একটাই পরিচয়-এটা মানুষের লাশ
লিখেছেন লিখেছেন আবরণ ২৯ মার্চ, ২০১৩, ০৪:২১:৫৭ বিকাল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রচন্ড দাবদহে জ্বলছে। রাজনৈতিক আকাশ ঘোর অমানিশায় ছেয়ে গেছে। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। পরষ্পরের প্রতি সন্দেহ আর অসহনশীলতা আজ চরমে উঠেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় সব পক্ষেরই আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সবাই দাঁড়িয়ে আছে ' পয়েন্ট অব নো রিটার্ন ' পজিশনে। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে আন্দোলন-আর প্রতি আন্দোলনের খবর। হরতাল, সমাবেশ, মিছিল, পুলিশের বেপরোয়া এ্যাকশন, গাড়ী ভাংচুর, আহত নিহতের সংখ্যা আর গ্রেপ্তারের খবর ছাড়া আর কিইবা আছে খবরের কাগজে। টিভির সুইচ অন করলেই দেখি ছোট ছোট মিছিলের চেষ্টা, কাঁদুনে গ্যাস আর ককটেলের ধোঁয়া, জ্বলন্ত বাস ট্রাক, বুলেটের ঠাঁস ঠাঁস শব্দ আর তার মাঝেই পড়ে থাকা নিহত মানুষের ছবি। টিভির পর্দার সবাক ছবি দেখে ভাবতে কষ্ট হয় এই আমাদের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সোনার বাংলাদেশ। কেন এত জ্বালাও পোড়াও, কেন এত সম্পদ হানি? এ দেশের পুলিশ কেন দলীয় ক্যাডারের মত এ দেশের মানুষের বুকে নির্দ্ধিধায় গুলি ছোঁড়ে? এ পুলিশ তো কোন শত্রু দেশ থেকে আসে নাই। এ পুলিশ আমাদেরই কারো না কারো আত্মীয় স্বজন, ভাই, বাবা, চাচা, অথবা স্বামী। তাহলে কেন তারা বিদেশী হানাদারের মত আচরণ করছে-কেন এত অবলীলায় গুলি ছুঁড়ছে নিজ দেশের স্বজনের বুকে । এক দিকে যেমন চলছে হরতাল পক্ষের নির্দয় অগ্নি সংযোগ আর ভাংচুর, অন্য দিকে পুলিশের মানবতা বিবর্জিত হিংস্র বাঘের ন্যায় রক্তের স্বাদ গ্রহন। হরতাল চলাকালীন থেমে থাকা একটি বাস, ট্রাক, ট্রেনে অগ্নি সংযোগ অথবা দরিদ্র মানুষের রিক্সা, অটো, সিএনজি ভাংচুর যেমন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না, তেমনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার খোঁড়া অজুহাতে সমাবেশ বা মিছিল দেখলেই নির্বিচারে নিজ দেশের মানুষের বুকে গুলি চালানোর অসূস্থ্য ও সর্বনাশা প্রবনতাও সমর্থন যোগ্য নয়। গত দুই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় এবং পুলিশের গুলিতে দুই শতাধিক লোকের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। যাদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে অনেক পরিবারের ভবিষ্যত সুখ স্বপ্ন। একটি স্বাধীন দেশে নিজ দেশের পুলিশের গুলিতে এত প্রান হানি বড় লজ্জার, বড় কষ্টের। একটি গনতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ এ সবকিছুই স্বাভাবিক। মিছিল সমাবেশ যখন লাগামহীন বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল হয়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হয়। তাই বলে সেই ব্যবস্থার নামে পলায়নপর মানুষকে লক্ষ্য করে টার্গেট প্রাকটিস করা কিংবা কাউকে গ্রেপ্তার করা অবস্থায় তার গায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করার মত মানবতা বিরোধী কাজ আর কি হতে পারে? এত কিছু ছাপিয়ে সব চাইতে জঘন্য আর নির্মমতম দৃশ্য হলো পুলিশের গুলিতে নিহত মানব সন্তানের লাশটি নিয়ে পুলিশের নির্মম রসিকতার দৃশ্য। হায়রে মানব সন্তান ! 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'- মানবতার কবির এ পংক্তি যেন আমাদেরকে বিদ্রুপ করে। মহান সৃষ্টি কর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর সৃষ্টি কর্তার সেরা সৃষ্টি সেই রক্তাক্ত মানুষের লাশটিকে যখন পুলিশ হাত পা ধরে কুকুর বেড়ালের মত টেনে হিঁচড়ে অথবা চ্যাং দোলা করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য টিভির পর্দায় এ দেশের মানুষ দেখে তখন স্বভাবত:ই মনে প্রশ্ন জাগে ওরা কি শুধুই পুলিশ -নাকি ওরাও মানুষ। মৃত মানুষটি সে যে দলেরই হোক, যে ধর্মেরই হোক জীবিত থাকতে তার একটি পরিচয় ছিল। সব জাতি ধর্ম বর্ণের মানুষই মরে গেলে লাশ হয়ে যায়। লাশের যত পরিচয়ই থাকুক তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তখন-এটা একটা মানুষের লাশ। আর এই লাশটিকে যখন অমানবিক ভাবে হাত পা ধরে মাটির সঙ্গে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে জড় পদার্থের মত নিয়ে যাওয়া হয়, তখন মানবতাকেই অপমান করা হয়। মনে হয় এটা মানুষের লাশ নয়, এটা রাস্তায় মরে পড়ে থাকা একটা কুকুরের দেহ। যত শত্রুতাই থাকুক জীবিত থাকতে একজন আর একজনকে সম্মান করতে না পারলেও প্রতিপক্ষের লাশটি যেন আমরা অসম্মান না করি। আমরা যেন কোন লাশকে প্রতি পক্ষের লাশ না ভেবে মানুষের লাশ হিসাবেই ভাবি, সম্মান করি।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন