বিশ শতকের ইসলামী জাগরনের নারী নেত্রি
লিখেছেন লিখেছেন বদরুজ্জামান ২৯ মে, ২০১৩, ০৩:১৫:১৩ রাত
জয়নাব আল গাজালী আল জুবাইলী। বিশ শতকের ইসলামী জাগরণে যারা ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে একটি অন্যতম নাম। বিশ্বব্যাপী এ জাগরণের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঢেউটি তুলতে সক্ষম হন হাসান আল বান্না।আর জয়নাব হাসান আল বান্নার নিজের হাতেই তৈরি। আর তাই তিনি ছিলেন আল বান্নার মতই নির্ভীক, মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। স্বৈর শাসকের রক্তচক্ষু, নিষ্ঠুর নির্যাতন অথবা অর্থ-ক্ষমতার লোভ কোন কিছুই তাকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অল্প বয়সে তিনি যে আদর্শের পথে পা বাড়িয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন তার উপর পর্বতের মতই অবিচল। তার বক্তৃতা চুম্বকের মত মানুষকে আকৃষ্ট করত এবং তিনি হাজার হাজার মানুষকে বক্তৃতা দ্বারা প্রভাবিত করতে পারতেন। এমনকি জেলে চরম নির্যাতনের মুখে তার ক্ষুরধার সত্যভাষণে অত্যাচারীরা হতভম্ব হয়ে যেত, কখনও তারা হত ক্রোধে উন্মাতাল। শুধু সুবক্তাই নয়, তিনি ছিলেন সুপন্ডিত লেখিকা, একজন যোগ্য সংগঠক ও সমাজসেবীও বটে।
জয়নাবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারী মিশরের বিহারা প্রদেশের মাইতিন গ্রামে। তিনি ছোট বেলায় বাসায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি পাবলিক স্কুলে যান এবং পরে হাদিস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে সার্টিফিকেট লাভ করেন। তিনি আল আজহারের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শেখ আলী মাহফুজ ও মোহাম্মাদ আল নাসারের কাছে শিক্ষা লাভ করেন।
তিনি এমন এক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন যার সঙ্গে হযরত ওমর (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) এর বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে। তার বাবা আল আজহারে পড়াশোনা করেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি তুলার ব্যবসা করতেন। উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সাহসী যোদ্ধা নুসায়বাহ বিনতে কা’ব আল মাজিনিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি জয়নাবকে ইসলামের অগ্রনায়ক হতে ছোটবেলা থেকেই উদ্বুদ্ধ করতেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে জয়নাব আল গাজালী নিজেই ‘জমিয়াত আল সাইয়্যেদাত আল মুসলিমাত’ (মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশন) নামে সংগঠন দাঁড় করান। এর আগে অবশ্য তিনি ১৯৩৫ সালে হুদা শারাভির ‘ইজিপশিয়ান ফেমিনিষ্ট ইউনিয়ন’ এ যোগদান করেছিলেন। কিন্তু এ সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হতে না পেরে তিনি পরের বছরই এটি ত্যাগ করে নিজের সংগঠন তৈরী করেন। এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১৯৬৪ সালের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছে যায়।তিনি মহিলাদের উদ্দেশ্যে প্রতি সপ্তাহে ‘ইবনে তুলুন’ মসজিদে বক্তৃতা করতেন, যেখানে প্রায় তিন হাজার মহিলা জমায়েত হতো। রমজানের সময় এ সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যেত। দাওয়াহ্ এবং ইসলামী শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি তার এসোসিয়েশন নানা সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল। তারা ম্যাগাজিন বের করতো, এতিমখানা পরিচালনা করতো, দরিদ্র পরিবার গুলোকে সহায়তা প্রদান করতো। এছাড়া জয়নাব ওয়াক্ফ মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় ১৫ টি মসজিদ স্থাপন করেন। সংগঠনের ও নিজের উদ্যোগে আরো কয়েক ডজন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
জয়নাব আল গাজালীর চিন্তা ও কাজ ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা (১৯২৮) হাসান আল বান্নার (১৯০৬-১৯৪৯) দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসোসিয়েশন গঠনের ছয় মাসের মধ্যে ১৯৩৭ সালে তাদের দেখা হয়। তখন জয়নাব ইখওয়ানের হেডকোয়ার্টারে সমবেত মহিলাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। সে সময় হাসান আল বান্না আল ইখওয়ানের মহিলা শাখা ‘আল-আখওয়াত আল মুসলিমাত’ গঠনের প্রক্রিয়ায় ছিলেন। তিনি জয়নাবকে আল-আখওয়াতের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। এ প্রস্তাবের অর্থ ছিল ইখওয়ানের সাথে মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের একীভূত হয়ে যাওয়া। যদিও হাসান আল বান্নার সাথে তার চিন্তা চেতনার একাত্মতা ছিল কিন্তু তার পরও তিনি মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের স্বকীয়তা বজায় রাখতে চাচ্ছিলেন। ফলে জয়নাব এসোসিয়েশনের জেনারেল এ্যাসেম্বলীর সাথে পরামর্শ করে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এ প্রসংঙ্গে মন্তব্য করতে যেয়ে ডেনিস জে সুলিমান এবং সানা আবেদ কুতুব ‘জয়নাব আল গাজালী : ইসলামিষ্ট ফেমিনিষ্ট ?’ প্রবন্ধে লিখেন, “হাসান আল বান্নার মতো নেতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া থেকে বোঝা যায় জয়নাব ছিলেন স্বাধীন চেতা এবং তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রতি একাগ্রচিত্ত ও নিবেদিতপ্রাণ।”
অবশ্য একীভূত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও তিনি ও তার এসোসিয়েশনের সদস্যরা বান্নার সাথে পরিপূর্ণ সহযোগীতা করার আশ্বাস দেন। পৃথক অস্তিত্ব থাকলেও তাঁদের মধ্যে পারষ্পারিক সহযোগীতা ও যোগাযোগের কোনো কমতি ছিলনা। অবশ্য বান্না সবসময়ই একত্রিত হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তদুপরি ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৪৮সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শক্তি ইখওয়ানকে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যে সমস্ত ইখওয়ান সদস্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের বন্দি করা হয়। ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং সব তহবিল বাজেয়াপ্ত করা হয়। দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো জয়নাবকে বিচলিত করে তোলে। তিনি হাসান আল বান্নার প্রস্তাবের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। জয়নাবের নিজের ভাষায় “ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরবর্তী দিনই আমি দলের কেন্দ্রিয় দফতরে আমার নির্দিষ্ট কক্ষে উপস্থিত হই। এই সেই কক্ষে যেখানে আল বান্নার সাথে শেষ বার আমার আলাপ হয়েছিল ...আমি আমার কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। আমার বিশ্বাস জন্মালো আল বান্নার কথাই ঠিক। তিনিই সেই নেতা, যার পেছনে কাজ করতে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিৎ ... আমার নিজের চাইতে আল বান্নাকে অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হলো।... তার মতো এমন সাহস সকল মুসলমানের থাকা উচিৎ ...।”
এর কিছুদিনের মধ্যেই জয়নাব আল গাজালী আল বান্নার সাথে দেখা করে আনুগত্যের শপথ করেন। হাসান আল বান্না শপথ গ্রহন করে বলেন, “তবে মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশন আপাতত যেভাবে কাজ করছে সেভাবেই করতে থাকুক।”
বান্না তার উপর প্রথমেই আল নাহাসের সাথে মধ্যেস্থতা করে দেয়ার দায়িত্ব দেন। মুস্তফা আল নাহাস (১৮৭৬ - ১৯৬৫) ন্যাশনালিষ্ট ওয়াফ্দ পাটির নেতা ছিলেন। ১৯৫২ এর পট পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত তিনি মিশরের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হন। তার সাথে জয়নাব নিজের পরিচয় সূত্রকে কাজে লাগিয়ে ইখওয়ানের সাথে ওয়াফ্দ পাটির যোগাযোগ স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আনুগত্যের শপথ নেয়ার ঘটনার অল্প কিছুদিন পরই আল বান্নার হত্যাকান্ড (১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী) সংগঠিত হয়। বান্নার প্রতি জয়নাবের কমিটমেণ্টটি ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের এবং তখনও তা প্রকাশিত হয়নি।
ওয়াফ্দ পার্টির সরকার আসলে হাসান আল হুদায়বীর নেতৃত্বে ইখওয়ান পূণরায় কাজ শুরু করে। তখন জয়নাব তার কমিটমেণ্ট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ উপলক্ষে তিনি আল হুদায়বীর দফতর সাজানোর জন্য তার ঘরের সবচেয়ে প্রিয় ফার্নিচারটি উপহার হিসেবে দেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আব্দুল কাদির আওদাহ জয়নাবের সাথে সাক্ষাৎ করে তার উপহারের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, “এটা আমাদের আনন্দিত করবে যদি জয়নাব আমাদের একজন হয়ে যান।” জবাবে জয়নাব বলেন, “আমি আপনাদের একজন হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি।” আব্দুল কাদির আওদাহ বলে উঠেন, “আলহামদুলিল্লাহ আপনি ইতোমধ্যেই আমাদের একজন।”
ইখওয়ানে আনুষ্ঠানিক যোগদানের পরও অবশ্য জয়নাব তার মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের কাজ আলদা ভাবেই বজায় রাখেন এবং ১৯৬৪ সালে নাসের সংগঠনটি নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত এর কাজ এভাবেই চলতে থাকে।
জয়নাব আল গাজালী ১৯৫৪ সালের পর ইখওয়ানের সংকটকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৫৪ সালে তৎকালিন প্রেসিডেণ্ট জামাল আব্দুন নাসের ইখওয়ানের সমস্ত বড় বড় নেতাকে গ্রেফতার করে। একটি লোক দেখানো বিচারের পর সবচেয়ে যোগ্য নেতাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন হচ্ছেন আব্দুল কাদির আওদাহ এবং শেখ মুহাম্মদ ফারগিল। হাসান আল বান্নার মৃত্যুর পর যে বিশাল শূণ্যতা তৈরী হয়েছিল তা পূরনে এদুজন সবচেয়ে সক্ষম ছিলেন। কেননা তারা যোগ্যতা ও গুনের দিক থেকে হাসান আল বান্নার খুব কাছাকাছি ছিলেন। তাদের মৃত্যুদন্ড ইখওয়ানের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। মুর্শীদে আম (সর্বোচ্চ নেতা ) হাসান আল হুদায়বিরও মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল নাসের। ঘটনাক্রমে তার হার্ট এটাক হওয়ায় তিনি মৃত্যুদন্ড এড়াতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি মুক্ত হওয়ার পর বয়স এবং শারিরীক অসুস্থার জন্য পুরোপুরি নেতৃত্ব দানের অবস্থায় ছিলেন না। ফলে সূচনার পর থেকে এই প্রথম সত্যিকার অর্থে ইখওয়ান সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের সংকটে পড়ে যায়। আর ঠিক এই ক্রান্তিলগ্নে ক্রিটিকাল ভূমিকা পালন করেন সাইয়্যেদ কুতুব, জয়নাব আল গাজালী এবং আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল। সাইয়্যেদ কুতুব জেলের ভেতর থেকে গাইড হিসেবে কাজ করেন আর বাহিরে থেকে জয়নাব আল গাজালী এবং আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, মুর্শীদে আম হাসান আল হুদায়বির সম্মতিতে সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন।
১৯৩৬ সাল থেকেই জয়নাব মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন এবং নানা সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। ফলে তিনি ইতিমধ্যেই সামাজিক ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছিলেন এবং সমাজের প্রতিটি স্তরেই তিনি ভালবাসা ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। তার ব্যাপক প্রভাবের বিষয়টি ভালমতই বুঝতে পারেন আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল এবং ইখওয়ানের পূনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা করার জন্য তিনি জয়নাবকে খুজে বের করেন। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯৫৭ সালে সুয়েজ বন্দরে হজ্বে যাওয়ার পথে। পরবর্তীতে তাঁরা কাবা ঘরের দরজা (আল মুলতাজিম) কে সামনে রেখে প্রথম আলোচনায় বসেন। সেখানে তারা ইখওয়ানের পূনর্গঠনে সার্বিকভাবে কাজ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন।
১৯৫৮ সালের শুরুর দিকে আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈলের সাথে জয়নাবের নিয়মিত যোগাযোগ হতে লাগলো। তারা পূনর্গঠনের কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। তারা বুঝতে পারলেন যে এমন একটি প্রোগাম হাতে নেয়া প্রয়োজন যাতে মুসলমানেরা তাদের আক্বীদায় ফিরে আসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল শিক্ষাদানের মাধ্যমে তরুন-যুবকদের মন গঠন করা। এজন্য তারা গবেষনা করে কতকগুলো বইয়ের তালিকা তৈরী করেন। যারা এই কাজের জন্য প্রস্তুত তাদেরকে খুঁজে বের করে একত্রিত করার পরিকল্পনা করেন।
হাসান আল হুদায়বি অনুমতি দিলে তারা প্রাথমিক কাজ শুরু করেন। এ উপলে আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল সারা মিশর (জেলা, শহর, গ্রাম) সফরে বের হন। আব্দুল ফাত্তাহর পাঠানো রিপোর্ট নিয়ে জয়নাব হাসান আল হুদায়বির সাথে দেখা করতে যেতেন। জয়নাব কোনো সমস্যার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলে হাসান আল হুদায়বি বলে উঠতেন, “পেছনে না তাকিয়ে কাজ চালিয়ে যাও। মানুষের পদবী বা খ্যাতির দ্বারা প্রভাবিত হবে না। কারণ তোমরা একদম শুরু থেকে নতুন একটি কাঠামো তৈরী করতে যাচ্ছ।” ১৯৫৯ সালে সম্পূর্ণ গবেষণা শেষ করে জয়নাব তাদের ‘এডুকেশনাল প্রোগামকে ’ চূড়ান্ত রূপ দেন।
১৯৬২ সালে জয়নাব এবং ফাত্তাহ সাইয়্যেদ কুতুবের সাথে জেলে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। তাদের নির্ধারণ করা বইয়ের তালিকাটি সাইয়্যেদ কুতুবকে দেন। সাইয়্যেদ তালিকার ব্যাপারে পরামর্শ দেন এবং তার একটি বইয়ের কিছু অংশ দেন, যেটি তিনি জেলে বসে লিখছিলেন। পরে বইটি ‘মা’লিম ফিততারিক’ (ইংরেজীতে ‘মাইলষ্টোন’ এবং বাংলায় ‘ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা’) নামে প্রকাশিত হয়। পর্যাক্রমে তারা বইটি তাদের পরিচালিত স্টাডি সার্কেলে পাঠ করেন। অল্প সময়ে তারা স্টাডি সার্কেলের মাধ্যমে একটি ব্যাপক সাড়া তৈরি করতে সক্ষম হন। সাইয়্যেদ কুতুবের পরামর্শে তারা ঠিক করেন এ ধরনের স্টাডি সার্কেল তারা তের বছর চালাবেন। যদি ৭৫ ভাগ মানুষ ইসলামের পক্ষে মত দেয় তবে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের ডাক দেবেন। আর যদি এর চেয়ে কম মানুষ মত দেয় তাহলে তারা স্টাডি সার্কেল আরও তের বছর চালাবেন এবং আবার জরিপ করবেন। এভাবে চলতে থাকবে। ’৫৪ সালে ইখওয়ানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তারা তাদের এই তৎপরতা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এতে কোনো ধংসাত্মক বা ষড়যন্ত্রমূলক কিছুই ছিলনা, তার পরও তাদের কাজ দ্রুত প্রেসিডেণ্ট জামাল আব্দুন নাসেরের রোষানলে পড়ে যায়।
১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে জয়নাবকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। একটি গাড়ী এসে ধাক্কা দিলে তিনি মারাত্মক আহত হন। তার উরুর হাড় ভেঙ্গে যায়। হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর নাসের বিভিন্ন ভাবে জয়নাবকে প্রলোভিত করে, হুমকি দিয়ে তাকে তার কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জয়নাব ছিলেন তার কাজে অবিচল, নির্ভীক।
১৯৬৫ সালের আগষ্টে নাসের আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। জয়নাবের নিজের ভাষায়, “বস্তুত: ওরা মনে করেছিল আমাদের এটা ভাববাদী আন্দোলন। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারারুদ্ধ নেতা জনাব সাইয়্যেদ কুতুব। আর বাইরে এর বাস্তব অনুশীলন করছেন আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল এবং জয়নাব আল গাজালী ।... এমন সময় আমরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে এ তথ্য পাই যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীন এবং তার সব তৎপরতাকে অবিলম্বে খতম করার জন্য মার্কিন ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা প্রেসিডেণ্ট নাসেরকে একটি রিপোর্ট হস্তান্তর করে। রিপোর্টে শংকা প্রকাশ করা হয় যে, অবিলম্বে ইখওয়ানকে স্তব্ধ না করলে নাসের সরকার জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে আনার ব্যাপারে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ... ১৯৬৫ সালের আগষ্ট মাসের গোড়ার দিকে আমি খবর পাই যে, অবিলম্বে যাদের গ্রেফতার করা হবে তাদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তালিকার কয়েকজন হচ্ছে - সাইয়্যেদ কুতুব, জয়নাব আল গাজালী, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল এবং মোহাম্মদ ইফসুফ হাওয়াস”।
আগষ্টেই নাসের লাখ লাখ ইখওয়ান নেতা কর্মী গ্রেফতার করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৫ সালের ২০ আগষ্ট জয়নাব আল গাজালী গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের কারণ হিসেবে নাসেরকে ‘হত্যা প্রচেষ্টা’র ষড়যন্ত্রের কথা প্রচার করা হয়। কিন্তু ইখওয়ানের প্রতি নাসেরের ক্রোধের আসল কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জয়নাব আরও লিখেন ঃ “ নাসের নাস্তিক্যবাদ ও অশ্লীল ছায়াছবি, পত্র পত্রিকা আমদানী করে দেশের নবীন বংশধরদের চরিত্র হননের আপ্রাণ চেষ্টা করে... । ইসলামী আন্দোলনে তরুনদের প্রধান ভূমিকা দেখে নাসের ক্ষেপে পাগল হয়ে পড়ে। সে তার সাঙ্গ পাঙ্গদের প্রায়ই বলতো, “ জয়নাব আল গাজালী এবং আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল তরুন সম্প্রদায়কে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে।” নাসেরের এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য গৌরবের কথা। তার র্নিলজ্জ কঠোর থাবা থেকে আমরা তরুন সম্প্রদায়কে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি ।... এমন তরুন বাহিনী সৃষ্টি করে দিয়েছি, যারা যুগের যে কোন হুযুগের মোকাবেলায় ইসলামের ঝান্ডাকে বুলন্দ রাখতে সক্ষম।”
গ্রেফতারের পর জয়নাবকে সামরিক কারাগারে নেয়া হয় এবং সেখানে তিনি জঘন্যতম নির্যাতনের সম্মূখীন হন। এ নির্যাতনের কাহিনী তিনি বর্ণনা করেন তার ‘আইয়্যাম মিন হায়াতি’ বইতে (বইটি ইংরেজীতে ‘Return of the pharaoh’ এবং বাংলায় ‘কারাগারের রাতদিন’ নামে অনুদিত হয়)।
কারাগারে নেয়ার পর শুরুতেই তাকে হিংস্র ক্ষুধার্ত কুকুর ভর্তি একটি সেলে ঢুকিয়ে তিন ঘণ্টা বন্দী রাখা হয়। সেখান থেকে বের করে তাকে ৬ দিন একটি সেলে বন্দী রাখা হয়। জয়নাব এ প্রসঙ্গে লিখেন “২০ আগষ্ট থেকে ২৬ আগষ্ট পর্যন্ত বরাবর ৬ দিন একই কক্ষে আবদ্ধ থাকি। এর মধ্যে একটি বারও করে দরজা খোলা হয়নি। এক ফোটা পানি বা কোনো রকমের খাদ্য দেয়া হয়নি। বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ বা কথাবার্তাও হয়নি। পানি নেই, খাদ্য নেই, কথাবার্তা নেই - ৬ দিন, ৬ রাত অন্ধকার কক্ষে একাকীত্বের এই জীবন, একটু কল্পনা করে দেখুন তো! পানাহার নাইবা হলো কিন্তু মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকে কেউ কিভাবে অস্বীকার করতে পারে।”
জয়নাব বলেন, নাসেরের নির্দেশে তাকে যে কোনো পুরুষের চাইতেও কঠিন নির্যাতন করা হয়। এক সময় জয়নাবের সেলেই আরও দুজন মহিলাকে বন্দী করে রাখা হয়। তারা হচ্ছেন আলীয়া হুদায়বী (মুর্শীদে আম হাসান আল হুদায়বীর কন্যা) এবং গা’দা আম্মার। তারা জয়নাবের অবস্থা দেখে আৎকে ওঠে। জয়নাব তার বইয়ে বর্ণনা করেন, “ আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললামঃ ‘গা’দা আমার মেয়ে! (জয়নাব নিঃসন্তান ছিলেন কিন্তু তার কর্মী তরুন-তরুনীদের তিনি ছেলে ও মেয়ে সম্বোধন করতেন) আমাকে চিনতে পারছিস না?’ সে বললঃ ‘না... আপনার শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।’ ... আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললামঃ ‘... এমন হওয়াই স্বাভাবিক।... রাতে দিনে চব্বিশ ঘণ্টায় খাদ্য হিসেবে পাই শুধু এক চামচ সালাদ। তাও একজন সিপাহী লুকিয়ে দিয়ে যায়।’... একটু পরে তারা হাণ্টারের দগদগে ঘা দেখে আৎকে উঠে। ... আমি পবিত্র কোরআনের ‘আসহাবুল উখদুদ’ সংক্রান্ত আয়াত পড়ে শুনাই। গা’দা আম্মার নিরবে কাঁদতে থাকে আর আলীয়া বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে স্বগত প্রশ্ন করেঃ ‘মহিলাদের সাথেও এমন নির্মম নিষ্ঠুর ব্যবহার কিভাবে সম্ভব হলো? কোন্ বন্য নৃশংসতার নিদর্শন এসব’.... কিন্তু আলীয়া হয়তো কল্পনা করতে পারেনি ইসলাম ও মানবতার দুশমন জামাল নাসেররা আল্লাহ ও তার রাসূলের শত্রুতায় এর চেয়েও নিচে নামতে পারে।”
তাদের নিচতার নমুনা পাওয়া যায় সামরিক কারাগারে শামস্ বাদরান নামে এক লোকের বন্য অত্যাচারের বিবরণ থেকে। জয়নাব বর্ণনা করেন, “সাফওয়াত ... আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যায়। জানেন, কে এই শামস্ বাদরান? নির্দয়-নিষ্ঠুর পশুর চেয়েও অধম এক দুশ্চরিত্র ব্যক্তি .. জুলুমের ভয়ংকর রেকর্ড সৃষ্টি করেছে । আমি পৌঁছলে সে অত্যন্ত দম্ভ এবং তাচ্ছিলের সাথে জিজ্ঞেস করলো
: জয়নাব আল গাজালী ! তুই এখনো বেঁচে আছিস?
: হ্যাঁ। ধীর শান্ত কণ্ঠে একই শব্দে জবাব দিলাম আমি।...
...
: সাইয়্যেদ কুতুবের পেশা কি? সে জিজ্ঞেস করলো।...
স্পষ্ট উচ্চারণ করে ধীরে ধীরে বললাম-
: অধ্যাপক সাইয়্যেদ কুতুব নেতা এবং শিক্ষক, ইসলামী চিন্তা নায়ক, লেখক ...
সে জল্লাদের দিকে নীরব ইঙ্গিত করলে জল্লাদরা তাদের চাবুক ও হাণ্টার নিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অনেকণ মার-পিট চলার পর সে আবার প্রশ্ন করলো -
: এই মেয়ে ! হুদায়বীর পেশা কি?
আমি জবাব দিলাম -
: অধ্যাপক হাসান হুদায়বী মুসলমানদের নেতা ইমাম।...
: আমার কথা শেষ হবার আগেই চাবুক আর হাণ্টার আমার পিঠে আগুন জ্বালাতে শুরু করলো।
...
: ... ‘মা’লিম ফিত-তারিক’ থেকে তুমি কি শিক্ষা পেয়েছ?
এবার গাম্ভীর্যের সাথে বললাম -
: ‘মা’লিম ফিত-তারিক’ মুফাসসির ও সাহিত্যিক সাইয়্যেদ কুতুবের বিখ্যাত গ্রন্থ এতে তিনি... (এরপর জয়নাব পুরো বইয়ের সার সংপে বর্ণনা করেন।)
...
আমার কথা শুনে কয়েক মূহুর্ত সবাই নিরব নিশ্চুপ বসে রইলো। ... মন্তব্য করলো -
: এ দেখছি ভাল বাগ্মী , চমৎকার বক্তৃতা করতে পারে। অপর একজন বলল-
: তা ছাড়া সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকও। এরপর সে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকার: সম্পাদকীয় থেকে একটি অংশ পড়ে শোনালো। কিন্তু শামস্ বাদরানের এসব ভাল লাগছিলনা । সে বললো, এ মেয়েটির কোনো কথায়ই মাথায় ঢোকেনা । তার এই কথার সাথে সাথেই জল্লাদরা তাদের চাবুক নিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো।...
এরপর আমাকে লক্ষ্য করে বললো
: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ... তার তাৎপর্য জানতে চাই ।
আমি বললাম-
... ...
সে চেঁচিয়ে বললো
: বন্ধ কর এসব বাজে কথা। এর সাথে সাথেই তার পোষ্য পশুরা আমার উপর হাণ্টার আর চাবুক বর্ষাতে শুরু করলো।
...
: আমাদের ব্যাপারে তোমার কী মন্তব্য। আমরা মুসলিম না কাফের?
আমি বল্লাম -
: নিজেকে কোরআন ও সুন্নাহর কষ্টি পাথরে রেখে পরখ করে দেখ...
আমার কথা শুনে শামস্ বাদরান রাগে ফেটে পড়লো ... অশ্লীল গালাগালি শুরু করে... হিংস্র পশুর মত
হাফাতে লাফাতে লাগলো ... সাফওয়াতের দিকে চেয়ে বল- -
মারধরেও এ কাবু হবে না দেখছি ; একে উল্টো করে লটকিয়ে দাও ।
...
..মোটা রড এবং কাঠের দু'খানা ষ্ট্যান্ড .. হাজির হল ...
...
শামস্ বাদরান আমাকে লটকানোর কাজে লোকদের এমন ভাবে হুকুম চালাচ্ছিল যেন রণাঙ্গনে সৈন্য পরিচালনা করছে।
...
... হেঁকে বলল - সাফওয়াত, একে পাঁচশ বেত্রাঘাত কর। এর সাথে সাথেই শুরু হল সেই নৃশংস অত্যাচারের তান্ডব লীলা। তারা কে কার চেয়ে বেশী পেটাতে পারে, তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছিল। এমন সম্মিলিত প্রহারে আমার ব্যাথা যন্ত্রনা যে কী পরিমানে বেড়েছিল তা অনুমেয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব পশুদের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রদর্শন করিনি। ... চাবুকের ত্রস্ত ঘা সহ্য করে ... আল্লাহর নাম স্মরণ করে অন্তরের প্রশান্তি খুঁজছিলাম। কিন্তু ব্যথা-বেদনা যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো, তখন আর নিরবে সয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ... ইয়া আল্লাহ - ইয়া আল্লাহ ধ্বনি তুলছিলাম।... অচেতন হওয়া পর্যন্ত শুধু আল্লাহকেই ডাকতে থাকি। বেহুশ হয়ে প্রাণহীন দেহের মতো মাটিতে পড়ে যাই। ওরা আমাকে দাঁড় করিয়ে আবার লটকানের চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারলনা। দাঁড়নোর মতো বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট ছিলনা। ... আমি যন্ত্রনার আতিশর্যে দেয়ালের সাথে হেলান দেয়ার চেষ্টা করলে সাফওয়াত চাবুক মেরে দূরে সরিয়ে দেয়। আমি এবার অনন্যোপায় হয়ে বললামঃ আমাকে একটু মাটিতে বসতে দাও। এর জবাবে শামস্ বাদরান বললোঃ মোটেই বসতে দেয়া হবে না। কোথায় তোর আল্লাহ! ডাকতো দেখি, তোকে আমাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু এর পরিবর্তে আব্দুন নাসেরকে ডেকে দেখ কী লাভ হয় । ... চুপ করে থাকি। সে আস্ফালন করে বলে, আমাকে বল দেখি, এখন তোর আল্লাহ কোথায়?
... আবার চেঁচিয়ে বললো কোথায় তোর আল্লাহ? জবাব দে! এবার আমি অশ্রু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললাম আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান এবং উত্তম ব্যাবস্থাপক। এরপর আমাকে শামস্ বাদরানের অফিস থেকে সোজা হাসপাতালে পাঠানো হয়।”
এটা ছিল মাত্র একটি দিনের নির্যাতনের বর্ণনা। দিনের পর দিন তাকে একই রকম নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তাকে খাবারও দেয় হতো খুব সামান্য। যা দেয়া হতো তাও প্রচন্ড দুর্গদ্ধযুক্ত এবং খাবার অযোগ্য। প্রতিবার তাকে তদন্তের নামে অর্থহীন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হতো এবং মিথ্যা স্বীকাররোক্তি দেবার জন্য হুমকি, ধমকি দেয়া ছাড়াও নানা প্রলোভন দেখানো হতো। তাদের কথা শুনলে তাকে মন্ত্রিত্ব দেবার লোভও দেখাতো তারা। কিন্তু জয়নাব সকল কিছুর মোকাবেলায় ছিলেন দৃঢ়, অবিচল। মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বা সত্য থেকে বিচ্যুত হতে তিনি কোনো ভাবেই রাজী হতেন না। আর তখনই তার উপর নেমে আসতো অমানুষিক নির্যাতন।
কখনো তাকে ৫ দিন এমন কী ১০ দিনের জন্য পানির সেলে রাখা হতো। সেখানে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে অনড় অবস্থায় বসে থাকতে বাধ্য করা হতো। চাবুকের ক্ষতগুলোতে পানির পরশ লাগায় যন্ত্রণা অনেকগুন তীব্র হয়ে যেত। পানির সেলে হেলান দেয়া, ঘুমানো বা নড়া কোনোটাই সম্ভব হতো না। সে এক অবর্ণনীয় দুর্দশা! কখনো আবার ইঁদুর ভর্তি সেলে নেয়া হতো। কখনো মানুষ এবং কুকুরকে একসাথে লেলিয়ে দেয়া হতো তার উপর ঝাপিয়ে পড়তে। তারপর হয়তো নেয়া হতো আবার পানির সেলে কিংবা নিকৃষ্ট শামস্ বাদরানের অফিসে। শামস্ বাদরান দফায় দফায় উল্টো ভাবে ঝুলিয়ে পাঁচশ করে চাবুক লাগাতো। অচেতন হয়ে গেলে সেখান থেকে হাসপাতালে পাঠানো হতো। চেতনা ফিরলে আবার নিয়ে আসা হতো এবং ব্যান্ডেজ মোড়া সারা শরীরে চাবুক চালানো হতো, তার পা থেকে রক্ত আর পুঁজ গড়িয়ে পড়তো। হাসপাতালে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল আসলে আরো নির্যাতন করার জন্য কিছুটা সুস্থ করে তোলা। জয়নাব লিখেন এভাবে কতবার হাসপাতালে গেছি আর বেরিয়েছি এবং অজ্ঞান-অচেতন হয়ে পূণরায় জ্ঞান-চেতনা ফিরে পেয়েছি তার সঠিক হিসেব তুলে ধরা কঠিন।” প্রতি মুহুর্তেই অশ্রাব্য গালিগালাজ আর বুটের অজস্র লাথি ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। এই নিকৃষ্ট নির্যাতনের চিত্রটি ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সত্যিই কঠিন।
এখানে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, এই নির্যাতনের মুখে তিনি টিকে থাকলেন কীভাবে? ভাবলে এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হয়। একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জয়নাব বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর স্মরণই অসহনীয় যন্ত্রনা থেকে তার চেতনাকে পৃথক করে দিত। যন্ত্রনার মধ্যে কোরআন পাঠ তাকে শান্তি দিত। এসব দিন গুলোতে তিনি রাসূল (সা.) কে চারবার স্বপ্নে দেখেন। জয়নাব বলেন, এসব স্বপ্ন তাকে অপূর্ব এক শক্তি এবং প্রশান্তি দান করতো। এটা তাকে বর্তমানের সব জুলুম নির্যাতনের ভাবনা থেকে র্নিলিপ্ত উদাসিন করে দিতো। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালের ১৭ মে একটি লোক দেখানো বিচারের পর, নাসেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে জয়নাব আল গাজালীকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। সেই সঙ্গে সাইয়্যেদ কুতুব, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল এবং মোহাম্মদ হাওয়াসকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বিচার চলা কালিন সময়ে এবং দন্ড দেওয়ার পরও জয়নাবের উপর নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার অব্যাহত থাকে। জয়নাব এ প্রসংঙ্গে লিখেন, “ ... অন্ধকার যুগের কোরাইশরা পর্যন্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অসৎ আচরণ করেনি। সত্যিই করেনি। ইতিহাস সাক্ষী। ”
আনওয়ার এল সা’দাত ক্ষমতায় এলে ১৯৭১ সালের ১০ আগষ্ট জয়নাব মুক্তি পান।
ইখওয়ানের পূনর্গঠন তৎপরতায় অংশগ্রহন এবং মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেণ্ট হিসেবে কাজ করতে যেয়ে তিনি যে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করেননি তা নয়। অবশ্য তাকে বাড়ীর বাইরের কাজে অনেক সময় কাটাতে হতো এবং এসব তৎপরতায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। এজন্য তিনি বিয়ের আগে স্বামীর সাথে একটি চুক্তি করেন। প্রথম স্বামী চুক্তি ভঙ্গ করায় শর্ত অনুযায়ী তিনি তালাক নেন।তার দ্বিতীয় স্বামী মুহাম্মদ সালেমের প্রতিও তিনি বিয়ের আগে একই শর্ত আরোপ করেন। তিনি বলেন, “আমার জীবনে এমন কিছু আছে যা তোমার জানা দরকার ... আমি মুসলিম ওমেন্স এসোসিয়েশনের সভানেত্রী।... আমি ইখওয়ানের নীতির প্রতি আস্থাশীল।... যদি কখনো এমন হয় যে, তোমার ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আমার ইসলামী কাজের সাথে দন্দ্ব তৈরী করে অথবা আমাদের দাম্পত্য জীবন যদি আমার ‘দাওয়াহ্’র পথে বাঁধা সৃষ্টি করে, তবে আমরা পৃথক হয়ে যাব।”
স্বামীর সাথে চুক্তি করার বিষয়টি নেতিবাচক ভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো অবকাশ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতেও এটি অসমীচীন নয়। কারণ ইসলামে অন্যায় নয় এমন যে কোনো চুক্তি বৈধ। নিজের যোগ্যতার উপর জয়নাবের আত্মবিশ্বাস ছিল এবং তিনি বিনা বাধায় কাজ করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু সমাজে নারীর ভূমিকার ব্যপারে ধারণাগত ভ্রান্তি থাকায় তিনি ব্যাপারটি আগে থেকেই পরিষ্কার রাখতে চাচ্ছিলেন। আর এটা করা তার জন্য সহায়কই হয়েছে।
তার স্বামী একজন উন্নত চরিত্রের মানুষ ছিলেন এবং তিনি সবসময় জয়নাবের কাজের প্রতি সমর্থন জানাতেন। কিন্তু যখন তাদের গোপন এডুকেশন প্রোগ্রামটি সরকারের রোষানলে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তখন তিনি জয়নাবের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েন এবং এ ব্যপারে জয়নাবকে প্রশ্ন করেন। জয়নাব তখন তাদের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দেন এবং কোনো প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকতে বলেন। শংকা সত্ত্বেও এরপর তার স্বামী অবশ্য আর কোনো প্রশ্ন তোলেননি। বরং তার প্রতি সর্বোচ্চ সহায়তা অব্যাহত রাখেন। এ প্রসংঙ্গে জয়নাব তার বইয়ে ‘আমার ন্যায়নিষ্ঠ স্বামী’ শিরণামে লিখেন ঃ “এরপর আমাদের তৎপরতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। দিন রাত কর্মীদের যাতায়াত এবং গতিবিধিতে আমাদের বাড়ী সরগরম হয়ে থাকে। এমনকি মধ্যরাতে যদি কেউ এসে দরজায় কড়া নাড়ে তো আমার স্বামী উঠে গিয়ে আগমন কারীদের দরজা খুলে দেন। তাদেরকে সাক্ষাৎকারের কক্ষে নিয়ে যান। এরপর পরিচারিকাকে জাগিয়ে চা-নাস্তা তৈরীর আদেশ দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে আমাকে জাগিয়ে বলতেন, ‘তোমার ছেলেরা এসেছে। তাদের চোখেমুখে শ্রান্তির ইঙ্গিত স্পষ্ট।’ আমি উঠে গিয়ে তাদের স্বাগত জানাই এবং আমার স্বামী ঘুমোতে যাওয়ার আগে বলে যান যে, ‘যদি ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে পড় তো আমাকেও জাগিয়ে দিও ...।’ ”
ফলে দেখা যাচ্ছে জয়নাবের মতো গ্রেট লিডারের এ ধরনের চুক্তি করা ভাল হয়েছে। নতুবা মুসলিম বিশ্ব হয়তো বড় একজন ব্যক্তিত্বকে হারাতো। আমাদের দেশে নারীর ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি আরও বেশী। ফলে দেখা যায় অসংখ্য মেধাবী মেয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারছেনা। তাই আমাদের দেশের মেয়েরা - যারা নিজেদের সমাজে কন্ট্রিবিউট করার যোগ্য মনে করে তাদেরও এ ধরনের চুক্তি করাটা ভাল হতে পারে। অনেকে জয়নাবকে ফেমিনিষ্ট বলে নিন্দা করতে চায়। এটা অন্যায়। কেননা তাকে কোনো ভাবেই পাশ্চাত্য ধাঁচের ফেমিনিষ্ট বলা যায় না। নারীর অধিকারের ব্যাপারে কথা বলা, সেজন্য সংগ্রাম করা কী ফেমিনিজম? বেগম রোকেয়াও তো নারী শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। সেজন্য কী তাকে আমরা ফেমিনিষ্ট বলতে পারি?ইসলামও নারীর অধিকারের কথা বলেছে। সেই অর্থে বলা যায় ইসলামেও একধরণের ফেমিনিজম আছে। তবে তার ধরণটি অনেক বেশী ভিন্ন, অনেক বেশী সুন্দর। আর জয়নাব এ ধরণটিরই ধারক ছিলেন।
তিনি নারীদের স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করেছেন এবং অসহায় নারীদের প্রতি হাত বাড়িয়েছেন । তিনি ওমেন্স এসোসিয়েশনের মধ্যমে নারীদের বিভিন্ন ধরনের স্বকর্ম সংস্থানের ট্রেনিং দিতেন। এসোসিয়েশন অনেক নারীর শিক্ষার সমস্ত ভার নিয়ে নিত। ১৯৫৪ সালে ইখওয়ানের উপর নির্যাতন নেমে আসার পর গ্রেফতারকৃত ও নিহতদের পরিবারের প্রতি তিনি তার এসোসিয়েশনের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তার প্রচেষ্টা ছিল নারীদের সার্বিকভাবে তাদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন করে তোলা। তিনি সমাজের প্রতি দায়িত্বের ব্যাপারে পুরুষ ও মহিলার ভূমিকায় পার্থক্য করতেন না।
জয়নব আল গাজালীর সাড়া জাগানো বই কারাগারে রাতদিন ডাউনলোড করুন...
http://www.priyoboi.com/2012/07/blog-post_09.html
তথ্যসূত্র : ফেসবুক পেজ নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য আবরনে, নগ্নতায় নয়
[লেখাটি ২০০৫ সালের আগষ্টে জয়নব আল গাজালীর মৃত্যুর পর লিখিত এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত]
বিষয়: বিবিধ
১৮০১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন