একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা : সমাপনী পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান আল আহসান ১৫ মার্চ, ২০১৪, ১২:৪২:১৯ রাত
একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা : পর্ব- ০১
একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা : পর্ব- ০২
একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা : পর্ব- ০৩
ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ৩.০০ টা। চারপাশের নিস্তব্ধতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নিশাচর প্রাণীগুলোও মনে হয় তাদের কর্মব্যাস্ততা শেষে বিশ্রাম নেয়া শুরু করেছে। আগের মত দূরের বাড়িগুলোতে আর আলো চোখে পড়েনা। এক নিবিড় প্রশান্তিতে পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে পড়ার প্রত্যাশায় চোখ মেলে ধরেছে। কিন্তু চোখে ঘুম নেই আমার মত শত শত বাড়ি ফেরা মানুষের যারা কষ্টকর রাত্রি শেষে প্রিয়জনের সাথে একটি আবেগঘন সকালের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কেউ অপেক্ষা করছে মায়ের আদরমাখা হাত আর বাবার স্নেহের পরশের, পিতা অপেক্ষা করছে সন্তানের জন্য পাহাড়সম ভালোবাসা নিয়ে হাজির হবার আর প্রিয়তমা স্ত্রী অপেক্ষা করছে তার নিত্যদিনের স্বপ্নের মানুষটির জন্য।
ইচ্ছে ছিল পুরা যাত্রাটাই উপরের এই রকম স্মৃতিকাতর সময়ের মধ্য দিয়ে পার করার। কিন্তু কেন জানি আর এই বিপদের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাছাড়া চাটমোহর স্টেশনে অনেক যাত্রীই নেমে যায় বলে সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই নেমে সিটে যাবো। চাটমোহর স্টেশনে পৌছলে দেখলাম সেখানে মই দিয়ে নিচে নামছে অনেকেই। ১০ টাকার বিনিময়ে প্লাটফরমের উল্টো পাশে নামলাম। কিন্তু একি!! ট্রেনের গেট মানুষ এ ভর্তি, কোন কোনটাতে তো ঝুলছে দুএকজন। এত মানুষ নামার পরও ট্রেনের এ অবস্থা দেখে কি পরিমান যাত্রী ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তবে এবার আর আগের মত ভুল করিনি। খুব দ্রুত গেটের সিড়ি বেয়ে, অনেকটা ধাক্কা দিয়ে গেটের কাছে নিজের পা দুটো ভালো মতই বসিয়ে নিলাম। পরে অনেকের ধাক্কাধাক্কিতে এমনিতেই ভিতরে ঢুকে পড়েছিলাম। দুপাশের সিটের সারির মাঝের অংশে বসে থাকা যাত্রীদের পেরিয়ে অবশেষে বন্ধুদের কাছে পৌছলাম। বন্ধু সানাউল্লাহ আমাকে অভিনন্দন জানালো। ধন্যবাদ জানালাম তাকে।
এবারের বাড়ি যাওয়া নিয়ে অনেক প্ল্যান ছিল। ইচ্ছে ছিল সারা রাস্তায় বন্ধুদের সাথে গল্প আর আড্ডাবাজি করে কাটিয়ে দিব। বন্ধু সানাউল্লাহর ডাক নাম সানা। যদিও আমি সানাউল্লাহ ডাকতেই পছন্দ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ভদ্র, নম্র আর দায়িত্ববান একজন মানুষ। সানাউল্লাহর সাথে ছিল ঢাবির একই বিভাগের আরেক বন্ধু বিপ্লব। হালকা শরীর, কিছুটা কালো, মায়াবী চেহারা আর অসাধারণ বাকপটু। পদার্থবিজ্ঞানের থিওরীগুলোকে খুব সাধারণভাবে বাস্তবের সাথে বর্ণনা করে, তার অ্যানালিটিক্যাল মাইন্ড আমাকে খুব আলোড়িত করেছিল আগেরবারের ট্রেন যাত্রায়। আমার মতে সে পদার্থ বিজ্ঞানে বাংলাদেশের বড় একটি সম্ভাবনা হবার ক্ষমতা রাখে। তাদের সাথে থাকা এক বড় আপুর সাথে স্বভাবসূলভ প্রাথমিক পরিচয় হয়ে বাকি পথটা বন্ধু সানাউল্লাহর সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
রাতের যাত্রায় রাজশাহী স্টেশনে পৌছার ঠিক একঘন্টা আগে প্রতিবারই দরজায় দাড়িয়ে ভোরের বাতাস উপভোগ করি। আধো আলো ছায়ার মাঝে আস্তে আস্তে ধরণীর জেগে উঠা, কৃষকের নতুন কর্মব্যস্ততা আর আমার প্রিয়জনের কাছাকাছি হওয়া, এরকম প্রত্যেকটি সকালই মনে নতুন আশা দিয়ে যায়, নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসা সুমধুর আযান খোদার প্রতি অবনত হবার প্রেরণা যোগায়। আল্লাহ তায়ালার প্রতি আমার অসংখ্য অবাধ্যতার মধ্যে কোন রকমে নামাজটা পড়ে ফেলি। এবার সিটে বসেই নামাজ সারতে হলো।
সকাল প্রায় ৬.০০টা । সাপের মত ট্রেনটি হুইসেল দিতে দিতে প্লাটফরমের দিকে এগিয়ে যায় একটি অনন্য সাধারণ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তির জন্য। বন্ধু বিপ্লব নেমে গিয়েছিল আগেই, নাটোরে। আমাদের বগি ছিল একেবারে পেছনের দিকে, ফলে জিনিসপত্র নিয়ে বেশ লম্বা প্লাটফরম পার হতে হয়েছিল। স্টেশন থেকে বের হয়ে অটোরিকশাতে চড়ে বাকি দুজনকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে একই অটোরিকশা নিয়ে রওনা হলাম আমার চিরচেনা সেই আবাসস্থলে। এভাবে যাওয়ার সময় স্মৃতির মণিকোঠায় প্রতিবারই ভেসে উঠে সেই স্কুল, সেই মাঠ আরো কতকিছু। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ক্লাশরুম গুলোর জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ফিরে গিয়েছিলাম ৬ষ্ঠ শ্রেণীর সকাল ১১.০০ টার কোন ক্লাশে। টিফিন পিরিয়িড এর ঘন্টাধ্বনির কথা মনে পড়ে গেল। কি দারুণ সেই দিনগুলো, তাই না?? সেই দিন কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব??
লেখাটির নাম “একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা” দেয়ার পেছনে দুটি কারণ ছিল, যার একটি লম্বা এ লেখায় প্রকাশ করা হয়েছে। বাকী কারণটা আমার সাথে আমার পরিবারেরও। রিকশা থেকে নেমে হাটতে হাটতে বাসার দিকে যাচ্ছি, আর কিছুক্ষণ পর বাসায় প্রবেশ করবো। বাসায় প্রবেশ করেই অচেনা একটি নিস্তব্ধতার আভাস পেলাম। প্রতিবারের মত এবারের ট্রেনের যাত্রাটা যেমন ব্যতিক্রম ছিল তেমনি বাসায় প্রবেশটাও ছিল ব্যতিক্রমী। বড় একটি শূন্যতা নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলাম। আমি যতটা না এ শূন্যতা অনুভব করেছি, আব্বা-আম্মার জন্য এ শূন্যতা ছিল অনেকগুণ। তাদের জন্য এ ঈদ ছিল সত্যিই ব্যতিক্রমী। কারণটা জানা কি খুব জরুরী? থাকুক না আজ এখানেই। শূন্যতার গল্প না হয় হবে আরেকদিন।
বিষয়: সাহিত্য
১২৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন