♣ ছায়া সঙ্গী ... ♣
লিখেছেন লিখেছেন রাইয়ান ০১ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:১৮:৩৯ সন্ধ্যা
আমি প্রায় প্রতিদিনই রোদ কিংবা বৃষ্টিতে নারীটিকে ম্যাপল গাছটির নিচে বসে থাকতে দেখতাম !
আমার ছেলেমেয়ে দুটি খুবই দুষ্টু হয়েছে। একটি বছরও হয়নি ওদেরকে এই স্কুলটিতে ভর্তি করিয়েছি , এরই মধ্যে এ দুটো চঞ্চলমতি হিসেবে স্কুলে নাম করে ফেলেছে। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর এ দুটো আমার কাছে আসতে আসতে নালিশের তুফান তুলে ফেলে। ওদের সামলাতে সামলাতে যখন পার্কিংয়ে রাখা গাড়ির দিকে এগোই , তখনও নারীটিকে স্থির ও অচঞ্চল ভাবে একই জায়গাতেই বসে থাকতে দেখি। মাঝে মাঝে কৌতুহলে ফেটে পড়তে চাইতাম , ইচ্ছে হত তার পাশে গিয়ে বসি , কথা বলি। কিন্তু কখনই কাউকে তার সাথে কথা বলতে ও মিশতে না দেখে ইচ্ছেটাকে আবার নিজের মাঝেই দমিয়ে ফেলতাম।
আমার বাচ্চাদুটো ছুটির ঘন্টা বাজলেই বুলেটগতিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ত , তাই নারীটির সন্তানকে তার কাছে ফেরার দৃশ্য কখনই আমার দেখা হতনা। মাঝে মাঝে হয় এরকম , ক্লাস শেষ হবার পর বই ব্যাগ গুছিয়ে শান্ত সুবোধ বাচ্চারা ধীরে সুস্থে অপেক্ষায় থাকা বাবা মায়ের হাত ধরে বাড়ীর পথ ধরে। সবাই তো আর আমার দুটোর মত অস্থিরমতি চঞ্চল চড়ুই পাখিটি নয় !
তবে , সন্তানের জন্য অপেক্ষায় থাকা মায়ের চোখ যেমন সন্তানের আগমন পথের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষার ক্ষণ গুনে চলে , তাঁর চোখে কি আমি কখনো তেমন প্রতীক্ষা দেখেছি ? দেখেছি হয়তবা , অথবা দেখিনি ! তার দৃষ্টি যেন পথ হারিয়ে যাওয়া পাখির মত সুদুর পানেই বিদ্ধ থাকত সারাক্ষণ।বয়স তাঁর কপালে গভীর কয়েকটি বলিরেখা এঁকে দিয়েছিল , যা হয়ত সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছিল তার ফেলে আসা অতীতের , সুখে দুখে মেশানো বিপুল অভিজ্ঞতার !
সময় কেটে যেতে লাগলো সময়ের নিয়মেই। ম্যাপল গাছটির পাতাগুলো তাদের তারুণ্য হারিয়ে সময়ের সাথে সাথে জীর্ণ হতে লাগলো। উষ্ণ বাতাসে একসময়ে লাগলো শীতল স্পর্শ। কিন্তু নারীটির অবস্থান বদলায়নি কখনই। এমনকি অন্যরাও ওই বেঞ্চটি বাদ রেখে অন্য কথাও বসত বা জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু বেঞ্চটি খালি থাকলেও কাউকে কখনো ওখানে বসতে দেখিনি। ভেততে ভেতরে আমি ভীষনভাবে তাঁর ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে , তাঁর পাশে বসে সেই কৌতুহল নিবৃত্ত করার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছিলামনা কিছুতেই !
এমনি সময়ে ঘটনাটি ঘটল। তখনও স্কুল ছুটি হয়নি , একটি ছোট বাচ্চা লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসতে গিয়ে হঠাত জুতার ফিতায় পা বেঁধে হাঁটু মুড়ে আছড়ে পড়ল সিমেন্টের বাঁধাই করা চত্বরটিতে , ওই নারীটির ঠিক সামনেই ! ছোট্ট শিশুটির এই আকস্মিক আঘাতপ্রাপ্তি যেন পাথরের একটি প্রতিমাকে জাগিয়ে তুলল নিমেষে ! নারীটি ছুটে গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়ে বিমূঢ় ! আমার মত অনেকেই ভেতরে ভেতরে নারীটিকে নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলেন হয়ত ! আমাদের এতদিনের কৌতুহলের নিবৃত্তি ঘটল অবশেষে। স্কুল অফিসের রিসেপশনিস্ট মাঝবয়েসী মিসেস গিলবার্ট আমাদেরকে যা বললেন তা শুধু বিস্ময়ের ই নয় , বরং করুণ , মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শীও বটে !
নারীটির ছেলে এই স্কুলেই পড়ত। বছর পাঁচেক আগে ক্যাম্পিং এ গিয়ে সবার চোখের আড়ালে বন্ধুদের সাথে বাজী ধরে সাঁতার কাটতে গিয়ে খরস্রোতা নদীতে ভেসে গিয়েছিল। ব্যাপক অনুসন্ধান করে দুদিন পর তার নিরব নিস্পন্দ দেহ পাওয়া গিয়েছিল সেখান থেকেও প্রায় ৬/৭ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গায়। সেই থেকে নারীটি হারিয়ে ফেলেছেন তার জীবনের স্বাভাবিকতা। আগে তিনি তাঁর নাড়ীছেঁড়া ধনকে পরম মমতায় সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরতেন , আর গত পাঁচটি বছর ধরে তিনি প্রতিদিনই এসে ম্যাপল গাছের নিচে পাতা বেঞ্চটিতে আগের মতই এসে বসে থাকেন , কিন্তু ঘরে ফেরার সময়টিতে তিনি ফেরেন একাকী , এক বুক যন্ত্রণা ও নি:সঙ্গতাকে সাথী করে ! আর এতগুলো বছর ধরে তার অকূল অসীম বেদনার মূক সাক্ষী হয়ে ম্যাপল গাছটি পরম মমতায় তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে ! এ যেন ' মাদার অফ ম্যানভিল ' এর উল্টো প্রতিরূপ !
আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অসম এই দুই সঙ্গীর দিকে। আমার ভাবনায় সাড়া দিতেই যেন পাতা ঝরার এই শেষ লগ্নেও যে কয়টি শুকনো নির্জীব পাতা প্রানপনে পরম আশ্লেষে আঁকড়ে ধরে ছিল গাছের শাখা , আজ সেই পাতা কটিও যেন তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হাহাকার ভরা হৃদয়ের ওই শোকাতুরা মায়ের গায়ে ঝরে পড়ল হালকা হিমেল হাওয়ায় , যেন বা স্বান্তনার ই পরশ বুলিয়ে দিল তাঁকে , আর সব নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল যে কত স্বল্পস্থায়ী আমাদের জীবন , কতইনা ক্ষীন আমাদের আয়ুষ্কাল ! হায় , সময় থাকতেই যদি আমরা বুঝতাম ........!
বিষয়: বিবিধ
২৮০৬ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কমেন্টস ? !!
আসিতেছে.......
আপু আর ভাইয়া আপনাদের দুইজনের সাথে আমি এটাই বললাম।
ধন্যবাদ আপু ।
মন ছুয়ে গেল। ধন্যবাদ
জেরি হলো মারজরী কিনান র'লিংস এর বিখ্যাত গল্প ' মাদার অফ ম্যানভিল ' এর ছোট্ট বালকটি , যে তার না থাকা মাকে লেখিকার কাছে তার কল্পনা দিয়ে বাস্তব করে উপস্থাপন করেছিল , পরে লেখিকা জানতে পেরেছিলেন যে , আসলে তার মা মৃত । গল্পটি আসলে প্রকাশ করছিল একজন মায়ের জন্য একটি শিশুর বুকে কি পরিমান হাহাকার জমা থাকে , সেটি । @ হারিকেন মনি
বরাবরের মতই চমৎকার সাহিত্যিক মান সম্পন্ন লেখা। এবার আমাকে একটু শিখিয়ে দিন কিভাবে এত সুন্দর গল্প লিখতে হয়!!!
যার হাতের মিহিন রেশমি সুতায় রুপালি জমিনে কথা ও কাব্যের সোনার ফুল ফোটে নিমেষে , সে শিখতে চায় সুন্দর করে গল্প লেখা ! তাও আবার আনাড়ী এক গল্পকারের কাছে !
আমি শেষ ....
ঘটনা তো মর্মস্পর্শী বটেই, আপনার লেখার স্টাইল আরো বেশি খতরনাক, একদম শরৎ বাবুর মত কান্দাইয়াই ছাড়িলেন।
আপু , আপনার একেকটি আদরমাখা মন্তব্য আমাকে যে কতখানি উত্সাহ যোগায় , তা যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম ! অবারিত অফুরান শুভেচ্ছা আমার প্রিয় আপুজ্বির জন্য !
সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
প্রীতিময় মন্তব্যের জন্য অফুরান শুকরিয়া !
এটি একটি গল্প। তবে বিশ্বের কোথাও ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার ছায়া হয়ত পড়তেও পারে এই গল্পে। তবে এমন কোনো ঘটনা কখনই না ঘটুক , কোনো মায়ের বুক কখনো কোনো কারণেই খালি না হোক .... ক্ষুদ্র লেখিকার এ এক বিশাল কামনা !
আপনি কই গেলেন আপু?
কেমন আছেন আপনি ?
আপনার লেখা কই? লিখা না পেলে হাতুড়ি দেয়া হপে
ঘটনা চারপাশের মত খুব স্বাভাবিক। কিন্তু অঘটন ঘটালেন আপনি। আপনার বর্ণনাভঙ্গী দ্বারা।
কবিতার মত গদ্যেও আধুনিকতা এসেছে কিনা আমি কখনো ভেবে দেখিনি। তবে ধাঁচটা পুরোনোই মনে হয়েছে।
গদ্যেও আধুনিকতা এসেছে বৈকি ! বদলে গেছে ঘটনার অনুসঙ্গ , ভাষা , বর্ণনারীতি .... কিন্তু আমার এই লেখাটিতে আমি ইচ্ছে করেই পুরনো রীতিটিকেই আঁকড়ে রাখতে চেয়েছি। ব্লগে আমার সব লেখার ভেতর এই লেখাটিই আমার কেন যেন খুবই প্রিয় .....
অনেক ভালো লেগেছে এটা জেনে যে আমার লেখাটি আপনাকে লগইন করিয়েছে .... ভালো থাকুন , অনেক ভালো। শুভেচ্ছা ....
মন্তব্য করতে লগইন করুন