" কথনে আঞ্চলিকতা হাস্যকর নয়, ভাষার অলংকার "
লিখেছেন লিখেছেন দুর দিগন্তে ০৪ এপ্রিল, ২০১৫, ০৬:৪০:৫৬ সন্ধ্যা
পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন দেশ পাওয়া দুরুহ । যে দেশের মানুষ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে । সুদীর্ঘ লড়ায় সংগ্রাম করেছে । ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যূথ্যানে অর্জন করেছে মা ও মাটির ভাষা । সংরক্ষন করেছে কথা বলার অধিকার । সে দেশ, আমার বাংলাদেশ । সে ভাষা, অমর বাংলাভাষা । এই মাতৃভাষাকে অনেকে অনেক ভাবে সজ্ঞায়িত করতে পারে । তবে- যেভাবেই ধরি না কেনো, সব সজ্ঞার মুলকথা একই । মা যেভাবে কথা বলেন- সে ভাব, সে ভাষাই মাতৃভাষা । সূতরাং যার মা যে সুরে কথা বলেন, সে সুরই তার মাতৃভাষা ।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সকল মা কি ? একি ভাবে, একি ঢঙে, একি টোনে, একি উচ্চারণে কথা বলেন ? উত্তরে আমি বলবো অবশ্যই না । আবার যদি প্রশ্ন করি, দেশের সকল মা কি, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন ? আপনারা বলবেন অবশ্যই না । তখন অত্যান্ত যৌক্তিক ভাবেই সামনে চলে আসে, কথনে আঞ্চলিকতার প্রসঙ্গ । কেননা প্রত্যেক দেশেই ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন শব্দে-বর্ণে-উচ্ছারনে টেনে কথা বলেন । যেমন- নোয়াখালীর মা'য়েরা রাজশাহীর মত করে বলেন না । চট্রগ্রামের মা'য়েরা বরিশালের মা'দের উচ্চারনে ডাকেন না । রংপুর বা খুলনার মা'য়েরা সিলেটি মা'দের স্বরে, শিশুদের কথা বলতে শেখান না । কারন- প্রাচীন একটি জনশ্রুতি আছে । প্রতি চল্লিশঘর অন্তর ভাষার উচ্চারণ ক্রমশোঃ বদলাতে থাকে । তাহলে আমি বলতেই পারি, বিশুদ্ধভাষা মানেই মাতৃভাষা নয়, আবার মাতৃভাষা মানেই যে সেটা শতভাগ শুদ্ধ হবে তেমনটিও নয় । তাই ভাষায় আঞ্চলিকতার গুরুত্ব অপরিসীম । বলা যায়, অনেকটা আঞ্চলিক ভাষার প্রতিবিম্বই মাতৃভাষা । সে দিক থেকে সজ্ঞায়িত করলে অবশ্যই বলতে পারি, “কথনে আঞ্চলিকতা হাস্যকর নয়, ভাষারই অলংকার” । আমরা আল-কুরআন লিখন ও পাঠনের ইতিহাস জানি । সেখানেও আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব ঈর্ষনীয় । আল-জাজিরাতুল আরবের মুলভাষা আরবী । কিন্তু রাসুল ( স: ) এর জীবনদশ্যায় সাত অঞ্চলের উচ্চারনে আল-কুরআন লিখিত ও পঠিত হতো ।
এখন প্রশ্নহলো কখন বিশুদ্ধ বলব ? কেনই বা আঞ্চলিকতার ঘাঁনি টানব ? আমি মনে করি, এখানে স্থান-কাল-পাত্র প্রভেদে, প্রায়োগিক যথার্থতা নিরুপন করা উচিত । যখন নিজ অঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলব, তখন স্ব-স্ব আঞ্চলের ভাষায় কথা বলাই ভদ্রতা । আবার যখন অফিস আদালত বা অন্যান্ন অঞ্চলের মানুষ বেষ্টিত থাকব, তখন পরিচ্ছন্ন ভঙ্গিতে, শুদ্ধভাষা ব্যবহারই আধুনিকতা । কিন্ত আমরা প্রায়শই যে ভূলটা করি । তা হলো, কে কোন অঞ্চলের মানুষ, তা বাচ-বিচার না করে, সমানে গ্রামীন ভাষায় কথা বলে অনেকে হাসিরপাত্র হই । আবার অনেকেই একমুঠো শুদ্ধের সাথে, এক চিমটি আঞ্চলিকতা মিশিয়ে ভাষার ডায়রীয়া বের করে ছাড়ি । সেটাও খুব বিব্রতকর । আর হাল-আমলে শুদ্ধ-অশুদ্ধের সাথে অতি যত্নে দু-একটা ভীনদেশী শব্দ চয়ন করে নিজেকে বিজ্ঞানমনোস্ক বা মুক্তবোদ্ধা ভাবতে শুরু করি । আমাদের নতুন প্রজন্ম খেয়ালে বেখেয়ালে অনেকটা এ ভয়ঙ্কর দিকেই হাঁটছে । সে যাই হোক, এবার আসি মূল প্রসংগে- যা বলার জন্য এতো কিছু বলা-
আমি চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার মানুষ । এ অঞ্চলের ভাষা শব্দে নয়, উচ্চারনে বেশ ভিন্ন । সে নিয়ে বহু হাস্যরস উপাখ্যানও আছে । যেমন অমর সৃষ্টি গম্ভীরা,পূথীমালা বা আলকাপ ইত্যাদি । ১৯৯৮ সালের পূর্বে, অন্য জেলার মানুষের সাথে মেশার সুযোগ কম হয়েছে । তাই অনেকের মত আঞ্চলিক ভাষা, আর শুদ্ধ বাংলার মাঝে পার্থক্য করার ক্ষমতা কমই ছিলো । মেস জীবনের শুরুর তিনমাস উত্তরণ ও সাময়িকী ছাত্রাবাসে ছিলাম । রুমে একা থাকায় খুব একটা সমস্যা হয়নি । যদিও কোচিং ক্লাসে আড়ালে আবডালে বিব্রত হতাম । কিন্ত চতুর্থ মাসে মেস পরিবর্তন করে উঠি রুপান্তর ছাত্রাবাসে । সেখানে রুমমেট ছিলেন রংপুরের এক বড়ভাই । তিনি এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক । সে মেসের পরিচালক ছিলেন বগুড়ার আরেক বড়ভাই । বর্তমানে তিনি ইসলামী বাংকের বড় কর্মকর্তা । আরো দু/তিন জন প্রিয় মেসমেট থাকলেও উপরোক্ত প্রিয় দুইভাই আমাকে ব্যাপক ভাবে সহযোগিতা করেছেন । আমি আজীবন চিরঋণী থাকবো তাদের স্নেহ-ভালবাসা, আত্নরিকতা এবং সার্বক্ষনিক সহযোগিতার জন্য ।
কিন্তু বিপদের কথা হলো, প্রথম প্রথম আমি যা বলি তা শুনেই উনারা হেসে গড়াগড়ি খান । ভূল-ভাল শোনার জন্য বেশিবেশি প্রশ্ন করেন । আমি কিছু বলতে গেলেই হোহো করে হাসেন । মজা করেন । মাথা নিচু করা ছাড়া কিইবা করা । অনেকেই জানে, চাপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিকতায় "সমস্যাতেই বেসি সমস্যা" । অর্থাৎ স'-কে শ-বলা, আর শ'-কে স'-বলা । যেমন- সুবহান আল্লাহর স্থানে শুবহান আল্লাহ । আবার ইনশাআল্লাহর স্থানে ইনসাআল্লাহ বলা । তবে অল্প সময়ে, মেসমেটদের সহযোগিতায় সচেষ্ট হই, উচ্চারণ জনিত ত্রুটি কাটিয়ে উঠার । সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে ভূল বললে তা ধরার । কোনো ছাড় না দেয়া । সাথে সাথেই সংশোধন করে দেয়া । ফলে দ্রুতই নিজের ভূল বুঝতে শিখি । কখনও ভূল বললে পরোক্ষনেই সঠিকটা বলি । তাই কোচিং পিরিয়োডেই বেশীরভাগ সংশোধন হয়ে যায় ।আলহামদুলিল্লাহ । যা ক্যাম্পাসের পুরো সময় জুড়ে এর সূফল ভোগ করেছি । সে জন্যে অশেষ ধন্যবাদ আক্তারুজ্জামান মন্ডল ও নূরুল মাতিন ভাইকে । হৃদয়পুরে আপনাদের নাম স্পষ্টই থাকবে আমরণ । তবে এখনো যে ভূল হয়না তা কিন্তু নয় । সেটুকুন ঐতিহ্যের লালন বলেই ক্ষ্যান্ত দেয় আজ ।
মোশাররফ-০৪০৪১৫
বিষয়: বিবিধ
১৭৫১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন