" অন্ধের হাতি ও আমার ক্যাম্পাস দর্শন "
লিখেছেন লিখেছেন দুর দিগন্তে ২২ এপ্রিল, ২০১৫, ০৫:৪৮:২৫ বিকাল
প্রবাদ প্রবচনে বাংলা ও বাঙ্গালীর ঐতিহ্য বেশ পূরোনো । এক একটি প্রবাদ বা উপাখ্যান, এক একটি সমাজের দর্পণ । যা আমাদের মানোষপটে স্পষ্টই ফুটিয়ে তুলে, সমূহ স্ংগতি ও অসংগতি । তাই ঘুরে ফিরেই আসে আবহমান বাংলায় প্রবচিত সেই কথামালা । চর্বিত চার্বণ হতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী । তেমনি একটি মশহুর প্রবাদ, অন্ধের হাতি দেখা বা কানাকে হাইকোর্ট দেখানো । ব্যাবহারিক ঘটনা সবার জানা । একটি ঐরাবতের বিশাল দেহ ঠিক কেমন হতে পারে ? তিন অন্ধ দর্শনার্থীর পূর্বধারণা ছিলনা । যথারীতি একজন পাঁ স্পর্শ করে তো অন্যজন কান, কেউ বা লেজ । ফলে হাতির পূর্ণরুপ, অদেখাই রয়ে গেলো সবার । কিন্ত তাদের অভিজ্ঞতা ও ধারণা জন্মালো ভিন্ন ভিন্ন । হাতি দেখতে যথাক্রমে খাম্বা, কুলা ও লাঠির মত । যা বাস্তবের সাথে শুধু অসংগতিপূর্ণই নয়, হাস্যকর ও বটে । যেমন বড় বিল্ডিং বা লাল দালান মানেই হাই কোর্ট নয় ।
আমাদের জীবন সংসারে বিভিন্ন দিক ও বিভাগের মোড় পরিবর্তনে- শিক্ষা সচেতনতা, অনুসন্ধিৎস্যা ও মননশীলতা পরস্পর গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য্য অধ্যায় । সামাজিক অসচেতনতা আমাদের তারুণ্যকে অকর্মন্য বাংগালী করে রেখেছিলো বহুদিন । মানুষ হতে দেয়নি বহুবছর । এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে কখনো বর্গীরা । কখনো ব্রিটিশ বেনিয়া ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী । কখনো বা উগ্র-হিন্দুত্ববাদী ব্রাম্ভন্যবাদ ও পাকিস্থানি ফেৎনা । কখনো আবার তথাকথিত সুশীল এবং স্বদেশী দালাল শ্রেনী । ওরা আমাদের মেধাবীদের বসিয়ে বসিয়ে মেধার আপচয় শিখিয়েছে । কিন্ত মেধার ব্যাবহার শিখতে দেয় নি । আজকের অবাধ তথ্য-বিপ্লব সে অক্টোপাশের নাগপাশ থেকে নিজেদেরকে ক্রমোশঃ খোলোস মুক্ত করে চলেছে । তাই আজকের তারুণ্য অনেক বেশী স্বধীন ও সচেতন । অনেক বেশী সৃষ্টিশীল ও কৃষ্টিশীল ।
এইতো কদিন আগের কথা । একজন তরুণ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বসেই থাকত ফলাফল পর্যন্ত । তখনো সে চিন্তা মাথায় আসতো না ? এরপর কোথাও ভর্তির জন্য প্রস্তুতি দরকার । জানতো না তার কোথায় ভর্তির সুযোগ আছে । কিভাবে সেখানে যেতে বা ভর্তি হতে হয় । ফলে শহুরে তরুণরা যখন সহজে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতো । গ্রামীণ জনপদের অনেক মেধাবীর অজানায় থাকতো তখন, মেডিকেল,প্রকৌশল কিংবা বিশ্ব্যবিদ্যালয় প্রতিদন্দিতার সুযোগ । ফলে হাতেগনা দু-একজন শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, উচ্চশিক্ষার চৌহদ্দী মাড়াতে পারত । বাকি নব্বইভাগ তরুনকেই গ্রামের কেলেজে ডিগ্রীতে ভর্তির লাইন দিতে হতো । প্রীভিয়াস মাস্টার্সে বিশ্ববিদয়ালয়ে প্রথম পা রাখতে এসে, পড়তে হতো শত বিড়ম্বনায় । তাদের নিয়ে সেই রম্য পিলু-কলুর নানা উপাখ্যানের জন্ম হয়েছে । বেধেছে যুদ্ধও । এই যে নব্বই ভাগ পাস-কোর্সের ছাত্র ! তাদের বড় অংশই অসচেতনতার জন্য একবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির চেস্টাও করে দেখেনি । অথচ দিব্যি করে বলা যায়, তাদের অনেকেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মত ছিলো মেধাবী । আজ প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ও ফ্যাকাল্টি বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ । সেই সাথে নতুন প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক ক্যারিয়্যার সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে । তাই এখন ডিগ্রীতে পড়ার জন্য গ্রামে গ্রামে হারিকেন দিয়ে ছাত্র খুজতে হয় । এর মুল কারণ তথ্য সচেতনতা । দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি । এখন একটা ছেলেকে মিডিয়া, তথ্য প্রযুক্তি, কম্পিউটারের রচনা মুখস্ত করা লাগে না । টু্-থ্রিতে পড়াকালিন জানতে পারে মেডিকেল বুয়েট কি । শিশুবেলায় পিকনিকে এসে ঘুরে বেড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের এভবন থেকে সে ভবন । ফিরে যাওয়ার সময় একবুক স্বপ্ন নিয়ে যায় । ক্যাম্পাসের বৃক্ষরাজিকে বলে যায়। অপেক্ষা করো আমি আসছি তোমাতে বিলীন হতে । তখন থেকেই নতুন ভুবনে, মানষিক যাত্রা শুরু হয় প্রগতির পথে । যা থেকে আমরা বঞ্জিত হয়েছি । অনেকাংশেই থেকে গেছি অসচেতন ।
শৈশব কৈশরের কিছু কিছু উপলব্ধি, হৃদয়ে খুব দাগ কাটে । এ দাগ সহজে মুছবার নয় । দিন যত গড়ায় । দাগ তত দগদগে হতে থাকে । স্বাধীনতা উত্তর সময় থেকে নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত । দেশের প্রায় সকল ক্যাম্পাস গুলোতে বাম রাম ও মুজিববাদের দখলে ছিলো । স্বাধীনতার নামে বিকৃত চেতনা ধারীদের ইবলিশীয় বন্য উল্ল্যাসে কম্পমান থাকত শিক্ষাঙ্গন । কবি আল-মাহমুদের ভাষায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তখন ডাকাতদের এক একটি গ্রাম । খাতা কলমের পরিবর্তে অস্ত্র এবং অস্ত্রই ছিলো আবাসিক হলের বিনীদ্র মানুষ গুলোর শিক্ষার উপকরণ । সন্ত্রাস নৈরাজ্যই ছিলো তাদের আদর্শের হাতিয়ার ।
কিন্ত অন্ধকারের মাঝেও জোনাকীরা বেঁচে থাকে । তখনও কিছু আলোকিত মানুষ ছিলো । দ্বীণের পথে মানুষকে ডেকে ফিরতো । জাহিলিয়াতের মহামারীতেও ছিলো কিছু কলঙ্কমুক্ত সাদাহৃদয় । একত্র হতো চুপিচুপি তাওহীদের মিশন নিয়ে । ইসলামী ছাত্র আন্দলোনে তারা ছিলো অকুতভয় ও নির্ভীক । হল মাসজিদের শববেদারীতে এ মানুষ গুলোর ফরিয়াদ ! ফেরাউনের চেতনা ধারীদের ঘুম হারাম হয়ে যেতো মাঝে মধ্যেই । প্রতি ফেব্রুয়ারী কেই তারা তাই কারবালায় রুপান্তরিত করতো । ফেবুয়ারী মাস জুড়েই বিশ্ববিদয়ালয়ের রাস্তা আর মেডিকেলের করিডর রক্ত প্রবাহিত হতো । বেছে বেছে মেধাবী সেই আলোকিত মানুষ গুলোকে নারকীয় কায়দায় খুণ করতো । সীমারীয় উৎসবে একত্রে মিলিত হতো সকল কুফরী শক্তি । শহীদের সাথীরা তখন সেই রক্তাক্ত দেহের ছবি সম্বলিত পোষ্টার বানাতো । সারা দেশে, হাটে, বাজারে টাঙ্গিয়ে অসহায় প্রতিবাদ করতো । বিশেষতঃ সে পোষ্টার গুলো কোনো মাসজিদের দেয়াল বাদ যেতো না । ফজর নামাজ শেষে প্রায় সব মুসল্লিরা জটলাপাকিয়ে দেখতো সে হৃদয় বিদারক দৃশ্য । তদের সাথে আমিও দেখতাম । খুব প্রতিক্রিয়া হতো আমার পিচ্চি হৃদয়ে । সব লোক চলে গেলেও, আমি দাড়িয়েই থাকতাম দীর্ঘ সময় । মনে হত তরতাজা রক্ত পোষ্টার বেয়ে বেয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে তখনও । ছোট বুকটা ফেটে খান খান হতো । দুচোখ জুড়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো । কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় মাথা নুয়ে যেতো । কেনো কাঁদছি তার উত্তর তখনও জানা ছিলো না । কেউ প্রশ্নো করলে নিরবে পালিয়ে যেতাম । এভাবে লুকিয়ে রক্ত রাঙ্গা পোষ্টার দেখতে দেখতে কখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও রক্ত মাখা মানুষ গুলোর রেখে যাওয়া উঠনের প্রেমে পড়েছিলাম । আমি জানি না ।
ছিয়ানব্বই সালে আলিম প্রথম বর্ষে পড়ি । রাজশহীতে একটি জমকালো ইসলামী সাংস্কৃতিক উৎসব । সন্ধানী শিল্পী গোষ্ঠীর আমরা কয়েকজন সে অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে শহরে আসি । উদ্দ্যেশ্য সকালে ক্যাম্পাস দর্শন, বিকালে সাংস্কৃতিক উৎসব । যথারীতি শহর থেকে হেঁটে ক্যাম্পাসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা । আমরা এ গন্তব্যে এবারই প্রথম । আমার নেতৃত্বে চার/পাঁচ জনের এ গ্রুপ অভিযান । বয়সে আমিই সবার ছোট । সত্যিই আমার কিশোর কৌতুহলী মনে, কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের তুলোনায়, সে অভিযানে কম এ্যাডভেঞ্চার ছিলো না । হাঁটতে হাঁটতে কাজলা গেটে পৌছতেই আমাদের পাঁ ব্যাথায় যায় যায় । সামনে এগুতে মন সায় দিচ্ছিল না । স্কুলের সামনের মাঠে কিছুক্ষন জিরিয়ে, আবার হাঁটা । এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে জুবেরী ভবন, ইবলীশ চত্বর, মমতাজ উদ্দীন ভবনের পিছন দিয়ে প্যারিস রোডে এসে ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গলো । সেখান থেকে মনে হলো, এতো লম্বা রোড ঘাঁটের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় খুজে পাওয়া মুশকিল । তারচে রণেভঙ্গ দিয়ে শহরে ফেরায় উত্তম । ক্যাম্পাস দেখার স্বাধ অধরা রেখেই,সে যাত্রায় অন্ধের হাতি দর্শনের মত ক্যাম্পাস দেখে ফিরতে হলো । দু-তিনটা বিল্ডিং আর লম্বা কটা রাস্তা যে বিশ্ববিদয়ালয় নয়, সে জ্ঞান সচেতনতাই আমার ছিলো না । সারাদিন সমুদ্র সৈকত ঘুরে, বালি আর পানি ছাড়া কিইবা মিলতে পারে সে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় ? তবে নগদ কিছু না মিললেও, প্রশস্থ প্যারিস রোড ঠিকি আমায় হাত ছানি দিয়েছিলো । তার তিন বছর পর সে ডাকেই, ঐ আলোকিত মানুষ গুলোর পরোষ পেতে শামীল হতে পেরেছিলাম লিচুতলায় । আজো সেটা টের পায় বুকের খুব গভীর থেকে ।
২০০৪১৫
বিষয়: বিবিধ
১২৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন