মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
লিখেছেন লিখেছেন বদরুজ্জামান ২৬ মার্চ, ২০১৪, ০২:২৬:১৯ রাত
মায়ের কাছে নয়নের বারবার একটি প্রশ্ন। প্রতিবারই মা নিরুত্তর। নয়ন সব সময় দেখেছে মায়ের চোখে মুখে ঘৃণার ছাপ সমাজ,সমাজপতি কিংবা রাজনীতিকদের প্রতি। অনেক কষ্টে জীবণের সাথে যুদ্ধ করে মা বড় করেছে নয়নকে।মাঝে মাঝে রাতে পাশের ঘর থেকে নয়ন শুনতে পায় নির্বাক মায়ের গোংরানোর আওয়াজ। দ্রুত ছুটে যায় নয়ন মায়ের পাশে । মায়ের মাথা মুখে হাত বুলিয়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে-মাগো বলনা আমার বাবা কে? মায়ের প্রাণপণ চেষ্টা, কিন্তু বলতে পারেন নি।
নয়ন আর ভাবে না তার পিতৃপরিচয় নিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবে পিতৃপরিচয় জেনে লাভ কি। মানুষের কর্মেই তার আসল পরিচয়। তারপরও মাধবীর কথা মনে হলে আঁৎকে উঠে পিতৃপরিচয়ের জন্য। নয়ন মাধবী কে ভালবাসত। মাধবীও ভালবাসত প্রাণপণ। কিন্তু মাধবী জানতো না নয়নের বাবা কে। নিজের পিতৃপরিচয় হয়তো কোনদিনই দিতে পারবেনা। তাই ভেবে নয়ন মাধবীকে ভূলে যায়। একদিন মাধবীকে বলেছিলো-যদি তোমাকে নিয়ে সংসার করতে না পারি, তাহলে কোনদিন সংসারই করবো না। নয়ন তেতাল্লিশ বছরে পা দিয়েছে । আজ অবধি সে তার কথা রেখেছে।
জন্মের পর থেকেই নয়ন মাকে দেখেছে নির্বাক।মা কোনদিন তাকে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। এমন কি ঘটনা ঘটেছিল মা নির্বাক জীবণ কেটে দিলেন।জীবণের অনেকগুলো অধ্যায় অজানা, দৃষ্টির অগোছরে রয়েই গেল। নয়ন নিজেকে বড় অভাগা মনে করে । জন্মের পর কোনদিন মায়ের মুখের মিষ্টি কথা শুনেনি। জানে না তার পিতৃপরিচয়। শতচেষ্টা করেও অজানা রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। রাতের বিছানায় এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।
পাশের ঘরে মায়ের গোংরানো আওয়াজ কানে আসে। বিছানা ছেড়ে দ্রুতছুটে যায় মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে মাকে বলে--কি হয়েছে মা?
নির্বাক মা হাতের ইশারায় যেন তাকে বলছেন--কাল তাকে সিলেট নিয়ে যেতে। মা তার সকল প্রশ্নের উত্তর দেবেন সিলেট মানিক পীরের টিলা গোরস্থানে গিয়ে।
তিনি দেখিয়ে দিতে চান তার বাবার কবরস্থান কিংবা নয়নের জন্মস্থান। যেখানে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ হানাদাররা নিরস্ত বাংলাদেশীদের উপর চাপিয়ে পড়েছিল। সারাদেশের ন্যায় তারা সিলেটেও চালায় হত্যাযজ্ঞ। সাথে যোগ দেয় দেশীয় দোশররা। যুদ্ধের সময় পাক হানাদাররা তার সবকিছু শেষ করে দিয়েছিল। দেশীয় এক দোশর তাকে তুলে দিয়েছিল হায়েনাদের হাতে।তারপরের দুঃসহ স্মৃতি। মা নিজে দেখেছেন বাবার মৃত্যুযন্ত্রণা। তারপর থেকে মা নির্বাক।
মায়ের কথামতো পরদিন নয়ন মাকে নিয়ে রওয়ানা হয় সিলেটের উদ্দেশ্যে। সিলেট রেলষ্টশনে নেমে তারা রিক্সা নেয় মানিকপীরের টিলার উদ্দেশ্যে। কীনব্রীজ পার হওয়ার আগেই তারা শুনতে পায় মাইকের আওয়াজ।কে বা কারা কোর্টপয়েন্টে জনসভা করছে। তাদের ধারনা কোন রাজনৈতিক দলের জনসভা। মাইকের আওয়াজে মা শুনতে পান অনেক উপাধিযুক্ত করম আলী নামটি। করম আলী নামটি তার কানে বজ্রাঘাতের মতো লাগছে । করম আলী আজ মুক্তিযোদ্ধের স্বপক্ষের কোন রাজনৈতিক দলের বড় নেতা। তার ছেলে মনসুর আলীও দলের একজন নেতা। একবার এম পি ও হয়েছেন মনসুর আলী। সিলেটের জামতলায় বাস করছেন করম আলী। একজন জনদরদী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সকলে জানে। অথচ কেউ জানে না অথবা অনেকে জানে জামতলার সেই বাড়ীটি নয়নের বাবা হিমাংশু মল্লিকের। বাড়ীর সামনে দেবতা ঘরটি আজো কালের সাক্ষি হয়ে দঁড়িয়ে আছে । অবশ্য করম আলী দেবতা ঘরটি রেখেছেন অতিযত্নে বাংলো হিসাবে। এখন ঘর কোন দেবতা নেই। মুক্তিযোদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট জেলা শান্তি কমিটির প্রধান করম আলীর সহায়তায় হানাদাররা একে একে হত্যা করেছিল নয়নের বাবা ও তার ভাইবোনদের । করম আলী দখল করে নেয় তাদের বড়ীটি। নয়নের জন্ম তখনো হয়নি। করম আলী মাকে তুলে দেয় হানাদারদের হাতে। তরপর----
করম আলী নামটি শুনে মা ছটপট করতে লাগলেন। দ্বিতীয়বার নামটি মাইকে উচ্চারিত হলো। মা চমকে উঠলেন। হাতের ইশারায় রিক্সাকে ঐ দিকে যেতে বললেন। রিক্সা জনসভার একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো । মা দেখলেন তীক্ষদৃষ্টি দিয়ে করম আলীকে। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী, পাঞ্জাবীর উপরে কালো রংয়ের বগলি কোট। মা শুনলেন করম আলী উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার এবং নিজের অবদানের কিচ্ছা বলছেন। কারণ ঐ দিন ছাব্বিশে মার্চ । স্বাধীনতা দিবস। বিয়াল্লিশ বছর পর মা করম আলীকে চিনতে পেরে চিৎকার দিয়ে বললেন-- ঐ করম আলীই তোর বাপের খুনী। একাত্তরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল তোর বংশ পরিচয়। আমাকে করেছিল ঘরছাড়া। তুলেছিল পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে।
হঠাৎ নয়নের ঘুম ভেঙ্গে যায়। হতভম্ব হয়ে উঠে। দ্রুত চলে যায় মায়ের কাছে। মা ছটপট করছেন পানির জন্য। নয়ন পানি নিয়ে আসে। মা পানি পান করেন। নয়নের মুখে চুমু দেন মা । হাত ধরে বলেন--নয়ন ঐ দেখ তোর বাবা আমাকে ডাকছেন। আমি যাচ্ছি তোর বাবার কাছে। তুই গর্বে থাকা অবস্থায় তোর বাবা তোর নাম রেখেছিলেন নয়ন। তোর বাবার দেয়া নামে তোকে ডেকে আমি শান্তি পাচ্ছি বাবা। তুই আমাকে ভূল বুঝিস না। তোর বাবা কোন ভূল করেনি। তোর বাবা স্বাধীনতার জন্য জীবণ দিয়েছেন। তুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বাবা। তুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
---------
বিষয়: বিবিধ
১০৪৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন