" একজন ছাত্রের জীবনে মেস ও তার মনস্তাত্তিক প্রভাব "
লিখেছেন লিখেছেন দুর দিগন্তে ১৯ আগস্ট, ২০১৫, ০৫:১৭:৩৭ সকাল
স্মৃতিকথা- ৫
-----------------
( এক )
" নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে, ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।" আষাঢ়ের আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে কবি গুরুর এ সাবধানী আর্তনাদ শুনে, কেও ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করেছিল কি না ? তা গবেষনার বিষয়। কিন্ত প্রয়োজন যে কখনো মানুষকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে পারে না । একথা হলফ করে বলা যায় । কারণ," বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে " প্রতিটি শিশুর জন্মের পর কিছু কাল মাতৃক্রোড়ই তাদের পৃথিবী । দিন যায় । মায়ের আঁচল তলার প্রয়োজন ফিকে হয় । শিখে পায়ে পায়ে হাটতে । দৌড়াদৌড়ি লম্ফঝম্ফ । ব্যাস্ত রাস্তায় গিয়ে হুমড়ি খাওয়া । ব্যাট-বল হাতে খেলার মাঠ দপিয়ে বেড়া । সাতরিয়ে পুকুর পার । বন্ধুদের সাথে বন-জংগোলে এগাছে ওগাছে দোল খাওয়া । অতপর একদিন এ বাদরামীর দিন শেষ হয় ।
বাবা মা ক্ষেত্র বিশেষে গৃহশিক্ষকের কড়া শাসনে নিয়ম মেনে পড়ার টেবিলে বসতে হয়। সন্ধা থেকে গভীর রাত l টেবিল ল্যাম্পের আলো আধারী l ধপধপে সাদা কাগজের পাতায় পাতায়, স্বপ্নময় ভবিষ্যতের ছবি আকতে হয় । এভাবে স্কুল আঙ্গিনার স্মৃতিময় দিনগুলও আতীত হয় । বড়দের আদেশ নিষেধ, বাক-বিতন্ডার পরিসমাপ্তি ঘটতে থাকে সময়ের ক্রমবর্ধমান পরিক্রমায় । সাধারনতঃ কেউ কলেজ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় পাঁ রাখতে গিয়ে বাড়ির চার দেয়াল থেকে মুক্তি পায় । গ্রাম থেকে গঞ্জে । এক শহর থেকে অন্য শহরে । এ ক্যাম্পাস সে ক্যাম্পাস l নতুন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুবাদে আশ্রয় নিতে হয় বিভিন্ন ছাত্রাবাসে । যার বহুল পরিচিত ব্যাবহারিক শব্দ 'মেস' । প্রকৃতপক্ষে এ মেস জিবন থেকে একজন ছাত্র নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে শিখে । স্বাধীন ভাবে স্বপ্ন দেখে । কবিতা লিখার কাব্যিক ছন্দও এই বয়ষেই খুজে পায় l
অনেকে হেডলাইনের সাথে আষাঢ়ের প্রাসঙ্গিকতা খুজেছেন ? আজ আমার লিখার বিষয়বস্তু আষাঢ় নয় । কিন্ত আষাঢ়ের কালোমেঘ ততধিক কুন্ডলী পাকিয়ে যখন পৃথিবীর ডিজিটাল আকাশে তর্জন গর্জন করছে । ডিশ, স্যাটেলাইট নেট চ্যাট সহ ভার্চুয়াল দুনিয়ার সমস্ত টেকনোলোজি কোমলমতি ছাত্রদের মননে, মগজে নিয়মিত ফিকশন সৃষ্টি করে চলেছে । তখন মেস জীবনের শুরুতে একজন ছাত্রের পূর্ণ স্বাধিনতা যথেষ্ট আশঙ্কার । কারন প্রজন্মের বেড়ে উঠার কারখানায় আজ ক্যান্সারের জন্ম হচ্ছে । সুশিক্ষা ও সুনাগরিক তৈরীর মেশিনপত্রে উত্পাদিত 'মানিক' ভাইরাস মহামারীতে রুপ নিচ্ছে । ঠিক তখন বিশ্বকবির সেই আর্তনাদে শুনি পরিবর্তনের সুর । শতাব্দীর সব পিতামাতার উদ্যেশ্যে কবির হাহাকার -
" নীল নবঘনে নেট স্যাটেলাইট গগনে তিল ঠাই আর নাহি রে,
ওগো, আর তোরা দিসনে যেতে একাকী বাড়ির বাহিরে, "
( দুই )
আমাদের সমাজ সভ্যতায় প্রচলিত কিছু নিয়ম পদ্ধতি খুব হতাশা জনক । যখন একটি ছেলে প্রাথমিক কিংবা উচ্চবিদ্যালয়ে লিখাপড়া করে , তখন আমাদের সম্মানিত অভিভাবক গণ খুব চোখে চোখে রাখেন । কড়া আদেশ নিষেধের গ্যাড়াকলে অব্যাহত অনুশাসনের গীত শুনাতে শুনাতে কিশোর মনকে বিষিয়ে তুলেন । অথচ পড়া শুনার বাইরে অন্য কিছু করার ক্ষমতা ,অর্থ, সাহস বা জ্ঞান তখনও তাদের থাকে না ।বরং কলেজ ভার্সিটিতে ভর্তির প্রথম দুএক বছর বড় বেশি প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যার । কিন্ত তখন তারা অবসর নেন । ছেলে মেয়ের আর তেমন খোজ খবর রাখেন না। অথচ কলেজে লাইফটায় অনুশাসনে গড়ে তুলার উপযুক্ত সময় । মানসিকতা পরিবর্তনের সব থেকে কার্যকর মুহুর্ত । এমন 'ট্রানজিট স্টেজে' অভিভাবকদের দিক নির্দেশনাহীন একজন উঠতি যুবক, মেস জীবনে প্রথম পা রাখে । তির্ছক দৃষ্টি রাখে তার চতুর্পাশে । কোন ধারাই চলে তার অন্য মেস মেটরা । কোন রঙ্গ ঢঙ্গে কথা বলে । কোন মত ও পথ অনুস্বরণ করে । তার মেস বন্ধুদের কি আচার ব্যাবহার । হাফ প্যান্টস, সর্টস,জিনস, গলায় চেন, বুকে চসমা না সাদাসিধা বিনম্র মার্জিত পোষাক পরিচ্ছদ, তা খুব খেয়াল করে । তারপর সেও আস্তে আস্তে নিজেকে সে ধাচে প্রস্তুত করে । খোলস ছেড়ে নিজেকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে মরিয়া হয়ে উঠে । সে ধারা মোতাবেক তার বন্ধু সার্কেল গড়ে উঠতে থাকে । এভাবে তার শিক্ষা জীবন কর্ম জিবন এমন কি বার্ধক্য জীবনও সে ধারা বজায় থাকে । সুতরাং একজন ছাত্রের প্রথম মেস নির্বাচনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ । এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা দুরদর্শিতা ও দায়িত্বশীলতা অনিবার্য ।
কারন- একটি ইট বা বরফের প্রফর্মা যেমন তার ভেতরের পদার্থ কে নিজস্ব অবয়বে তৈরি করে । ঠিক একটি মেসের পরিবেশ ও তার বর্ডারদের চারিত্রিক বৈশিষ্টও সে মেসে আগত নবীণ অতিথিকে গড়ে তুলতে শত ভাগ কার্যকর । যেমন- একটি মেসে অধিকাংশ ছেলে যদি নামাজি হয় । নম্র, ভদ্র দাওয়াতী চরিত্রের অধিকারী হয় । সকালটা শুরু হয় কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে । আর ইসলামী সাহিত্য হাদীস পাঠ কিংবা পারস্পারিক মুহাসেবা বা আত্ন সমালোচনার মাধমে ঘুমাতে যায় । তাহলে, সে মেসের নতুন বর্ডারও ইসলামী তাহজীব তামদ্দুনে অভ্যস্ত হতে বাধ্য । আর ইসলামের সৌন্দোর্য যে একবার কৈশরে উপলব্ধি করতে পারে । সে আমৃত্য সে পথে অটুট থাকতে চেষ্টা করে । অপরপক্ষে, যে মেস বর্ডাররা গান-বাজনা, তাস-জুয়ার আড্ডা, গাঞ্জা-ইয়াবা, ফেন্সিতে অভ্যস্ত । সকাল-সন্ধা যে মেসে মেয়ে বন্ধুদের আনাগোনা থাকে ? গ্রুপ স্টাডির নামে গেটটুগেদার লিভটুগেদারে মেতে উঠে । সে মেসে নতুন অতিথি কি শিখতে পারে । তার গন্তব্য কোন দিকে । প্রিয় পাঠক আপনারাই একটু কল্পনা করুন । অতএব, প্রতিটি অভিভাবক যদি বাড়ির বাইরে প্রথম পা রাখা সন্তান কে নিজে এসে মেস ঠিক করে দেন । কোন পরিবেশে তার ছেলে কে রেখে যাচ্ছেন , সে বিষয়ে পূর্ণ ওয়াকিফহল থাকেন । পিতা যেমন সুসন্তান আশা করেন তেমন পরিবেশ নিশ্চিত করে যেতে পারেন । অর্ধেক সফলতা সেখানেই সুনিশ্চিত । বাঁকি অর্ধেকের জন্যে প্রয়োজন, সঠিক পন্থায় সুপারভিশন ও আল্লাহর দরবারে ধরনা ।
প্রিয় পাঠক-এখন যদি প্রশ্ন করা হয় , শতকরা কত ভাগ অভিভাবক স্বশরীরে এসে মেস ঠিক করেন ? কতজন পিতা মাসে অন্তত একবার ছেলেমেয়ে ও তার বন্ধু সার্কেলের খোজ রাখেন ? কজন পাওয়া যাবে যে, তার সন্তানের ফেসবুক টুইটার ব্লগ সহ ব্যাবহৃত সকল ওয়েব পেজের পোস্ট সমূহ পরখ করেন ? প্রিয় সন্তানের মোবাইল আইফোন ট্যাব কম্পিউটারের সেভ ফাইল চেক করে ব্যাবস্থা গ্রহন করতে পারেন ? লাইভ অডিও ভিডিও ভয়েস চ্যাটে কি করে ? কি বলে ? কি ভাষা ব্যাবহার করে ? কোন পাড়ায় আড্ডা দেয় ? কাদের পেছনে, কি বাবদ টাকা খরচ করে ? তাহলে এ সকল প্রশ্নের খুব কমই সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যাবে । তাহলে কিভাবে আমরা আশা করতে পারি ? প্রজন্ম শিক্ষিত হলেই জাতির উন্নতি বা মুক্তি মিলবে ? সৈয়দ মুজতবা আলীর 'স্বশিক্ষিত মানেই যেমন সুশিক্ষিত নয়' । তেমন শিক্ষিত মানেই সুনাগরিক নয় । নামে মুসলীম আর আমল আখলাক ওয়ালা প্রাক্টিসিং মুসলীম এক কথা নয় । শিক্ষা কে সুশিক্ষায় রুপান্তরের জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষার সামাজিকি করন । সমন্বিত অনুশীলন । পারিবারিক অনুশাসনের আবহ l ভার্সাম্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রন । সুস্থ সুন্দর মনোরম ও মননশীল পরিবেশ ।
( তিন )
মেস জীবনের শুরু জুন' উনিশশো আঠানব্বই । প্রথম মেস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন উত্তরণ ছাত্রাবাস । রুমমেট নাটর গুরুদাসপুরের এক ভাই । গনিত প্রথম বর্ষের ছাত্র সে । তার কাছে পুরা রাজশাহী শহরের মেস সমূহের হালহকিকত জানতে পারি । কোন মহল্লার মেস গুলোর পাশ দিয়ে হাটলে সকাল সন্ধা কুরআনের মিষ্টি সুর ভেসে আসে । নামাজ ওয়াক্ত হলে সালাত সালাত ধ্বনীতে মুখরিত হয় চতুর্দিক । কোন মোড়ের মেস গুলো রাতের আঁধারে 'পেইডকুইনের' বাজারে পরিনত হয় । কোন গলির মেস মদ গাঞ্জা ইয়াবার সদর দপ্তর । কোন এলাকার মেস মানে তাস জুয়ার জমজমাট আসর । মাসের খরচ ফতুর করে অশ্রুসজল ঘরে ফেরার নিত্য আয়জন । এমন জাহিলিয়াত পূর্ণ পরিবেশ থেকে একজন নবাগত কিশোর কে আলোর পথে পরিচালিত করতে পারে ? এমন কোন শক্তি আছে কি ? এমন বিবেক ও বোধশক্তি কজনের আছে ? কজন পারে স্রতের বিপরিতে নিজেকে চালিত করতে । প্রয়োজনে মেস পরিবর্তন করে আলোর ফোয়ারায় নিজেকে শামীল করতে কজন পারে ? যে পারে সেইতো সফল । দুনিয়ায় নাস্তিক্যবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মন্ত্রতো সে, সেখানেই পেয়ে যায় । বড় বাঁচা বেচে যায় সে । দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকে তার পরিবার।
এক সময় ব্যাক্তিগত কখনও গ্রুপ দাওয়াতী কাজে গোটা রাজশাহীর এ মেস থেকে সে মেস ঘুরে বেড়িয়েছি । পড়েছি হাজারো পরিস্থিতির মুখে । হয়েছি বহুমূখী অভিগ্যতার নীরব সাক্ষী । যার দুএকটি বলে লিখা শেষ করতে চায়-
এক মেসে সালাম পরিচয় উদ্যেশ্য বলে প্রবেশ করেই বিব্রত হলাম । কারন- রুম গুলোর দেয়ালে দেয়ালে নগ্ন, অর্ধনগ্ন, কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির নারীদেহ সম্বলিত পোষ্টারে ভর্তি । যে পরিবেশ আমাদের ও তাদের জন্য শুধু লজ্জারই নয় অশস্থিকরও বটে ।
আরেক মেসে মুলগেট পার হতেই তাজা মাদকের গন্ধ ও গঞ্জিকার ধুয়া আমাদের আছন্ন করে ফেলল । সালাম পরিচয় দিতেই তেড়ে এলো কটা অমানুষ । অকথ্য গালি গালাজ আর ভার্সাম্যহীন মাতলামি, পরিস্থিতি কে জটিল করে তুলল । খুব কৌশলে পেছনে হটে যাবনিকা টানতে হয়েছিলো সে যাত্রা ।
অন্য একটি মহল্লার মেসে ঢুকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আহবান করাই যুদ্ধই বেধে গেলো । আমরা কজন ভাইতো ৮/১০ ঘন্টা ইসলামের দুশমন আবুজাহেলের উত্তরসূরীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আটকা পড়লাম । জীবন মৃত্যুর ফয়সালা কারীর দরবারে প্রাণভিক্ষার দরখাস্ত করা ছাড়া, আমাদের কিছুই করার ছিলো না । হুদায়বিয়ার বাবলা চত্তরে রাসুল (সঃ) এর হাতে বায়াত নেয়া, ওসমান (রাঃ) মুক্তি আন্দোলনের উত্তরসূরীদের আপসহীন অসম এক যুদ্ধের পর, মিলেছিলো মহান আল্লাহর আসমানী সাহায্য ও সুষ্পষ্ট বিজয় । অক্ষতই ছিলো অবরুদ্ধ আমাদের প্রিয়্সাথীরা । কিন্তু অক্ষত ছিলো না সে অভিশপ্ত জনপদ । ছিলো না অবশিষ্ট অনেক অবকাঠামর চিহ্ন ।
070815
বিষয়: বিবিধ
২৮৭৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন