একটি ব্যতিক্রমী ঈদ যাত্রা : পর্ব- ০১
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান আল আহসান ০৯ মার্চ, ২০১৪, ১০:০৫:৪৬ রাত
“ভাই, আপনার ভাইগ্যটা ভালা, আর একটু হইলেইতো পইড়া যাইতেন। আর পইড়া গেলেই কেল্লাফতে”- চটপট করে বলে উঠলো খলিল। তার আরেক নাম রাজু।
১২ই অক্টোবর ২০১৩। বরাবরের মতই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও বিলম্ব করে স্টেশনে পৌছাই রাত ১০.৩০ এর দিকে। ট্রেন রাত ১১.১০ এ ছাড়ার কথা। বন্ধু সানাউল্লাহর কয়েকবার reminder দেয়ার পরও দেরি করে স্টেশনে পৌছে তাকে ফোন দিলাম । অনেক্ষণ চেষ্টা করার পর যখন ফোন রিসিভ করলো, তখন শুধুই হতাশার বাণী শুনলাম। অসম্ভব রকমের ভিড়ের কারণে তারা বহু কষ্টে ট্রেনে উঠেছে, নামলে আর উঠা সম্ভব না। আগেকার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে বিষয়টা খুব সহজেই বুঝে আসলো। কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম, কারণ টিকেট বন্ধুদের কাছে আর টিকেট ছাড়া গেটে ঢুকতে দিচ্ছেনা গার্ডরা। টিকেট ছাড়া একজন সমবয়সী ছেলে ঢুকতে চাইছিল, সবার সামনে গার্ড তাকে যেভাবে অপমান আর মাইর দিলো তাতে লুকোচুরি করার চিন্তা মাথা থেকে উড়িয়ে দিলাম।
একবার ভাবলাম আর যাবো না, রুমে ফিরে যাই। সিদ্ধান্তটা প্রায় নিয়েই ফেলেছিলাম। তবে, গার্ড এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার কথা অনুযায়ী ৫০ টাকার বিনিময়ে ঢাকা টু ঢাকা বিমান বন্দর এর একটা টিকেট নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আরও বেশি আশাহত হতে হলো। ট্রেনের কোন দরজা দিয়েই ঢুকার সামান্যতম জায়গা নেই। নির্ধারিত ‘ছ’ বগিতে গিয়ে জানালা দিয়ে বন্ধু সানাউল্লাহকে ব্যাগটা দিয়ে দিয়ে নেমে পড়লাম ট্রেনে উঠার যুদ্ধে। বহু কষ্টে গেটের প্রথম সিড়িতে পা রাখলাম। কিন্তু প্রথম সিড়িতে এক পা আর আরেক পা ঝুলিয়ে তো আর এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া যায় না। আমারই মত কোন হতভাগ্যের চাপাচাপিতে পুরা দুই পা-ই সিড়িতে দিতে সক্ষম হলাম। আমি এখন দুই পায়ের উপর ভর করে দাড়িয়ে। একটু স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, হয়তো এইভাবেই অন্তত গেটের পাটাতন এ দাড়াতে পারবো। কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকলে যা হয়। পরের প্রায় পনের মিনিট বহু চেষ্টা করেও সামনের মানুষগুলোকে একচুলও নড়াতে পারিনি। খুব খারাপ লেগেছিল গেটের মুখে দাড়ানো দুইটা মানুষের নিচু মানসিকতা দেখে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এ অবস্থায় সামান্যতম জায়গা বের করা খুবই কঠিন কিন্তু তারা সামনের মানুষ গুলোকে একটু কষ্ট করে চেপে যাওয়ার অনুরোধ করার মত সৌজন্যতাটুকু দেখাননি। তারা যেই অবস্থায় ছিল ঠিক সেই অবস্থায় আমি কয়েকবার ট্রেনে গেছে, দেখেছি একে অপরকে কিভাবে সাহায্য করে একটু একটু করে ভিতরের দিকে যাওয়া যায়।
যাই হোক, প্রায় পনের মিনিট দরজার দুই পাশের রেলিং ধরে যুদ্ধ করার পর দুই হাত প্রায় অবশ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ট্রেন ছাড়ার সতর্কতামূলক বাশি বাজিয়ে দিল গার্ডরা। কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। এইভাবে গেলে ট্রেন থেকে পড়ে যাবার নিশ্চিত সম্ভাবনা আছে। হাতে ন্যুনতম শক্তিটুকুও নেই। পনের মিনিটের সংগ্রামের মাঝেই কোন এক গার্ড বেশ শংকিত হয়েই বলেছিল, ভাই ছাদে উঠে যান। উনার চোখে মুখে ছিল এক অজানা আশংকার ছাপ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনের ছাদে উঠবো। কিন্তু হাতে সময় কম, সর্বোচ্চ ১ মিনিট সময় আছে। কিন্তু গেটের যে অবস্থা গেট ও জানালা দিয়ে যে ছাদে উঠবো সে সুযোগটুকুও নেই। তাছাড়া উচু কোন স্থানে উঠতে পারলেও অনেকদিন পরে বলে বেশ ভয় লাগছিল। হঠাৎ করে পিছনে ফিরে দেখি সেই গার্ডটি। ভাইকে বললাম একটু সাহায্য করতে। তার সাহায্যে এক পা জানালাতে দিলাম, সামনে কোন একটা কিছু ধরে জোরে চাপ দিয়ে উঠার চেষ্ট করলাম, কিন্তু ব্যর্থ। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, ট্রেন প্রায় চলতে শুরু করলো, ঝড়ো হাওয়ার মত বুকে দমকা বাতাসের আঘাত লাগলো। উপরের এক ভাইকে বললাম, ভাই, আমাকে ধরে জোরে টান দেন। তাড়াহুড়ো করে দু’জন ভাই আমার দুহাত ধরে টান দিয়ে উঠালো। পা কাঁপছে, দুহাতে কোন শক্তি নেই। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ট্রেন ভালো মতই চলতে শুরু করেছে। বাম হাত দিয়ে কি যেন একটা ধরলাম। পড়লাম আল্হামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ জানালাম সেই ভাই দুটিকে যারা আমাকে একটি সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এভাবেই এসব কুলি-মজুর, রিক্সাচালক-ভ্যানচালকরা তাদের শ্রম দিয়ে আমাদেরকে, আমাদের দেশকে সব সময়ই বিপদ থেকে টেনে তুলে। আমরা ক’জনইবা তাদের খোজ খবর রাখি। বামে ঘুরে বসতেই হাসতে হাসতে সদা চঞ্চল একটি ছোট্ট ছেলে বলে উঠলো, “ভাই, আপনার ভাইগ্যটা ভালা, আর একটু হইলেইতো পইড়া যাইতেন। আর পইড়া গেলেই কেল্লাফতে”।
ছেলেটির নাম খলিল, অসম্ভব চটপটে ছেলে, তার আরেক নাম রাজু। নাম জিজ্ঞেস করার পর ওকে বললাম, তোমাকে আমি রাজু নামেই ডাকবো। রাজু, বয়স বড়জোর ৮/৯ বছর হবে। অসম্ভব কল্পনাশক্তির অধিকারী। তার বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পনার অনেক গভীর রাজ্যে। ননস্টপ বলে যাচ্ছে বিভিন্ন কাহিনী, কখনও নিজেকে নায়ক এর চরিত্রে, কখনওবা ভিলেন আবর কখনও এলাকার গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি। কতভাবে যে নিজেকে উপস্থাপন করছে তা লিখে বোঝাবার নয়। ভাবলাম, যাত্রাটা মনে হয় ভালই হবে।
মনে ভয় থাকলেও রাজুর ননস্টপ গল্প শুনে ভয়ের পরিবর্তে যাত্রাকে উপভোগ্যই মনে হচ্ছিল। সেই রাজুই এবার শোনাল তার মতই ছোট্ট এক ছেলে ট্রেনের ছাদে দাড়িয়ে যাবার সময় অসাবধানতার ফলে ট্রেনের ঝাকুনিতে পাশে পড়ে মারা যাবার কথা। শোনা মাত্রই আমি আমার হাত দিয়ে ট্রেনের ছাদের লাগানো একটা রিং শক্ত করে ধরলাম। সে আবার নতুন গল্প শুরু করলো। আমি তার গল্প শুনি, বুঝি না বুঝি বোকার মত হাসি কারণ সেও হাসে। আমি হয়তোবা তার বলা গল্পগুলো বলতে পারবো না কিন্তু এতটুকু বলতে পারি সে নিজেকে গল্পের মধ্যে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে বিমানে আকাশে উড়ে কলকাতার কোন এক বড় সাহেরেব বাসার ডাইনিং রুমে নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তার গল্পের ধাঁচ দেখে মনে হয়েছিল ভারতীয় বাংলা ছবি আর আমাদের দেশের সাকিব খানের ছবিগুলোই তার এ কল্পনা শক্তির উৎস, কারণ সে মাঝে মাঝেই বলতো, “আমি সাকিব খানের অ্যাসিস্টেন্ট”। (চলবে)
বিষয়: সাহিত্য
১১৮৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন