছে সেগুলোও অদক্ষ পরিচালকদের (কৃষকদের) হাতে পড়ায় সর্বোচ্চ উৎপাদন করতে পারছে না।
এ সেক্টরে প্রচুর লাভ থাকায় ইদানীং দেশের বড় বড় কোম্পানীগুলো ধীরে ধীরে এসবের পণ্যের দিকে ঝুকছে – সেটা একটা ভালো দিক, তবে এখনও তারা ক্ষেতের দিকে ছোটেনি। এরা ছাড়াও শাইখ-সিরাজ বা এরকম পরিশ্রমী কেউ কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন এলাকার জমিগুলো বর্গা নিয়ে ছোট ছোট প্রজেক্ট করে গ্রাম-বিমুখ কর্মঠ মানুষকে দলবদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসতে পারে এবং নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায় এগুলো করলে সরকার-ই এর বড় ফাইনান্সিয়ার হবে অথবা কোম্পানী করে মানুষদের থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। নিশ্চিত-সম্ভাবনাময় এ সেক্টর থেকে তারা একদিকে লাভও অর্জন করতে পারে এবং দেশকেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এবং হয়তো এসবের যন্ত্রপাতিতে কিছু উদ্ভাবনও যোগ হতে পারে, এখনতো এ সেক্টরের যন্ত্রপাতিগুলোও আমরা পাশের দেশ থেকে এনে থাকি!
এভাবে এতে যোগ্য সবাই এগিয়ে এসে দেশের মানুষের বিভিন্ন রকমের খাদ্যের মোট চাহিদা নিরূপন করে এবং মোট আবাদযোগ্য ভূমি নিরূপন করে – কোন আইটেম কি পরিমাণ চাষাবাদ করলে দেশের সব চাহিদা পূরণ করা যায় এবং সাথে সাথে রপ্তানীও করা যায় সেটা মনে হয় বেরিয়ে আসবে, মনে হয় এগুলো বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের হাতে আছেও। আর সাথে সাথে হয়তো আরও অনেক সম্ভাবনাময় ফুড-প্রোসেসিং-ইন্ডাষ্ট্রী গড়ে উঠবে! ইদানীং ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু গড়ে উঠছে বলে মনে হয়।
জেলাগুলোয় যেসব বাসায় ছোটবেলা থাকতাম, পরবর্তীতে সেখানে ঘুরতে গিয়েছি এবং দেখেছি – আমরা চলে আসার পর সেগুলো আবার জঙ্গলে ভরে গিয়েছিলো অথবা ফুলের বাগানে রূপান্তরিত হয়েছিলো এবং যে লোকগুলোকে আমরা এসবে খাটাতাম তারা অলস বসে আছে। অথচ সে জায়গাগুলোতে ঐসব লোকদের দিয়েই ভালো কিছু করা যেতো, অনেকেই করে না – মনে করে এতে যেন সম্মানহানী হয়!
আরেকটা জায়গা হচ্ছে হাইওয়েগুলো, মাইল এর পর মাইল রাস্তার পাশে শুধু কড়ই এবং এ জাতীয় গাছ লাগানো রয়েছে, এখানেও মনে হয় এসব কেটে ফেলে ফলবান বৃক্ষ-রোপন করলে, দেশের ফলের চাহিদা মেটাতে আমদানীও অনেক কমে যাবে। একবার রাস্তার পাশে তুত এর প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছিলো মনে হয় সরকার এবং এরকম একটা এলাকা আমি দেখেছিলাম, তাতে করে এর উৎপাদন মনে হয় অনেক বেড়েছিলো। আসলে অনেক ভালো প্রোজেক্ট-ই হাতে নেয়া হয়, কিন্তু যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবে সবই অঙ্কুরেই মাঠে মারা পড়ে!
এসব আমার স্বল্প-কালের কিছু অভিজ্ঞতা, দেশের অধিকাংশ মানুষগুলোকে এবং জায়গাগুলোকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে নিশ্চিতভাবেই আমরা সম্ভাবনাময় এসব সেক্টরে এগিয়ে যাবো তাও আল্লাহর রহমতে অনেকটা হলফ করেই বলা যায়! বর্তমানে এসবে নিয়োজিত মানুষগুলোর অধিকাংশের এসব বিষয়ে অনেক কম জ্ঞান থাকায় এবং এসব সেক্টরে তেমন কোন যোগ্য-বিনিয়োগকারী না থাকায়, গ্রাম এলাকার সহায়-সম্বলহীন কর্মঠ মানুষগুলো শহরে ছুটে আসছে এবং শহরে তাদের প্রচুর সরবরাহের কারনে, নিগৃহীত-শ্রমমূল্য গ্রহণ করেই মানবেতর জীবন-যাপন করে চলছে। এতে করে যে কেউ লাভবান হয় না তা বলবো না, তবে সামগ্রীকভাবে বড় ক্ষতি হয় এতে!
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৩ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে এসব উতপাদনশীল কাজকে মন থেকে ভালো না বাসলে লেগে থাকা সম্ভব নয়!
আমার অভিজ্ঞতায় অসংখ্য মানুষকে স্বাবলম্বী হতে এসব কাজে নিজে খেটে সাহায্য করেছি! কিন্তু অধিকাংশই ধরে রাখেনি/পারেনি মূলত অনাগ্রহের কারণে!
এসব করার জন্যও কিছু প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক- সেটা যার কাছেই হোক!
আপনার ইচ্ছার কথা জেনে ভালো লাগলো।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এ লিখা হতে উপকৃত হয়েছি। ধন্যবাদ।
আপনাকে পেয়ে অনেক ভালো লাগলো, অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন