নাগরি বর্ণে সিলেটি ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান দাবী ও প্রেক্ষাপট

লিখেছেন লিখেছেন বদরুজ্জামান ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৫:১১:৫৪ বিকাল



বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় প্রায় ৬০০ বছরের পুরানো নাগরি লিপিতে সিলেটী ভাষা । নাগরি লিপিতে সাহিত্য চর্চা দেশ বিভাগের পর প্রায় বন্ধ হয়েগিয়েছিল। বাংলা সংস্কৃতিতে বিস্তৃত এই ঐতিহ্য জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে চলছে নিরন্তর গভেষনা আর দুরলব সাহিত্যের প্রকাশনা। এক সময়কার হরিকেল রাজ্য যা আজকের সিলেট। এই অঞ্চলেরই তৃণমূল মানুষের জনপ্রিয় লোকসাহিত্যের যে বিপুল সম্ভার তার চর্চা বাংলা লিপিতে নয় , হয়েছিল ঐ অঞ্চলের মানুষের কাছে তুলনামূলক সহজবদ্ধ নাগরি লিপিতে । আর সময়টা ১৩থকে ১৪শতক।

'

হজরত শাহজালাল (র) সিলেট আসার পরে এক বিশাল জনগোষ্ঠী সূফী ফকির দরবেশ সেখানে আসলেন। তাদের আগমন এবং সেখানকার লোকজন যারা মুসলমান ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কোন না কোন কারনে এই লিপির সৃষ্টি হয়েছিল । প্রথম দিকে এটি তারা গোপন হিসাবেই নিয়েছিলেন । কারণ এগুলোতে দেখা যায় দেহ তত্ত্ব এবং সাধনার কথা বলা হয়েছে। যে গুলোকে আমরা গুপ্ত সাধনা বলে থাকি। নাগরি লিপির যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পুঁথি এবং এটি বলা হয় যে , পবিত্র কোরান শরীফের পর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ সেটি হচ্ছে কেতাব হালুতুন্নবি । নাগরি লিপির বর্ণ সংখ্যা ৩২ টি মোহাম্মদ সাদিক তার গভেষনায় এটি ৩৩ বলেছেন। তবে নাগরি লিপির বর্ণমালা বাংলা বর্ণমালার থেকে অনেক সহজ সরল। এপর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক পুঁথি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। তবে এর বড় অংশই হচ্ছে হাতের লেখা।

'

৪৭ পরবর্তি বাংলাদেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এটি অনেক চ্যালেঞচের মুখোমুখি হয়েছে। ৭১ সালে নাগরি লিপির একমাত্র মুদ্রণ যন্ত্র ছাপাখানা বিধ্বস্ত হয়। গভেষকরা বলছেন এই লিপি দ্বারা প্রমানিত হয় যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রাগ ছিলেন। যার কারনে তারা এই লিপি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের একই ভাষার একাধিক বর্ণমালার যে ঐতিহ্য তা বিস্ময়কর বিষয়। মুলত ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রচলিত এই লিপি সেসময়কার সমাজ আর সংস্কৃতির অনবদ্য দলিলই শুধু নয় এই অঞ্চলের মানুষের অতীত ঐতিহ্য বটে।

ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে বাংলাদেশের দুটি ভাষার কথা উল্লেখ রয়েছে একটি বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি। সিলেটিরা মূলত বাংলাভাষী নন। সিলেটি জনগোষ্ঠি নিজস্ব ভাষার অধিকারী।সিলেটি ভাষা বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং প্রাচীন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। গবেষককেদের মতে, বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা হলেও সিলেটিদের মাতৃভাষা সিলেটি বা প্রচীন নাগরী। ফ্রান্সের বিখ্যাত ভাষা যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উদৃতি রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ভাষার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে- বাংলাদেশে দুটি ভাষা প্রচলিত। এর একটি বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি। সিলেটি ভাষা নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে গবেষণা। কিন্তু প্রাচীন এই ভাষাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এখনো। সিলেটি ভাষার প্রচলন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটী। এটি একটি প্রাচীন ভাষা তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাষা গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতে জটিল সংস্কৃত প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে ‘সিলটী নাগরী’ লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে। গবেষকদের ধারণা, ইসলাম প্রচারক সুফী দরবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মনের ভাব বিনিময়ের সুবিধার জন্যে নাগরী লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল। এই নাগরী বা সিলেটী ভাষা শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল এবং ভারত ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত লক্ষেরও বেশী। বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান জনসংখ্যা এক কোটি। লন্ডনের সিলেটী রিসার্চ এন্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে সিলেটী। অন্যান্য আধুনিক ভাষার মত সিলেটী ভাষারও একটি নিজস্ব বর্ণলিপি রয়েছে। ইংরেজী ভাষায় যেমন ২৬টি অক্ষর বা বর্ণ রয়েছে, বাংলায় ৫০টি অক্ষর, ঠিক অনুরূপভাবে সিলেটী ভাষায় ৩২টি অক্ষর বা বর্ণ রয়েছে। ইংরেজী ভাষায় ভাওয়েল বা স্বরবর্ণ হলো ৫টি । বাংলায় স্বরবর্ণ ১১টি।সিলটী ভাষায় স্বরবর্ণ ৫টি।

নাগরি বর্ণে সিলেটি ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান সিলেটবাসির প্রাণের দাবি। কারণ, একটি ভাষা ধবংস হলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ধবংস হয়। সিলেটবাসীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর। সরকারী স্বীকৃতি ও সহযোগীতার অভাবে প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষের এই আদি ভাষাটি আজ বিলুপ্তির পথে । গোলাম কাদের ও জেমস উইলিয়াম সহ দেশী-বিদেশী অনেকে পিএইচডি করেছেন সিলেটি ভাষার উপর।

সিলেটি নাগরি বর্ণমালায় মুন্সী সাদেক আলী, সৈয়দ শাহনুর ও শীতালংশাহ্ সহ অনেক লেখকের প্রায় শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কম্পিউটারে লেখার জন্য মোস্তফা জব্বার আবিস্কৃত বাংলা ফন্ট ‘বিজয়’এর মতো নাগরি ফন্ট আবিস্কৃত হয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় আট হাজার ভাষার মধ্যে তিন হাজার ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। তন্মধ্যে সিলেটিভাষা একটি, যার নিজস্ব বর্ণমালা আছে।

'

সিলেটবাসির প্রাণের দাবি, নাগরি বর্ণমালায় সিলেটি ভাষাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অথবা জাতীয় সংসদে বিল উত্থপনের মাধ্যমে এই ‘নাগরিবর্ণে সিলেটিভাষা’কে স্বীকৃতি প্রদান সহ জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করে এবং প্রত্যেক প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে সিলেটি ভাষাকে পাঠ দানের সুযোগ করে এই ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা।

সিলেটবাসি’র প্রাণের দাবি নাগরিবর্ণে সিলেটিভাষা-কে স্বীকৃতির দাবিতে ইতিমধ্যে প্রতিটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে । প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল, কলেজে ও ইউনিয়ন পরিষদের সাথে আলোচনা সভা, সিলেটি ভাষার উপর ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে রচনা,কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গণসাক্ষর অভিযান, মানব বন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। তাছাড়া ও মাননীয় প্রধান মন্ত্রীসহ সংশ্লিষট মন্ত্রণালয় বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। নাগরি বর্ণে সিলেটী ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে সিলেটবাসি সাংবাদিকসহ সুশিলসমাজের সার্বিক সহযোগীতা কামনা করছেন।

বিষয়: বিবিধ

২০৫৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

355822
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:৩৩
আবু জান্নাত লিখেছেন : এক ভাষা শিখতেই যে জীবন পার। নাগরী ভাষা শিখার সময় কই।
355829
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ০৮:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সিলেটি নাগরি লিপি মুলত দেবনাগরি লিপির সরলিকৃত রুপ। একইভাবে চট্টগ্রামেও একটি সরলিকৃত আরবি লিপি ব্যবহত হত। আলাওল এর একাধিক গ্রন্থ সেই লিপির বাংলায় আবিস্কৃত হয়েছে।
355866
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ১১:০৪
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ভালো লাগল।
355874
৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ রাত ১১:২১
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : কঠিন কঠিন জিনিস :(

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File